গণধর্ষকদের নির্লজ্জ মুক্তি
নীলকন্ঠ আচার্য
এ বছরের স্বাধীনতা দিবস আমাদের কাছে যে বিশেষ কয়েকটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার মধ্যে অন্যতম গুজরাত দাঙ্গায় গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আজীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন কুখ্যাত অপরাধীর সরকারি বদান্যতায় সমস্ত আইনি বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে জেল থেকে মুক্তি। স্বাধীনতার 'অমৃত মহোৎসবে' সারা দেশ এই সরকারি বেপরোয়া ন্যক্কারজনক ঘটনায় স্তম্ভিত। একদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর লালকেল্লা থেকে ৮৩ মিনিটের অদ্ভুত ভাষণের এক অংশে দেশের নারী সমাজকে সম্মান দেওয়া, সুরক্ষিত ও শক্তিশালী করার কথা উদাত্ত ভাবে তুলে ধরা হচ্ছিল, অন্যদিকে তার কিছুক্ষণের মধ্যেই গুজরাতের সরকারের নির্দেশে গোধরার সাব-জেল থেকে ১১ জন খুনী ও ধর্ষকদের ঘটা করে মিষ্টি খাইয়ে ও ফুলের মালায় বরণ করে বের করে আনা হল। এই ঘটনা বহু আইনজীবীকেও হতবাক করেছে। কারণ, দেশের সংবিধান, শীর্ষ আদালতের সিদ্ধান্ত এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের (গুজরাত) রেমিশন নীতি অনুযায়ী ধর্ষণ ও পরিকল্পিতভাবে খুনের অপরাধে আজীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের কোনও অবস্হাতেই ক্ষমা প্রদর্শন করা যায় না, এ কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে। তবুও কেন এই সিদ্ধান্ত?
প্রাথমিকভাবে এর একটাই উত্তর হতে পারে: সরকারি খোলসের মধ্যে (কেন্দ্র ও গুজরাত) বিরাজমান এই চরম জনবিরোধী, অমানবিক, দেশবিরোধী ফ্যাসিস্ত শক্তিটি আজ আরও উদ্ধতভাবে তার নির্দিষ্ট অশুভ লক্ষ্যের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে চাইছে। অতএব, এই বেপরোয়া উদ্ধত পন্থা গ্রহণে তাদের আর কোনও দ্বিধা নেই। বরং বলা যায়, এই লক্ষ্যে তাদের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছেছে।
দিনটা ছিল অভিশপ্ত ৩ মার্চ, ২০০২'র সকাল; যখন ১৯ বর্ষীয়া বিলকিস বানো (পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা) গোধরায় তাঁর পৈতৃক বাড়ি থেকে তিন বছরের মেয়ে, মা সহ পরিবারের প্রায় ১৭ জনের একটি আর্ত দলের সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে উর্ধ্বশ্বাসে কোনও নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন উগ্র হিন্দুত্ববাদী নরঘাতকদের একটি দল তাঁদের পথ আটকায়। ওই ঘাতক দলের মধ্যে ১১ জন ছিল বর্তমানে সরকারি মদতে জেল থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত খুনী ও গণধর্ষণকারীরা। এদের মধ্যে অনেকেই বিলকিসের পরিচিত। ঘাতকের ওই দল সেদিন মোট ১৪ জনকে হত্যা করে যার মধ্যে বিলকিসের তিন বছরের মেয়েটিও ছিল, যাকে বিলকিসের সামনেই আছাড় দিয়ে মেরে ফেলা হয়। একই সঙ্গে বিলকিস সহ ওই পরিবারের কয়েকজনকে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। বিলকিসকে মৃত ভেবে ঘাতকের দল বধ্যভূমি ত্যাগ করে।
বর্তমানে সেই ১১ জন ঘাতককে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার ফলে বিলকিসের অবশিষ্ট পরিবার পুনরায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। উল্লেখ্য, ১১ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এই ঘাতকের দলকে এভাবে ছেড়ে দেওয়ার পিছনে শীর্ষ আদালতেরও পরোক্ষ ভূমিকা আছে। ওই ঘাতকদের একজন ক্ষমা প্রার্থনার জন্য শীর্ষ আদালতে আবেদন জানালে গত ২৩ মে ২০২২ আদালত একটি প্যানেল গঠন করে তাদের ওপর ক্ষমা প্রদর্শন সংক্রান্ত বিষয়টি ফয়সালা করার দায়িত্ব দেয়। সংশ্লিষ্ট প্যানেল পরোক্ষভাবে ক্ষমা প্রদর্শনের পক্ষে মতামত জ্ঞাপন করে গুজরাত সরকারকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলে। ঘুঁটি সাজানোই ছিল। গুজরাত সরকার হরিয়ানা উচ্চ আদালতের রেমিশন সংক্রান্ত একটি রুলিংকে অজুহাত করে অপরাধী ১১ জনকে 'ক্ষমা প্রদর্শনের' মাধ্যমে মুক্তির নির্দেশ দেয়।
বিচারশাস্ত্রের মাপকাঠিতে গোটা প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত এবং অনেকের মতেই এটি আইন ব্যবস্হার পরিপন্থী। বিলকিস বানোর আইনজীবী বলেছেন, এত বড় একটা ঘটনা আদালত ও সরকারের অংশগ্রহণে হয়ে গেল, অথচ এ বিষয়ে বাদী পক্ষকে আগাম কোনও প্রতিলিপিও দেওয়া হল না! তাঁর প্রশ্ন, যেখানে শীর্ষ আদালতের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ থেকে ২০০৫ সালে স্পষ্টভাবে বলা আছে, আজীবন কারাবাস মানে জীবনের 'শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত' কারাবাস, যেখানে জানুয়ারি ২০১৪, গুজরাত ও কেন্দ্রীয় সরকারের রেমিশন নীতিতে ধর্ষক এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যাকারীদের ক্ষমা প্রদর্শন নীতির বাইরে রাখা হয়েছে, তখন এই ঘটনা বিচার ব্যবস্হা ও সরকারি প্রশাসনকে একসঙ্গে অভিযোগের কাঠগড়ায় তুলে দেয়।
গুজরাতের জনৈক মানবাধিকার কর্মীর মতে, ওই রাজ্যের সমস্ত কারাগারে অধিকাংশ সাজাপ্রাপ্তরা হলেন সাধারণ অপরাধী। এদের অনেকের জন্য এর আগে রেমিশন চাওয়া হলেও কোনও সুরাহা হয়নি। এই 'অমৃত মহোৎসবে' এদের অনেকেই তো রেমিশন পাওয়ার যোগ্য। সরকার ও আদালত এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় কেন? প্রশ্ন আরও আছে। যেখানে আজীবন সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষক ও খুনীরা আইন অনুযায়ী কোনওভাবেই জেল থেকে ছাড়া পেতে পারে না, সেখানে সেই সাজাপ্রাপ্তরা আবেদন করেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। অথচ, এই একই গণতান্ত্রিক(!) বিচার ব্যবস্হার মধ্যে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় ৮৪ বছরের নিরলস ব্যক্তিত্ব ফাদার স্ট্যান স্বামীকে- যিনি তীব্র পারকিনসন রোগে আক্রান্ত- একজন বিচারাধীন কারাবন্দী থাকাকালীন জল ও তরল খাদ্য খাওয়ার জন্য জেল ও আদালতের কাছে একটি সিপার দেওয়ার জন্য আবেদন করলেও তাঁকে তা দেওয়া হয়নি। জীবনের অন্তিম লগ্নে আদালতের কাছে শেষ কয়েকটা দিন সবুজ প্রকৃতি ঘেরা আদিবাসী অঞ্চলে বেঁচে থাকার জন্য জামিনের আবেদন করলেও এই ন্যায় (!) প্রদানকারী বিচার ব্যবস্থা এবং হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট প্রভুদের পদলেহনকারী কেন্দ্রীয় সংস্থা NIA সংশ্লিষ্ট হিংস্র গোয়েন্দা অধিকর্তারা তা অনুমোদন করেনি। শুধু তাই নয়, উক্ত মিথ্যা মামলায় আটক বিচারাধীন বয়স্ক অসুস্হ আরও অনেক মানবাধিকার কর্মীদের জামিনের আবেদন বার বার করা হলেও এই বিচার ব্যবস্হা তা অনুমোদন করছে না। এই মুহুর্তে সোমা সেন, আনন্দ টেলটুম্বে, গৌতম নাভলাখা, রানা জ্যাকব, অরুণ ফেরেইরা, ভারনন গনজালভেস, হ্যানিবাবু, উমর খালিদ, শারজিল ইমাম, সিদ্দিকী কাপ্পান সহ সারা দেশে প্রায় ৬ হাজার রাজনৈতিক বন্দীদের বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে। পশ্চিমবাংলায় এই সংখ্যা প্রায় ১০০। এদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে ১৪/১৫ বছর বিনা বিচারে আটক আছেন।
সম্প্রতি শীর্ষ আদালতের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত এক দূরদর্শন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সারা দেশে বিচারাধীন বন্দীদের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ, যদিও ২০২০ সালের NCRB-র প্রিজন স্ট্যাটিস্টিকস অনুযায়ী এই সংখ্যা হল ৭৬.১ শতাংশ। এই সূত্র মতে, দেশে মোট কারাবন্দীর সংখ্যা ৪,৮৮,৫১১ (৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত)। অতএব, বিচারাধীন বন্দীর সংখ্যা তাহলে ৩,৭১,২৬৮। দেশের এই বিচার ব্যবস্হায় আজ সরকারি মতে প্রায় পৌনে চার লক্ষ বন্দী রয়েছেন দোষী সাব্যস্ত না হয়েও কারারুদ্ধ এবং জামিন পাচ্ছেন না। সম্প্রতি, তিস্তা শেতলাবাদ, হিমাংশু কুমারের মামলা সম্পর্কে এক আলোচনা সভায় বর্ষীয়ান সুপরিচিত আইনজীবী কপিল সিব্বল খুব দুঃখের সঙ্গে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, এই শীর্ষ আদালত সহ দেশের বিচার ব্যবস্হার প্রতি তাঁর সমস্ত আশা ভরসার সমাপ্তি ঘটেছে। প্রখ্যাত গান্ধীবাদী অধিকার রক্ষা কর্মী হিমাংশু কুমার বলেছেন, কয়েকজন বিচারপতি মানে আদালত নয়। দেশের আদালত ও বিচার ব্যবস্হাকে রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষদের আজ এগিয়ে আসতে হবে। প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেছেন, আদালতের কোনও রায় অন্যায্য অনৈতিক জনবিরোধী হলে তার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। তার স্বরূপ মানুষের মধ্যে উন্মোচিত করতে হবে।
তাই, এই গোটা প্রেক্ষাপটে আজ বিলকিস বানো সহ দেশের সামগ্রিক পরিস্হিতিকে আমাদের বুঝতে হবে। এখন ফ্যাসিবাদ শুধু একটা শব্দ নয়। এই চরম অপশক্তিটি আমাদের জনজীবনে ক্রমশ প্রবেশ করে চলেছে। রাষ্ট্রশক্তি ও এই ফ্যাসিস্টদের যেন বর্তমান সন্ধিক্ষণে সব থেকে নিবিড়ভাবে পরস্পরের পরিপুরক হয়ে একে অপরের সঙ্গে লীন হয়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। একে প্রতিরোধ করতেই হবে। একে আটকাতেই হবে। এবং একে নিশ্চিন্হ করার জন্য সবাই মিলে, হ্যাঁ, সবাই মিলেই আমজনতাকে সঙ্গে নিয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী নির্ভীক বন্ধুর অভিযানের পথে এগোতেই হবে। অন্য আর কোনও বিকল্প নেই।
৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে কালি লেগে গেল। লজ্জা
ReplyDeleteবিচার ব্যবস্থার উপর জনগণ বিশ্বাস হারালে চরম অরাজকতা তৈরী হতে পারে।
ReplyDeleteবিচার ব্যবস্হার কোনো সিদ্ধান্ত/ঘোষণা/রায়/আচরণ/নিরীক্ষণ/সুপারিশ যদি বিচারশাস্ত্রের এবং মানবতার পরিপন্থী হিসেবে দেখা দেয় তখন সেই বিচার ব্যবস্হাকে রক্ষার স্বার্থেই তার এ হেন বিচ্যূতি/অধঃপতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠানোই একটি সভ্য সমাজের দায়ীত্ব ও কর্তব্য হিসেবে সামনে চলে আসে। বিচার ব্যবস্হা কোনো নৈর্ব্যক্তিক সত্বা নয়। এই ব্যবস্হা কার্য্যত একটি সাংবিধানিক বিধি দিশা-নির্দেশের ভিত্তিতে দায়ীত্বপ্রাপ্ত পরিচালন মন্ডলীর দ্বারা পরিচালিত হয় এই পরিচালন মন্ডলী গঠিত হয় রক্তমাংসের মানুষদের দ্বারা যারা বিচারপতি, রেজিস্ট্রার, প্রধাণমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, সংসদীয় কমিটি, রাষ্ট্রপতি ইত্যাদিদের দ্বারা। এদের দায়ীত্ব হল এই বিচার ব্যবস্হার মধ্যে সুবিচার ও ন্যায়কে যথাযথভাবে সুনিশ্চিত
Deleteকরা। সেই দায়ীত্ব যদি যথাযথভাবে পালিত হয় তবে সেটাই হল অরাজকতা এবং সেই অরাজকতাকেই আটকানোটাই সেই দেশবাসীদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এটাই যথাযথ পথ। অরাজকতা নয়।
সংশোধন :-- "...সেই দায়ীত্ব যদি যথাযথভাবে পালিত *না* হয় তবে সেটাই হল অরাজকতা..."
Delete