বন্ধুত্বের মর্মস্পর্শী কাহিনি
সোমা চ্যাটার্জি
মধ্যপ্রদেশের জনহীন মহাসড়কে দুই পরিযায়ী শ্রমিক কোভিডের লকডাউনে ঘরে ফিরছে পায়ে হেঁটে। তাদেরই একজন জ্বরাক্রান্ত, হাঁটার শক্তি নেই, টলে পড়েছে, আকুল হয়ে তাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে অপরজন। পথশ্রমে হতক্লান্ত, অসুস্থ বন্ধুর জন্য গাঁয়ের নির্জলা টিউবওয়েল প্রাণপণে পাম্প করছে সামান্য জলের আশায়। কখনও আদর করে, কখনও ধমক দিয়ে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, কখনও তার অবসন্ন হাতের তালুতে ক্যাম্বিসের ক্রিকেট বল গুঁজে দিয়ে বা মায়ের হাতে বানানো বিরিয়ানির সুগন্ধের অসত্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বোতল থেকে বিন্দু বিন্দু জল ছুঁইয়ে তাকে জীবনে ফিরিয়ে আনার অসাধ্যসাধনের চেষ্টা করছে বন্ধু।
এই সত্য গল্পটিই এক চালচিত্র হয়ে উঠেছে এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও প্রশংসিত কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ভারতীয় ছবি ‘হোমবাউন্ড’এ।
এই ছবি উত্তর ভারতের একটি ছোট গ্রামের দুই বন্ধুর-- ইশান খট্টর (শোয়েব- মুসলিম) এবং বিশাল জেঠওয়া (চন্দন- দলিত)। দুজনেই দরিদ্র ও সমাজের প্রান্তিক মানুষ এবং পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ছবির শুরুতেই দেখা যায়, পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি প্রার্থী হাজার হাজার যুবক-যুবতীর ট্রেন আসার শব্দে রেললাইন পেরিয়ে প্ল্যাটফর্ম বদলানোর প্রাণান্তকর দৌড়। ভিড় কামরায় অগুনতি উৎকণ্ঠিত মুখ, সবাই একই স্বপ্নের সুতোয় বাঁধা। শোয়েব-চন্দনের বন্ধুত্বের উত্থান-পতন সবই কনস্টেবল হওয়ার স্বপ্নে ও বিশ্বাসে আবর্তিত। কারণ, তারা ভাবে যে তাদের পুলিশের ইউনিফর্ম, ধর্ম ও বর্ণের তাদের প্রতিদিনের অপমানের বিরুদ্ধে এক বর্ম হবে। কিন্তু পুলিশের চাকরির পরীক্ষায় পাশ করলেও নিয়োগের উপর কোনও অজ্ঞাত স্থগিতাদেশের জন্য তাদের চাকরি হয় না। অবশেষে পুলিশে চাকরির চিঠি যখন তাদের বাড়িতে এসে পৌঁছয়, চন্দন আর নেই।
এই ছবি আমাদের সামনে প্রতিষ্ঠানের চিরকালীন দৈন্য তুলে ধরে, উন্মোচিত করে সরকারি কাজের দীর্ঘসূত্রিতা ও ঘুণধরা ব্যবস্থার বঞ্চনার ইতিহাস। দলিত চন্দনের মা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী হলেও গ্রামের স্কুলে তার রান্না করা খাবার উচ্চবর্ণের লোকেরা টান মেরে ফেলে দেয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সামনেই। (সহজেই অনুমেয় কেন সেন্সর বোর্ড ছবিটিতে মোট ছ’টি ‘কাট’ প্রস্তাব করেছিল।) উঠে আসে সমাজে জাতপাত, লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি, নতুন বন্ধু সুধা ভারতী (জাহ্নবী কাপুর)'কে নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় দ্বিধাগ্রস্ত চন্দনের হাবেভাবে প্রকাশ পায় অস্বস্তি। প্রতিভাত হয় এই একুশ শতকেও আমাদের দেশের গ্রামে গ্রামে অপমান আর অপ্রাপ্তির চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে বড় হওয়া হরিজন পরিবারের সন্তানের সরকারি চাকরির ফর্মে নিজের ‘দলিত' পরিচয় লিখতে দ্বিধার কথা।
কিন্তু চাকরির ফর্মে নিজেকে 'সাধারণ বিভাগ' উল্লেখ করা চন্দনকে তার পরিবার-- মা (শালিনী ভাটসা) ও বাবা (দধি আর পান্ডে)-- সবসময় স্বপ্ন দেখায় যে তার চাকরির মাধ্যমে তাদের পরিবারের একটি পাকা বাড়ির স্বপ্ন পূরণ হবে; বোন (হর্ষিকা পারমার) বলে, 'সির্ফ তুমকো চুন-নে কা অধিকার মিলা হ্যায়'। তাদের চারজনের দলিত পরিবারে কেবল তারই পছন্দ করার অধিকার রয়েছে। বোঝা যায় যে আজও আমাদের সমাজে পুরুষ হয়ে জন্ম নেওয়া সুবিধা-বঞ্চিতদের মধ্যেও একটি সুবিধা।
শোয়েব এবং চন্দন ছোটবেলার বন্ধু হলেও তাদের মানসিকতা ভিন্ন; শোয়েব আক্রমণাত্মক কিন্তু চন্দন সংযত, তাই পুলিশে চাকরির পরীক্ষায় পাশ-ফেল জনিত কলহ-হাতাহাতির পর তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। হাঁটু ক্ষয়ে যাওয়া ক্র্যাচ অবলম্বনকারী বাবার উপার্জনের অক্ষমতা আর সংসার পালনের দায়িত্ব শোয়েবকে বাধ্য করে কর্পোরেট অফিসে বেয়ারার পদে যোগ দিতে, অন্যদিকে চন্দন যোগ দেয় সুরাতে কাপড় মিলে শ্রমিকের চাকরিতে। কর্পোরেট অফিসে মুসলিম বেয়ারার হাতে ভরা জলের বোতল টেবিলে রাখতে বাধা-দেওয়া ও বসের বাড়ির নৈশভোজে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট যুদ্ধে মুসলিম কর্মচারীকে কেন্দ্র করে ব্যঙ্গক্তি ও টীকা-টিপ্পনী বুঝিয়ে দেয়, এখনও ধর্মীয় বিভাজন সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের মধ্যে কতটা প্রকট। অপমানিত শোয়েব হাজির হয় সুরাতের কাপড় মিলে কর্মরত বন্ধু চন্দনের ডেরায়। কয়েক মাসের ব্যবধানে অভিমানী, অপমানিত ঘাড় গোঁজ করে থাকা শোয়েব সান্ত্বনা দিতে আসা চন্দনকে বারবার ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলেও একসময় আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে চন্দনকে জড়িয়ে ধরে। অসামান্য অভিনয় করেছেন ঈশান এবং বিশাল। দুই বাল্যবন্ধুর সারল্য, খুনসুটি, স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্নভঙ্গ, ঝগড়া-হাতাহাতি এবং তারপরে আবার পরস্পরের কাছে অবলম্বন হয়ে ফিরে যাওয়ার যে নকশিকাঁথা নীরজ বুনেছেন, তা সম্ভব হয়েছে ঈশান-বিশালের অভিনয়ের গুণে।
'হোমবাউন্ড'এর সার্থকতা শুধু তাদের গল্প বা অভিনয়ে সীমাবদ্ধ নয়, সেট নির্মাণের বাস্তবতা, কস্টিউম ও সব কিছুর মধ্যেই বিস্তৃত এবং সঙ্গীতের বিচ্ছিন্ন কিন্তু অনুরণিত ব্যবহার (সুরকার নরেন চন্দভারকর এবং বেনেডিক্ট টেলর) ছবিটিকে সব দিক থেকেই অতুলনীয় করে তুলেছে। দীর্ঘ হাইওয়ের উপর জোরালো সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলোতে উপর থেকে দেখা যায় অজস্র খুদে খুদে পোকামাকড়ের সারি দল বেঁধে চলেছে কোথাও দূরে। ওই পোকামাকড়ের ঝাঁক আসলে মানুষের দঙ্গল। কোভিড লকডাউনের সময় ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকের দল, এক একটা আলোর বৃত্তে তারা দৃশ্যমান। সেলুলয়েডের এই দৃশ্য আমাদের মনে ঝাঁকুনি দেয়। এক ধাক্কায় নিয়ে যায় পাঁচ বছর আগের সেই অবিশ্বাস্য, অসহনীয় কোভিডের দিনগুলোতে যখন আত্মীয়, পরিচিত পড়শির দিকে সবাই তাকাত অবিশ্বাসীর চোখে; সহমর্মিতা-বন্ধুত্ব ছাপিয়ে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে গণসৎকারের চিতায় পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছে নিজেদেরই ঘরের মানুষ, অসহায়তায় একাকী প্রাণ হারাচ্ছেন প্রিয়জনেরা, প্রান্তিক মানুষেরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন, জীবিকা হারাচ্ছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণচিতা জ্বলছে, কেউ তাদের বন্ধু আত্মীয়ের দেহ ফেলে রেখেই পাড়ি দিচ্ছেন বাকি পথ। নীরজের ছবি আমাদের আরও একবার নিয়ে যায় মানবিকতার সেই গভীর সঙ্কটের মুহুর্তে যখন কোভিড-সন্দিগ্ধ গ্রামবাসীরা টিউবওয়েলে জল নেবার সময় তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে।
এই ছবির বীজ বপন হয় কোভিডের সময় তৎকালীন টুইটারে ভেসে আসা মধ্যপ্রদেশের এক হাইওয়ের পাশে মে মাসের রোদে পড়ে-থাকা দুই তরুণের এক ছবিতে; ২০২০ সালে ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এর দিল্লিস্থিত সাংবাদিক বশরত পিরের লেখা একটি খবর থেকে, যার শিরোনাম ছিল ‘টেকিং অমৃত হোম'। দলিত অমৃত কুমার এবং তার বন্ধু মহম্মদ সাইয়ুব'এর উপর প্রকাশিত 'নিউ ইয়র্ক টাইম্স’ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ওই খবরটির স্বত্ব কিনে নেওয়ার পরে যে কাহিনির নাম বদলে গিয়ে হয়েছে ‘আ ফ্রেন্ডশিপ, আ প্যানডেমিক অ্যান্ড আ ডেথ বিসাইড দ্য হাইওয়ে’। সেটাই এই ছবির গল্প। দুজনেই মজুরের কাজ করতেন সুরাতের কাপড়ের মিলে। বাস্তবেও সাইয়ুব অমৃতকে বেওয়ারিশ ছেড়ে যায়নি বরং পুলিশের সহায়তায় তার মৃতদেহ গ্রামে ফিরিয়ে এনে পরিবার-পরিজনের উপস্থিতিতে গ্রামের বাইরেই সৎকার করেছিলেন। ধর্মে হিন্দু এবং জাতে দলিত অমৃত জীবিতাবস্থায় যে সম্মান পাননি তা তিনি পেলেন ভিন্ধর্মের মুসলমান বন্ধুর সৌজন্যে তাঁর মৃত্যুর পর।
এই ছবি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কোভিডের সময় রাষ্ট্রের লকডাউনের মতো হঠকারী সিদ্ধান্তের কথা, যার জন্য হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন বিপন্ন হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে অগুনতি মানুষের, বিনা যানবাহন ও চূড়ান্ত অব্যবস্থার মধ্যে দেশের এক বড় জনসংখ্যার বলি হয়েছে অনাহারে, খাদ্য ও ওষুধ সামগ্রীর অপ্রতুলতায়। কোভিড কালে সরকার যে অপদার্থতার প্রমাণ দিয়েছে, এই ছবি তার জলন্ত উদাহরণ।
২০১৫ সালে নীরজ তৈরি করেছিলেন এক অকল্পনীয় ছবি ‘মসান'। দশ বছর পরে এটি তাঁর কেরিয়ারের দ্বিতীয় পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি। গত ২১ মে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটির প্রদর্শন শেষ হওয়ার পরে দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন ছবিটিকে এবং একটানা হাততালির ঝড় উঠেছে প্রায় দশ মিনিট ধরে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের গিঁটগুলো খুলে অপাপবিদ্ধ বন্ধুত্ব এবং মানবিকতার এক ক্লাসিক ও সরল আখ্যান তৈরি করেছেন পরিচালক নীরজ ঘ্যাওয়ান। আবেগে পরিপূর্ণ হলেও পূর্ণমাত্রার সচেতন শৈল্পিক বিকাশ ঘটেছে ছবিটিতে। এমন অসংখ্য মুহূর্ত আছে যা প্রচণ্ড ক্রোধ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আবার এই ছবি একই সঙ্গে বলে আশাবাদের কথা। প্রচারসর্বস্ব অর্থলোভী এবং অসত্য দুনিয়াতেও গ্রাম্য বাছবিচার, ছোঁয়াছুঁয়ি ঘুচে যায় যখন দিন আনা-দিন খাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকেরা পাশাপাশি বিছানায় ঘুমোয়, একই শয্যা দিন ও রাতের শিফ্টে ভাগাভাগি হয়। দলিত বাড়ির মায়ের পাঠানো আচারের বয়াম নিয়ে কাড়াকাড়ি করে সকলে। সেখানে ধর্ম, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা এক লহমায় ঘুচে যায়। তেমনই কোভিড-জর্জর সময়েও ভীত-সন্ত্রস্ত এবং পলায়নপর দুই আপাত-সন্দেহভাজন আগন্তুকের আঁজলায় স্টিলের জগ হাতে জল ঢেলে দিতে দেখা যায় দেড় হাত ঘোমটা টানা সহানুভূতিশীল গ্রাম্য বধূকে। তাঁর খালি পায়ের ফাটা গোড়ালির দিকে নজর যায় চন্দনের। ঠিক তার মায়ের পায়ের মতো। ছবির শেষে সাদা কাপড়ে বাঁধা চন্দনের মৃতদেহ খাপরার চালের বাড়ির দাওয়ায় রেখে ঘরের ভিতরে শোয়েব দ্বিধাগ্রস্ত হাতে সন্তানহারা মায়ের হাতে তুলে দেয় মৃত বন্ধুর মলিন ব্যাকপ্যাক হাতড়ে পাওয়া নতুন একজোড়া মেয়েদের চপ্পল। ফাটা গোড়ালির বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। শোকে পাথর মূক মায়ের বাঁধ ভাঙা কান্নার দৃশ্যটি নিঃসন্দেহে আলোড়িত করে। হৃদয় দ্রব হয়!
ছোট ছোট এই সব মুহূর্ত রচনা করেছেন পরিচালক নীরজ যা আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষের অসহায়তাকে ধরে এক গভীর অভিঘাতের সৃষ্টি করে। ছবি শেষ হয়েও যেন হয় না। আমাদের পূর্ণবৃত্তের জীবনে ঘরে ফেরার আবহে মানবিক বোধ, অসহায়তা ও নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের এই কোলাজ এক অসামান্য প্রতিচ্ছবি, যা সবাইকে ফিরতে বাধ্য করে কোভিডের অসহনীয় স্বার্থপর মনখারাপের দিনগুলিতে!

ছবিটা দেখতে হবে।
ReplyDeleteYou Tube এ দেখা যাবে কিভাবে ?
ReplyDelete