Thursday, 28 April 2022

এক অত্যাশ্চর্য আত্মকথন

যে বই হাতে নিলে নিঃশব্দ রাত

ঝর্নার মতো মৌন প্রভাতে অবতরণ করে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

শ্রীমতী কৃষ্ণকামিনী দাসী। যদিও নামটা আসল নয়। ১৯০৩ সালে বাঁকুড়ার এক গ্রামে জন্ম, ২০০৩'এ দেহাবসান। ১৯১২ সালে মাত্র ন' বছর বয়সে বিয়ে। স্বামী ১৪ বছরের বালক। বিয়ের পর পরই স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন কলকাতায় তাঁর মামাশ্বশুরের বাড়িতে। ১৯১৯ সাল অবধি সে বাড়িতেই বসবাস। উত্তর কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে যে বাড়ির অদূরেই পান্তীর মাঠ। জানালার খড়খড়ি খুলে সেই মাঠের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণকামিনী আবিষ্কার করেন এক অভিনব জগৎ; আর তাঁর কলকাতা যাপনের সেই বাল্য-কৈশোরের আট বছরে, গ্রামের সরলমতি বালিকা থেকে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন এক প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বময়ী সত্তা। 

তাঁর বয়স যখন আশির কাছাকাছি, স্মৃতিতে সতত উজ্জ্বল কলকাতা যাপনের তাঁর সেই অলৌকিক গাথা তিনি কতকটা আত্মজীবনীর মতো নিজের খেরোর খাতায় লিখে ফেলেন-

‘কলিকাতা আমাকে মানুষ করিয়াছে, দেশ কী বস্তু শিখাইয়াছে, লক্ষ মানুষের প্রাণস্পন্দন শুনাইয়াছে, সেকালের কত বিচিত্র ঘটনায় সামিল করিয়াছে, আমার ভাগ্য লইয়া ছিনিমিনি খেলিয়াছে, হাসাইয়াছে, কাঁদাইয়াছে, আমায় লইয়া যা-ইচ্ছা করিয়াছে। আর সাক্ষীর ন্যায় চুপ করিয়া দেখিয়াছে পান্তীর মাঠ – যেন একটী আত্মা। কলিকাতা আমাকে কুহকের ন্যায় নিশিডাক দেয়, এই বার্দ্ধক্যের কালেও, তবুও আমি কিন্তু আর কখনো কলিকাতা যাই নাই।'

তারপর যতদিন বেঁচেছেন, পাতা উল্টে বারবার তাঁর আত্মকথনের ভেতর দিয়ে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন সেই ফেলে আসা আট বছরের দিনলিপিতে। কী সেই আমোঘ টান, কী সেই অমূল্য প্রাপ্তি- যা তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের সমস্ত কিছুকে ম্লান করে শুধুমাত্র সেই কটি বছরের মায়ামোহতেই তাঁকে টেনে টেনে নিয়ে যায়?

এই অত্যুজ্জ্বল মননের অধিকারিণীর মৃত্যুর কিছুকাল পরে ২০০৭ সালে তাঁরই এক উত্তরপুরুষের হাতে নিরুদ্ধ সেই আত্মকথনের পাতাগুলি এসে পড়ে। তিনি সে কথামালা পড়ে মোহিত হয়ে যান; সযত্নে সেগুলিকে যথাযথ পরিচর্যা করে মনস্থির করেন যে তা প্রকাশ করবেন। যেহেতু কৃষ্ণকামিনী তাঁর কথাগুলি নিজের জন্যই লিখেছিলেন, কখনই জনসমক্ষে প্রকাশ করতে চাননি, তাই সে উত্তরপুরুষ (বিশ্বজিৎ মিত্র) তাঁর অভিপ্রায়কে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তাঁর আসল নামটি অপ্রকাশ রেখে ‘পান্তীর মাঠ’ নামে আত্মজীবনীটি প্রকাশ করেন। ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘এই বিশিষ্ট মানুষটি আমার একান্ত আপনার জন। ২০০৭ সালে যখন এই রচনার পাণ্ডুলিপি হাতে পাই, তখনই আমার মধ্যে এটি বই আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছে জাগে। তার কারণ শুধু এই নয় যে, ভাষ্যটি একটি টালমাটাল সময়ের দলিল আর এর ভাষা সুললিত ও পুরনো ধাঁচের। আমাকে বেশী আকর্ষণ করেছিল এই নারীর উত্তরণের তাগিদ ও ঋজু অকপটতা, যার ব্যাপ্ত-কিন্তু-নিরুচ্চার অভিব্যক্তি সেই সেকালের রক্ষণশীল পরিবারের স্বাভাবিকভাবেই লজ্জাশীলা এক মহিলার পক্ষে অকল্পনীয় ঠেকেছে আমার কাছে। কিন্তু একই সঙ্গে আবার তিনি নিজের পরিবারের সম্মান নিয়েও চিন্তিত। জীবনীর মধ্যেই সেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। তাই সবদিক বিবেচনা করে লেখিকার নাম পরিবর্তন করাই সাব্যস্ত হল।’

তিনি তো ছিলেন কৃষ্ণ অনুরাগী, কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর, সম্ভবত তাই তাঁর উত্তরপুরুষেরা তাঁর কলম-নাম রাখলেন কৃষ্ণকামিনী দাসী।

‘পান্তীর মাঠ’ এক অত্যাশ্চর্য আত্মচরিত। শুধুমাত্র এই কারণে নয় যে, কস্মিনকালেও ইস্কুল বা বিদ্যায়তনের চৌকাঠ না পেরিয়ে কৃষ্ণকামিনী অক্ষর-ধ্বনি ও শব্দের ব্যঞ্জনায় এক অনাবিল ছন্দে গ্রথিত করেন তাঁর লেখনি, তদুপরি, মনের মাধুরী, অভিমান ও জীবনরসকে যে এইভাবে স্রোতস্বিনী নদীর মতো ‘সচলবচল’ (তাঁরই ব্যবহৃত শব্দ) করে তোলা যায়, তা এই গ্রন্থটি না পড়লে ঠাওর করার কোনও উপায় নেই। তাই, এ বই হাতে নিলে নিঃশব্দ রাত ঝর্নার মতো মৌন প্রভাতে অবতরণ করে, নিঃসঙ্গ দুপুর তার দহন তেজের দীপ্তি ফুরিয়ে টুপ করে সন্ধ্যা হয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়!

কৃষ্ণকামিনী শুরুতে দু-এক পাতা গৌরচন্দ্রিকা করেছেন। কেন লিখতে গেলেন তিনি এ আত্মকথন?

‘প্রথমেই বলি, আমার এ কাহিনী কেহ পড়িবে না। আমি ইহা লুকাইয়া রাখিব স্থির করিয়াছি সকলের চক্ষুর অন্তরালে। কারণ, পড়িলে অনর্থ হইবে। কেহ পড়িবে না জানিয়াও আমার লিখিবার কারণ কী?’

এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এই মুহূর্তে পাঠকের কৌতূহল নিবারণের ইচ্ছে আমার নেই। তা করলে, এই অসাধারণ সাহিত্যকর্মের অন্তর্লীন বাঁশির সুরটি থেকে রসিক পাঠক বঞ্চিত হবেন। প্রায় প্রতিটি বাক্যে যে নির্মেদ উচ্চারণ, যে অসীম বোধ ও ভালবাসার গভীর আকুলতা- তা পাঠককেই সিঞ্চন করে নিতে হবে যে! বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে কলকাতার ধনী গৃহে অন্তঃপুরবাসিনী যে কিশোরী গৃহবধূ, যার নয়ন জুড়ে চারপাশে নানাবিধ রঙ ও মাধুর্য, শুধু কি তাই, সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির টুকরো-টাকরাগুলিও যথাবিধ প্রখর, যেন মনে হবে তা আসলে ইতিহাসের এক নিবিড় ব্যাখ্যা ও পাঠও বটে। স্ত্রীর প্রতি অমনোযোগী কিন্তু সুগায়ক স্বামী, পনের কি ষোলো বছর বয়সে কোলে প্রথম সন্তান, দাস-দাসী পরিব্যাপ্ত ভরা সংসার, সুতীব্র আগ্রহে ঘরে বসেই অক্ষরশিক্ষা ও বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, হরিসাধন মুখোপাধ্যায় মায় যা হাতের কাছে মেলে তাইই পড়ে ফেলা, সচকিতে স্বদেশির ছোঁয়া- এতসব কি আর পল্লবিত হত কৃষ্ণকামিনীর মন ও মননে, যদি না, ‘তখন আমরা দুইজন কিশোরকিশোরী সেই সদ্য-আগত সন্ধ্যার আবছায়ায় পরস্পরের উপস্থিতি উপভোগ করিতে লাগিলাম।’

আর শব্দচয়ন? বাংলা ভাষায় যে কত সুরময়, লাবণ্যময় শব্দের বাস, তা আরও একবার এই বইটি থেকে বুঝতে পারি। অড্ডবড্ড, হটোঠ্যাং, ফৌৎ, থাকদমা, খুঞ্চেবোস, মুড়োয়-কাঁটা-হেঁটোয়-কাটা- এতসব শব্দের বিচিত্র রসভাব তো এই গ্রন্থ থেকেই সংগ্রহে পেলাম!

সব পেরিয়ে ‘পান্তীর মাঠ’ কি আসলে এক সুনিবিড় প্রেম-আখ্যান? যা বলতে গিয়ে চারপাশটাই লেখিকার কাছে হয়ে ওঠে অমৃতময়? যা লিখতে গিয়ে তিনি এঁকে ফেলেন এক নিগূঢ় দৃশ্যকল্প-

‘আমার আনন্দের রাজ্যে আমি এক অদ্ভুত ভাব লইয়া প্রবেশ করিলাম। উদ্ভাসিত সেই মনের রাজ্য। কত রঙের আনাগোনা সেস্থানে। কত কুসুম, কত কুমকুম, কত আবীর। কত গন্ধ-সুবাস। আর সকল কিছু কী কোমল। আমার শরীর বলিয়া সেস্থলে কিছু নাই। তাহা যেন কেবলই ক্রমশ গলিয়া পড়িয়া যাইতেছে। লজ্জা নাই, বেদনা নাই, পূর্ব্ব জীবন নাই, পিছুটান নাই, সঙ্কল্প নাই, পরিণাম নাই, আশা-আকাঙ্খা নাই, এমনকী কী বলিব সন্তানও নাই। কিছু নাই। শুধু এক আশ্চর্য্য আনন্দ ঘিরিয়া থাকে চারিদিক, আমার অন্তর – যেন সকলই অমৃতময়। খাইলেও হয়, না খাইলেও হয়। শুইলে হয়, না শুইলেও চলে। বেশবাস আছে কী নাই, কে জানে ছাই। স্নান করিলে সুখ, না করিলেও সুখের ঘাটতি তো দেখি না। শুধুমাত্র অবস্থাগতিক হইতে পরিত্রাণ পাইবার আশায় অনন্যোপায় হইয়াই হয়ত এই ভাবরাজ্যে আশ্রয় লইয়াছিলাম, কিন্তু তাহার ফলে যাহা মিলিল তাহা বিস্ময়কর। ইহা সত্যিই এক অভূতপূর্ব দশা।’

এ এক অনাস্বাদিত গদ্য। এক অবগাঢ় প্রবাহ। এই এক স্বল্প আত্মকথন ছাড়া তিনি আর কখনও কিছু লেখেননি। লিখবেনই বা কেন? তিনি কি লেখক হতে চেয়েছিলেন? প্রলোভনের শিখর বাইতে বাইতে, হা-হতোহস্মি, এ সমাজে যথাযথ গ্রন্থরস নেওয়ার পাঠকই বা কই? যারা ‘আধুনিক’, সমাজের কত কিছু নিয়ে কত কী বলেন, কখনও ভাববেন কি, অন্যতর যোগ্য হয়ে ‘পান্তীর মাঠ’ হাতে তুলে নিই!

প্রকাশক: অভেদ ফাউন্ডেশন।

(এই অমৃতসমান বইটি আমার হাতে তুলে দিয়েছেন দীপঙ্কর কুণ্ডু, এক নিরলস বইওয়ালা। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।)     

Tuesday, 26 April 2022

জাহাঙ্গিরপুরীতে সরকারি সন্ত্রাস!

বুলডোজার: মোদী-শাহ'র নয়া রথ 

প্রশান্ত ভট্টাচার্য 

 

তখন স্কুলে পড়ি। চলছে জরুরি অবস্থা। সেটা খায় না মাথায় দেয়, তখনও বুঝে উঠিনি। বুলডোজার দিয়ে মানুষের বাসস্থান গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা তখনই প্রথম শুনলাম। নয়াদিল্লির আশেপাশে এই কুকীর্তিটির অধিনায়ক ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর 'নয়নের দুলাল' সঞ্জয় গান্ধী। হয়তো সেই বাসস্থান ছিল অবৈধ নির্মাণ, সরকারি জায়গার ওপর মানুষের সংসার। নগর পরিচ্ছন্নতার নামে চলেছিল বুলডোজার দিয়ে তাণ্ডব। তবে তখনই বুঝেছিলাম, শাসনের তরে বুলডোজার দরকার পড়ে। 

তার অনেকদিন পর ১৯৯৬ সাল।  এক রাতে হাতিবাগান-গড়িয়াহাটের ফুটপাথ সাফা হয়ে গেল। চলেছিল সেই বুলডোজার, পে-লোডার। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ফুটপাথের ধারের সব দোকানের কাঠামো। কলকাতার ইতিহাসে যা ‘অপারেশন সানশাইন’ নামে পরিচিত। আর এই অপারেশনের সর্বাধিনায়ক ছিলেন জ্যোতি বসুর কমরেড-ইন-আর্মস সুভাষ চক্রবর্তী আর তাঁর ডেপুটি কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই রাতের পরে ফাঁকা ফুটপাথ দেখেছিল বটে শহরবাসী, একইসঙ্গে দেখেছিল বলের কী প্রচণ্ড কলরব। তবে তখনও বুলডোজারের গায়ে দলীয় রাজনীতির দাগ লাগেনি। 

আমার বিবেচনায় প্রথম দলীয় রাজনীতির ছোপ লাগল ত্রিপুরাতে। মনে পড়ছে, ২০১৯ সালে যখন আমাদের রাজ্যে সিপিআইএম শিবির ও গেরুয়া শিবির মিলে হুইসপারিং ক্যাম্পেন শুরু করেছিল, 'উনিশে রাম, একুশে বাম', তখন এই রাজ্যে ভোট প্রচারে এসে ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও সিপিআইএম পলিটব্যুরো সদস্য মানিক সরকার বলেছিলেন, 'তৃণমূল বাংলায় বুলডোজার দিয়ে পার্টি অফিস ভাঙেনি'। ত্রিপুরায় ক্ষমতাসীন বিজেপির অত্যাচারের ছবি তুলে ধরতে গিয়েই মানিক সরকার এই তুলনা করেছিলেন। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, শুধু বামপন্থীদের দলীয় অফিসই নয়, বিজেপি সরকারের বুলডোজারের আঘাত থেকে রেহাই পায়নি লেনিনের মূর্তিও। 

তবে সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে জাহাঙ্গিরপুরী। ষষ্ঠ বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে দেশ-বিদেশের উদ্যোগপতিদের সামনে ঐক্যের বার্তা তুলে ধরতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'আমরা বুলডোজ করতে চাই না। আমরা মানুষে মানুষে বিভেদ চাই না। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আমাদের বৈশিষ্ট্য। আমি চাই সবাই এক সঙ্গে থাকুক। ঐক্যবদ্ধ পরিবারই সফল পরিবার।' পাঠক খেয়াল করুন, মমতা এখানে 'বুলডোজ করতে চাই না' বাক্যটি ব্যবহার করলেন। করলেন ঠিক সেদিন, যার আগের দিন দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীর বুলডোজার তাণ্ডব সারা পৃথিবী দেখেছে। দেখেছে, সেই বুলডোজারের সামনে শীর্ষ আদালতের স্থগিতাদেশের কথা রীতিমতো জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করছেন সিপিআইএম নেত্রী বৃন্দা কারাত ও সিপিআইএমএল লিবারেশনের নেতা রবি রাই'রা। 

আপাতত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পিছু হঠেছে বুলডোজার। দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া বিজেপি শাসিত নর্থ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ও শাহ'র দিল্লি পুলিশের এই উচ্ছেদ অভিযানকে 'বিজেপির বুলডোজার রাজনীতি' বলে তোপ দেগেছেন এবং আপ বিধায়কদের রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষের পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। পুর নিগমের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অবৈধ নির্মাণ হঠাতেই উচ্ছেদ অভিযান। তা নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। গত শুক্রবার এই উচ্ছেদ অভিযান নিয়েই বিজেপির বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ আনল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি।  আপের অভিযোগ, শহরের বাসিন্দাদের থেকে ঘুষের টাকা চেয়েছিল বিজেপি কাউন্সিলররা, তারপরই দলের সভাপতি পুর নিগমগুলোকে বুলডোজার নিয়ে অবৈধ নির্মাণ উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। টুইটে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন, 'গোটা দিল্লি থেকে এই ধরনের অভিযোগ আসছে। দিল্লির মানুষ এই ধরনের তোলাবাজি ও গুণ্ডাগিরি বরদাস্ত করবে না। এই কারণেই কি পুর নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে?'

এ নিয়ে আরও কথা বলার আগে 'বুলডোজার রাজনীতি' নিয়ে কিছু কথা বলি। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তথাকথিত সমাজবিরোধী দমনের নামে প্রথম বুলডোজার ব্যবহার করেন। উদ্দেশ্য মূলত, রাজ্যের মুসলমানদের শিক্ষা দেওয়া। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এই নীতি বিশেষ জনপ্রিয় হয়। যোগী আদিত্যনাথের নামকরণ হয় 'বুলডোজার বাবা'। সম্প্রতি রামনবমীতে সহিংসতার পর মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানও বুলডোজার ব্যবহার করেন।

গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীও বুলডোজার-নীতি আঁকড়ে ধরার কথা বলেছেন। এরপরই দিল্লির হিংসাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে আমরা বুলডোজার নামতে দেখলাম। হনুমান জয়ন্তীর শোভাযাত্রার নামে হিংসার ঘটনার পরে পরেই। রামনবমীর ধর্মীয় অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রা দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীর মসজিদের সামনে আসতেই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। সংঘর্ষের ঘটনায় বেশ কয়েকজন পুলিশকর্মী ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দারা আহত হয়েছিলেন। এই সংঘর্ষের রেশ কাটতে না কাটতেই চারদিনের মাথায় বুধবার বিজেপির দখলে থাকা নর্থ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের তরফে বুলডোজার দিয়ে এই এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। অতএব, বলাই বাহুল্য, এই বুলডোজার বা পে-লোডার কোনও কাঠামো ভাঙার যন্ত্র নয়, বিজেপির উৎপীড়নের হাতিয়ার। এটাই বুলডোজার রাজনীতি। সংখ্যালঘু পীড়নের রাজনীতি। 

জাহাঙ্গিরপুরীতে বুলডোজার অভিযানকে বেআইনি আখ্যা দিয়ে আইনজীবী দুষ্মন্ত দাভে বলেন, বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নামে আসলে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে টার্গেট করা হচ্ছে। বুলডোজারকে একটি রাষ্ট্র হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে আদালতে সওয়াল করেন তিনি। দুষ্মন্ত দাভে সুপ্রিম কোর্টে  আরও বলেন, শুধুমাত্র জাহাঙ্গিরপুরীই নয়, দেশের যে কোনও জায়গাতেই কোনওরকম হিংসাত্মক ঘটনার পর বুলডোজার ব্যবহার করে সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকে টার্গেট করা হচ্ছে। রাষ্ট্র এভাবে কাজ করতে পারে না বলে শীর্ষ আদালতে সওয়াল করেন তিনি।

একটা সময় এই বাংলায় স্লোগান ছিল: 'মানুষ যখনই চায় বস্ত্র ও খাদ্য/ সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য'। এখন দেখা যায়, যখনই দুয়ারে ভোট কড়া নাড়ে বিজেপি তখনই হিংসা নামিয়ে আনে। গেরুয়া শিবিরের এই রাজনীতিটা নতুন নয়। গত ৪০ বছর বিজেপির রাজনীতির হালহকিকত যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন ভোট এলেই বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে তৎপর হয়ে ওঠে। বাজপেয়ী-আদবানির জমানায়ও তাই। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার কলঙ্কিত ইতিহাসেরও তো আমরা সাক্ষী। এখনও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তাওয়ায় বিজেপি তাদের ভোটের রোটি সেঁকা আজও চালিয়ে যাচ্ছে। এখন বুলডোজার হয়েছে হরধনু। 

নরেন্দ্র মোদী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যতই উন্নয়নের কথা, ডিজিটাল ভারতের কথা বলুন না কেন, তিনিও মনে মনে জানেন, ভোটের জন্য দরকার সেই জয় শ্রীরাম। এটাকেই রাজনীতির কারবারিরা বলেন, ব্যাক-টু-বেসিক, বাবা গোড়ায় ফিরে এসো। অর্থাৎ, বিজেপি প্রযুক্তি, স্বনির্ভর, উন্নয়ন এমন সব যতই যা বলুক, ভোটের সময় গোড়ায় ফিরে আসে। সীমান্তের এপারে সংখ্যালঘু পীড়ন আর ওপারে 'পুলওয়ামা'। হিন্দু মনে সুড়সুড়ি। তাই তো দুষ্মন্ত দাভে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করতে গিযে বলেন, 'দিল্লিতে ৭৩১টি অবৈধ নির্মাণের কলোনি আছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ লোক বাস করেন, আর পুর নিগম বেছে নিল একটা কলোনি! যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তুমি নির্দিষ্টভাবে একটা সম্প্রদায়কে টার্গেট করেছ।' আদালতকে দাভে বলেন, 'পুলিশ ও পুর প্রশাসন সংবিধান দ্বারা চালিত হতে দায়বদ্ধ, বিজেপি নেতাদের কথায় চলতে নয়।' দাভে তো আইনের কথা বলছেন কিন্তু বুলডোজার রাজনীতি চলে নিজের তরিকা মেনে। মানে না সে আদালতের নির্দেশও। তাই তো বিধ্বস্ত জাহাঙ্গিরপুরীকে দিল্লি পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে মুড়ে রেখেছে, সেখানে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। সেখানকার বীভৎসা যাতে বাইরের পৃথিবীতে পৌঁছতে না পারে। 

রমজান মাসে এই ঘটনায় আবারও এক সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক মেরুকরণ আমরা দেখতে পেলাম। রাজনৈতিক দলগুলোর চাপানউতোর শুরু হয়ে গেছে। ঘটনার জন্য কে দায়ী কে দায়ী নয়, সে সব গবেষণা চলছে। দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে কেস-ডায়েরি হিসেব কষেই তৈরি করা হবে। তবে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার যে, জাহাঙ্গিরপুরীর ঘটনার ফলে বিজেপির রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার প্রচেষ্টা কিন্তু এখন ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা। দিল্লির সাতটি লোকসভা আসন বিজেপির দখলে থাকলেও সরকার হাতে নেই। পঞ্জাব বিধানসভা ভোটে বিপুল জয় পাওয়ার ফলে কেজরিওয়াল এখন অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। তিনি তাঁর ওয়েলফেয়ার ইমেজ দিয়ে দিল্লির মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজধানী শহরে তিন-তিনটে পুর নিগম কব্জায় আনতে চান। নির্বাচন আসন্ন। এই তিনটে নিগমেই কিন্তু ক্ষমতাশীল বিজেপিকে পাঙ্গা নিতে হবে আপের সঙ্গে। উলটোদিকে কেজরিওয়ালও মরিয়া, তাঁর সরকার ব্যাপক জনকল্যাণমুখি কর্মসূচি নিয়েছে। বিদ্যুতের দাম থেকে শুরু করে অবৈতনিক স্কুল চালু করা এবং জলের কর না নেওয়া- এই সবই কিন্তু কেজরিওয়ালের বিশেষ ওয়েলফেয়ার-ইমেজ। তার সুফল কেজরিওয়াল হাতেনাতে পেয়েছেন। এখন পুর নিগমের ভোটেও সেই তাসই খেলতে চাইছে আপ। বিজেপির হাতে তাই সেই পুরনো তাস। নাগপুরের তাস: সহিংসতা জারি রাখো, ভোট ঘরে তোলো। 

সামনে ২০২৪। লোকসভা ভোট। বিরোধীদের দমনে দেশের সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা পদক্ষেপ নেয়। কখনও মামলা দিয়ে বিরোধীদের চাপে রাখার উদ্যোগ নেয়, বিরোধী নেতাদের পিছনে এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়া হয়, কখনও বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নামানো হয় বিরোধীদের কণ্ঠরোধে। এবার বিজেপি নিয়েছে নতুন পন্থা: বুলডোজার পন্থা।


Monday, 25 April 2022

মৌলবাদের রকমফের

প্রশ্ন হল মোকাবিলার

মালবিকা মিত্র

 

তিনি ছিলেন একজন জোনাল কমিটি সম্পাদক ও পার্টির জেলা কমিটির সদস্য। দুর্গাপুজোয় পার্টির বুক স্টলে ক্যাসেটে বাজছিল কাজী সব্যসাচীর কন্ঠে আবৃত্তি 'ওই কালো রঙের মানুষ'। কালো মানুষের শ্রমে গড়ে ওঠা মার্কিনী বৈভব। বিনিময়ে সে পায় বঞ্চনা ও পীড়ন। তারপরেই সেই করুণ আর্তি - 

'আহা, আমাকে একবার অন্তত ওই তালগাছটায় উঠতে দাও, 

যে তালগাছ থেকে সুমিষ্ট রস চুঁইয়ে পড়ে। 

তালগাছে বসে আমি মদ খাবো মদ খাবো মদ খাবো 

আর মাতলামির মধ্যে ভুলে যাবো ভুলে যাবো ভুলে যাবো, 

আমি একজন কালো রঙের মানুষ।'

কালো মানুষ তার যন্ত্রণার উপশম খুঁজছে আকন্ঠ নেশা ও ভুলে যাবার মধ্যে। এছাড়া সে আর কীই বা করতে পারে! কিন্তু ওই নেতাটি এইখানে এসে মুখ খুললেন, 'এহ্ হে। দিসে কবিতাটার... মাইরা, শেষটায় আইয়া মাইরা দিসে।'

আগেই বলেছি, বক্তা এলিতেলি কেউ নয়। পার্টি নেতা ছাড়াও তার অন্য পরিচয়- একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের রসায়ন শিক্ষক। কবিতার ছন্দ, বিষয়বস্তু আমার পছন্দ না হতেই পারে। আমার বোধগম্য নয়, এমনও হতে পারে। কিন্তু নাকচ করার কায়দা-ধরনটা দেখুন কত উদ্ধত: 'মাইরা দিসে'। এই ঔদ্ধত্য থেকেই এরা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত' কবিতাকে সংশোধনবাদ তকমা লাগিয়ে দেয়। কবিতার মেজাজটা না বুঝেই জবাবী কবিতা লেখেন বিখ্যাত বামপন্থী কবি 'ফুল ফুটুক তবেই বসন্ত'। কবি হিসেবে তিনি যত বড়ই হোন না কেন, রাজনৈতিক চেতনায় তিনি ওই পার্টি সম্পাদকের সমকক্ষ। 'ও আলোর পথযাত্রী' সলিল চৌধুরীর সাড়া জাগানো গানকে কাঠগড়ায় তোলে এই চেতনা।

অথচ মার্কস নিজেই যোশেফ ওয়াইড মেয়ার'কে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, একজন মানুষের অসংখ্য আত্মপরিচয় থাকতে পারে। শ্রেণি সংগ্রাম সুতীব্র পর্যায়ে অবস্থান করলে তখন শ্রেণি পরিচয় প্রাধান্য পায়। হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-বিহারী, বাঙাল-ঘটি, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, ভারত-পাকিস্তান এসব পরিচয় অনস্বীকার্য। ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে বসে আমার শ্রেণি পরিচয় বা জাতীয় পরিচয় ভুলে যাই। আবার ইন্টার-ক্লাশ ফুটবল খেলার সময়ে আমার পরিচয় আমি নাইন (বি) অথবা এইট (এ), তখন আমি শ্রমিক শ্রেণির না, ইস্টবেঙ্গল না, হিন্দু না, ভারতীয় না। এটা মার্কস আগেই বলেছেন, কিন্তু আমরা রাজার চেয়েও রাজকীয়, মার্কসের চেয়েও মার্কসবাদী। 

মার্কসবাদকে ডগমা করে বাকি সব কিছু তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি। মনে আছে, রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হলেন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর। সংবাদ মাধ্যমে জ্যোতি বসুর প্রতিক্রিয়া, 'ও তো পাইলট, প্লেন চালায় শুনেছি, দেশ চালাতে পারবে?' আমার মনে হয় এও এক প্রকার মৌলবাদ, গোঁড়ামি মতান্ধতা। অন্য সকল মত পথ ও ব্যক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। কোনও মতের প্রতি অন্ধ আসক্তি থেকে এই মনোভাবের জন্ম। 

কথার পৃষ্ঠে কথা এসে যায় আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার পরোয়া না করেই। এই রকম তাচ্ছিল্যের ভাব দেখেছি আমাদের 'এক্সট্রা 2ab' তত্ত্বের স্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির কথাবার্তায়। 'আমি হার্ভার্ডে বিশ্বাসী নই, হার্ড ওয়ার্কে বিশ্বাসী'- স্পষ্ট বোঝা যায় মন্তব্যের লক্ষ্য সমালোচক অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক প্রমুখেরা। যে ভাবে, যে ভাষায় তাচ্ছিল্যের সাথে 'রাহুল বাবা' বলেন, 'দিদি ও দিদি' সম্বোধন করেন, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় তার জ্ঞানবুদ্ধির দৌড়। বৌদ্ধিক ক্ষমতা বলতে আছে ধূর্ততা। সেই ধূর্ত পণ্ডিতকে মনে আছে তো? জনসমক্ষে মহাপণ্ডিতকে হেয় করার জন্য প্রশ্ন করেছিল, 'বলুন তো 'আই ডোন্ট নো' কথার মানে কী?' নির্বোধ ভেড়ার পাল স্পষ্ট উত্তর শুনেছিল, 'আমি জানি না'। নিজের কানে শোনা। মহাপণ্ডিতকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে গ্রামবাসী গ্রাম ছাড়া করে। ধূর্ত পণ্ডিত সংসদে একাই তিনশো তিন (৩০৩)। 

রাজনীতির ভাষায় এটাকে বলা হয় ডিমাগগিক লাইইং। বাকচাতুর্যের সাহায্যে তিল মাত্র সত্যকে ভুরিভুরি মিথ্যার সাথে পরিবেশন করা। গোবর গ্যাস একটি সত্য। এই সত্য ধারণাকে ব্যবহার করে নর্দমার পচা দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস থেকে জ্বালানি গ্যাসের কাহিনীর অবতারণা। সেটাও আবার এতই মামুলি পদ্ধতিতে, ভাবা যায় না। একটা বড় ডাব্বা ফুটো করে নর্দমার মধ্যে উপুড় করে দেওয়া হল। ফুটো থেকে পাইপ লাগিয়ে বার্নারে জুড়ে দেওয়া হল। বিনা খরচে জ্বালানি। ইন্টারনেট যুগের আগেই তিনি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারতেন। প্লাস্টিক সার্জারি বৈদিক যুগের জ্ঞান। তা না হলে গণেশের মাথা কীভাবে ট্রান্সপ্ল্যান্ট হল! মিশর, গ্রিস, মেসোপটেমিয়া সর্বত্র দেবদেবীর মূর্তিতে অনেক জীবজন্তুর মাথা বা ধরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। প্রাচীন ধর্মের সাথে প্রকৃতির অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক- এসব তো জ্ঞান ও বোধের বিষয়। প্লাস্টিক সার্জারি বললে আপন ধর্মের গরিমা ঘোষণা করা যায়। তিনি নাকি কুমীর ধরে পুষেছিলেন। এভাবে মানুষের অজ্ঞতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, সামান্য চা'ওয়ালার উত্থান কাহিনী শুনিয়ে প্রান্তিক মানুষকে আত্মগর্বী করে তোলার চেষ্টা। যে আত্মগর্ব পেটের আগুনকে ভুলিয়ে দিতে পারে। একটা আত্মতৃপ্তি লাভ। 

স্বামী বিবেকানন্দ সংঘ পরিবারে সমাদৃত। স্বামীজী হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সোচ্চারে ঘোষণা করেন। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের চোখে হিন্দু ধর্ম হল বহুস্বর, বহুত্ববাদ, বহুমাত্রিকতা। এগুলিকে হিন্দু ধর্ম স্বীকার করে- সবাইকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা স্বামীজীর হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য। কপিল মুনি, চার্বাক, ত্যাগবাদী, ভোগবাদী, ঈশ্বরবাদী, নিরীশ্বরবাদী, একেশ্বরবাদী, বহুত্ববাদী, মূর্তি, বিমূর্ত সব ধারণাকে ধারণ করে আছে ভারতের সনাতনী ধর্ম। এটা এই উপমহাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য। এই ধর্মের নাম বৈদিক, অবৈদিক বৌদ্ধ জৈন অজিবিক, বৈষ্ণব, শাক্ত সকল মত। একটা সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণ, সিন্থেসিস, ভারতীয় ধর্মের আত্মা। 

সংঘ পরিবার স্বামীজীর এই বহুমাত্রিক হিন্দু ধর্মকে জনসমক্ষে তুলে ধরে না। বরং সনাতন হিন্দু ধর্মের কূপমণ্ডুকতা, গোঁড়ামি, অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কারকে স্বামীজীর সিলমোহর লাগিয়ে প্রচার করে। আশ্চর্যের বিষয় হল, স্বামীজী হিন্দু উচ্চবর্ণের মাতব্বরিকে 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' বলে বিদ্রুপ করেছিলেন। ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের জাতবর্ণ ভেদকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন ও শূদ্র জাগরণের সম্ভাবনাকে আবাহন করেন। এমনকি নব্য যৌবনকে ধ্যান না করে ফুটবল খেলার পরামর্শ দেন। এও বলেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। বিপরীতে, অভুক্ত নিরন্ন কর্মহীন চাষি মজুরের সামনে সংঘ পরিবার রাম মন্দিরের স্বপ্ন প্রচার করে। নিষিদ্ধ গো মাংস, হিজাব আর হালাল আজ প্রধান আলোচ্য বিষয়। 

অপরদিকে দেখুন, ফয়েরবাখের বস্তুবাদ ও হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্বের সার্থক সংশ্লেষণ মার্কসবাদের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। যেখানে বস্তু জগৎ নিরন্তর পরিবর্তনশীল, একই সাথে চেতনার জগৎ'ও পরিবর্তনশীল। চেতনা আসমান থেকে আসে না, বস্তুর মাধ্যমে আসে। আবার সেই চেতনা বস্তুর পরিবর্তন ঘটায়। প্রকৃতি জগতে মানুষ দেখেছে পাথরকে গড়িয়ে পড়তে আবার বহু পাথরকে গড়িয়ে না পড়তে। বস্তুর সমতলের সংখ্যা যত কম হবে, ছয়-পাঁচ-চার, বস্তুর গড়িয়ে যাবার প্রবণতা ততই কম হবে। বারো-চোদ্দো তল বিশিষ্ট বস্তু প্রায় গোলাকার আকৃতি নেয়। তুলনায় অনেক সহজেই গড়ায়। আবার বক্রতল বিশিষ্ট বস্তু সবচেয়ে সহজে গড়ায়। একদিকে সরাসরি বস্তু জগৎ ও প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ, ফলে চেতনার জগতে পরিবর্তন। আবার পরিবর্তিত চেতনায় প্রকৃতি জগতের পরিবর্তন। এভাবেই জ্ঞানের জগৎ ও প্রকৃতি জগতের মধ্যে অবিরাম নিরন্তর দ্বন্দ্ব ক্রিয়া চলতেই থাকে- বস্তু জগৎ থেকে চেতনার জগৎ, আবার আমারই চেতনায় জগৎকে নতুনভাবে নির্মাণ, আবার পরিবর্তিত জগৎ চেতনার পরিবর্তন ঘটায়। জগৎ ও চেতনা দুইই অস্থায়ী। পরিবর্তন একমাত্র স্থায়ী। আর মূর্খ মার্কসবাদী বলে কিনা মার্কসবাদ একমাত্র সত্য! সত্যই যেখানে পরিবর্তনশীল। রাজার চেয়েও রাজকীয় একেই বলে। 

আমরা গোঁয়াড়ের মতো একবগ্গা আচরণ করলে সমস্যা জটিলতর হবেই। এক পক্ষের অর্ধ সত্য মোকাবিলা করতে একই পন্থা দিশা দেখাতে পারবে না, সফল হবে না। সংঘ পরিবার রামায়ণ মহাভারত পুরাণ বেদ স্মৃতি হিন্দুত্ব ইসলাম-বিরোধিতা পাকিস্তান-বিরোধিতা কপট-দেশপ্রেম এই সরণিতে স্বচ্ছন্দ বিচরণে সক্ষম। হিন্দি বলয়ে সাধারণ বোধ্য, সর্বজনগ্রাহ্য তুলসীদাসের রামায়ণকে তুলে ধরে সংঘ পরিবার। মহাকাব্যের ভিন্ন ভিন্ন পাঠ থাকে। আমরা একটি ভিন্ন পাঠকে উপস্থাপন করে বলতেই পারি, রামায়ণ সীতার প্রতি সুবিচার করেনি, শম্বুকের প্রতি অন্যায় অপরাধ করেছে। কিন্তু এই পিচে খেলার ক্ষেত্রে সংঘ সদস্যরা এক্সপার্ট। ভিন্ন পাঠের পাণ্ডিত্য এলিটের মান্যতা পেলেও সর্বজনগ্রাহ্য হবে না। 

আমরা যখন যুক্তি সাজাই 'মহাকাব্যের যুগে বহু বিবাহ স্বীকৃত ছিল' তখন নিজের অজান্তেই সংঘের খেলার ছকেই ঢুকে পড়ি। আধুনিক যুগের সত্যকে প্রাচীন যুগের সত্যকে অবলম্বন করে দাঁড় করাই। 'স্বয়ম্বরসভাগুলি প্রমাণ করে পতি নির্বাচনে নারীদের স্বাধীনতা ছিল'- এটা বলার মধ্য দিয়ে আমি ধর্মের ভুলভুলাইয়াতে আটকে গিয়ে পথ হারাই। ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের বিকল্প আত্মপরিচয় গড়তেই পারি না। আমি তো বলতে পারতাম- সত্যযুগ ত্রেতাযুগ বিগত। যা চলে গেছে তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। ঠাকুরদার আমলের বাড়িটাও তো নাতি-নাতনীদের আমলে আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। তাদের আমলের আসবাবপত্র পাল্টে যায়, ফিরে আসে না। বিজলি বাতি, রেলওয়ে, উড়োজাহাজ আর মোবাইল, মিসাইলের যুগে রামরাজ্য ফেরানো সম্ভব নয়। ফি বছর লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার প্রতিরক্ষা বাজেট আর মহাকাশ গবেষণার কী দরকার, সবই যখন বেদে আছে। মন্দির ফিরিয়ে আনার আগে মন্ত্রী-সান্ত্রীদের আধুনিক বিধর্মী জীবনযাপন ত্যাগ করতে হবে। পর্ণকুটিরের আশ্রমের জীবনে ফিরে চলো। তার বেলা ছয় হাজার কোটি টাকার বিলাসবহুল উড়োজাহাজ! আশ্রম তপোবন যদি না ফিরে আসে তবে বৃথাই রাম মন্দির ফেরানো। 

এ কথাও বলতে পারিনি, শ্রমিক কৃষক ইত্যাদি শ্রেণি পরিচয়গুলিও আমার পরিচয়। হতেই পারে তুমি হিন্দু আমি মুসলিম, কিন্তু তোমার আমার সাধারণ পরিচয় আমরা শ্রমিক, আমরা কৃষক। কারণ, মার্কস আগেই বলেছেন, শ্রেণি সংগ্রাম যখন তীব্র রূপ ধারণ করে তখন শ্রেণি পরিচয় প্রধান সত্য হিসেবে হাজির হয়। সেই কাজেও আমি ব্যর্থ। ভাবা যায়, ২০১৪'র লোকসভা নির্বাচনে ইউপিএ জোট হারের আশঙ্কায় তড়িঘড়ি কাসভ ও আফজল গুরুর ফাঁসি কার্যকর করে। নরেন্দ্র মোদির ক্রমাগত 'মৌনমোহন সরকার', 'কাঠপুতলি সরকার' ইত্যাদি আক্রমণের সামনে কংগ্রেস চাল দেয় পাকিস্তান বিরোধিতার। এই চাল ও ছকে মোদি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। অতএব, ২০১৪'এ ইউপিএ জোট গোহারা হল অনিবার্য ভাবেই। 

স্টান্স নেব কীভাবে সেটা বোঝা খুব জরুরি। এমন ভাবে হবে, যেন যে কোনও শট নেওয়া যায়। নিজস্ব ঢঙে স্টেপ আউট করে সামনের পায়ে ভর দিয়ে 'বাপি বাড়ি যা' শট নেব, নাকি বুঝে শুনে ব্যাকফুটে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে শরীরটা বলের লাইনে নিয়ে গিয়ে মোচড় দিয়ে 'হুক শট' অথবা বল ব্যাটে আসার পর ওখানেই স্থিতু। শট নির্বাচন বড্ড জরুরি শর্ত।


Friday, 15 April 2022

দলসমাজের পাঁকে নিমজ্জিত বাংলা

হরে কৃষ্ণ হরে হরে

তৃণমূল ঘরে ঘরে

সোমনাথ গুহ

 


আজ ২০২২'এ এসে আক্ষরিক অর্থেই শিরোনাম-শ্লোগানটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন সর্বত্র তৃণমূল। সামনে-পিছনে, ডাইনে-বায়ে, ওপরে-নীচে, ঘরে-বাইরে, পথেঘাটে, মাঠে-ময়দানে, অফিস-কাছারিতে, পাড়া-বেপাড়ায়, স্কুল-কলেজে, ফ্ল্যাটবাড়ি-বসতবাড়িতে, সিনেমা-নাটকে, পুলিশ-প্রশাসনে, পুরসভা-পঞ্চায়েতে, বুদ্ধিজীবী-মিথ্যেজীবী সর্বত্র তৃণমূল। প্রায় সবাই তৃণমূল। পরিচিত-অপরিচিত, আগন্তুক-প্রতিবেশী, শত্রুমিত্র, কেউ বাদ নেই। পরিবারের মধ্যেও তাই, যেমনটা মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন: কাকা-কাকি, জ্যাঠা-জ্যাঠি, নানা-নানি, ভাইবোন, বাবা-মা, দাদু-দিদিমা, খালা-খালি, সবাই ঘাসফুল। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। ২০২১'এর নির্বাচনে টিএমসি বিজেপির থেকে ৬০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছে। সিপিএমের প্রাপ্য ভোট যদি যোগ করা হয়, তাহলে, তৃণমূলের ভোট মাত্র ৩০ লাখ বেশি। তাহলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এই বিরোধী ২ কোটি ৬০ লক্ষ লোক কি গায়েব হয়ে গেল! ভ্যানিশ! 

আসলে ভয়! রুটিরুজি চলে যাওয়ার ভয়; পাড়া, মহল্লায় একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়; ধোপা-নাপিত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়; এরপরেও বেশি বাড়াবাড়ি করলে, অর্থাৎ শাসক দলের বিরোধিতা করলে বাড়ির বৌ-মেয়ের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি, তাঁদের এবং নিজের জীবনের ভয়। এই ভয়ে বিপুল সংখ্যক বিরোধী মানুষ হয় শাসক দলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন নয়তো সামাজিক জীবন থেকে নিজেকে পুরো বিযুক্ত করে ব্যক্তি জীবনে সিঁটিয়ে গেছেন। ১৯৩৩ সালে হিটলার যখন সাড়া জাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তখনও কম্যুনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীরা মিলে ১১৮৪৫০০০ ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা নাৎসি রাজনীতির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। কারণ, ভয়! এটা অবশ্যই বলতে চাইছি না যে তৃণমূলীরা নাৎসিদের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু ভয় মানুষকে কীরকম জড়ভরত করে দেয় এটা তার একটা দৃষ্টান্ত। এটা তখনই হয় যখন পুরো সমাজটাই একটা দল হয়ে যায়। যাঁরা বিরোধী, ব্যাতিক্রমী, তাঁরা পাশের মানুষটাকেও ভয় করতে শুরু করেন। আশেপাশে যেদিকে তাকান, দেখেন সব ঘাসফুল, সব ঘাসফুল! ফ্রান্সের সর্বশক্তিমান সম্রাটের মতো নেত্রীও তখন বলতেই পারেন- আমিই পার্টি, পার্টিই সমাজ। 

ক্ষমতা কতটা ভয়ঙ্কর সেটা বোঝাতে 'দল' শব্দটা ঠিক চলে না। 'পার্টি' বলতে হবে। পার্টির লোক দেখলেই শরীর দিয়ে হিমস্রোত বয়ে যাবে। পার্টি বলেছে, অর্থাৎ স্বয়ং ঈশ্বর বললেও তার নড়চড় হবে না। পশ্চিমবাংলার সমাজ পার্টি সমাজ। ধর্ম নয়, জাতপাত নয় এখানে সমাজে নির্ধারক শক্তি, চালিকা শক্তি হচ্ছে পার্টি। অনেকে বলবেন, সেই ধান ভানতে শিবের গীত; কিন্তু পার্টি এবং সিপিএম যে সমার্থক এই ধারণাটা বাম আমলেই শুরু এবং এই শব্দটাকে হেলাফেলা করলে কিংবা পার্টিকে গুরুত্ব না দিলে কপালে যে দুঃখ আছে সেটা ঐ আমলেই সমাজের গভীরে প্রোথিত হয়ে যায়। ক্ষমতার যে আজ সর্বস্তরে, সর্বব্যাপী বিস্তার আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তারও শুরুওয়াত ঐ আমল থেকেই। 

সোভিয়েত ইউনিয়নে বলা হত, পাঁচটা লোক এক জায়গায় জড়ো হলে তাঁদের মধ্যে একজন অবশ্যম্ভাবী এনকেভিডির চর। বাম আমলেও বৃহত্তর বন্ধু বৃত্তের মধ্যে একজন ছিল যে মাঝে মধ্যে এসে উদয় হত, দেঁতো হেসে কুশল জিজ্ঞাসা করত। ‘বহুদিন দেখি না’ বলে পিরিত দেখাত। আশেপাশের সব বাড়ি তো তখন সিপিএম, তাঁদের রান্নাঘরে পর্যন্ত ক্যাডারদের অবাধ যাতায়াত। সেই প্রতিবেশীরাই খবর দিত অমুক বাড়িতে নতুন কেউ এসেছে কিনা! তখন তো সিসিটিভি'ও ছিল না, পেগাসাসও ভবিষ্যতের গহ্বরে। তাই সমর্থকদের মধ্যে নিঁখুত নেটওয়ার্ক গড়ে এই নজরদারি চালানো হত। আর চারিদিকে তো তখন তাঁদেরই সমর্থক, সবাই সিপিএম। 

সুতরাং ক্ষমতা ও পার্টির এই সর্বব্যাপী প্রসার এটা আগেও ছিল। কিন্তু এই আমলে এসে তা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। কলকাতায় মধ্যবিত্ত এলাকায় তৃণমূলের নজরদারি করার সেরকম প্রয়োজন নেই, কারণ এখানে টাকাপয়সার গল্প তুলনামূলক ভাবে কম। কিন্তু গ্রামবাংলায় পার্টির দাপট অভুতপূর্ব এক হিংস্র রূপ নিয়েছে। বাম আমলের হিংসাত্মক রাজনীতির সাথে এই আমলের পার্থক্য আছে। তখন নানুর থেকে নেতাই এবং নন্দীগ্রাম- সবকটি হত্যাকাণ্ড ছিল হয় কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে, নয় শাসকের ওপর বিক্ষুব্ধ জনতার বিরুদ্ধে। তারও আগে যদি যাই, অর্থাৎ মরিচঝাঁপি, বানতলা বা আনন্দমার্গী নিধন- কোনওটাই কিন্তু সিপিএমের আভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে ঘটেনি। তা বলে কি সিপিএমে কোনও দলাদলি ছিল না। বিলক্ষণ ছিল, কিন্তু প্রকাশ্যে এলেও পারস্পরিক হানাহানি কদাচিৎ হত। সিপিএম শহরে ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে সবাইকে চুপ করিয়ে রাখত। গ্রামাঞ্চলে কলাটা মূলোটা দিয়ে বিরোধীদের বশে রাখত, বেগড়বাই করলে আক্রমণ করত। 

তৃণমূলের বিরুদ্ধে তো বলার মতো কোনও বিরোধী শক্তিই নেই। পঞ্চায়েত ও পুরসভাতে লাগামছাড়া সন্ত্রাস করে তারা তো রাজ্যটাকে বিরোধী-শূন্য করে দিয়েছে। তাহলে কেন এত হিংসা, প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, খুন? যখন পার্টির বাইরে কোনও বিরোধী থাকে না, তখন পার্টির ভিতরে বিরোধী তৈরি হয়। পুরো সমাজটাই যখন দলের করায়ত্ত হয়ে যায়, তখন নিজেদের মধ্যে শুরু হয় হানাহানি। এখন প্রচুর সরকারি প্রকল্প, প্রতিটি পঞ্চায়েতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এছাড়া বালি, কয়লা, গরু পাচার, অবৈধ খনন, নির্মাণের কাঁচা টাকা তো আছেই। এর জন্য শাসক দল একটি পঞ্চায়েত বা পুরসভাও হাতছাড়া করতে রাজি নয়, তাতে রক্তগঙ্গা বয়ে গেলে যাক। একমাত্র ঝালদার ঘটনা বাদ দিলে, আনিশ খানের হত্যা থেকে শুরু করে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হেনস্থা করা, বেহালায় দু' দিন ধরে বোমাবাজি- প্রতিটি ক্ষেত্রে তৃণমূলিরা জড়িত। তৃণমূলের বিরুদ্ধে তৃণমূল- যারা মরছে তারাও তৃণমূল, যারা মারছে তারাও তৃণমূল। 

বাম আমলের থেকে আরেকটা পার্থক্য হল- তখন সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষাগুলো হত (পিএসসি, এসএসসি)। নিজেদের লোক কি ঢুকত না, আলবত ঢুকত। এরা এসে তো পিএসসি তুলেই দিল; এসএসসি'তে এত কারচুপি যে পরীক্ষার্থীদের রোদ, বৃষ্টি, শীত উপেক্ষা করে মাসের পর মাস সঠিক ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। পুলিশ সম্পর্কে দলদাস কথাটা বহুকাল ধরেই ব্যবহৃত হয়। দশ বছর আগেও দময়ন্তি সেনের মতো মেরুদণ্ডসম্পন্ন অফিসাররা ছিলেন, এখন তাও নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের তাঁবেদার হয়ে গেছে। মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশনের অস্তিত্ব আদৌ আছে কি? একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, কোথাও তো এঁদের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অনমনীয় ভূমিকা পালন করছেন এবং তার জন্য তাঁকে যে ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে তা অভুতপূর্ব। এইসব ঘটনা সম্পর্কে যে সব নিকৃষ্ট, অসংবেদনশীল মন্তব্য করা হয়েছে তাও অভুতপূর্ব। 

কেউ কেউ বলেন, দলটার মধ্যে একটা মন্থন চলছে। পুর নির্বাচনের আগে ‘এক নেতা এক পদে’র দাবি, পার্টির ওয়েবসাইটে নেতৃত্বের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও বিকল্প প্রার্থী তালিকা দীর্ঘদিন থেকে যাওয়া- এর থেকে হালকা একটা আভাস পাওয়া গিয়েছিল। এরপরে অতীতের পুর নির্বাচনে গা-জোয়ারির বিরুদ্ধে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌগত রায় আওয়াজ তুলেছিলেন। হাঁসখালির ঘটনা কেন ধর্ষণ তা সম্পর্কে একটা আইনি ব্যাখ্যা মহুয়া মৈত্র মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছেন। সৌগত রায় তো বলেই ফেলেছেন যে একজন মহিলা যেখানে মুখ্যমন্ত্রী সেখানে একজন নারীরও নিগৃহীত হওয়া উচিত নয়। সর্বোপরি কুণাল ঘোষ, যাঁর নিজের মাথার ওপরে খাঁড়া ঝুলছে, তিনি পর্যন্ত হেভিওয়েট মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কামান দাগছেন। এসব কীসের ইঙ্গিত? ভবিষ্যৎ বলবে।

আপাতত এই দলসমাজের নাগপাশ থেকে পশ্চিমবাংলার মুক্তি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। 


Wednesday, 13 April 2022

ভারত কেন শ্রীলঙ্কা হবে না

তিলে তিলে আত্মহননই যখন পথ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

শ্রীলঙ্কায় তুমুল অর্থনৈতিক সংকট ও ব্যাপক গণবিক্ষোভের প্রেক্ষিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, আমাদের দেশেও কি এমনতর সংকট আসন্ন? কারণ, গত কয়েক দিনে পেট্রোল, ডিজেল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যে ভাবে উর্ধ্বগামী হয়ে চলেছে, তাতে এক প্রবল অর্থনৈতিক বিপন্নতার সম্ভাবনা যে একেবারে অমূলক তা বলা যাচ্ছে না। উপরন্তু, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারেও টান পড়েছে (এ বছরের এপ্রিলের গোড়ায় তা ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমে গিয়ে ৫৪০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে)। সাধারণ মানুষের গড় আয় পড়তির দিকে, ছোট ব্যবসা ও লেনদেন তীব্র সংকটে। এই মার্চে মূল্যবৃদ্ধির হার গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ (৬.৯৫ শতাংশ)- যেখানে আনাজপাতির মূল্যের উর্ধ্বগতির হার ১১.৬৪ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে, আমরা এক সর্বগ্রাসী সংকটের মুখে। তদুপরি, শিল্প বৃদ্ধির হারও তলানিতে এসে ঠেকেছে (এই ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ১.৭ শতাংশ)।

তবুও, এখুনি ভারতবর্ষের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো একেবারে হুড়ুমুড় করে রাস্তায় নেমে পড়ছে না, দেশ জুড়ে এক উত্তাল গণরোষের সম্ভাবনাও তেমন ভাবে প্রকট নয়। কিন্তু অন্য অর্থে ও ব্যঞ্জনায় তা যে দিনে দিনে আরও ভয়ানক ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর নির্দিষ্ট কারণসমূহ আমাদের দেশের কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈততা ও মিশ্র অর্থনীতির আবহের মধ্যেই অন্তঃস্থ। 

দেশে একটি শক্তিশালী ও আধিপত্যকামী কেন্দ্রীয় সরকার বিরাজমান থাকলেও, খাতায়-কলমে ও সংবিধানে আমরা নিজেদের ‘Union of States’ বলে বর্ণিত করেছি। সেই অর্থে, এখনও কিছু আপেক্ষিক ক্ষমতা রাজ্য সরকারগুলির হাতে ন্যস্ত আছে। উপরন্তু, বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রে যেহেতু নানা ধরনের পরস্পর বিরোধী দল ও সরকার ক্ষমতায় আসীন, তাই সবটা মিলিয়ে এমন এক অর্থনৈতিক বাতাবরণের চল হয়েছে যেখানে আক্রমণের বর্শামুখটা কোনদিকে থাকবে তা নিয়ে সাধারণ্যের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বেরও যথেষ্ট অবকাশ থেকে গেছে। তাই দেখা যায়, পেট্রোপণ্যের বর্ধিত মূল্যের দিকে যখন কেন্দ্র বিরোধী দলগুলি সরব হয়, তখন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বলে, রাজ্যগুলি নিজ নিজ রাজ্যে তেলের ওপর আরোপিত কর কমিয়ে মূল্যহ্রাসে সহায়তা করুক। অথচ, কোনও দলই জিএসটি কাউন্সিলে তেলকে জিএসটি’র আওতায় নিয়ে আসার কথা উত্থাপন করতে চায় না; কারণ, সে ক্ষেত্রে তেলের ওপর সর্বোচ্চ কর ২৮ শতাংশের বেশি হবে না আর তাতে রাজ্য ও কেন্দ্র উভয়েরই কর থেকে আয় অনেকটা কমে যাবে, যদিচ সামগ্রিক ভাবে জনজীবনে মূল্যস্তর বেশ কিছুটা হ্রাস পাবে।

বলা যায়, এমনতর দ্বন্দ্বমূলক পরিস্থিতি বরং আখেরে ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে আপাত অর্থে ইতিবাচকই সাব্যস্ত হয়েছে। কারণ, ক্ষমতার পৃষ্ঠে লেপ্টে থাকার অভিলাষে রাজনৈতিক দলগুলি নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক প্রকল্প বাধ্যত অনুসরণ করার চেষ্টা করে যা দেশের অর্জিত সম্পদকে কিছুটা হলেও বিস্তৃত পরিধি জুড়ে বন্টিত হতে দেয়। তা পিএম কিষাণনিধি প্রকল্পই হোক কি কৃষক-বন্ধু প্রকল্প অথবা দুয়ারে রেশন কিংবা মহল্লা ক্লিনিক! এই অনুশীলন অবশ্যই দেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সরকারি এইসব উদ্যোগ অন্তত দুর্ভিক্ষ জাতীয় পরিস্থিতি থেকে একটা নড়বড়ে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে নিঃসন্দেহে।

কিন্তু এর অপর পিঠে ভিন্নতর একটি গল্প আছে। সে গল্প এক অন্য ধরনের বিপন্নতা ও অসহায়তার কথা বলে। তা নিমেষে দেশ ও দশকে নিঃস্ব করে দেয় না বটে, কিন্তু তিলে তিলে নিয়ে চলে এক ভয়ানক আত্মহননের পথে। সে এক বিচিত্র ও ভয়ঙ্কর অভিসার। আমাদের দেশ এমনই এক অভিনব ধ্বংসাত্মক অভিমুখে দাঁড়িয়ে; যে লয় অতি ধীর, প্রগাঢ়, নিষ্ঠুরতম ও মর্মস্পর্শী।

গত শতকের পঞ্চাশ থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগসমূহের প্রবল উপস্থিতি এমন এক স্থিতিশীল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজের জন্ম দিয়েছিল যেখানে উপার্জনের একটা স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হয়েছিল, যার ওপর ভিত্তি করে জনসমাজের কিছু অংশ এক আপেক্ষিক নিশ্চিতির মধ্যে জীবনযাপন অতিবাহিত করতে পেরেছিল। যদিও জনপরিসরের এক বড় অংশ ছিল এই আলোকবৃত্তের বাইরে ও তাদের দিনকাল ছিল অতীব দরিদ্র ও শতচ্ছিন্ন। ইন্টারনেট-বিপ্লব, তথ্যপ্রযুক্তির আগ্রাসী উত্থান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্দাম আগমনে এই রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র নির্ভর জনসমাজের আপাত নিশ্চিন্ত জীবনে ক্রমেই এক বড়সড় অভিঘাত নেমে এল। বহু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র বন্ধ হয়ে গেল অথবা বেচে দেওয়া হল, সরকারি চাকরির সংখ্যাগত প্রাবল্যও কমে এল, ভিআরএস নিয়ে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ স্থায়ী চাকরি থেকে বিদায় নিল এবং তারা অচিরেই ফুরিয়ে গেল। ফুরিয়ে গেল দুটি অর্থে: এক) সমাজ ও অর্থনীতিতে এদের যে প্রাবল্য ছিল (ট্রেড ইউনিয়নগত শক্তিতে, মাইনে বাড়িয়ে নেওয়ার ক্ষমতায় ও নিঃসন্দেহে সমাজ-রাজনীতির সক্রিয়তায়) তা একেবারে কমে গেল এবং দুই) যে সামাজিক ক্ষমতা ও মর্যাদা এদের করায়ত্ত ছিল, তাও গেল নিভে। যেমন, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে শেষ জীবন অবধি কাজ করে অবসরপ্রাপ্ত বড়বাবু কি কোনওদিনও ভাবতে পেরেছিলেন যে তাঁর ছেলে তেমন যুৎসই কাজ না পেয়ে একবিংশ শতকের প্রথম দশকে পৌঁছে শেষমেশ অটো চালাবে! অথচ, যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের সে সুদিন থাকত, তাহলে নিদেনপক্ষে ছেলেটির একটি পাকা চাকরি ও নিশ্চিত জীবন কি সেখানে বাঁধা ছিল না? এই অযাচিত স্খলন এক আচম্বিত বিপন্নতা। তারপর যখন ছেলেটি অটো না চালিয়ে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে সামান্য চাকরি নিল এবং হঠাৎ করে সে সংস্থা একদিন বন্ধ হয়ে গেল, তখন ফুরিয়ে আসা অসহায় পিতার ছোট্ট ফ্ল্যাট ভেঙে কি পুলিশ তাদের সকলের অর্ধপচা লাশ উদ্ধার করল?

খবরে প্রকাশ, প্রায় সর্বত্র খুনের থেকে আত্মহত্যার সংখ্যা এখন অনেক বেশি। আমাদের দেশে একমাত্র বিহার বাদে প্রায় সব রাজ্যেই খুনের থেকে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি বেশি করে ঘটে চলেছে। মানব সূচকে উন্নত রাজ্য কেরালায় একটি খুনের ঘটনার তুলনায় প্রায় ২৭টি আত্মহত্যার ঘটনা পাওয়া যাচ্ছে। হতে পারে, কেরালায় অপরাধ প্রবণতা কম, কিন্তু এতগুলি আত্মহত্যার ঘটনা কীসের ইঙ্গিত দেয়? আত্মহত্যাও তো এক ধরনের হত্যাই- নিজেকে হত্যা। তেলেঙ্গানা এবং তামিলনাড়ুতেও দেখছি, খুনের থেকে আত্মহত্যার ঘটনা ১০ গুনেরও বেশি। আর এই প্রবণতা এখন প্রায় সারা বিশ্ব জুড়েই (কিছুটা ব্যতিক্রম লাতিন আমেরিকার দেশগুলি, যেখানে সংগঠিত অপরাধের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে অধিক)। জাপানের মতো একটি উন্নত দেশে আত্মহত্যার ঘটনা খুনের ঘটনার থেকে প্রায় ৫৭ গুন বেশি। ভাবা যায়!

এখানেই তীব্র সংকটের মহাবীজ লুকিয়ে আছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির আবহে (যন্ত্র চালিত গিগ অর্থনীতির উত্থান) এবং সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক বাতাবরণে মানুষ হয়ে পড়ছে অসহায়, বিপন্ন, দরিদ্র ও ছিন্নমূল। তার তাৎক্ষণিক ক্ষুধার নিবারণ হয়তো রাষ্ট্র করছে, কিন্তু তার যে সার্বিক অধঃপতন- অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক- তা তাকে নিয়ে চলেছে এক অচিন্তনীয় অন্ধকারের করালগ্রাসে। তার সারা অঙ্গে এক মসৃণ শৃঙ্খলের জাল, যে জাল কেটে বেরতে গিয়ে সে আরও ঘোরতর ভাবে জড়িয়ে পড়ছে তার নাগপাশে। তার যাপনের প্রতিটি মুহুর্তে তাকে সজাগ থাকতে হচ্ছে জীবিকা-অর্জনের নানাবিধ পথ খুঁজে নিতে; যে কর্মে সে নিয়োজিত, সেখানেও তার প্রতিনিয়ত আসুরিক লড়াই নিজেকে প্রমাণ দেওয়ার, নয়তো ছিটকে পড়তে হবে বৃত্তের বাইরে। এটা শাসকেরা বুঝেছে- তাই অন্তত পেটে ভাত জুগিয়ে যদি প্রাণে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তবে সংকটের প্রকাশ দৃশ্যত অত তীব্র হয় না; কাজের জগতে যেমন তেমন চরে বেড়ানোও যায়! গিগ অর্থনীতির এই হল জমানা- এই কাজ আছে তো, আবার এই কাজ নেই!

শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী রাজাপক্ষের পারিবারিক গোয়ার্তুমি শাসন ও একচেটিয়া ভুলভাল অর্থনৈতিক নীতি দেশটাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমাদের দেশেও বিমুদ্রাকরণ ও আচম্বিত লকডাউন ঘোষণায় যে তুমুল সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল- যার প্রভাব এখনও বিরাজমান- তার প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশ জুড়ে পথে নেমে মানুষ যে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়নি তার কারণ, রাজ্যে রাজ্যে জনকল্যাণমূলক রাজনৈতিক-অর্থনীতির অনুশীলন ও প্রসার। কিন্তু এতে করে তো বিপন্নতা ও দারিদ্র্য ঘুচছে না। সেই অসহনীয় জ্বালা থেকে মুক্তি পেতেই কি তবে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত মানুষ সন্ধান করছে আত্মহননের পথ? কারণ, তার চোখে রাষ্ট্র বেপাত্তা, দুয়ারে খাদ্যসামগ্রী জুগিয়ে তার আপাত কাজ শেষ। এরপর যা কিছু অপ্রাপ্তি ও ‘ব্যর্থতা’, তার দায় ব্যক্তির নিজের- যুক্তি হল, আজকের গিগ অর্থনীতিতে কাজের যে অযূত লভ্যতা, সেখানে যদি সফল না হওয়া যায় তার দায় কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরই নয়? সকলেই তাই উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে! কে রইল, কে পড়ে গেল- তা দেখার সময় ও বাসনা কারও নেই। কারণ, তুমি পিছিয়ে পড়লে মানে তুমি হেরে গেলে। এ এক অবিশ্বাস্য ও ভয়ঙ্কর যুক্তিবদ্ধ সংকট।

এক সময় কর্মজীবী মানুষ ট্রেড ইউনিয়নে জোটবদ্ধ হয়ে আশা ও আদায়ের পথ পেয়েছিল। এখন নতুনতর রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিন্যাসে সেই ট্রেড ইউনিয়নের সম্ভাবনাও ক্রমেই সুদূরপরাহত। শত যুদ্ধ, হাজারও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন করেও যে মনুষ্য-সমাজকে সম্পূর্ণত নিয়ন্ত্রণাধীন করা যায়নি, তা কি অবশেষে আত্মহননের পথকে (পঙ্গপালের আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো) উন্মুক্ত করে যন্ত্রের অ্যালগরিদমেই সমাধা হবে? কারণ স্পষ্ট বার্তা হল, হয় অ্যালগরিদমের নিয়মে চলো, নয়তো ম’রো।