আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে চাইছে দিল্লিশ্বর?
প্রবুদ্ধ বাগচী
হীরক রাজার বিপুল ধনভাণ্ডারের দরজা খুলে ঢুকতেই এক প্রকাণ্ড বিস্ময়। গুপী-বাঘা দেখল, সেই কোষাগার পাহারা দিচ্ছে এক রাজকীয় বাঘমামা। তার দু' চোখে গভীর আলস্য। এই চমকে ওঠা ঘটনার মধ্যে দিয়েই গুপীর গলায় উঠে এল গান। 'পায়ে পড়ি বাঘমামা/ কোরো না কো রাগ মামা/ তুমি যে এ ঘরে কে তা জানত?' গানের জাদুতে বাঘের শরীরে যখন দুলুনি লেগেছে তখন এই গানেই উঠে এল আর্ত আশঙ্কা-- 'যদি ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা/ কী জানি কি হবে বাবা/ মারা যাবে তাজা দুটি প্রাণ তো!' একটি চলচ্চিত্র আখ্যানের আশঙ্কা আজ ছায়া ফেলছে গোটা দেশ জুড়ে। সত্যিই কার ঘাড়ে কখন যে বাঘের থাবা এসে পড়বে, এ নিয়ে এই রাহুকালে গোটা দেশের মানুষ আজ ত্রস্ত। যে বাঘ একইসঙ্গে সম্পদের পাহারাদার ও ঘাতক।
শুরুটা হয়েছিল কয়েক বছর আগে ভীমা-কোরেগাও মামলাকে কেন্দ্র করে। প্রায় পরিকল্পিত এক চক্রান্তে একসঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশিষ্ট কয়েকজন সমাজকর্মী ও মানবাধিকার কর্মীকে। তাঁরা অনেকেই নিজেদের পেশায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ--- অন্তত ‘দেশের বিরুদ্ধে’ যে ভাবে জেহাদিরা যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন, এঁদের সেই গোত্রে ফেলা যায় না। কিন্তু আমি আপনি কী ভাবছি তা নিয়ে কেন্দ্রের প্রশাসনের কোনও মাথাব্যথা নেই। তাঁরা যাকে দেশ বা রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করেছেন, বা তাঁরা সেই দেশ-এর পরিসীমা ঠিক করে দিয়েছেন, সেই গণ্ডি পেরলেই তাঁদের দেগে দেওয়া হবে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলে। এবং সেইভাবেই গুছিয়ে তোলা হবে মামলার পাহাড়- আইনের যত ধারা-উপধারা প্রয়োগ করে তাঁদের যতদিন কারার আড়ালে অন্তরীণ রাখা যায় ততই নাকি দেশের মঙ্গল। বাস্তবে হয়েছেও তাই। এঁদের সকলের সঙ্গেই নাকি ‘মাওবাদী’ যোগ আবিষ্কার করে ফেলেছে প্রশাসন। যারা এই ব্যাভিচারগুলির বিরোধিতা করছেন তাঁরা ‘মাওবাদ’ নামক একটা গোলমেলে বিষয়ে দু' হাত তোলা সমর্থক, এমন নয় মোটেও। আজকে যারা মাওবাদী নামে পরিচিত তাঁদের পথ ও মতের সঙ্গে অনেকের অনেক ধরনের বিরোধ আছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে মতামত প্রকাশের অধিকারকে পায়ের তলায় ফেলে দিলে আদপে গণতন্ত্রের পবিত্র কাঠামোটাই কোথাও দূষিত হয়ে যায়। মনে পড়ে যায়, প্রথমবার সংসদ ভবনে প্রবেশের আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আভূমি প্রণত হয়ে পড়ার সেই ‘হিট ছবি’টা। মুখ ও মুখোশের তফাত যে থাকেই সেটা ভারতের আমজনতা সেদিন বোঝেননি। আজ বুঝছেন।
স্ট্যান স্বামীর মতো মানুষ নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন জনজাতিদের উন্নয়নে, সেবায়। তাঁর বাড়িতে একটা লাঠিও ছিল কিনা সন্দেহ। অথচ তিনিও হয়ে গেলেন দেশদ্রোহী বিপজ্জনক মানুষ, এমনকি অসুস্থতার প্রকোপে যিনি জলের গ্লাস থেকে জল খেতে পারতেন না, তাঁকে জেলের মধ্যে একটা স্ট্র অবধি দেওয়া হয়নি। তাঁর মৃত্যু ঘটে গেছে এক বছর আগেই। জনজাতিদের জন্য বাস্তবিক যিনি নিজের জীবন বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন, সেই অশীতিপর যাজককে শেষ অবধি জামিন দেওয়া যায়নি।
কিন্তু বাঘের রক্তপিপাসা তো অনন্ত, তাই সে নতুন নতুন শিকার খুঁজে বেড়ায়। গুজরাট নরমেধ যজ্ঞ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট একটি অত্যন্ত অসংবেদনশীল রায় ও মন্তব্য করার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে থাবা এসে পড়ল তিস্তা শীতলবাদের ওপর। আপাতত তিনি জামিনহীন জেলবন্দি। তার অল্প আগেই আটক করা হয়েছে মহম্মদ জুবেইরকে। তিনি তাঁর 'অল্ট নিউজ' চ্যানেলে সরকারের নানা কুমতলব আর আইটি সেলের ভুয়ো খবর ‘ভান্ডাফোড়’ করে দিচ্ছিলেন। আর ‘নূপুরের’ কাংস্যনিন্দিত কন্ঠে যিনি বেচাল বাক্য বলে দেশের সরকারকে কূটনৈতিক সমস্যায় ফেলেছিলেন, তাঁর সেই ‘মধুর’ ভাষণ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে সরকারের আরও বিরাগভাজন হলেন জুবেইর। সুতরাং, ‘তুই না করলেও তোর বাবা জল ঘোলা করেছিল’ কায়দায় চল্লিশ বছরের পুরনো হৃষিকেশ মুখার্জি'র একটি ফিল্মের ছবি তুলে এনে জুবেইরকে জব্দ করার এক ফন্দি আঁটা হল। দুয়েকটি মামলায় জামিন পেলেও অন্য নানা মামলায় তিনি এখনও কারা প্রাচীরের ওপারে। অবশ্য সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীদের নানা ধরনের হেনস্থায় বা বৃহত্তর অর্থে সংবাদমাধ্যমের কাজে বাধাদান ও তাদের স্বাধীনতা রুদ্ধ করার প্রশ্নে বর্তমান জমানায় ভারত নামক এই দেশটি আন্তর্জাতিক নিরিখেই এখন এগিয়ে। কোথাও সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিগৃহীত হতে হচ্ছে তাঁদের, তুচ্ছ অজুহাতে গ্রেফতার করে ‘দেশদ্রোহ’এর অভিযোগে তাঁদের বেঁধে ফেলা হচ্ছে। এমন দৃষ্টান্ত আজ ভুরি ভুরি। রাণা আইয়ুব'এর ‘গুজরাট ফাইলস’ আমরা অনেকেই পড়েছি, সেখানে বিধৃত আছে আরএসএস বাহিনীর নৃশংসতা ও প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় রাখার কূটনীতি কতদূর পর্যন্ত বিষাক্ত হতে পারে। সেইসব ঘটনার পরে দেশে সংঘীদের শাসন ইতিমধ্যে আট বছর পেরিয়ে গেছে, আরও আঁটো হয়ে বসেছে তাদের দাপট আর অনাচার।
ঘটনা হল, এই ‘ম্যান ইটার অফ নিউ দিল্লি’ এতকাল যাদের ঘাড়ে থাবা মেরে জিভ চাটছিল, তাঁরা কমবেশি চেতনায়, ভাবনায় কিছুটা বামাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়া, সবাই অবশ্যই ঘোষিত অর্থে ‘কমিউনিস্ট’ নন। কিন্তু সামাজিক চিন্তা বা মানবাধিকারের আন্দোলন অনেকটাই প্রগতিশীল মতবাদের সঙ্গে ঘর করা বিষয়। কিন্তু এবারে ঘাতকের দৃষ্টি যে সব দিকেই পড়েছে তার হদিশ মিলল যখন সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশ সরকার এফআইআর দায়ের করল সমাজকর্মী মেধা পাটেকরের নামেও। মেধা বহুদিনের পরিচিত গান্ধীবাদী সমাজকর্মী, যার মূল পরিচয় পরিবেশ আন্দোলনের সূত্রে। ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলন তাঁকে দেশজোড়া খ্যাতি দিয়েছে, পাশাপাশি তিনি নানা ধরনের সামাজিক আন্দোলনের সহযোদ্ধা। এই রাজ্যের জমি আন্দোলনে আমরা তাঁকে দেখেছি শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের ভূমিকায়। কিন্তু এইরকম একটি ব্যক্তিত্বকে আঘাত করার নতুন ফিকির হল তাঁর তৈরি একটি ট্রাস্ট। জনৈক সংঘী অভিযোগ তুলেছেন, ওই ট্রাস্টের অর্থ নাকি বিদেশ থেকে পাওয়া এবং তা নাকি জনজাতিদের জন্য খরচ করা হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। মেধা স্বয়ং এবং ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ সরকার অভিযোগের তদন্ত করবে বলে খবর।
কিন্তু এগুলো যে আসলে হিমশৈলের চূড়া তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এইভাবেই একেকটা খুচরো অভিযোগ সামনে রেখে বড় ধরনের আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়, এই অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ পত্রিকার সঙ্গে এমনই কোনও এক ট্রাস্টের পুরনো যোগাযোগ খুঁচিয়ে বার করে সনিয়া গান্ধী ও তাঁর পরিবারের পেছনেও ইডি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে- নিছক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া যাকে আর কিছুই বলা যায় না। মেধা পাটেকরও পরিবেশ অধিকার আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে কোনওদিনই কোনও সরকারের সুনজরে ছিলেন না; বিশেষ করে আজকের কেন্দ্রীয় সরকার ও তাদের বশংবদ রাজ্য সরকারগুলি যখন দেশের নদী নালা পাহাড় সমুদ্র জঙ্গল সবই বহুজাতিকদের হাতে একচেটিয়াভাবে তুলে দিতে মরিয়া, তখন তাদের সামনে ন্যূনতম কোনও প্রতিরোধের মুখ থাকুক এটা তাদের অভিপ্রেত নয়। অনেকেই ইতিমধ্যে জানেন, গুজরাট রাজ্যে নর্মদা নদীর পাড় বুজিয়ে সেখানে বিলাসবহুল হোটেল ও শপিং মল তৈরি করা হয়েছে। কাজেই নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থে ঘা লাগলে, প্রয়োজন বুঝলেই মেধার মতো গান্ধীবাদীকেও খাঁচায় পুরতে তাদের চক্ষু লজ্জায় বাঁধবে না। নরখাদকের আবার লজ্জা!
এরই মধ্যে আরও এক খবর শিরোনামে এল। ছত্তিশগড়ের পরিচিত গান্ধীবাদী সমাজকর্মী হিমাংশু কুমারকে আমরা অনেকেই চিনি। এক সময় ছত্তিশগড়ের ‘সালওয়া জুড়ুম’ ব্যবস্থার প্রতিবাদে যিনি সংগঠিত করেছিলেন এলাকার আদিবাসী মানুষদের, বারবার বিভিন্ন ফোরামে বলে বেড়িয়েছেন এইভাবে পুলিশ ও সেনার তরফে সাধারণ মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া অনৈতিক ও গণতন্ত্রবিরোধী। পরিণামে তাঁর তৈরি করা আশ্রম পুলিশ এসে ভেঙে দেয়। যদিও তিনি তার বিরুদ্ধে সারা দেশ ঘুরে জনমত সংগ্রহ করেছিলেন, এসেছিলেন কলকাতাতেও- তাঁর বক্তৃতা ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশও হয়েছে বাংলা ভাষায়।
সম্প্রতি তিনি সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছিলেন। কিছুকাল আগে ছত্তিশগড়ে ‘মাওবাদী’ দমন অভিযানের সূত্রে ১৭জন নিরীহ আদিবাসীকে পুলিশ হত্যা করে- নিরীহ নাগরিকদের প্রতি এই রাষ্ট্রীয় অবিচার যেন সুপ্রিম কোর্ট বিবেচনা করে দেখে, এই ছিল তাঁর আর্জি। এতে কোনও অন্যায় আছে বলে মনে হয় না। যে দেশে একজন জনজাতি মহিলাকে রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর তোড়জোড় চলছে এবং বলা হচ্ছে এই ‘মহান প্রয়াস’কে নাকি সকলের সমর্থন করা উচিত, সেখানে নিরীহ সহায়হীন আদিবাসীদের ওপর এমন নির্বিচার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে একজন সমাজকর্মী আইনি সুবিচার চাইতে পারেন না? কিন্তু হলে হবে কি, ইদানিং দেশের সব থেকে উঁচু আদালতের মাথা সব সময় সিধে পথে চলছে না। আদালত জানিয়ে দিয়েছে, হিমাংশু কুমারের জানানো অভিযোগ তাঁরা পত্রপাঠ খারিজ করে দিচ্ছেন। সুতরাং, বাঘের বিচরণভূমি আরও খানিকটা বেড়ে গেল, বেড়ে যাচ্ছে। আপাতত তার লোলজিহ্বা রক্তে মাখামাখি, সে শুধু খুঁজে চলেছে তার পরের শিকার।
একেবারে টাটকা খবর হল, সংসদের আসন্ন বাদল অধিবেশনেও সংসদের ভিতর সমালোচনার জন্য বেশ কিছু শব্দকে স্পিকার নজরবন্দি করেছেন। অর্থাৎ, সংসদের ভিতরে সরকারের সমালোচনাও আর নথিভুক্ত হবে না- বেচাল সমালোচনা হলেই তা কার্যবিবরণী থেকে মুছে দেওয়া হবে। আপাতত শান্তিকল্যাণ। এমনকি সংসদ চত্বরে সাংসদদের কোনওরকম বিক্ষোভ অবস্থান প্রতিবাদী মিছিল ধর্না, তাতেও জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তার মানে শুধু একমুখি প্রচার আর তার অন্তরালে ক্ষিপ্ত বাঘমামার ল্যাজ আছড়ানোর আওয়াজ।
শুধু বাঘ নয়, এখন অশোকস্তম্ভের নিরীহ সিংহগুলোও নাকি সুউচ্চ নতুন সংসদ ভবনের মাথায় বসে দাঁতে শান দিয়ে একশো তিরিশ কোটির রক্তপান করবে বলে চনমন করছে! আশেপাশে কোনও রিংমাস্টার আছেন নাকি?
বাঘের সঙ্গে তুলনা করা অনুচিত।খাদ্যশৃঙ্খলের যে জায়গায় তার অবস্থান এই প্রাণীটি সেই অনুযায়ী আচরণ করে।
ReplyDeleteতার মধ্যে কোনো নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা নেই।
শাসকের দানবীয় হিংসা একমাত্র
মানুষের পক্ষে ই সম্ভব।
আমাদের বোধ হয় রূপক ব্যবহারে সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।