ভেসে যায় মানুষ!
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
বন্যার
খবর পাওয়ার পর অন্য কিছুতে আর মন বসে না, অথচ রোজই কত কী ঘটে চলেছে। মানুষ খুন হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে, অপমানে ছোট হচ্ছে- হতেই হচ্ছে সর্বত্র-
উদয়পুর থেকে বীরভূম বা ইউক্রেন। উমর খালিদদের বিচার নিয়ে চলেছে
বিচারব্যবস্থার হাস্যকর অবস্থান, সংবাদমাধ্যম ব্যস্ত 'মহা' খবর নিয়ে।
গণতন্ত্রে হতাশ হয়ে কারা যেন শিরদাঁড়ার খোঁজ করে চলেছেন। আর তারই মধ্যে
শুনছি জনসভায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কথা- রাজ্যে রাজ্যে চাই ডবল ইঞ্জিন
সরকার; শুনছি তাঁর দেওয়া আশ্বাস। হায়,
তবে কী (গোপাল) ভাঁড়ামো সত্য, সত্য আর মিথ্যার দূরত্ব মাত্র চার আঙুলের!
তবে বন্যার খবর তো অসত্য নয়। অসত্য
নয় যে মানুষ বড় কষ্টে আছে। বন্যা মানেই যেন অশেষ দুর্ভোগ। যাঁরা গেলেন তাঁরা তো
গেলেন, রইলেন যাঁরা তাঁদের দুর্ভোগ কী কম?
ভুলিনি
১৯৭৮'এর বন্যা। ট্রেন, বাস বন্ধ। সব্বাই তাকিয়ে কলকাতার দিকে।
রাজ্যটাই তখন কলকাতা কেন্দ্রিক (এখনও তাই)। সেই কলকাতাও তখন জলে ভাসছে। কলকাতা
এখনও জলে ভাসে অল্প বৃষ্টি হলেই। রাস্তা, পার্ক সবেতে বিপদের গন্ধ। তার মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি। পঞ্চায়েত নির্বাচন আসছে।
এদিকে
বন্যার খবর আসছে অসম, মনিপুর, মেঘালয়, উত্তরাখণ্ড থেকে।
বাদ নেই আমাদের উত্তরবঙ্গও। বাংলাদেশের একাংশও বন্যায় ভাসছে। দক্ষিণবঙ্গে আমরা আকাশে চোখ তুলে দিন গুনছি তার আগমনের। হাওয়া অফিসকে
বোকা বানিয়ে সে বোকা কাকটার মতো ফ্যাচফ্যাচ করে হাসছে। সেই
ছবিটা মনে পড়ে? হাওয়া অফিসের কথা অমান্য করে খটখটে রোদের মধ্যে একজন ছাতা
নিয়ে বেরচ্ছে। হাওয়া অফিসের ভবিষ্যদবাণী নাকি এমনই- যা ঘটবে বলে,
ঘটে তার উলটোটা। অথচ, দিনকাল নাকি বদলেছে- এখন হাওয়া অফিসে কত লোকজন, যন্ত্রপাতি, আকাশ থেকে কৃত্রিম উপগ্রহও নাকি বার্তা পাঠায়। সব মিথ্যে?
কেবল সত্য ঐ ফ্রাক্টাল থিয়োরি (দিল্লীত প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে নাকি লন্ডনে
বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে!)!
গান্ধীজীর প্রাণ কেড়ে নেওয়া স্বঘোষিত প্রাণপ্রিয় বন্ধুরা এখন বন্যাপীড়িত নানা রাজ্যে ক্ষমতায়। তারা নাকি হৃদয়হীন নয়।
দেখছি। দেখতে হচ্ছে। সংবাদমাধ্যম যে দেখাচ্ছে। আইন পাশ হলেও তারা বিধি তৈরি করেনি আজও, এমনকি কেন্দ্রীয় মহাশক্তিধর কমিটির রাজনৈতিক
প্রস্তাবেও তারা এনআরসি নিয়ে কথা বলেনি। বলা চলবে না যে ভুলে গেছে, বলা চলবে
না এ এক কৌশল। এভাবেই তারা নাকি অসম তথা উত্তর-পূর্ব ভারতকে সাহায্য
করছে। আর উত্তরাখণ্ড বা মুম্বই সবে তাদের ফের ক্ষমতায় এনেছে, ওদের কথা
পরে ভাবলেও চলবে! সবই তো ডবল ইঞ্জিন সরকার। আর মনিপুর? তারাও।
মানুষ চায়নি তবু বদলুরা চেয়েছে একদা। সেই মনিপুরেও জওয়ানরা ধ্বসে প্রাণ
দিয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র
এবারও যেন ক্ষেপেছে। সে একা নয়, ছোট ছোট সব নদী, ঝর্ণা সবাই যেন এক সঙ্গে
ক্ষেপে উঠেছে। মানুষকে বাধ্য করেছে প্রতিবারের মতো, ঘরবাড়ি, পরনের
জামা-লুঙ্গি নিয়ে, খাবারদাবার ফেলে প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিতে। তবু সবাই বাঁচে না।
ধ্বস নামে, নদী গতিমুখ বদলায়। মানুষ দেশ-গ্রাম ফেলে দৌড় দেয়। আশ্রয় চায়,
খাদ্য চায়, গলা অবধি ডুবেও পানীয় জল চায়। চায় না শুনতে ওকালের
মাতব্বরদের কথা বা একালের সাম্প্রদায়িকতার কথা, ভুলে যায় রঞ্জন গগৈদের কথা,
ভুলে থাকে ধর্ষণ, খুনের ইতিকথা। তারা নিশ্চয়ই সরকার চায় (ডবল ইঞ্জিনের গপ্পো
বা প্রতিশ্রুতি নয়)। চায় এমন সরকার যারা তাদের প্রাণে বাঁচাবে, ত্রাণ
দেবে (খাবার দেবে, খাবার জল দেবে), নিরাপদ আশ্রয় দেবে। এমন সরকার যা মাতব্বরি করবে না, দলবাজি করবে না, ত্রাণে ভোটের হিসেব কষবে
না। তেমন সরকার ডবল না সিঙ্গল ইঞ্জিনের তা কে দেখে? মানুষ আজ বড় অসহায়,
মানুষ কাঁদছে, মানুষ বুলডোজার বা ইঞ্জিন চায় না, মানুষ বাঁচতে চায়।
No comments:
Post a Comment