'প্রধানমন্ত্রীর কোনও নথি দেখানোর প্রয়োজন নেই'
নীলকন্ঠ আচার্য
পর্ব ২
গত ৪ অগস্ট এই ব্লগে জানিয়েছিলাম, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় নাগরিকত্বের সপক্ষে কী প্রামাণ্য নথি আছে তা জানতে চেয়ে আমি ২০২০ সালে একটি আরটিআই আবেদন করি। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দু' বছর পর প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিনা নথিতেই আমাকে একটি উত্তর দেওয়া হয়। সেই উত্তরে আমি সন্তুষ্ট না হওয়ায় দেশের মুখ্য তথ্য কমিশনারের কাছে যথাযথ বিহিত পেতে প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের প্রামাণ্য নথি দেখতে চাই। কারণ, এই নাগরিকত্বের প্রামাণ্য নথি 'না থাকার' কারণে যখন অসম সহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে 'বিদেশি' বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে, তখন এটা অনুমান করা যেতেই পারে যে প্রধানমন্ত্রী সহ মন্ত্রী পরিষদের কাছে নাগরিকত্বের নিশ্চয়ই এমন কোনও প্রামাণ্য নথি আছে যা দেখিয়ে তাঁরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন ও দেশ শাসন করছেন। কী সেই নথি? তা জানতেই আমার আরটিআই আবেদন যার বিবরণ আমি পর্ব ১'এ লিখেছি। তার লিঙ্ক:
https://ekakmatra2013.blogspot.com/2022/08/blog-post_4.html
আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে মুখ্য তথ্য কমিশনারের পক্ষ থেকে ৮ অগস্ট অনলাইন ভিডিও কনফারেন্স মারফত শুনানির জন্য উত্তর ২৪-পরগণায় বারাসাতে জেলা শাসকের অফিসে আমাকে দুপুর ১২টায় তলব করা হয়। কিন্তু দেখা গেল, দেশের মুখ্য তথ্য কমিশনার ওয়াই কে সিনহা'র (প্রাক্তন রাষ্টদূত: যুক্তরাজ্য, শ্রীলঙ্কা) সমীপে অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নির্ধারিত শুনানিটি এক ঘন্টা দেরি করে শুরু করেও তড়িঘড়ি করে শেষ করে দেওয়া হল! না, এই শুনানীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের পক্ষে কোনও নির্দিষ্ট প্রামাণ্য নথির সন্ধান এই কমিশন দিতে পারল না।শুনানির একদম শুরুতেই কমিশনার যেন একটু কর্কশ সুরেই বললেন, 'আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের জন্য তথ্য চাই আপনার? তাই না? যা উত্তর আপনাকে দেওয়া হয়েছে তা একদম ঠিকই দেওয়া হয়েছে।' এর জবাবে যখন আমি বলি, কমিশনের দেওয়া নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-র প্রতিলিপিতে কোথাও তো প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের কোনও তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেল না! এই কথায় কমিশনার সদর্পে বলে ওঠেন, 'ঐ আইনে না আপনার, না আমার, না প্রবীণজী (CPIO/US/PMO), না প্রধানমন্ত্রী মোদিজীর, কারওরই নাগরিকত্বের প্রমাণ পাওয়া যাবে না। ঐ আইনে নাগরিকত্বের বিষয়ে যদি আর কোনও বিশেষ তথ্য থাকত তাহলে সেটা আপনাকে নিশ্চয়ই দেওয়া হত। প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্ব সম্পর্কে আপনার কোনও সন্দেহ থাকলে আদালতে যেতে পারেন। আপনি যেমন প্রশ্ন করেছেন তার জন্য ঠিক এরকমই উত্তর পাবেন।'
স্বভাবতই অবাক হয়ে বলতে হয়, আবেদনে চাওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ কোনও নথির, কিন্তু আমাকে দেওয়া হয়েছে একটা আইনের আংশিক প্রতিলিপি মাত্র! এই আইনটা তো প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের কোনও নির্দিষ্ট প্রামাণ্য নথি নয়! চাওয়া হল প্রামাণ্য নথি আর দেওয়া হল একটা আইনের নাম ও প্রতিলিপি! এটা কেমন হল?
ওনাকে এও বলি, আমার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্ব সম্পর্কে কোনও সন্দেহের কথা বলা হয়নি বরং এই আবেদন করার অন্যতম প্রধান কারণ, ওনার মতো দেশের একজন উচ্চপদস্থ সরকারি ব্যক্তিত্ব ও পদাধিকারীর নাগরিকত্বের কোনও প্রামাণ্য নথি যদি কমিশনের মাধ্যমে পাওয়া যায় তবে তা এই আবেদনকারীকে সব থেকে ভালো ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে যে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য প্রামাণ্য নথির ধরনটা ঠিক কেমন হওয়া উচিত।
উত্তরে মুখ্য তথ্য কমিশনার স্পষ্টভাবে বলেই দিলেন, 'আমি যতদূর জানি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জন্ম ভারতেই। উনার মা-বাবাও ভারতীয়। সুতরাং, ওনার কোনও প্রমাণপত্রের দরকার নেই।' উনি আরও বলেন, 'এই আইনটাই (অর্থাৎ নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫) হল নথি।' ওনার তাহলে নথি থাকার কোনও প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে উনি ঠিক এভাবেই বললেন, 'ওনারও নথি থাকার দরকার নেই, আমারও (অর্থাৎ কমিশনারের ) দরকার নেই, এই প্রবীণজীরও দরকার নেই।' কারণ, প্রবীণজী যেহেতু ভারত সরকারের চাকরিজীবী হিসেবে ছিলেন, আছেন, তাই উনি নাকি এই কারণেও নিশ্চিত ভাবে ভারতের নাগরিক!
এই শুনানিতে আবেদনকারীর সঙ্গে চলমান পারস্পরিক সংলাপের এক জায়গায় উক্ত CPIO/US/PMO প্রবীণ কুমার (যিনি আমাকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছিলেন বলেই মুখ্য তথ্য কমিশনারকে হস্তক্ষেপের আবেদন জানানো হয়েছিল) বলে ফেলেন যে, 'আপনি যা চাইছেন তা আমার কাছেও নেই।' সঙ্গে সঙ্গেই আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করি, 'আপনার কাছে কী নেই স্যার? আরেকবার একটু বলুন।' প্রত্যুত্তরে উনি বিষয়টি থেকে সম্পূর্ণ রূপে সরে গিয়ে বলেন, 'এই কথাটা আপনাকে বোঝানোর জন্য বলেছিলাম। আমার কাছে কী নেই, কী আছে এসব কথা এখন বলতে গেলে আলোচনাটা অন্যদিকে চলে যাবে। এভাবে কথা বলে কিছু হবে না।' সেই সময় মুখ্য তথ্য কমিশনার ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, 'এসব কথা এখন থাক।'
এরপর কমিশনার নাগরিক আইনের ধারা-৩ ইত্যাদির কথা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলতে শুরু করেন। মাত্র ১২ মিনিট মতো সংলাপ বা শুনানি চলার মধ্যেই কমিশনারের আচরণে শুনানির পর্বটাকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি করে শেষ করে ফেলার একটা প্রবণতা প্রকট হয়ে ওঠে। আমার পক্ষ থেকে আরও কিছু কথা বলার চেষ্টা করা হলে ওনার মধ্যে কোথাও একটা ধৈর্যচ্যুতির লক্ষণ ফুটে ওঠে। আলোচনা গুটিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে উনি অবশেষে আমাকে অদ্ভুতভাবে এ কথাও বলেন যে, 'আপনি যেখানেই কাজ করে থাকুন না কেন আপনি অবশ্যই একজন ভারতীয় নাগরিক। কারণ, আপনার RTI-আবেদনকে স্বীকার করে এর উত্তরও দেওয়া হয়েছে আপনাকে একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করে।' ওনার এই মন্তব্যে অবাক হওয়ার পর যথারীতিই জানতে চাই, 'তাহলে আপনার মতে ভারতীয় নাগরিকত্বের অন্যতম দুটি মাপকাঠি হল: ১) যারা RTI-আবেদনকারী এবং ২) যারা ভারত সরকারের চাকরিজীবী, তাই তো?'
এরপর খুব আশ্চর্যজনকভাবে হঠাৎই উনি বলে ওঠেন, 'ছাড়ুন ছাড়ুন এসব বিষয়। আপনাকে অনেক সময় দেওয়া হয়ে গেছে। ধন্যবাদ। ধন্যবাদ৷' এই কথা বলে উনি এই শুনানির দ্রুত সমাপ্তি ঘোষণা করে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যান এবং আমি অগত্যা নিরুপায় হয়ে অসহায় দৃষ্টিতে ঝকমকে ঐ বড় ভিডিওর পর্দায় পৃথিবীর তথাকথিত বৃহত্তম গনতান্ত্রিক দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর এ হেন দ্রুত প্রস্হান অবলোকন করতে থাকি। ঝলমলে কনফারেন্স ঘরের আলোক বিচ্ছুরিত আধুনিক বাতিগুলো ঘরের উজ্জ্বল নীরবতার সঙ্গে একীভূত হয়ে আমার কাছে যেন অসহায় সাক্ষী হয়ে থেকে যেতে চায়।
মনের আঙিনায় ভেসে ওঠে অসম ও দেশের নানান প্রান্তের সেই সব লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষের মুখগুলি, যাঁদের কাছে নাকি নাগরিকত্বের যথাযথ নথি পাওয়া যায়নি বলে তাঁরা আজ বাদ 'ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স' (এনআরসি) থেকে, তাঁরা আজ 'বিদেশি'। কিন্তু নাগরিকত্বের নথিটা ঠিক কী আর তা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে কেন দেওয়া হল না, সে প্রশ্ন অধরাই থেকে গেল।
এরে নাকি গণতন্ত্র কয়!
ReplyDeleteআমি সুভাষ দাস জানাচ্ছি যে, আনন্দবাজার পত্রিকাতে (২১ জুলাই ২০২২) সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় (পৃষ্ঠা ৪) প্রকাশিত নিবন্ধে "রাজনীতি" স্তম্ভে প্রেমাংশু চৌধুরী লিখেছেন যে 'বিজেপি
ReplyDeleteএখন আতিফ রশিদ নামে একজন 'পসমন্দা'
বা অনগ্রসর শ্রেণির মুসলমানদের নেতার সাহায্যে এই শ্রেণির মুসলমানদের বোঝাচ্ছে
যে তাঁরা যদি বিজেপির থেকে দূরত্ব রেখে চলে, তাতে কোনও লাভ নেই। দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই এখন বিজেপির সরকার।প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ। তাই অনগ্রসর মুসলিমদের যন্ত্রনা শুধু তিনিই বুঝবেন।' অর্থাৎ ভোটে জয় সুনিশ্চিত করতে বিজেপি অনগ্রসর, দলিত ও জনজাতির মুসলমানদের
ওপর জোর দিচ্ছে। 'বিজেপি দীর্ঘ দিন শিয়াদের মন জয়ের চেষ্টা করেছে। লাভ হয় নি। এবার লক্ষ্য পসমন্দা। দানিশ আনসারি সেই সুন্নি ওবিসি বা মসপন্দা মুসলিমদের প্রতিনিধি।' ***তাই বিজেপি সিএএ চালু করতে দরকারি কয়েকটা পদক্ষেপ নিয়েও বাকী পদক্ষেপ না নিয়ে সংবিধান সংশোধন ঝুলিয়ে রাখছে।
একই কারণে অসমে বহু অর্থ খরচ ও হয়রানির মধ্য দিয়ে এন আর সি চালু করতে গিয়ে বিজেপি বুঝতে পেরেছে যে বহু মানুষ
বৈধ নাগরিকত্বের তালিকায় স্থান পান নি।
তাই তখন কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে এই তালিকা গ্রহণ করা হবে না।
*** তাই উপরে বর্ণিত মুখ্য তথ্য কমিশনার আহূত ভিডিও কনফারেন্সের এই পরিণতি।
অর্থাৎ এন আর সি ও চালু করা অসম্ভব।
সিএএ ও এন আর সি তাই গাজরের মতো ঝুলিয়ে রেখে এদেশে অমুসলিমদের উদ্বাস্তুদের স্বীকৃতি বা বাংলাদেশের অত্যাচারিত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টানদের ভারতে নাগরিকত্ব ও পুনর্বাসন অধরাই রাখতে চায় বিজেপি। কারণ এখন বিজেপি বুঝেছে তাদের পক্ষে দেওয়া অঙ্গিকার পালন করা অসম্ভব।