ঝুঁকিপূর্ণ অনলাইন লটারির রমরমা!
অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
টিভি খুললেই লটারির বিজ্ঞাপন। শুধুমাত্র তাই নয়, ফেসবুক কিংবা ইউটিউব- সর্বত্রই এখন এরই রমরমা। এমনকি বড়-বড় তারকারাও এর প্রচারে কসুর করছেন না।
জুয়া খেলার ইতিহাস বহু প্রাচীন হলেও লটারি খুব বেশি পুরনো নয়। ছেলেবেলায় বাতিল লটারির টিকিট জমিয়ে আমরা মফস্বলের ছেলেরা খেলাও করেছি। পুজোপার্বণে মেলায় গিয়ে বাজি ধরা থেকে জুয়ার নানান ধরন-ধারণও দেখেছি। কিন্তু এখন লটারির যে-অবস্থা দেখা যাচ্ছে তা যেন একটা শিল্পে পরিণত হয়েছে। ভারতের প্রায় ১৩টি রাজ্য লটারি খেলাতে সম্মতি দিয়েছে আর বাকিগুলি নিষিদ্ধ করেছে। তবে মনে হয় না খুব বেশিদিন এই নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখা যাবে। কেননা এটা এখন একটা মুনাফাজনক শিল্প, যা থেকে আমজনতা ও সরকার উভয়েই লাভের ফল কুড়িয়ে নিচ্ছে। যেহেতু ফাটকা কারবার, তাই অনেকেই আবার নিঃস্বও হয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারের রাজকোষে তাতে প্রভাব পড়ছে না।
২০১৭ সালে সরকারের তরফে লটারির উপরে প্রথম ২৮ শতাংশ জিএসটি লাগু করা হয়। এ-নিয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর বিতর্ক চলেছিল। কেননা লটারিকে না পণ্য হিসাবে দেখা যায়, না পরিষেবা হিসাবে- তাই আদৌ এর উপরে কর চাপানো যায় কিনা তা নিয়ে জল্পনা ছিল। তবে ২৮ শতাংশ জিএসটি যথেষ্ট বেশি হওয়ায় বেআইনি লটারির রমরমাও শুরু হয়ে গেল। ফলে, সরকার যে লাভের গুড় খাবে বলে প্রত্যশা করেছিল, তা ছোট-ছোট কালোবাজারি কারবার গ্রাস করে ফেলল। সে-কারণে দ্বৈত কর নীতির প্রচলন হল– এক) রাজ্যাভ্যন্তরীণ লটারিতে লাগু হল মাত্র ১২ শতাংশ জিএসটি আর দুই) রাজ্যের বাইরে গেলেই বজায় রাখা হল ২৮ শতাংশ। জল গড়াল সুপ্রিম কোর্ট অবধি। শেষমেশ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গিয়ে এর সুরাহা হল। তাতেও খুব বেশি লাভ হয়নি। কেননা করের বোঝা সংস্থার থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে জনসাধারণের উপরে চাপানো হল। আসলে উপায় ছিল না– পুরস্কার মূল্য কম করে দিলে বাজার হয়তো ভেঙেই পড়ত, তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু তাতেও দেখা যায় লটারি বিক্রিতে ঘাটতি। বিখ্যাত ‘প্লেউইন’ বন্ধ অবধি হয়ে যায়।
তথাকথিত লটারির ব্যবসায় যখন ঘাটতি দেখা দিল তখনই অনলাইন-লটারির চালু। এক ধাক্কায় রাজ্য-দেশের সীমানা ভেঙে গেল। খুলে গেল বিরাট বাজার। জুয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৫.১ শতাংশ বাজার দখল করে আছে লটারি। সুতরাং, ব্যাপারটাকে আর অবহেলা করার মতো অবস্থা থাকল না। এমনিতেই কোভিড, মানুষ ঘরে বসে। হাতে মোবাইল, অফুরন্ত ইন্টারনেট। অতএব, লাফিয়ে-লাফিয়ে অনলাইন-লটারির বাজার বৃদ্ধি পেল। লাভের অঙ্কে জোয়ার এল।
প্রাক্-জিএসটি অবস্থায় ভারতে লটারির বাজার ছিল বছরে ৫০,০০০ কোটি টাকার। কিন্তু জিএসটি লাগু হওয়ার পরে এই বাজারে ধস দেখা গিয়েছিল, দাঁড়িয়েছিল ১৫,০০০ কোটিতে। কালোবাজারিও শুরু হয় সে-মোতাবেক। আর এইখানেই অনলাইন লটারি সম্রাটের জায়গা করে নেয়। ‘সুগাল ও দামিনী’ জানিয়েছে যে অনলাইন মাধ্যমে ইতিমধ্যে তা ৭৫ শতাংশ বাজার দখল করেছে ও প্রতিদিন ২৫ হাজার পয়েন্ট-অফ-সেল এবং ১.৮ কোটি লেনদেন নথিভুক্ত করেছে। কেরালা– ১৯৬৭ সালে লটারিকে সরকারিকরণ করা প্রথম রাজ্য– ২০১৭ সালের খতিয়ান অনুযায়ী ৭৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব-অর্জন করেছে। অনুমান যে আগামী কয়েক বছরে এটা ১০,০০০ কোটি টাকাকে ছাপিয়ে যাবে। এর অর্থ দাঁড়ায়, কেরালার যা জনসংখ্যা তাতে করে প্রতি সপ্তাহে ৭.৯ কোটি লটারি বিক্রি হয়েছে; অথবা বলা যায়, প্রতিটি বাড়ি ৫০০টি করে লটারি কিনেছে। কেরালার ক্ষেত্রে লটারির ব্যবসা এর অর্থনীতির মূল ভিত্তি। অর্থনৈতিক-বর্ষ ১৯৮১তে যে আয় ছিল ১৩.৪ শতাংশ সেটাই ২০১৭ সালে পৌঁছেছে ৮০.৫ শতাংশে। এমনকি কেরালার সমাজ-কল্যাণ কর্মসূচিগুলিও এই আয় থেকেই রূপায়িত হয় বলে জানা যাচ্ছে। মহারাষ্ট্রে ১৯৬৯ সাল থেকে লটারি চালু হয়েছে। সেখানেই প্রাক্-জিএসটি বাজার ছিল ৬০ কোটি টাকা প্রতিদিন। এছাড়া পাঞ্জাব, গোয়া, সিকিম, মনিপুর ইত্যাদি আছেই।
পশ্চিমবঙ্গে লটারি চালু হয় ১৯৬৮ সালে। এখানে দীপাবলী, পুজো, রথযাত্রা, নববর্ষ, হোলি ও নিউ-ইয়ার বাম্পার খেলা হয়। সঙ্গে আছে সপ্ত-সাপ্তাহিক লটারি ধনকেশরি। অর্থ দফতর প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, রাজ্য বছরে ১৮ কোটি টাকার লাভ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে অর্থাৎ জিএসটি-উত্তর অবস্থায় এটাকে নতুনভাবে সাজানো হয়। ফলে, ২০০ কোটি টাকার অ-কর রাজস্ব ও রাজ্য জিএসটি ২০০০ কোটি টাকা প্রতি বছর প্রত্যাশা করা হয়েছে। এখানেও ডিজিটাইজেশন প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। সুতরাং, লটারির বাজার ও মুনাফা অন্য রাজ্যগুলিকে যে আকৃষ্ট করবে এবং এটা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু কারা খেলছে এসব? ২০১৯ সালের একটি গবেষণা জানাচ্ছে যে, অনুর্ধ্ব ৩০ বছরের বিবাহিত লোকজন মূলত এর খেলোয়ার। সংখ্যার ভিত্তিতে দেখলে ২৫-৩৪ বছরের লোকজনের অংশগ্রহণ সব থেকে বেশি, প্রায় ৩১.৪৪ শতাংশ। যদি ব্যাপারটাকে কিউমুলেটিভ করা হয় তবে দেখা যায় যে অনুর্ধ্ব ৩৪ বছরের মানুষই বেশি, প্রায় ৫৬.৪ শতাংশ। পক্ষান্তরে মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেক গুণ বেশি। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৭৯.২৪ শতাংশ পুরুষ, বাকিরা মহিলা। অনলাইন চালু হবার পরে সেখানেই মানুষের ভিড় বেশি। তথ্য বলছে যে, প্রায় ৮৬.৫১ শতাংশ মানুষ মোবাইল-মাধ্যমে খেলে, কম্পিউটারে মাত্র ১৩.০২ শতাংশ আর ট্যাবলেটে ০.৪৭ শতাংশ। তাছাড়া এখন ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু হয়ে যাওয়ায় ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে লটারির রবরবা আরও বৃদ্ধি পাবে বলেই অনুমান।
এই প্রবণতা এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আগামী অর্থনীতির একটা অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসাবে লটারি নিজের জায়গা করে নেবে। কেবলমাত্র জাতীয় স্তরে নয়, বৈশ্বিক স্তরেও। কেননা এটাই ব্যাঙ্ক ও ফিনটেকের জগতে বিপ্লব আনতে চলেছে। বহু সাবেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। মোবাইল অ্যাপ ও লটারি নির্ভর আয়ের উৎস খুলে যাবে। এটাকে কি তখন অনেকে কাজের বাজার হিসাবে গণ্য করবে না? অবশ্যই করবে। আর তখনই এটা নিজেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। কে জানে তখন হয়তো দেশে-দেশে ‘গ্যাম্বলিং কমিশন’ নামের সংস্থা গড়ে উঠবে, যারা একটা টেঁকসই লটারি ব্যবস্থার পরিকল্পনাকে রূপায়িত করার চেষ্টা করবে ও করের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে চালু রাখবে। আজকের দিনে এইসব নিত্যনতুন ব্যবস্থাগুলিই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অর্থনীতির সাবেক সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। মানুষ নতুন এক রূপান্তর কালে এসে পৌঁছেছে। এটাকে অনুধাবন করাটা জরুরি।
লটারি, বেশ্যাবৃত্তি, ব্যক্তিগত পরিচারক-পরিচারিকা এসবই নতুন অর্থব্যবস্থার খুঁটি হতে চলেছে বোধহয়।
ReplyDeleteলটারিতো ছিলোই। দেখা যাচ্ছিলো না। কোন বানেগা ক্রোড়পতি কি লটারি নয়? বিহারের সেই যুবক যে 25 কোটি টাকা জিতে শ্রম ক্ষমতা হারিয়ে বিক্রি হয়ে গেল।
ReplyDeleteমানুষ কাজ না পেয়ে সারাদিন বসে বসে লটারি খেলবে , ভিডিও গেম খেলবে! রোজগারের জন্য ইউটিউব ফেসবুক লাইভ এ আগডুম বাগডুম বকবে। ভালই ব্যবস্থা।
ReplyDelete