অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
আশ্চর্য হলেও সত্যি! ২০২২ সালের প্রথম ছ’ মাসে বিশ্বের তাবৎ ধনীদের সম্পদে কল্পনাতীত পতন ঘটেছে। ব্লুমবার্গ’এর একটি তথ্য-প্রতিবেদন জানাচ্ছে, উল্লিখিত সময়ে বিশ্বখ্যাত ধনী মার্ক জুকেরবার্গ, জেফ বেজোস এবং এলন মাস্ক’এর সম্পদ হ্রাসের পরিমাণ যথাক্রমে ৬৬, ৬৩ ও ৬২ বিলিয়ন ডলার। গত বছরও যেখানে বিশ্বে অন্তত দশ জন ধনী ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী ছিলেন, তাঁদের সংখ্যা এখন নেমে এসে দাঁড়িয়েছে চারে। শুধুমাত্র তাই নয়, ক্রিপ্টো সম্পদে বলীয়ান চ্যাংপেং ঝাও (‘বিনান্স’ কোম্পানির কর্ণধার) যিনি এই বছরের জানুয়ারি মাসেও ৯৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদের অধিকারী ছিলেন, তাঁর সম্পদও জুন মাসের শেষে এসে নেমে দাঁড়িয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলারে। হচ্ছে টা কী?
সাবেক বিশ্লেষণকারীরা বলছেন, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিতে তেলের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে গোটা বিশ্বে যে মন্দাবস্থা তৈরি হয়েছে, তারই ফলশ্রুতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের হাল খারাপ হয়ে আসায় ধনীদের সম্পদেও টান পড়ছে। উপরন্তু, মুদ্রাস্ফীতি ও বর্ধিত সুদের হার এই দুরবস্থাকে আরও প্রকট করেছে; তার ওপর কোভিডের আতঙ্কে চীনে নতুন করে সার্বিক লকডাউন বিষয়টিকে আরও ঘোরতর করে তুলেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, গত দু’ বছরে কোভিড জনিত মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যে সঙ্গীন অবস্থায় পৌঁছেছিল, কর্মহীন মানুষের দারিদ্র্য বৃদ্ধি যে দুঃসহ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তখন কিন্তু এইসব সর্বোচ্চ ধনীদের সম্পদের পরিমাণ মোটেও হ্রাস পায়নি। বরং বলা হয়েছিল, কোভিডের কারণে আমজনতা অর্থনৈতিক ভাবে যতটা ঘায়েল হয়েছিলেন, সেই তুলনায় গুটি কয়েক কোম্পানি ও তাদের অধিপতিরা কয়েক গুন বেশি মুনাফা অর্জন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে অক্সফ্যাম’এর একটি প্রতিবেদন (১৭ জানুয়ারি ২০২২) বলছে, মহামারির দু’ বছরে বিশ্বের সর্বোচ্চ দশ ধনাঢ্যের সম্পদ ৭০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে- দিনে ১.৩ বিলিয়ন ডলার করে বৃদ্ধি। এই দশ ধনীরা হলেন: এলন মাস্ক, জেফ বেজোস, বার্নার্ড আরনল্ট ও তাঁর পরিবার, বিল গেটস, ল্যারি এলিসন, ল্যারি পেজ, সার্গেই ব্রিন, মার্ক জুকেরবার্গ, স্টিভ বলমার ও ওয়ারেন বাফেট। ফলে, অনেকেই বলতে শুরু করেন যে এই মহামারি আসলে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র-প্রকল্প যেখানে কার্যত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত প্রযুক্তির সর্বব্যাপী অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে প্রায় গোটা বিশ্বের দখল নেওয়াটাই ছিল এই ধনীদের চক্রান্তমূলক অভিসন্ধি।
তাহলে আজ হঠাৎ কী এমন পরিস্থিতির উদয় হল যে সেইসব কতিপয় কোম্পানি ও ধনীরা তাদের সম্পদকে বিপুল ভাবে খোয়াতে শুরু করলেন? Meta (F)B), Amazon, Apple, Netflix, Alphabet (G)oogle)- বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্পদধারী এই কোম্পানিগুলিকে একসঙ্গে জুড়ে কোনও কোনও মিডিয়ায় FAANG বলা হয়। এই বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে FAANG’এর সম্পদ হ্রাস পেয়েছে ৩৭ শতাংশ। ‘ষড়যন্ত্র’ হয়ে থাকলে পাশা হঠাৎ উল্টে গেল কেন? নাকি সাময়িক মন্দা? তাহলে, এই মন্দার প্রকোপ তাঁদের ওপর কোভিড কালে দেখা গেল না কেন? কেউ কেউ আবার বলছেন- আমরা নাকি ২০০৮’এর মতো আবারও একটি সাব-প্রাইম সংকটের মুখোমুখি প্রায়, যা ২০২৩’এর গোড়ায় আত্মপ্রকাশ করবে। আসলে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত যে রাজনৈতিক-অর্থনীতির জমানা গত দশকের গোড়া থেকে বিশ্ব জুড়ে ধীরে ধীরে প্রায় গেঁড়ে বসতে থেকেছে, আমরা তারই পর্বান্তর পেরচ্ছি মাত্র। এই পর্বান্তরে বহুবিধ রূপান্তরের সাক্ষী থাকব আমরা, যাকে না বুঝলে বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে থ’ মেরে বসে থাকা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায়ন্তর থাকবে না।
কথাটা হল, ওয়েব ১.০-ওয়েব ২.০ পেরিয়ে আমরা এখন ওয়েব ৩.০ জমানায় প্রবেশ করেছি। এই ওয়েব ৩.০ জমানা হল এমন এক নৈর্ব্যক্তিক পর্বান্তর যেখানে লেনদেনের মধ্যবর্তী স্তরগুলি অপসারিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, রাষ্ট্রের নিয়মবিধি, ক্লাউড সার্ভার ইত্যাদি কোনও কিছুর আর দরকার থাকবে না; ব্যবহারকারীরা পরস্পরের মধ্যে সরাসরি আদান-প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবেন। ব্লকচেইন প্রযুক্তি হবে এই ব্যবস্থাপনার আধার এবং বিকেন্দ্রীকরণ (DeFI) হবে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ। অতএব, তথ্যকে কব্জা করে কতিপয় কর্পোরেট কোম্পানির ছড়ি ঘোরানোর যুগেরও অবসান হতে থাকবে। প্রত্যেক ব্যবহারকারীর নিজস্ব অনলাইন পরিচয় সুনিশ্চিত ও নিরাপদ হবে, যার সুবাদে তিনি তাঁর নিজস্ব তথ্য কীভাবে ব্যবহৃত হবে তার নিয়ন্ত্রণ তাঁর নিজের হাতে রাখতে পারবেন। এক কথায়, ওয়েব ২.০ জমানায় সোশ্যাল মিডিয়ার সুবৃহৎ কারবারীরা গত দু’ দশক ধরে যে একচ্ছত্র শাসন ও আধিপত্য কায়েম করে এসেছে, সম্ভবত তার অবসানের পথে আমরা এগোব এবার।
অর্থাৎ, ওয়েব ৩.০ জমানায় পুঁজি তার ক্ষেত্র বদল করে বিনিয়োজিত হতে চাইছে ব্লকচেইন স্টার্ট-আপ ও আনুষঙ্গিক পরিসরগুলিতে। খেয়াল করে দেখুন, ২০২১ সালে ব্লকচেইন স্টার্ট-আপগুলিতে পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ ৭১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত ‘গ্যালাক্সি ডিজিটাল রিসার্চ’এর একটি অনুসন্ধান বলছে, এই বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে বড় বড় সোশ্যাল মিডিয়া ও টেক কোম্পানিগুলিতে যখন সম্পদের পরিমাণ ক্ষয় পাচ্ছে, এমনকি ক্রিপ্টো বাজারও তার চূড়ান্ত শিখর থেকে অন্তত ৫০ শতাংশ পড়ে গেছে, তখন ক্রিপ্টো স্টার্ট-আপ’এ ভেঞ্চার পুঁজি ১০ বিলিয়ন ডলারের ওপর বিনিয়োগ সেরে ফেলেছে। মনে রাখতে হবে, ভেঞ্চার পুঁজিই কিন্তু আগামী দিনে পুঁজির উর্বর ক্ষেত্র কোথায় হতে চলেছে তার গন্ধ পায়। সেই হেতু, কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে তা আরও ভালো ভাবে মালুম করতে হলে সদ্য ঘটে যাওয়া বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট তথ্য হ্যাকিং’এর দিকে চোখ ফেরাতে হবে। খবরে প্রকাশ, সাংহাই পুলিশের হেফাজত থেকে জনৈক হ্যাকার ১০০ কোটি চীনা নাগরিকের যাবতীয় তথ্যাদি হ্যাক করেছে। ইতিমধ্যে ‘চীনা ড্যান’ নামক সেই হ্যাকার ‘ব্রিচ ফোরামস’এ (হ্যাকার ফোরাম) অপহৃত ওই ২৩ টেরাবাইট তথ্যের দর হেঁকেছে ১০ বিটকয়েন, যা এই মুহূর্তে ২ লক্ষ ডলারের সমতুল্য। এই তথ্যটি কেন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক? এটা বোঝার জন্য যে, সাবেক রাষ্ট্রব্যবস্থার সমস্ত নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এক সমান্তরাল অর্থনীতির ভুবন ইতিমধ্যেই প্রবাহিত। আফসোসের বিষয়, ডার্ক ইন্টারেনেটের এই জগতে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে কুখ্যাত অপরাধীরা।
মনে পড়ছে মার্কস কথিত সেই অমোঘ উক্তিটি: ‘What the bourgeoisie, therefore, produces, above all, is its own grave-diggers.’। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’এ মার্কস প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণিকে পুঁজিপতিদের কবর-খননকারী হিসেবে বুঝেছিলেন। তারপর প্রায় ১৭৫ বছর অতিক্রান্ত। খুব স্বাভাবিক, উনিশ শতকের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প ভিত্তিক উৎপাদন ও আনুষঙ্গিক শ্রমিক শ্রেণির অবয়ব অতিক্রম করে আমরা আজ এক নতুন পুঁজিবাদের দুনিয়ায় প্রবেশ করেছি যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত মূলত ডিজিটাল-নির্ভর এক সর্বব্যাপী ব্যবস্থা আমাদের এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির ঘরানা দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে, উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি ও মুনাফা আহরণের সূত্রটি তো হারিয়ে যায়নি। আর সেই সূত্র ধরেই তো আজ বিশ্বে নয়া ধনীদের উদয়, FAANG’এর সর্বজনীন আধিপত্য। এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইও তাই স্বতঃসিদ্ধ। সেই লড়াই একদিকে যেমন জোটবদ্ধ নতুন শ্রমবাহিনীর লড়াই, অন্যদিকে ভেতর থেকে প্রযুক্তি-বিদ্যাকে অপহরণ করে পদ্ধতিগত ভাবে অনুকূল পরিসরে নিয়ে আসারও লড়াই।
জাপানের সাতোশি নাকামতো, ক্রিপ্টোমুদ্রা বিটকয়েন প্রচলনের জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তির যে কাঠামোর কথা ভেবেছিলেন, তা আজ আর শুধুমাত্র ক্রিপ্টোমুদ্রায় আবদ্ধ না থেকে এক বড় পরিসরে বিকল্প অর্থনীতির ধারা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। পুঁজিরও বিনিয়োগ-অভিমুখ এখন সেই পানে। কারণ, পুঁজিবাদ যে আত্মঘাতীও বটে- সে নিজেই নিজের কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করে। তদুপরি, মার্কস সাহেবের সেই চিরায়ত উচ্চারণটিও যে অম্লান আজও- উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদিকা শক্তির মধ্যে আর যখন কোনও বোঝাপড়া সম্ভব নয়, তখন তা বিস্ফোরণের রূপ নেয় নতুন উৎপাদন সম্পর্ককে জন্ম দেওয়ার জন্য। সূত্রটি বলে দেওয়া আছে, যা বাস্তবে দেখাও গেছে বারে বারে, কিন্তু তা কোন পথে কেমনতর রূপে আসবে তা স্বভাবতই অধরা। আজকের বামপন্থীদের সমস্যা হল, তাঁরা কপিবুক স্টাইলেই খেলতে চান। তাই চোখ থাকতেও দৃষ্টিহীন। এখন বুঝি, ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার সময় কেন মার্কস’এর ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের বিক্রি হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল এবং বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মূল্যতত্ত্বের পরিচ্ছেদটি বার বার করে বুঝতে চাইছিলেন। তখন মার্কস’এর অধিকাংশ অনুগামীরা অবশ্য আতসকাঁচ নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন ১৮৭১ সালের প্যারী কমিউনের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা, যা আদপে আর ঘটার নয়।
প্রশ্ন হল, ব্লকচেইন প্রযুক্তি ভিত্তিক ওয়েব ৩.০ জমানা আমাদের কি নতুন কোনও উৎপাদন সম্পর্কের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে?
সম্পদের এই বাড়া কমা তো শেয়ার বাজারের পারসেপশন অনুযায়ী হয়। রিয়াল ভ্যালু তো অধরাই থাকে।
ReplyDeleteasitray797@gmail.com
ReplyDeleteপুঁজিবাদই স্রষ্টা ও কবর খোঁড়ার একমাত্র হকদার। তাহলে সমাজতন্ত্রিদের ধারণা কী?
ReplyDeleteনাকি শুধুই interpreterরের ভূমিকায়।
অতি সাম্প্রতিক তথ্যপূর্ণ এই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ যথেষ্ঠ যুক্তিপূর্ণ। সমসাময়িক বিশ্ব বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি খুব প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন লেখক-চিন্তাবিদ শ্রী অনিন্দ্য ভট্টাচার্য্য তার নিজস্ব ধারায়। সব যেন ঠিক মিলে যাচ্ছে ওনার ব্যাখ্যায়।
ReplyDeleteআর একটা কথা এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে যে এই দানবীয় আকারের নয়া শিল্পপতিদের মধ্যে একে অপরকে নির্মূল করে দেওয়ার চেষ্টা অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠছে।
লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো। সময়োপযোগী লেখা।
ReplyDeleteলেখাটি আজকের সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। আশা করি বামপন্থীদেরও ভাবাবে।
ReplyDelete