গুরু-শিষ্য সংবাদ
অরুণাভ ঘোষ
আড়াই হাত লম্বা সাদা দাড়ি নিয়ে গেরুয়া বসনে সন্ন্যাসী মোদিজি উচ্চাসনে বসে আছেন। নিচে পদতলে বসে ভক্তগণ মোদিজীর দিনের বাণী শোনার জন্য। তাদের মধ্যে থেকে মুহুর্মুহু উঠে আসছে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান।
দিনের বাণী শুরু করতে গিয়ে ভক্তগণের উদ্দেশ্যে মোদিজী বললেন,
'হে ভক্তগণ,
আপনাদের মধ্যে একটি অশুভ গুঞ্জন প্রায়ই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। তা হল, যুক্তির পথে নেতাদের, বিশেষ করে আমার, কার্যকলাপ বুঝতে গিয়ে আপনারা নাকি আজকাল খেই হারিয়ে ফেলছেন। তাই আপনাদের সামনে আজ রাজনীতি এবং ধর্মনীতির গোড়ার কথা একটু খুলে বলব যাতে আপনাদের যুক্তিবাদী মন আমাদের মুখ থেকে মাঝে মাঝে বিপরীত কথা শুনে বিভ্রান্ত না হয়ে পড়ে।
আপনাদের মধ্য থেকে প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায় যে আমি নাকি কথায় যা বলি বাস্তবে তার ঠিক বিপরীত কাজটাই করে থাকি। যেমন চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোলাকুলি করার কিছুদিন পরেই ওদের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত নিয়ে ঝামেলা বেঁধে গেল। পাকিস্তান আমাদের শত্রু দেশ বলে চিহ্নিত। অথচ আমি ওদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মেয়ের বিয়েতে বিনা আমন্ত্রণে চলে গিয়েছিলাম এবং জনসমক্ষে ঘনিষ্ঠ কোলাকুলি সেরে ফেলি। বেশ কিছুদিন আগে আমি ঘোষণা করেছিলাম যে রেল ছোটবেলা থেকে আমার জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই রেলওয়ে বিলগ্নিকরণ করার কোনও প্রশ্নই উঠে না। এখন আমার সরকার ভারতীয় রেলের এক বৃহৎ অংশকে ব্যক্তিগত মালিকানার কাছে বিক্রি করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একদিকে যখন চীনাদের হাতে আমাদের কুড়িজন ভারতীয় সেনা নৃশংস ভাবে মারা গেলেন আমাদেরই জমিতে, তখন আমি বলেছি যে চীনারা আমাদের ভূখণ্ডে পা রাখেনি। মহাত্মা গান্ধীকে একদিকে আমি যখন বলছি 'জাতির জনক' তখন একই সঙ্গে পাশাপাশি আমার দলের লোকেরা নাথুরাম গডস'এর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী হবার আগে আমি বলেছিলাম জিএসটি ভারতবর্ষে সর্বনাশ ডেকে আনবে, এখন বলছি জিএসটি'ই শেষ কথা ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য। ক্ষমতায় আসার আগে মনমোহন সিং সরকারের ৫১ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্তকে ধিক্কার জানিয়ে আমি বলেছিলাম যে এতে দেশের সর্বনাশ হবে। এখন বলছি, দেশের উন্নতি সাধনে ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ দরকার যা আমার সরকার অনুমোদন করেছে।
আমার নামে অভিযোগ যে আমার নাকি দুটি জন্মতারিখ। প্রথমটা ২৯ আগস্ট ১৯৪৯ যা আমার গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেটে লেখা আছে, বিরোধীরা যাকে জাল বলে অভিহিত করে; দ্বিতীয় তারিখটি হল ১৭ সেপ্টেম্বর, যা আমি আমার নির্বাচনী হলফনামায় দাখিল করেছিলাম। আমার বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ হল, আমি যখন ৬ বছর বয়সে ভাঁড়ে চা বিক্রি করতাম ট্রেনের কামরার বাইরে ভবনগর রেল স্টেশনে, সেখানে ওই নামে কোনও স্টেশনই ছিল না। ভারতীয় রেলের রেকর্ড অনুযায়ী ভবনগর স্টেশনটির উদ্বোধন হয় ১৯৭০ সালে, যখন আমার বয়স ছিল ২১ কি ২২। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল অবধি আমি দেশে জরুরি অবস্থার সময় গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপন করেছিলাম। ১৯৭৮ সালে আমি স্নাতক হই। বিরোধীরা প্রশ্ন তোলে, দু' বছর আত্মগোপন করার পর, কোনও ক্লাস না করে আমি কী করে পরীক্ষায় বসলাম এবং পাস করে গেলাম। এটা কী করে হয়? ১৯৮৩ সালে আমি গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'Entire Political Science'এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাই যা পৃথিবীর কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না। অভিযোগ, এমন কোনও মানুষকে আমি দেখাতে পারিনি যারা এসে বলবে যে তারা আমায় পড়িয়েছেন অথবা আমার সঙ্গে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ক্লাসে পড়াশোনা করেছেন। এটা ঠিক যে আমি একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছি, আমি ক্লাস টেন'এর গণ্ডি পেরোইনি ঘর থেকে পালিয়ে যাবার কারণে। তাই অনেকে আমাকে 'নন ম্যাট্রিক গ্রাজুয়েট' বলে থাকে। প্রধানমন্ত্রী হবার পর যখন প্রশ্ন উঠল আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে, তখন মন্ত্রী অরুণ জেটলি আমার স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষার দুটি মার্কশিট প্রকাশ করেন যা মাইক্রোসফট কম্পিউটারে ছাপা, যে কম্পিউটার ১৯৯০ সালে ভারতে আসে। প্রশ্ন ওঠে, ১৯৭৮ ও ১৯৮৩ সালের পরীক্ষার সার্টিফিকেট কী করে ছাপা হয় সেই সময়ে ১৯৯০ সালের বিদেশি মাইক্রোসফট কম্পিউটারের মাধ্যমে?
এবার আমি বলি?
আমার এই কথা আর কাজের ফারাকের ব্যাপারটা হল গিয়ে টাকার এ-পিঠ আর ও-পিঠের মতো। এ-পিঠে একরকম ছাপ আবার ও-পিঠে আরেক রকম ছাপ। কিন্তু ছাপ আলাদা বলে তো টাকাটা আলাদা নয়। এ-পিঠেও টাকা, ও-পিঠেও সেই টাকা। আপনারা যে মুহূর্তে যুক্তির ছুরি শানিয়ে চুলচেরা বিচারে বসবেন, তখনই বস্তুর খণ্ড রূপটি চোখের সামনে বড় হয়ে দেখা দেবে। অমনি ভ্রান্তি আসবে। মায়ের বাঁ বুকের দুধে পুষ্টি বেশি, না ডান বুকের দুধে বেশি, খিদের সময় ছেলে যদি তার মায়ের বুক ফালাফালা করে চিরে বিচার করতে যায় তাহলে কি তার খিদে মেটে? নাকি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে? ছেলের খিদে মেটা নিয়ে কথা, তা এ বুকের দুধেও মিটবে, ও বুকের দুধেও মিটবে। তার আবার অত চুলচেরা হিসাবে যাওয়া কেন? বিচার নয়, বিশ্বাস চাই। বিচারের পথ বড় শক্ত পথ। ও বড় কঠিন পথ। ও পথে চলতে গেলে বিদ্যে চাই, বুদ্ধি চাই, নিজের ওপর আস্থা চাই। ওটা হল কাকের পথ। কাক ডিমে তা দেবে, তার কত আয়োজন। খড় আনো, কুটো আনো, শক্ত জায়গায় ভালো করে বাসা বাঁধো। তবে ডিম পেরে তা দিতে বসো। কিন্তু কোকিলের অতশত বালাই নেই। সে কাকের বাসায় ডিম পেড়ে রেখে এসেই খালাস। তার অটল বিশ্বাস, এ ডিম ফুটে বাচ্চা হবেই, যেই তা দিক। এটা হল সহজ পথ। বর্তমানে আমাদেরও এই রকম সহজ পথ- 'বিশ্বাসের পথ'।
পূজারী বামুন নারায়ণ শিলাকে কখনও চাদরের খুঁটে বেঁধে, কখনও বা ফুলের সাজিতে বসিয়ে নিয়ে যায়। তারপর বাড়িতে গিয়ে সেই শালগ্রামটিকে টাটে বসিয়ে দেয়। আমি হচ্ছি সেই শালগেরাম। আমাকে টাটে বসানোই হল আপনাদের কাজ। তা আপনারা 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান তুলেই বসান বা অন্য কোনও পথে বসান, তাতে শালগ্রামের কিছু এসে যায় না। তিনি গদিতে বসতে পেলেই খুশি। এর মধ্যে বিভ্রান্তি ঘটার অবকাশ কোথায়? বরের লক্ষ্য ছাদনাতলা। তা আপনারা বরকে মোটরে করেই নিয়ে যান, নৌকো করেই নিয়ে যান আর পালকি করেই পৌঁছে দিন, বর গিয়ে ছাদনাতলায় দাঁড়াতে পারলেই হল। এর মধ্যে বিভ্রান্তিটা আসছে কোথায়?
পোয়াতির ব্যথা উঠেছে। একেবারে এখন তখন। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। তখন কি অ্যাম্বুলেন্স আসছে না বলে তাকে ঘরে ফেলে রাখবে? আমার গদিতে বসার ব্যাপারটাও ওই পোয়াতির গর্ভযন্ত্রণার মতোই আর্জেন্ট। কবে জনগণ চাইবে তার জন্য অপেক্ষা করা মূর্খতা। আদর্শের ভিত্তিতে ক্ষমতা দখল হলে ভালো, যদি তা না হয় তাহলে বিপরীত আদর্শের কোলে চেপেই ক্ষমতায় আমাকে বসিয়ে দিতে হবে।
আশা করি এই রূপ সদুপদেশ পেয়ে আপনাদের ভ্রান্তি দূর হয়েছে। এবার হৃষ্টচিত্তে যে যার এলাকায় ফিরে গিয়ে মনোযোগ সহকারে কাজে নেমে পড়ুন। জয় শ্রীরাম।
গৌরকিশোর ঘোষের 'গুরু শিষ্য সংবাদ'এর ছায়া অবলম্বনে।
অসৈধারন
ReplyDelete