এই মুহূর্তে কেন বৃহত্তর বাম জোট জরুরি
শোভনলাল চক্রবর্তী
বাম-কংগ্রেস ও ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের (আইএসএফ) মধ্যে হওয়া জোট নিয়ে বামপন্থী সহ অন্যান্য মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলির উত্তর পাওয়া জরুরি। বিশেষ করে আজ যখন একটা ফ্যাসিস্ট শক্তি আমাদের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। কে বা কারা এই শক্তিকে বাংলার মাটিতে খাল কেটে কুমির আনার মতো করে এনেছে, সে সব কূটকচালি এখন থাক। কারণ, বিপদ আজ ঘাড়ের উপর। তাই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কোনও সুরাহা হবে না। বরং সরাসরি প্রসঙ্গে আসা যাক।
শুরুতে দুটি প্রশ্ন রাখতে চাই। প্রথম প্রশ্ন, আপনারা কি মনে করেন, রামকৃষ্ণ মিশন, রাম মন্দির ন্যাস, ইসকন, ভারত সেবাশ্রম- এরা সবাই আলাদা প্রতিষ্ঠান নাকি মনে করেন এরা সবাই এক? উত্তরে বেশির ভাগই বলবেন যে আলাদা; তবে সবগুলিই হিন্দু ধর্মের অনুসারী, অতএব বৃহত্তর ক্ষেত্রে অভিন্ন। এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন, সিপিএম, সিপিআই, লিবারেশন এই দলগুলি কি আলাদা না এক? এর উত্তরেও ওই একই কথা বলতে হয় যে, আলাদা, তবে বৃহত্তর বামপন্থার ছাতার তলায় এক। এখানে একটা সামান্য পার্থক্য আছে। রামকৃষ্ণ মিশন, ইসকন ইত্যাদি যেমন সবাই এককাট্টা যে 'মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়', বামপন্থী দলগুলি কিন্তু আজও একটি কমন মিনিমাম প্রোগ্রামে এক হতে পারেনি। তাদের লাল ঝাণ্ডাগুলো এক জায়গায় আনতে পারেনি। দেশে যদি অন্তত একটি ঐক্যবদ্ধ বাম শক্তি থাকত তাহলে এই অবান্তর জোট ইত্যাদির প্রশ্ন উঠত না।
এটা কোনও হাসি বা মজার কথা নয় যে, নির্বাচনের আগে বামেদের ব্রিগেড না হলে নির্বাচনের মানহানি হয়। আসলে ব্রিগেড এক অন্য আবেগ। বড় পবিত্র আবেগ। এই ব্রিগেডের প্রস্তুতিতে ফ্ল্যাশ মব হল, নাচ, গান হল। এমনকি তেলেঙ্গানার প্রসঙ্গ উঠল, যে তেলেঙ্গানার নেতা বি টি রনদিভে'কে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে বর্জন করা হয়েছিল তেলেঙ্গানা লাইন। সবই ওই পবিত্র আবেগের বশে। আসলে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে পড়তে একটা বড় লাফ মারার চেষ্টা। যারা ব্রিগেডের ভিড়ে ছিলেন, তাঁরা কি জানতেন না বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে অনেকটাই থাকবে কংগ্রেসের হাতে, আইএসএফ'এর হাতে? নিশ্চয়ই জানেন। তাহলে? আসলে তাঁরা দেখতে চান সেই দলটির পতন যারা তাঁদের ২৩৫ থেকে নামিয়ে দিয়েছিল ৩৫-এ। সুজন-সেলিম পেরেছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে এই প্রতিহিংসার আগুন সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। তারা যে কোনও মূল্যে মমতার শাসনের অবসান চায়। সেই মূল্যেই তারা টুম্পা সোনা লিখে ফেলতে পারে, সেই মূল্যেই তারা আব্বাস ভাইজানের কথায় উদ্বেল হয়ে উঠতে পারে। এর মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই। গতবার তারা ভেবেছিল আব্বাস যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, তাই ভোট সরে গিয়ে পড়েছিল বিজেপির ঘরে। সংসদীয় গণতন্ত্রে কে কখন কার হাত বা আঁচল বা কোঁচা ধরবে তার কোনও ব্যাকরণ নেই। ক্ষমতা দখল যখন পাখির চোখ তখন কার সঙ্গে জোট করছি তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। কেউ কি কস্মিনকালেও ভেবেছিলেন, কংগ্রেস-শিবসেনা জোট হবে বা বিএসপি-বিজেপি? কিংবা অটলজি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তৃণমূল-বিজেপি জোট? সংসদীয় গণতন্ত্রের এটাই মজা, এই ব্যবস্থাটা সর্বংসহা। দেখবেন, টুম্পা সোনা থেকে আব্বাস সিদ্দিকি সব সহ্য হয়ে যাবে সময়ের সাথে।
পরস্পর বিপরীত মতের, দলের, মানুষ কীভাবে হাত ধরাধরি করে চলেন, সেটা দেখার আদর্শ জায়গা পার্লামেন্ট। লড়াইটা যখন মসনদের গদির, তখন কোনও স্থায়ী শত্রু বা বন্ধু বলে কেউ নেই। এক ঝটকায় আব্বাস এসে পড়ায় এত কথা উঠছে, তবে ওই যে, সব সয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন হল, তাহলে সেই সব স্বপ্নগুলোর কী হবে? সেই যে যৌথ খামার, গরম ভাত আর লাল ঝাণ্ডা? খেতে পাওয়ার প্রাচুর্যের সঙ্গে না খেতে পাওয়া ভুখা পেটের লড়াইয়ের কী হবে? সেই আলোর পথযাত্রীরা নিশ্চয় আছেন, তবে তার সঙ্গে এই আব্বাস আর টুম্পা সোনা মিশিয়ে ফেলবেন না, দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ।
একবার দেখা যাক এই রাজ্যে বাম শক্তির অবস্থাটা কেমন। প্রথম বড় শক্তি বামফ্রন্ট। তাঁদের অবস্থান পার্লামেন্টে একরকম, সেখানে নোটবন্দি থেকে কৃষি বিল, সব ক্ষেত্রে বামপন্থী আর তৃণমূলের সাংসদরা এককাট্টা। কিন্তু রাজ্যে বামেদের অবস্থান তৃণমূল বিরোধী। গত ১৫ দিনের 'গণশক্তি' ওল্টালেই দেখতে পাবেন- সেখানে ৮০ শতাংশ লেখা তৃণমূল বিরোধী আর ২০ শতাংশ বিজেপি বিরোধী। দলের ঘোষিত নীতি বিজেপি-তৃণমূল, মানে বিজেমূল হাটাও। এই রাজ্যের দ্বিতীয় শক্তিশালী বামপন্থী সিপিআইএমএল লিবারেশন, যারা বিহার নির্বাচনে আরজেডি'র সঙ্গে জোট করেছিল। লিবারেশন মনে করে তৃণমূলের হাজারও ত্রুটি বিচ্যুতি আছে, তথাপি বিজেপি'র সঙ্গে আগে লড়াই করা দরকার। বিহারে যাঁরা মহাজোটে ছিলেন, এখানে বামজোটে তাঁরা নেই। তাঁরা জানিয়েছেন, স্বল্প সংখ্যক আসনে তাঁরা সরাসরি প্রতিযোগিতা করবেন, বাকি আসনে যে যেখানে জিততে পারেন, তাঁকে সেখানে জেতানোর আবেদন করবেন। একই আবেদন রাখবেন সিপিআইএমএল রেড স্টার। এখানে লক্ষণীয়, এই শেষোক্ত দুই দল কিন্তু একসঙ্গে মোর্চা করতে পারেনি এবং ভাঙর পাওয়ার গ্রিডের আন্দোলনের মধ্য পর্যায় থেকে সিপিএম-এর সঙ্গে রেড স্টারের যে সখ্য তৈরি হয়েছিল, তা আপাতত উধাও। এছাড়াও বামফ্রন্টের বাইরের বহু বাম সংগঠনের একটা বড় অংশ 'নো ভোট টু বিজেপি' প্রচার চালাচ্ছে এবং তাদের পরিধি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে। সর্বভারতীয় স্তরের কৃষক আন্দোলনের নেতারা এই প্রচারে নিজেদের যুক্ত করেছেন। ফ্যাসিবাদকে চিহ্নিত করে আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁরা একজোট হতে সহমত হয়েছেন। এই হচ্ছে এবারের ভোটে বিভিন্ন বামশক্তির অবস্থান।
এর বিপরীতে প্রতিটি পুজো, রাসমেলা, নাম সংকীর্তন-এ সারা বছর ধরে বিজেপি-আরএসএস নিবিড় প্রচার চালিয়েছে- 'হিন্দু খতরে মে হ্যায়'। এই প্রচার তারা মজ্জায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, তাদের কোনও বিভেদ নেই, কোনও মতান্তর তাদের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। এই শক্তি যদি বামজোটের থাকত তবে নিশ্চিত করে বলা যেত যে বাংলায় বিজেপি খতরে মে হ্যায়। কিন্তু এই বিজেপি নামক দলটিকে যাঁরা চেনেন তাঁরা জানেন, ভোট জেতার জন্য নীতি নৈতিকতার যে কোনও অতল গহ্বরে নামতে এরা প্রস্তুত। সুতরাং, বাংলায় দল ভাঙিয়ে, নির্বাচন কমিশনকে চাপে রেখে যদি কাজ না হয় তাহলে দাঙ্গা, জঙ্গি আক্রমণ অথবা প্রশান্ত কিশোর যেমন বলেছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপর আক্রমণ পর্যন্ত হতে পারে। এই সব ঘটনা ঘটিয়ে একটা জাতীয়তাবাদী সুরসুরি দিয়ে জনগণকে দলে টানার শেষ চেষ্টা হবে। বামপন্থীদের তাই উচিত, অবিলম্বে বৃহত্তর জোট তৈরি করে আগে এই ফ্যাসিস্ট শক্তি বিজেপি'কে ঠেকানো, তৃণমূলের সঙ্গে ইগোর লড়াই পরে লড়া যাবে।
পুরো লেখাটা খুব কায়দা করে বাম ঐক্যের পাশাপাশি বিজেপির ভয়াবহতা দেখিয়ে আসল কথাটা ইনিয়ে বিনিয়ে শেষে বলেছেন তৃণমূলে যেন বঘাত না পড়ে মানে বিজেপির মুখোস যেন এ রাজ্যে থাকে, আসুন আমরা লড়াই করি মুখের বিরুদ্ধে। মানে এখানে যেমন অপশাসন চলছে চলুক। এখন উন্নয়নের গালগল্প যেমন চলছে চলুক। আসল কথাটা হলো লড়াইটা মুখ আর মুখোসের বিরুদ্ধে এটাই চলুক।
ReplyDeleteবঘাত স্থানে আঘাত পড়তে হবে
ReplyDeleteতৃণমূল, বিজেপির মধ্যে আমার বিজেপিকে বেশি বিপদজনক মনে হচ্ছে
Delete