Saturday 13 August 2022

‘রেউড়ি’ রাজনীতি

গরিবকে দিলে ‘রেউরি’

কর্পোরেটকে দিলে ‘বিকাশ’

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত ১৬ জুলাই উত্তরপ্রদেশের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ ‘রেউরি সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে সবিশেষ সোচ্চার হন। তিনি বোঝাতে চান, যে ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানান উৎসবাদিতে রেউরি (এক ধরনের উত্তর ভারতীয় মিষ্টি) বিলি করা হয়, সে ভাবেই নাকি বিরোধী দলগুলি সরকারি অর্থ মানুষের মধ্যে বিলি করে এ দেশে ‘রেউরি সংস্কৃতি’র আমদানি করেছে।

বলাই বাহুল্য, এর পটভুমি প্রস্তুত ছিল। প্রধানমন্ত্রী শুধু সলতেয় আগুন দিয়েছেন আর তা নিয়ে এক রাজনৈতিক সোরগোল খুব পরিকল্পিত ভাবে শুরু করে দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগকেও এর মধ্যে টেনে আনা হয়েছে। অর্থাৎ, দেশের অর্থনীতির পথ কী হবে, তা একমাত্র এবং শুধুমাত্র একটি কি দুটি লোকই (মোদী-শাহ) ঠিক করবে, বাকী সকলকে তা মানতে বাধ্য থাকতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, জনকল্যাণ প্রকল্পগুলি নিয়ে হঠাৎ করে মোদী সাহেব এত ক্ষেপে গেলেন কেন? কারণ, তিনি এখন বেশ বিপদে। সম্প্রতি সি-ভোটার কৃত একটি সমীক্ষায় প্রকাশ (ইন্ডিয়া টুডে চ্যানেলে দ্রষ্টব্য), এনডিএ চালিত দেশের অর্থনীতির অবস্থাকে জানুয়ারি ২০২১ সালে ৬৭ শতাংশ মানুষ ‘ভাল’ বলেছিলেন, অগস্ট ২০২২’এ এসে ৪৮ শতাংশ ‘ভাল’ বলছেন। পাশাপাশি, ওই ২০২১’এর জানুয়ারিতে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ অর্থনীতির অবস্থাকে ‘খারাপ’ বলেছিলেন যা অগস্ট ২০২২’এ এসে বলছেন ২৯ শতাংশ মানুষ। বোঝাই যাচ্ছে, মানুষ ক্রমেই মোদী সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। তদুপরি, এলপিজি’র দাম ১১০০ টাকা ছুঁইছুঁই, পেট্রল-কেরোসিন বহুদিন হল ১০০ টাকার সীমানা পেরিয়েছে, আটা-মুড়ির ওপর জিএসটি লাগু হয়েছে, ওষুধের দাম গগনচুম্বী- সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। অর্ধভুক্ত মানুষের একটা অংশ যে ভাবে অতি সস্তার বিষাক্ত নেশা করে খিদে ভুলে পড়ে থাকে (মরেও যায়), সে ভাবেই ধর্মের নেশা দিয়ে আমাদের পঙ্গু করে রাখার প্রয়াস চলেছে। এতে যে কোনও ‘কাজ’ হয়নি, তা তো নয়! কিন্তু গত কয়েক মাসে ছবিটা যেন দ্রুত পালটে যাচ্ছে। সম্ভবত, নেশার ঘোরও আস্তে আস্তে কাটছে।

বিশেষ করে আগামী নভেম্বরে গুজরাত নির্বাচন বিজেপির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আঞ্চলিক বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রকাশ পাচ্ছে যে, এবারে গুজরাতে বিজেপি ও নব উদিত আপ’এর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চলেছে। সাম্প্রতিক পঞ্জাবে অভাবনীয় সাফল্যের পর গুজরাতেও যে আপ অকল্পনীয় কিছু করে ফেলতে পারে, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই বেশ প্রত্যয় তৈরি হয়েছে। প্রতি মাসে অন্তত তিন-চারবার অরবিন্দ কেজরিওয়াল গুজরাত সফরে যাচ্ছেন ও বিশাল বিশাল জনসভা করছেন। দিল্লি ও পঞ্জাবে আপ সরকার যে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি নিয়েছে তা একপ্রকার রাজ্যের চেহারাই বদলে দিয়েছে, বিশেষত গরিব মানুষের জীবনযাপনে প্রভূত সহায়তা ও খুশখবরই এনেছে। বিদ্যালয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দিল্লি সরকার আগেই এক বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং পঞ্জাবেও অনুরূপ কাজগুলিকে তারা হাতে নিয়েছে। উপরন্তু, ২০০ কি ৩০০ ইউনিট অবধি ফ্রি বিদ্যুৎ গরিব মানুষের জীবনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে। এখানেই বিজেপির সব থেকে বেশি ব্যথা লাগছে। কারণ, গুজরাতে গিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন যে তাঁরা ক্ষমতায় এলে দিল্লি ও পঞ্জাবের মতো ২০০ কি ৩০০ ইউনিট অবধি বিদ্যুৎ ফ্রি করে দেওয়া হবে। এই ঘোষণাটি শোনামাত্র দেশের শাহেন শাহ ও তাঁর দোসর (দুজনেই যখন আবার গুজরাতের লোক) নিজেদের আর স্থির রাখতে পারেননি। গুজরাতই যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে আর থাকেটা কী! অতএব, খড়্গহস্ত হয়ে তাঁরা জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির ওপরেই বিষোদ্গার শুরু করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতে কীভাবে রোক লাগানো যায়, তারও অঙ্ক কষতে লেগেছেন। কারণ, লড়াইটা আসলে দু’ ধরনের ‘রেউরি বিলি’র চরিত্রের মধ্যে (আদতে দুই শ্রণির মধ্যে)।

কথাটা হল, ‘রেউরি’ (মোদীর ভাষায়) বা সরকারি অর্থ সাধারণ গরিব মানুষের উন্নতিকল্পে ব্যবহার করা হবে, নাকি, কতিপয় ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট হাউজকে দেওয়া হবে তাদের সম্পদ ও মুনাফা বৃদ্ধির জন্য- এখানেই মূল দ্বন্দ্বটা নিহিত আছে। শুধু আপ বলেই নয়, বিভিন্ন রাজ্যেই আঞ্চলিক দলগুলি নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক প্রকল্প গ্রহণ করে চেষ্টা করেছে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সক্ষমতা প্রদানে। এই অনুশীলনে নানারকম দুর্নীতিও দেখা গেছে (আপ পরিচালিত সরকার কিছুটা ব্যতিক্রম), সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলেরা সোচ্চারও হয়েছে, কারও কারও শাস্তিও হয়েছে; কিন্তু শুধুমাত্র দুর্নীতির অজুহাতে জনকল্যাণ প্রকল্পগুলিকে কখনই বন্ধ করে দেওয়া যায় না। কারণ, আমাদের দেশের দুর্নীতির সিংহভাগ (অন্তত ৭৫ শতাংশ) হচ্ছে কর্পোরেট লুঠ, যেখানে ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা তুলে কেন্দ্রীয় শাসকের মদতে হয় দেশ ছেড়ে লুঠেরারা পালিয়ে যায়, নয়তো রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া তাদের ঋণ মকুব করে দেওয়া হয়, অথবা জলের দরে তাদের হাতে সরকারি জমি, সম্পত্তি তুলে দেওয়া হয়। ললিত মোদী (যাকে সুস্মিতা সেন খুঁজে পান কিন্তু ভারত সরকার খুঁজে পায় না), নীরব মোদী, মেহুল চোক্সি, বিজয় মাল্য ইত্যাদিরা আমাদের সামনে এই ধারার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। কেন্দ্রীয় শাসকদের অতি ঘনিষ্ঠ আদানি-আম্বানিদের গত কয়েক বছরে বিপুল সম্পদ লাভ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই প্রবণতাকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়। এখন তো আবার বন সংরক্ষণ আইনকে সংশোধন করে বিনা বাধায় আদিবাসীদের জমি দখল নেওয়ার নীল নকশা তৈরি হয়েছে। এ এক সর্বগ্রাসী লুঠ। 

এই ভয়ঙ্কর লুঠকেই মোদী সরকার চাইছে ‘রেউরি’র হকের দাবিদার বানাতে। অর্থাৎ, সরকারের অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ন্যূনতম জীবনযাপন, রাস্তাঘাট, পরিবেশ এইসব সর্বজনীন জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় করা হলে তাকে বলা হবে ‘রেউরি’ বিলি, আর সেই অর্থ যদি কর্পোরেটদের দেয় অপরিশোধযোগ্য ঋণ, কর্পোরেট কর মকুব, পাইপলাইন মনেটাইজেশনের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলিকে জলের দরে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার ফন্দি-ফিকির হিসেবে বিলি করা হয় তবে তাকে ‘রেউরি বিলি’ বলা যাবে না। কারণ, এটা সর্বজনবিদিত যে লক্ষ লক্ষ কোটি সরকারি টাকা বন্ধু কর্পোরেটদের দিলে তার একটা অংশ ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ হিসেবে আবার বিজেপি’র কাছে ফেরত আসে। আর তাই এটাকেই বলতে হবে ‘বিকাশ’। এ নিয়ে নীতি নির্ধারণের পথেও এগোতে চলেছে মোদী সরকার। অথচ শুধু কেজরিওয়াল নন, ঊড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কও এ প্রসঙ্গে স্পষ্টতই জানিয়েছেন, তাঁর নিজ রাজ্যে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের আরও সক্ষমতা দিয়েছে। আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানার রাজ্য সরকারগুলিও বেশ কয়েক বছর ধরে এমনতর জনকল্যাণমূলক প্রকল্প অনুশীলন করে মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জীবনযাপনে কিছুটা হলেও উন্নতি এনেছে।

আজ যখন সারা বিশ্ব জুড়ে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের দাবি জোরালো হয়ে উঠছে, অগাধ বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক উদ্যোগকে অর্থনীতির সর্বজনীন পথ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে, তখন সে পথকে ‘রেউরি বিলি’ অপবাদ দিয়ে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের যুদ্ধ ঘোষণা এক অশনি সংকেতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০২৪ সালে ক্ষমতা দখল অটুট রাখতে মরীয়া বিজেপির সামনে এখন তাই মূলত দুটি পথ খোলা: এক) আদানি-অম্বানিদের মতো কর্পোরেট বন্ধুদের থেকে ইলেক্টোরাল বন্ড ও অন্যান্য পথে লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে অর্থবলের জোরে ক্ষমতা হাসিল করা; আর তাই, ‘রেউরি’টা কর্পোরেটদের মধ্যে বিলি করার একটা পাক্কা বিধিব্যবস্থা তৈরি করা; দুই) সে ক্ষেত্রে গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের ধর্মের আফিম খাইয়ে বুঁদ করে ভোট আদায় করা।

এইভাবে কতকটা সফলতা গত কয়েক বছরে তো তারা পেয়েছে। ২০১৭-১৮ সাল থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেকটা শক্তি কমলেও তারা তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসার খোয়াব দেখছে। যদি ঘটনাচক্রে তা বাস্তব হয়ে যায় (তর্কের খাতিরে ধরে নিলে) তাহলে আমরা শুধু ধর্মীয় হানাহানির এক অতল চক্রে নিমজ্জিত হব না, অর্থনৈতিক মহাবিপর্যয়ের এক করালগ্রাসেও নৃশংস ভাবে বিলীন হয়ে যাব। বিহারে জেডিইউ বিজেপির হাত ছেড়েছে, একে একে বহু দলই তাদের সঙ্গ ত্যাগ করেছে, অনেক রাজ্যেও তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে; এবার আশা করতে পারি, দেশের আমজনতাও তাদের হাত ছাড়তে বাধ্য হবে।

 

No comments:

Post a Comment