বাঙালির 'দ্বিপ্রহরের নায়ক' ছিলেন না
প্রবুদ্ধ বাগচী
আবেগ দিয়ে কোনও মৃত্যুকে রুখে দেওয়া সম্ভব নয়। ছিয়াশি ছুঁতে চলা কিংবদন্তী অভিনেতা যে ধরনের অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করছিলেন তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়াও তাই সম্ভব ছিল না। সুতরাং মৃত্যুকে আটকে রাখা যায়নি। শেষদিন অবধি তিনি সজীব ও কর্মক্ষম ছিলেন এটাই আমাদের অনেক পাওয়া। আরেক কিংবদন্তী ম্যাটিনি আইডল চল্লিশ বছর আগে প্রায় শুটিং ফ্লোরে কাজ করতে করতেই ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর দিকে। রবি ঘোষের মতো প্রতিভাশালী অভিনেতাও তাই। কিন্তু বেশ কিছু রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয় করলেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই অর্থে বাঙালির ‘দ্বিপ্রহরের নায়ক’ কোনওদিনই ছিলেন না, সম্ভবত তিনি নিজেও সেটা চাননি। কারণ, তাঁর ছিল ভিন্ন রকমের একটা মনন ও মেধাবী সাংস্কৃতিক পরিচয়। যে ভাবনা থেকে উত্তমকুমার তাঁর সহ-অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে বারণ করেছিলেন গাড়িতে তেল ভরার সময় রাস্তায় নেমে না দাঁড়াতে। তাঁর প্রশ্ন ছিল, রুপোলি পর্দার নায়ককে দর্শকরা এত সহজে তাঁদের নাগালের মধ্যে পাবেন কেন? নায়ক থাকবেন তাঁর ফ্যানদের দূরত্বের বাইরে অধরা, সেটাই গ্ল্যামার। এমন জীবনদর্শনে সৌমিত্র বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। অন্তত তাকে ঘিরে যে সব লেখাপত্র কাহিনি এতদিন পড়ে এসেছি এবং এখনও পড়ার সুযোগ হচ্ছে তাতে এমন কথা ভাবার সুযোগ নেই।
এর কারণটা ঠিক ঠিক লিখেছেন জয় গোস্বামী। বাংলা কেন, ভারতের চলচ্চিত্র জগতেও এমন একজন অভিনেতা পাওয়া সম্ভব নয়, বিপুল অভিনয়ের পাশাপাশি যার রয়েছে কবিতা, গদ্য ও নাটকের সংগ্রহ। রয়েছে পাঠ ও আবৃত্তির ঈর্ষনীয় সংকলন। দেশ-বিদেশের নাটকের অনুবাদ তাঁর কলমে, নতুন নতুন কবিতার আয়োজনে ঋদ্ধ তাঁর লেখনী, আমাদের শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রচর্চায় নিবেদিত তাঁর মনন। মনে না পড়ে উপায় নেই, গত বছর (২০১৯) সব থেকে খ্যাত ও পরিচিত সাহিত্যপত্রের শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর একটি দীর্ঘ কবিতা– তিনি এতটাই সমকালীন। এইসব কারণেই তাঁকে আমরা একটু কাছের মানুষ ভাবতাম, সচরাচর ফিল্মের নায়কদের সম্বন্ধে যা আমাদের ভাবার অবকাশ থাকে না। তাই তাঁর নতুন ছবির পাশাপাশি উন্মুখ হয়ে থাকতাম নতুন নাটকের জন্য, নতুন কবিতার জন্য। এটা নিছক একজন চরিত্র-অভিনেতার কাছে গড়পড়তা চাওয়ার থেকে বেশি।
এখান থেকেই প্রসঙ্গ ঘুরে যেতে পারে ভিন্ন একদিকে। তাঁর অভিনীত তিনশো ছবির কথা আমরা এখন শুনতে পাচ্ছি, হয়তো সংখ্যাটা আরও কিছু বেশি হলেও হতে পারে। ষাট বছরের অভিনয় জীবনে সংখ্যাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষে বেশ অনেকটা বেশি। এত ফিল্মের সব চরিত্রের সঙ্গে কি তিনি সুবিচার করতে পেরেছেন না তেমন করা আদৌ সম্ভব? সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে এবং নিজে একজন পড়ুয়া অভিনেতা হিসেবে অভিনয়ের আনাচকানাচ তাঁর অজানা ছিল না- কীভাবে চরিত্রের মধ্যে নিজে ঢুকে যেতে হয়, কীভাবে চরিত্রের দাবি মিটিয়ে পালটিয়ে নিতে হয় নিজেকে, এইসব তাঁকে শিখিয়ে দেওয়ার কোনও দরকার ছিল না। কিন্তু যে চরিত্র তিনি পর্দায় জীবন্ত করে তুলবেন তার পেছনে পরিচালকের কিছু ভাবনা ও মননশীলতা থাকা প্রয়োজন, কারণ ফিল্ম মূলত পরিচালকের মাধ্যম। হলফ করে কি বলা যায় খুব বেশি হলে গোটা পঞ্চাশ ছবি বাদ দিলে বাকি যে সব ফিল্মে তিনি অভিনয় করেছেন সেগুলোতে পরিচালকরা এতদূর যোগ্য ছিলেন যে সেইসব ফিল্মের কোনও সেরিব্রাল আবেদন ছিল? আদৌ সেখানে অভিনেতার খুব নিবিড় ভাবে বুঝে নেওয়ার জায়গা ছিল চরিত্রকে? কমার্শিয়াল ফিল্ম বলে কোনও ফিল্মকে অপকৃষ্ট বলা বিধেয় নয় কিন্তু বাণিজ্যিক ফিল্ম সমস্ত যুক্তি ও ফিল্মের শর্তকে মাড়িয়ে গেলে তা কি শেষ অবধি আর ফিল্ম থাকে? সমস্যা এখানে।
কথা উঠতেই পারে, একজন পেশাদার অভিনেতার পক্ষে কি এমন বাছাই করার সুযোগ থাকে? না, অবশ্যই থাকে না। ফিল্ম একটি বিনিয়োগের জায়গা, তার নগদবিদায় ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিচালকের ওপর প্রযোজকের চাপ থাকে। স্বয়ং সত্যজিৎ'কে ‘পথের পাঁচালী’র এক সম্ভাব্য প্রযোজক পরামর্শ দিয়েছিলেন সর্বজয়াকে দুয়েকটা পুকুরে চানের দৃশ্যে শুট করে নিতে। সব পরিচালক না বলতে পারেন না, আর অভিনেতার তো এই বিষয়ে কোনও ভূমিকাই নেই। ফলে, তাঁকে পরিচালক যে ভূমিকা ঠিক করে দেন সেটাই তার অবলম্বন। এই পর্যন্ত ঠিক। কিন্তু সৌমিত্রের মতো একজন ভিন্ন মানসিকতার অভিনেতার কেমন লাগত ওইসব মামুলি চরিত্রে অভিনয় করতে যাদের পেছনে সে ভাবে কোনও ভাবনার ছাপ আর তেমন নেই। কোথাও একটা যেন রুচির তফাত। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র অসীম চরিত্রের অভিনেতাকে যখন লিপ দিতে হত কোনও লঘু গানের সঙ্গে- কেমন লাগত তাঁর? কেমন লাগত ‘শাখা প্রশাখা’র প্রশান্তর, যখন একটা মেলোড্রামাটিক দৃশ্য শুট করে তাঁকে রোজগার করতে হত ?
আসলে সমস্যাটা এইখানে। আমাদের যদি এখন কেউ বাধ্য করে চড়া সুরের একটা পৌরাণিক যাত্রাপালা দেখতে অথবা খুব লঘু সুরের একটা জগঝম্প গানের শ্রোতা হতে কিংবা মুখের সামনে খুলে ধরে একটা শিশুপাঠ্য কবিতার বইয়ের পাতা- কেমন লাগবে আমাদের? নিশ্চয়ই আমাদের প্রথমে শুরু হবে অসোয়াস্তি; তারপরেও যদি এই জুলুম চলে তবে আমাদের দমবন্ধ লাগবে, কষ্ট হবে। কিন্তু এরপরেও যদি আমাদের উপায় না থাকে এগুলোর থেকে বেরিয়ে না আসার, তবে? সে এক গভীর বেদনার সময় যখন মনন যা দাবি করে ঠিক তার বিপরীতটাই আমাদের সামনে ঘনিয়ে ওঠে। বললে কি ভুল হবে, সৌমিত্র এমনই কিছু অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে চলেছেন তার কেরিয়ারের অনেকটা সময়! অন্তত সাতের দশক থেকে নয়ের দশক অবধি! হয়তো তাঁর সামনে কোনও বিকল্প ছিল না।
কেন বিকল্প ছিল না এটা প্রশ্ন নয়, কথাটা হল কেন বিকল্প থাকে না? আমাদের সমাজে ও সংস্কৃতিতে যারা এগিয়ে ভাবেন, এগিয়ে থাকেন তাঁদের জন্য কোনও যথার্থ পরিসর আমরা আজও তৈরি রাখতে পারিনি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে মাপের বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, শিল্পিত অভিনয়ের একজন পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর নাম আলাদা করে উল্লেখ করার মতো এবং পাশাপাশি তাঁর অন্যান্য শিল্পধারার প্রতি নিবেদন, সেও কম বলার কথা নয়- কিন্তু এমন একজন মানুষকেও সম্পূর্ণ তাঁর রুচির বিপরীতে গিয়ে জড়িয়ে পড়তে হয় এমন সব অভিনয়ে যা কেবলমাত্র তাঁর রুটিরুজির জন্যই কেবল প্রয়োজনীয়। একজন প্রকৃত শিল্পীর পক্ষে এ বড় বেদনার আবহ।
বাংলা বাজারে কেবলমাত্র লেখালিখি করে জীবন নির্বাহ করা শুধু কঠিন নয়, অন্য যে কোনও শিল্পের ঘরানাতেও তা সমান সত্যি। সত্যজিৎ রায়েরও ফিল্ম বানিয়ে সংসার চলত না বলেই শোনা যায়। পরের দিকে, এমনকি এখনও, বইয়ের রয়্যালটিই ছিল তাঁর রোজগারের বড় অংশ। সৌমিত্রের কাছ থেকেও আমরা আরও অনেক কিছু পেতে পারতাম হয়তো, যদি তাঁকে আমরা একটা দাঁড়াবার জায়গা দিতে পারতাম। কিন্তু পুরো সময়ের জন্য নাটক করতে চেয়ে শিশির ভাদুড়ী ‘জাতীয় নাট্যশালা’ পাননি, একই আকাঙ্ক্ষা বুকে পাথরের মতো জমিয়ে রেখে চলে গেছেন শম্ভু মিত্র। আমাদের রাজ্যে তার ব্যবস্থা করা যায়নি। একইভাবে করা যায়নি তেমন ব্যবস্থা যাতে সৌমিত্রের মতো অভিনেতাকে জাত খুইয়ে ভুলভাল অভিনয়ে না ঝরিয়ে ফেলতে হয় তাঁর জীবনীশক্তি।
আমাদের চলচ্চিত্র উৎসব, আমাদের নাট্য আন্দোলন, আমাদের ফিল্ম সোসাইটি, আমাদের সরকারি সংস্কৃতির নানা উদ্যোগ, ‘দমাদম দমাদম কৃষ্টি ভীষণ’- সব কিছুর ভিতর এই এক অপার শূন্যতা- কেউ মরে গেলে আমাদের আবেগ উথলে ওঠে, যা তাঁর জীবদ্দশায় ঠিক ততটা নয়। মনে পড়ছে, আরেক বিদগ্ধ অভিনেতা উৎপল দত্তের কথা- ঠিক ঠিক করে সংসার চালানোর জন্য দিনের পর দিন তিনি তৃতীয় শ্রেণির মুম্বাই ফিল্মে নায়িকাদের শ্লীলতাহানির দৃশ্যে অভিনয় করে যেতে বাধ্য হয়েছেন! কী বলা হবে? ট্রাজেডি?
যথার্থ প্রশ্ন। সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে এ ট্রাজেডি আরও নির্মম। বড়ো বেশি আবেগপ্রবণ জাতি আমরা। এই অপ্রিয় প্রশ্নগুলোকে তাই দূরে সরিয়ে রাখি।
ReplyDeleteখুব বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা।
ReplyDeleteকান্ত প্রসাদ সিংহ।
ReplyDelete