ফুটবল-ঈশ্বর-মারাদোনা
সুমন কল্যাণ মৌলিক
পিটার শিলটন ইংল্যান্ডে তাঁর বাড়িতে বসে আজ কী ভাবছেন জানি না, কিন্তু এটা জানি যে যতদিন এই গ্রহে ফুটবল বেঁচে থাকবে ততদিন ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড ম্যাচের সেই দুটো গোলের কথা থেকে যাবে মানুষের মনে, আলাপে, আলোচনায় বা নিছক স্মৃতি রোমন্থনে। নিজেদের সেন্টার লাইন থেকে বল পেয়ে প্রতিপক্ষের সাত জনকে কাটিয়ে মারাদোনার সেই অত্যাশ্চর্য গোল নিয়ে লাখ লাখ কথা হয়েছে, ক্রীড়া অনুরাগীদের ভোটে তা ইতিমধ্যেই শতাব্দীর সেরা গোল হিসাবে নির্বাচিত। কিন্তু আমার মতো মারাদোনা ফ্যানের কাছে আরও আনন্দের প্রথম গোলটা। নীতিবাগীশ পণ্ডিতেরা যতই নিদান দিন না কেন যে হাত দিয়ে গোল করা ফুটবল শাস্ত্র বিরোধী, কিন্তু আমি আজও বিশ্বাস করি সে গোল তো ঈশ্বরের হাত! আর কোনও শাস্ত্রে এটা তো লেখা নেই যে ঈশ্বর চিরকাল শুধু ধনীদের, ক্ষমতাসীনদের ধামাধরা হয়ে থাকবেন, ঈশ্বরেরও তো একবার শাপমোচন হওয়া দরকার। ফকল্যান্ড যুদ্ধ জয়ের পর ইংল্যান্ডের সেই গর্বিত বিজয় উল্লাস, গ্যালারিতে বৃদ্ধ সিংহের সেই উদ্ধত বারোফট্টাইকে একেবারে চুপ করিয়ে দিয়েছিল আমাদের 'বাঁটকুল' নায়ক। পরের দিন কাগজে ব্রিটিশ প্রেসের মারাদোনার প্রতি তীব্র বিষোদ্গার দেখে পাড়ার ভজাদা বলেছিলেন, 'লালমুখোগুলো হাতটাই দ্যাখলো, পিটার শিলটনের মতো অত লম্বা গোলকিপারকে বাঁটকুলটা যে স্পষ্ট জাম্পে হারাইয়া দিল, তা নিয়ে ব্যাটাচ্ছেলেরা এক্কেবারে চুপ।'
যুক্তিবাদীরা আমার বক্তব্য শুনে রে রে করে উঠতে পারেন। কিন্তু সে সময়ে তো আমরা এরকম করেই ভাবতাম। আমরা মানে সেই কিশোরেরা যারা সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। আসলে সময়টাই তো অন্যরকম ছিল। মফস্বল শহরগুলোতে বছর তিন-চারেক হল সাদাকালো টিভি এসেছে। তখন হামলোগ বা চিত্রহার দেখতে সন্ধ্যাবেলায় লোকের বাড়িতে গ্যাঁট হয়ে বসা যেত, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ থাকলে পাড়ার মোড়ে ফ্ল্যাগ টাঙানো যেত, বাঙাল-ঘটিদের টিমে দূরবীন দিয়ে বাঙালি ফুটবলার খুৃৃঁজতে হত না। গরমকালের শুরু থেকে প্রায় দুর্গাপূজা পর্যন্ত রবিবার বা অন্যান্য ছুটির দিনগুলোতে সারা দিন ধরে জমজমাট ওয়ান ডে টুর্নামেন্ট চলত। পাড়ার যে ছেলেটা ভালো ফুটবল খেলে তাকে সবাই এক ডাকে চিনত। খবরের কাগজ বিক্রেতা কাকুর কাছে 'খেলার কথা' বা 'খেলার আসর' (সে সময় বাংলা ভাষায় প্রকাশিত খেলার পত্রিকা) এনে দেওয়ার আব্দার থাকত। তখন স্যাটেলাইট বিপ্লবের কল্যাণে উয়েফা লিগ, ইপিএল বা লা-লিগা ডালভাত হয়ে যায় নি। ফলে বিশ্বকাপ, ইউরো কাপের মতো টুর্নামেন্ট আমাদের কাছে ছিল এক তাজা হাওয়ার মতো।
৬০ বছর বয়সে মারাদোনার হৃৎপিণ্ড চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার নিদারুণ খবর শোনার পর থেকে ভাববার চেষ্টা করছি কেন আমরা সবাই পাগলের মতো মারাদোনাকে ভালোবেসে ফেললাম। আসলে ফুটবল যতই দলগত খেলা হোক না কেন ব্যক্তিগত নৈপুণ্য বা সৃজনশীলতার একটা আলাদা আকর্ষণ আছেই। ইংরেজি 'স্কিল' শব্দটির অর্থ দক্ষতা, কিন্তু তা দিয়ে বিষয়টা ঠিক বোঝা যায় না। ইউরোপীয় ওয়ান টাচ পাসিং ফুটবলের দক্ষতা প্রশ্নাতীত, তাদের যান্ত্রিক-শৃঙ্খলা নির্ভর ফুটবলের সাফল্যের হারও অনেক বেশি। কিন্তু বাঙালির সেটা ঠিক পছন্দ নয়। আমাদের অনেক বেশি মনে ধরে ফুটবলে নান্দনিকতা, প্রতিভার আশ্চর্য স্ফুরণ যা অনেক বেশি সহজলভ্য ছিল তখনকার লাতিন আমেরিকার ফুটবলে। তাই বাঙালি জন্ম থেকেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ভক্ত। আমাদের সময়ে দু-একজন ছাড়া জার্মানি বা হল্যান্ডের ফুটবল ভক্ত চোখে পড়ত না। আর ইতালির কথা বললেই মনে পড়ত সারাক্ষণ নিজেদের সীমানায় লোক বাড়িয়ে ডিফেন্স, লম্বা-লম্বা থ্রো আর কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ক্কচিৎ কদাচিৎ দু একখানা গোল। ঠিক এখানেই মারাদোনার মাহাত্ম্য — জাদুকরী দক্ষতায় তিন কাঠি চিনে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা। মনে রাখতে হবে, সে সময় বল প্লেয়ারদের রক্ষার জন্য ফিফা এত নিয়ম করেনি। মাঠে ডিফেন্ডারদের কড়া ট্যাকল ও চোরাগোপ্তা আক্রমণে বার বার রক্তাক্ত হতে হয়েছে তাঁকে কিন্তু সারা মাঠ জুড়ে ফুল ফুটিয়েছেন এই খর্বকায় মানুষটা।
তবে মারাদোনার শৈল্পিক জাদুকরীই তার প্রতি আমাদের অনিঃশেষ মুগ্ধতার একমাত্র কারণ নয়। মারাদোনার আমাদের হৃদয় জুড়ে থাকার আরেকটা বড় কারণ তার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। মারাদোনা যখন ফর্মের চূড়ায়, বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফা তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ। ফুটবলের বিশ্বজনীন জনপ্রিয়তাকে বাণিজ্য করে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ক্রীড়া সংস্থা। জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ, শেপ ব্ল্যাটাররা আচার-আচরণে এক একজন খুদে স্বৈরশাসক। ঠিক সে সময় মারাদোনা ফিফার তুঘলকি আচরণের সমালোচনা করেছেন, দু-একবার শাস্তির মুখে পড়েছেন। মারাদোনার সব অভিযোগের হয়তো সারবত্তা ছিল না, কিন্তু আজ এ কথা প্রমাণিত যে সে সময় ফিফা সত্যিই ছিল ঘুঘুর বাসা। জুরিখে ফিফার অফিসের বহু শীর্ষ কর্তা (মায় কিংবদন্তি ফুটবলার ও প্রশাসক প্লাতিনি পর্যন্ত) আজ দুর্নীতির দায়ে জেলের ঘানি টানছে। ক্ষমতার কেন্দ্রকে প্রশ্ন করার অভ্যাস মারাদোনার ফুটবল ছাড়ার পরেও চালু থেকেছে। কখনও পোপের সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, কখনও এককেন্দ্রিক বিশ্বের স্বঘোষিত অভিভাবক মার্কিন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে তোপ বা ক্ষুধার প্রশ্নে উন্নত দেশগুলোর নিরুত্তাপ থাকাকে আক্রমণ — মারাদোনা সবসময় পক্ষ নিয়েছেন। এই অনুষঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারার প্রতি তাঁর ভালোবাসা, কিউবার জনমুখি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, সর্বোপরি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন ছোট বড় দেশে ফেটে পড়া মার্কিন সাম্রাজবাদ বিরোধী লড়াইয়ের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন। ধীরে ধীরে মারাদোনা হয়ে উঠেছেন এমন এক অপ্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থী আইকন যিনি আদতে প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুগত তথা চিরকালীন পলিটিকালি কারেক্ট ব্রাজিলের পেলের এক জীবন্ত প্রতিস্পর্ধা। আশির দশকে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ে দিশেহারা বামমনস্ক বাঙালি পরম মমতায় তাঁকে আঁকড়ে ধরেছে।
আজ এই অন্তহীন শোকের আবহে কেউ কেউ বলছেন, মাদক না নিলে, একটু শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করলে মারাদোনা নাকি আরও বহু দিন খেলতে পারতেন। হয়তো তাঁরা সঠিক। কিন্তু প্রতিভা বা সৃজনশীলতাকে সবসময় কি শৃঙ্খলায় বাঁধা যায়? আসলে ঋত্বিক ঘটক, মাইকেল মধুসূদন, রামকিঙ্কর বেইজ, জর্জ বেস্ট বা মারাদোনার মতো মানুষেরা তাঁদের যাবতীয় অপূর্ণতা বা দুর্বলতা নিয়েই আমাদের মধ্যে থেকে যাবেন, আমরা তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে বারবার খুঁজে নেব জীবনের রসদ।
অনেক দিন আগে এক আড্ডায় আমার এক বন্ধু প্রশ্ন করেছিল, 'বল তো, জুভেন্টাস, এসি মিলান, ইন্টার মিলানের মতো ওজনদার দল থাকা সত্ত্বেও মারাদোনা ইতালির লিগের খেলায় নাপোলির মতো এক অকুলীন দলে সই করেছিল কেন?' চুপ করে রয়েছি দেখে বন্ধুর গর্বিত উত্তর, 'আসলে মারাদোনা তো গডফাদার হতে চেয়েছিল। আর নাপোলির মাফিয়াদের নিয়েই তো গডফাদার উপন্যাসটা লেখা।' তর্ক করিনি, উত্তরটা আজও অজানা। কিন্তু এটা জানি যে সেই নাপোলিকে মারাদোনা প্রায় একক দক্ষতায় ইতালি চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। হ্যাঁ এটাই মারাদোনা। বিদায় কমরেড। বিদায় ফুটবলের ঈশ্বর।
মনের কথার প্রতিধ্বনি
ReplyDelete