ব্রাত্যপ্রাণের উৎসব
সঞ্জয় মজুমদার
ফেস্টিভ সিজন আশ্বিনের শারদপ্রাতে শুরু। তারপর একে একে দেবদেবীদের ধরাধামে অবতরণ। চলে ছট এবং জগদ্ধাত্রীর আলোকমালায় আলোকিত হয়ে যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত।
এইরে, ভুল বললাম? বিলক্ষণ। আর একটু বাকি থেকে গেল যে। হ্যাপি নিউ ইয়ার আর বাঙালির ভ্যালেন্টাইন-ডে সরস্বতী পুজো বাদ গেলে চলবে? একদম না। শক্তি আরাধনা আর সামাজিকতার আড়ালে তো আসলে ব্যবসা-বাণিজ্যের উৎসব, কনজিউমারিজমের উৎসব। ভবিষ্যতে আরও কত জুড়বে। দেবতা মানুষ তৈরি করেছেন, নাকি মানুষ দেবতাকে। পুজোর উৎসব নাকি উৎসবের পুজো, বোঝা দায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই যে কোনও পুজোয়, থুড়ি, ধর্মীয় উৎসবে, মানে উৎসবে, ভোর থেকেই আমজনতা এবং মিডিয়া আতসকাঁচের তলায় তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য খুঁজে বেড়ায়। মেইনস্ট্রিমের দৃশ্যমাধ্যম, মানে টেলিভিশনের সামনে বসলে বারো আনা ঠাসা থাকে পোশাক-আশাক, খাবার-দাবার, ঘোরাঘুরি, নানান কেনাকাটির জিনিসপত্র এবং আরও কত কিছুর বিজ্ঞাপনে। বাকি পঁচিশের কুড়িও চলে যায় প্রভাবশালীদের বক্তব্য আর প্রতিভার বিজ্ঞাপনে। শেষ পাঁচে অ্যাংকর ও রিপোর্টার বেচারি মিলে একটু একটু তথ্য আর সংবাদ পরিবেশন করেন। আর সম্পাদনাহীন সোশ্যাল মিডিয়ায় তো 'আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে'। অবস্থা এমন, আর কিছুদিন পর বোধহয় ফেসবুকে মুহূর্তে সেলিব্রিটি হতে চাওয়া আমজনতার স্ট্যাটাস আপডেটেও বিজ্ঞাপনদাতার বদান্যতা লাগবে। মানে, আমার সদ্য পোস্ট করা কভার ফটো দেখতে গেলেও প্রথমে ধূপের বিজ্ঞাপন দেখতে হবে।
প্রথম দিকে একটু ভয়-ভীতি সমীহ থাকলেও, এখন দেখছি করোনার বাজারে নিউ নরমাল, সামাজিক দূরত্ববিধি, স্যানিটাইজেশন, মাস্ক (যদিও থুতনিতেই সেঁটে থাকে বেশি) একটু একটু করে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে উঠছে। কোভিড-১৯'কে শিখণ্ডী খাড়া করে ডটকম কোম্পানিগুলো জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অনলাইন করার চেষ্টায় প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। উৎসবও বাদ যায়নি। যেতেই পারে না। জনগণ যাতে শারীরিক এবং মানসিক, সব দিক থেকেই সামাজিক দূরত্ববিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে তার দিকে কড়া নজর রেখেছে তারা। কারণ, নজর যত কড়া হবে ব্যবসার লাইন তত অন হবে, মানে অনলাইনে ফুলে ফেঁপে উঠবে। ক্যামেরাম্যান আর রিপোর্টার বুম হাতে, আধা-বাংলা আধা-ইংরেজি মেশানো ভাষায়, প্যান্ডেলে আর মন্দিরে ছুটোছুটি করে যত খুশি রিপোর্ট করুক, আপনি কিন্তু বেরবেন না। প্যান্ডেল হোক বা মন্দির, হপিং জিনিসটা অনলাইনেই বাঁধা থাকবে। উৎসবের দিনে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, বিশ্লেষণ আর ঈশ্বরের ফটোগ্রাফিক এভিডেন্স, স্ট্যাটাস আপডেট আর বায়োডাটার সম্প্রচার এবং মন্দিরের পুরোহিত, সেবাইতদের নাগাড়ে প্রেস ব্রিফিং ও বাইট, সবটাই অনলাইনে বিজ্ঞাপন বিরতি সমেত। 'কথিত আছে' শিরোনামে মন্দিরের বা পুজোর পৌরাণিক গাথা এবং জনপ্রিয়তা যত, স্পন্সরশিপও তত। মজার কথা হল, এসবের অত্যাচারে পুজো শব্দটা অপমানে, অভিমানে, সন্তর্পণে নিজেই যেন নিজেকে বিস্মৃতির অন্তরালে নিয়ে গেছে উৎসবকে জায়গা ছেড়ে দেবে বলে। বিশ্ব-পণ্যায়ন তো তাই চাইছে। পুজো নয়, আরাধনা নয়, সাধনা নয়, হোক শুধু উৎসব। মানুষের উৎসব, প্রাণের উৎসব ইত্যাদি মায়াবন্ধে আমাদের বেঁধে ফেলে, সব কিছুকেই এমনকি পুজোকেও বাজারজাত করে ফেলেছে। ভেবে দেখলে উৎসবের সাথে পুজোর সম্পর্কটা অনেকটা 'ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে'র মতো। শুধু পুজো শব্দটা দিয়ে যথেষ্ট ব্যবসা করা যাচ্ছে না বলেই হয়তো উৎসবের আমদানি। জনতার স্নায়ুতে রিল্যাক্সেশনের সুড়সুড়ি দিয়ে ফেস্টিভ সিজনের মুখোশ পরিয়েছে। উৎসব ঘিরে বাজারে তৈরি হয়েছে চাহিদা, কৃত্রিম চাহিদা। অফলাইনে কম, অনলাইনে বেশি। অমোঘ তার আকর্ষণ। উৎসব এখন বিলাসিতা নয়, বরং অধিকার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাঁধে ভর করে দুদিন পরে এ হেন উৎসবেরও কোনও বাজারজাত অনলাইন সংস্করণ বেরবে। তখন সে পুজোর মতো ঘুঁটে হয়েই পুড়বে।
কিন্তু উৎসবটা কিসের? মানুষের? প্রাণের? কোন প্রাণ? কোন প্রাণী? দু'রকম উত্তর আছে এ ক্ষেত্রে। প্রথমত, ভোট-বাজারের কথা ভাবলে, উত্তর হল মানুষ। কারণ, গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় অংশগ্রহণের উপযুক্ত দু-পেয়ে ছাড়া আর যে কেউ নেই। অতএব, শুধুই মানুষ। হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া, গরু, উট, হাতি, মাছ, এমনকি গাছপালার প্রাণ, শুধু বলির উপাদান। ভোটের বাজারে প্রাণের মূল্য শুধু মানুষেরই মেরেকেটে একটু আছে। এই যে করোনা বাজির বিস্ফোরণে, নিউ নর্মালের গুঁতোয় আদালত শব্দ দূষণে লাগাম পরিয়েছে, সেও তো শুধু মানুষের কথাই ভেবে। জীবজন্তুদের আদালত আছে নাকি? অস্তিত্বহীন কিছু একটা হয়তো আছে। খবর রাখিনি। আসলে জীববৈচিত্র বা বায়ো-ডাইভার্সিটি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনাচক্র আয়োজন করে কুম্ভীরাশ্রু ফেলা যেতেই পারে, কিন্তু উৎসবে, আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে, তাদের প্রাণের কোনও মূল্য নেই। পশুপ্রেম, পশুচিকিৎসা শতাংশের হিসেবে অদৃশ্য প্রায়। ধর্মমত জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে, গোটা পৃথিবী জুড়ে শয়ে শয়ে বছর ধরে মানুষের প্রাণের উৎসবের আড়ালে অসহায় জীবজন্তুর রক্তের উৎসব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মহামান্য আদালতের শুভ উদ্যোগে শব্দের তাণ্ডব যদি আলোর উৎসবে রাতারাতি রূপান্তরিত হতে পারে, তবে বলির উৎসব রক্তপাতহীন প্রকৃত পুজোয় ফিরতে পারবে না কেন? শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে আর কতটা নির্মম, কতটা অন্ধ হতে পারি আমরা?
এবার আসি দ্বিতীয় উত্তরটায়। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিত চিন্তা করলে উত্তরটা জটিল নয়, কিন্তু সহজও নয়। হ্যাঁ, আমি ভারতীয় সমাজে হাজার খানেক বছর ধরে প্রবহমান 'জাতের নামে বজ্জাতি'র প্রসঙ্গই তুলছি। আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে জাতপাতের রাজনীতি মারণব্যাধির চেয়েও মারাত্মক। আড়াই কোটির কাছাকাছি জনসংখ্যা দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেন এবং তাঁরা অধিকাংশই দলিত শ্রেণিভুক্ত। রাজস্থান বিহার ঝাড়খন্ড উত্তরপ্রদেশ উড়িষ্যা তামিলনাড়ু সহ বেশ কিছু রাজ্যে এঁরা একঘরে এমনকি আলাদা গ্রামের বাসিন্দা হয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে জীবনধারণ করেন। সত্যনিষ্ঠ সমীক্ষার তথ্য বলছে, সামাজিক প্রক্রিয়ায় রাস্তা আর জঙ্গলের পশুদের থেকে এঁদের খুব একটা পার্থক্য করা হয় না। কাজেই উৎসবের আঙিনায় এঁরা যে সমাদৃত হবেন না, বলাই বাহুল্য। অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ, দলিত এই মানুষগুলোর গ্রাম, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নেশায় বুঁদ ১৩৮ কোটির দেশে আছে এবং অনেক আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সবেতেই নিষ্ঠুর শীতল সামাজিক অবজ্ঞার শিকার এঁরা। উৎসব নাকি সামাজিক বন্ধনের গ্রন্থি। এই মানুষগুলো কিন্তু এখনও সেই গ্রন্থিতে ব্রাত্য। সরকার যে চেষ্টা করছে না এমনটা নয়। নাগরিক দায়দায়িত্ব, বোধবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে সবরকম সামাজিক প্রক্রিয়া যদি আদালতের চাবুক আর সরকারি বাধ্যবাধকতায় হতে থাকে, তাহলে তা আর মানুষের উৎসব থাকে কী? বিশেষত এইসব প্রান্তিক মানুষ? অনলাইন উৎসবের বিনিয়োগকারীরা কী বলছেন?
No comments:
Post a Comment