Tuesday, 25 February 2025

জার্মানির নির্বাচনী ফলাফল

কোন পথে বিশ্ব ও দেশ?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

বিশ্ব আজ এক বিচিত্র অভিসারে চলেছে। গত এক দশকে প্রযুক্তি, রাজনীতি ও অর্থনীতির জগতে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই পরিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল চরম দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির উত্থান। এই উত্থান এখন আর কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতিহাসের বিচারে এ হয়তো এক সাময়িক ঘটনা, কিন্তু এর প্রভাবে বিশ্ব জুড়ে বিদ্বেষ, হানাহানি, ঘৃণা ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে। মনুষ্য পরিবেশ আজ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, যদিচ এর শিকড় বর্তমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত।

প্রশ্ন, কেন এমন হল? কীভাবে এই পরিস্থিতির উদয়?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় এবং জার্মানিতে নাৎসি অনুপ্রাণিত AfD (Alternative für Deutschland) দলের উত্থান (২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত) এই প্রবণতার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ট্রাম্পের বিজয়ের পর জার্মানির সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে AfD দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে যা অভূতপূর্ব। উপরন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের (SPD) এবারে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল হয়েছে। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে ইউরোপ ও বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। যদিও প্রথম স্থানাধিকারী CDU (Christian Democratic Union) এবং তৃতীয় স্থানাধিকারী SPD (Social Democratic Party) মিলে জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনাই প্রবল, কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদী ধরনের শক্তির ক্রমবর্ধমান জনসমর্থন রাজনৈতিক পরিসরে এক তুমুল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

জার্মানির এবারের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ফ্যাসিস্ট AfD’র গতবারের ভোট প্রাপ্তি ১০.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে এবারে ২০.৮ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ও গ্রিন’দের ভোট গতবারে যথাক্রমে প্রাপ্ত ২৫.৭ ও ১৪.৭ শতাংশ থেকে কমে এবারে ১৬.৪ ও ১১.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। CDU একটি দক্ষিণপন্থী দল হলেও তারা ফ্যাসিবাদী নয়, কিছুটা ইংল্যান্ডের কনজার্ভেটিভ দলের মতো; তাদের ভোট শতাংশ অবশ্য এবারে বেড়ে ২৮.৫ শতাংশে পৌঁছেছে (গতবারে যা ছিল ২৪.১ শতাংশ)। মোট ৬৩০ আসন বিশিষ্ট জার্মানির সংসদে CDU (২০৮ আসন) ও SPD (১২০ আসন) মিলে জোট সরকার তৈরি করলে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিশ্চিতি নিয়ে অবশ্য কোনও সংশয় নেই।

তবে বিশ্ব জুড়ে রাজনীতির অঙ্গন যে ক্রমশ তপ্ত হয়ে উঠছে তা স্পষ্ট। ইতালির চরম জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি নিজেকে ট্রাম্প ও মোদির সঙ্গে এক ত্রয়ী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, তাঁদের তিনজনের কথা শুনলেই নাকি বামপন্থীদের রাতের ঘুম উড়ে যায়। অর্থাৎ, বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির একটা ঐক্যবদ্ধ অবয়ব গড়ে ওঠার ইঙ্গিত যেন পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন চরম দক্ষিণপন্থী দল ‘Make Europe Great Again’ (MEGA) স্লোগান দিয়ে স্পেনে সমবেত হয়েছে। এই স্লোগানটি ট্রাম্পের ‘Make America Great Again’এর (MAGA) প্রতিধ্বনি মাত্র। শোনা যায়, আমাদের মোদি সাহেবও নাকি অনুরূপ Make India Great Again’এর (MIGA) শ্লোগান তুলেছেন। MAGA-MEGA-MIGA— সম্ভবত এটাই হতে চলেছে বিভাজনের রাজনীতির বৈশ্বিক অক্ষরেখা। এই দলগুলির মূল উদ্দেশ্য হল, জনগণের মধ্যে কোনও এক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে বিদ্বেষ ও হিংসার রাজনীতি ছড়ানো। ঠিক যেমন হিটলার ইহুদিদের চিরশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তারা অভিবাসন নীতির সর্বোচ্চ বিরোধিতা করে এবং দাবি করে যে, বাইরে থেকে আসা লোকেরা তাদের দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটাচ্ছে। অথচ, এরা কিন্তু এতদিন গরিব দেশ থেকে সস্তার শ্রমিক এনেই নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে।

পরিস্থিতি আজ এইরকম এক অবস্থায় এসে দাঁড়ালো কেন? আসলে, আজকের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে একদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত প্রযুক্তির অবশ্যম্ভাবী ব্যবহার এবং অন্যদিকে মানুষের কাজ হারানো এবং না পাওয়া দ্রুতই প্রধান ধারা হয়ে উঠছে। ফলে, সামগ্রিক বেকারত্ব যেমন বেড়ে চলেছে, তার উপর স্থায়ী কাজেরও কোনও গ্যারান্টি নেই, যা মানুষের মধ্যে অস্থিরতা ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে। এই হতাশাকে কাজে লাগিয়ে উগ্র ধর্ম-জাতি-বর্ণ ভিত্তিক শক্তিসমূহ মুনাফা-তাড়িত অর্থনীতির নিয়মের দিকে আঙুল না তুলে মানুষে মানুষে গোষ্ঠী লড়াই লাগিয়ে দিচ্ছে। তাদের পথই হল, এই বিভেদ ও বিদ্বেষকে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করা।

সাবেক বামপন্থীরা এইসব ক্ষেত্রে বহু অর্থে ব্যর্থ। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতির গতিশীলতাকে না বুঝে পুরনো শ্লোগান ও ভাবনাচিন্তার গোলকধাঁধায় আটকে আছে। ফলে, তারা নতুন কোনও পথের সন্ধান দিতে পারছে না। এই ব্যর্থতা চরমপন্থী শক্তিগুলিকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। যদিও এ তাবৎকালের রাজনৈতিক ব্যাকরণকে অস্বীকার করে নতুন ধারার কিছু ইতিবাচক শক্তির উত্থান হচ্ছে যারা সাবেক বামপন্থার পথানুসারী নয় কিন্তু উগ্র দক্ষিণপন্থার ঘোরতর বিরোধী। নামে কিবা আসে যায়! কোথাও কোথাও এদের নতুন ধারার বামপন্থী শক্তি হিসেবেও কেউ কেউ চিহ্নিত করছেন অথবা নিজেরাও নিজেদের তেমনই বলতে চাইছেন। বরং এই শক্তি কোনও কোনও দেশে ফ্যাসিস্ট দক্ষিণপন্থী উত্থানকে প্রতিহত করতে সক্ষম হচ্ছে – যেমন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে, এমনকি আমাদের দেশের কিছু রাজ্যেও। জার্মানির নির্বাচনেও দেখা গেল, কিছুটা ভিন্নধর্মী বামপন্থী দল Die Linke, যারা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ও বামপন্থায় আস্থা রাখে, তাদের ভোট প্রাপ্তি এবারে বৃদ্ধি পেয়ে ৮.৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে (গতবার যা ছিল ৪.৯ শতাংশ); এবার তাদের মোট আসন প্রাপ্তি ৬৪। অতএব, ফ্যাসিস্টধর্মী দক্ষিণপন্থীদের অগ্রগতিকে রোধ করতে হলে বিরোধী সব ধরনের শক্তিকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত আজকের রাজনৈতিক অর্থনীতির পাঠ নতুনভাবে নিতে হবে। সম্যকভাবে বুঝতে হবে এই অর্থনীতির চরিত্র ও ক্ষমতাকে এবং তদানুসারী রাজনৈতিক পদক্ষেপে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে, যা হবে সম্পূর্ণত নতুন কোনও পথ বা অনুশীলন। আজকাল কিছু কিছু বাম ঘেঁষা মধ্যপন্থী দল বাস্তব রাজনীতির চাপে জনকল্যাণমূলক রাজনীতির পথ নিতে বাধ্য হচ্ছে। এই পথের কার্যকারিতাকে বামপন্থীদেরও নতুন আলোকে বিচার করে দেখতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত অর্থনীতি যদি যথেচ্ছ উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারে, জনকল্যাণের পথে যদি সেই উদ্বৃত্ত থেকে জনতার ন্যূনতম খিদে-তৃষ্ণা মেটে, তাতে অসুবিধা কী? এই সূত্র ধরে যদি বৃহৎ কোনও অর্থনৈতিক কার্যকারণে পৌঁছনো যায়, নতুন একটি অর্থনৈতিক ন্যারেটিভ নির্মাণ সম্ভব হয়, নতুন কোনও সাম্য-ভাবনার উদয় হয়, সেটাই তো নতুন যুগের নতুন কাজ! আমাদের মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদী বিদ্বেষী রাজনীতির রথকে যদি শুধুমাত্র এখনই নয়, দীর্ঘমেয়াদে না থামানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে মানবজাতি এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। ট্রাম্পের মুখে কিন্তু ইতিমধ্যেই গ্রিনল্যান্ড, কানাডা, গাজা ও পানামা খাল দখল সহ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুঙ্কারও শোনা গিয়েছে।

আমাদের দেশেও আমরা একই ধরনের বিপদের দিকে এগোচ্ছি। ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ছড়ানো হচ্ছে। এই রাজনীতির গতিকে যদি এখনই রুদ্ধ না করা যায়, আমাদের সমাজ ধ্বংসের দিকে এগোবে। ধর্মীয় বিভাজন ও বিদ্বেষের রাজনীতি দেশের ঐক্য ও সংহতিকে ধ্বংস করবে।

বলাই বাহুল্য, বিশ্ব জুড়ে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি, বিশেষত ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান একটি জটিল ও উদ্বেগজনক ঘটনা। তা আজকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার ফল। এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের নতুন ভাবে সূত্রায়ন এবং নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। নানা ধরনের বহুমুখি শক্তিকে একত্র হয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও কথাটি সমানভাবে প্রযোজ্য।


Monday, 17 February 2025

'গোটা লোকটাই তো একটা গান'

মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ

প্রবুদ্ধ বাগচী


(২৫ জুন ১৯৪২ - ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)

তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত প্রতুলদার অনেকদিনের বন্ধু সেটা বোধহয় গত শতকের নব্বইয়ের গোড়ার দিক তিনি তখন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের বিপরীতে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সদর দফতরের সব থেকে উঁচুতলায় একটা বড় মাপের ঘরে বসতেন অতবড় অফিস-চেম্বারে অমন ছোটখাটো মানুষটি যেন প্রকাণ্ড আয়তক্ষেত্রের মধ্যে একটা বিন্দু কিন্ত সেই বিন্দুবৎ মানুষটি যে চাইলেই এক বিরাট বৃত্তের পরিধি হয়ে যেতে পারেন সেটা সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিলাম আমুগ্ধ বিস্ময়েপারিব না' এ কথাটি বলিও না আর,/ কেন পারিবে না তাহা ভাব একবারএই চেনা ছড়াটি তিনি আমাদের সামনে বারবার উচ্চারণ করছিলেন, আর অল্পে অল্পে আমরা দেখলাম এক আবেশময় সুরের আবরণে ছেয়ে যাচ্ছে এই উচ্চারণ পরিচিত ছড়া আমাদের দু' জোড়া চোখের সামনে একটা গানের পাখনা মেলে উড়ে গেল এইভাবে কলকাতার মধ্য দুপুরের অফিসপাড়ায় ছড়িয়ে যেতে লাগল সেই আশ্চর্য সঙ্গীতের আবেশ প্রতুলদা এমনই ছড়াকে, কবিতাকে ভাসিয়ে দিতে পারেন সুতীব্র সুরের উড়ালে ম্যাজিশিয়ানের মতো হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে তুলে আনতে পারেন সুরের পুষ্পস্তবক

এই মানুষটার লেখা গান প্রথম শুনি আশির দশকের মাঝামাঝি যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীরা দলেবলে গাইতমুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি,/ সেদিন সুদূর নয় আর--/ দ্যাখো লাল সূর্যের আলোয় লাল/ পূর্ব সমুদ্রের পার’— তখনও সেই অবেলার দিনযাপনে লাল সূর্য আর পূব দিগন্তের একটা অনিবার্য সংযোগ এতটা মর্মান্তিকভাবে ফিকে হয়ে যায়নি খ্যাত গানের দলগণবিষাণ’ তাদের সংকলিত গানের বইয়ের নাম রেখেছিল ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি’। সেই বইয়েই পড়েছি এই গান, তবে গানের গীতিকারকে চেনার কোনও সুযোগ ছিল না এই একই কথা কিন্তু বলেন অনেকেই সত্তর দশকের আগুনে সময়ে তাঁর গান মুখে মুখে ফিরেছে গণসংগ্রামের ঢেউয়ের চুড়োয়, কারখানার গেটে— রাজনৈতিক সমাবেশে গাওয়া হচ্ছে তাঁর সব বিখ্যাত গান কিন্তু মানুষটাকে কেউই চেনেন না কোভিড কালেরেডিও কোয়ারান্টাইনতাঁকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছিল, সেখানে তিনি নিজেও জানিয়েছিলেন এই অভিজ্ঞতা বজবজের শিল্পাঞ্চলে গান করতে গেছেন, ধরেছেন তাঁর চেনা গান আর স্থানীয় মানুষ এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছেন, এ গান আপনার বাঁধা? আমরা তো আপনাকে চিনিই না! শুনেছি,চুঁচড়োর ভূমিপুত্রপ্রতুলের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল চুঁচুড়া-চন্দননগরে— তাঁর নামেই হল ভর্তি হয়ে যেত একসময় তবু দীর্ঘদিন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান বলে কোনও ব্র্যান্ড তৈরি হয়নি সেটা আমাদের জাতির অসভ্যতা

এ হেন মানুষটাকে যেদিন প্রথম মঞ্চে গান গাইতে দেখি সেদিন আমার অভিজ্ঞতা ভাল হয়নি বাংলা আকাদেমির হল সেই অর্থে গানের প্রেক্ষাগৃহ নয় তবু এমনই এক অনুষ্ঠানে সেদিন মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি, আগে-পরে ছিলেন অজিত পান্ডে, ঋষিণ মিত্র সদ্যপ্রয়াত শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরযেতে পারি কিন্তু কেন যাবকবিতার একটা কদর্য সুর করে অজিত সেদিন নিরাশ করেছিলেন আমাদের পাশাপাশি, প্রতুলকে সেই মঞ্চে শুনে আমার তৃপ্তি হয়নি একটুও গান চলাকালীন আরেক গান-পাগল বন্ধু আমায় বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলল, এটা কী হচ্ছে! এমনভাবে হাত-পা নেড়ে কি গান হয় নাকিসত্যি বলতে কি, ওই মুহূর্তে তাঁর বিরাগের সুরে সুর না মিলিয়ে পারিনি তাহলে কি গানের পারফরম্যান্সের থেকে কথাকার ও সুরকার হিসেবেই তাঁর পরিচয় প্রধান?

ঠিক এই প্রশ্নটাই তোলার সুযোগ পেলাম কবীর সুমনের সামনে এই ঘটনার কিছু পরেই কবীর ভুল ভাঙালেন বললেন, আরে ওই গোটা লোকটাই তো একটা গান! প্রতুলদার গান শুধু শোনার নয়, দেখার শরীরের প্রতিটি বিভঙ্গ আর অঙ্গচালনা দিয়ে একেকটা গানকে ধরতে চান তিনি তাঁর গানে প্রিল্যুড-ইন্টারল্যুড সবই তিনি, তাঁর গানে যন্ত্রের কোনও অনুষঙ্গ নিতান্তই অবান্তর এই শারীরিক উপস্থিতি দিয়ে কীভাবে এক খোলা আকাশের নীচে মানুষকে উদ্দীপ্ত করা যায় তার একটা জ্যান্ত প্রদর্শনী দেখার সুযোগ ঘটে গেল বেশ কিছুদিন পরে 

তখন লালগড়ে পুলিশি জুলুম নিয়ে খুব হইচই হচ্ছে, সেখানে তৈরি হয়েছেপুলিশি সন্ত্রাস-বিরোধী জনসাধারণের কমিটি কলকাতার মিডিয়া আর 'সুশীল সমাজ' প্রায়ই যাতায়াত করছেন জঙ্গলমহলে, যাঁদের অনেকেই কোনওকালে সেখানে যাননি বা সেখানকার মানুষের জীবনধারণ নিয়ে আদৌ চিন্তিত হননি ২০০৮-এর মাঝামাঝি কোনও এক সময়ে লালগড় তথা জঙ্গলমহলের আদিবাসী সংগঠনগুলি কলকাতায় সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয় সেই দুপুরে মেট্রো চ্যানেলে জমজমাট ভিড়, রাস্তায় চেয়ার পেতে বসে আছেন সমাবেশের দুই প্রধান সংগঠক অপর্ণা সেন ও শাঁওলি মিত্র আছেন মহাশ্বেতা দেবীতরুণ সান্যাল সহ নানা পরিচিত মুখ যারা সেই সময় সরকার-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত আছেন জঙ্গলমহলের পরিচিত যোদ্ধা ছত্রধর মাহাতো, শিবু সরেন ও আরও কেউ কেউ, রয়েছেন রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা এবং প্রতুল মুখোপাধ্যায় প্রতুলদা থাকবেন আর গান হবে না তা কি হয়গান হল তাঁর নতুন বাঁধা গান, লালগড়ের আন্দোলনকে কেন্দ্রে রেখে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে খোলা রাস্তার ওপর মাইক ব্যবহার হবে কী করে? গোটা শরীর দিয়ে গান ধরলেন তিনি আর এই অধম ছোট্ট একটা ডিজিট্যাল ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ডিং করছিল সেই পারফরম্যান্স সমবেত জনতার শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল সেই সুরের আগুন দুলছিলেন লালমাটির যোদ্ধারা, রিচার্জড হচ্ছিলেন তখনও মেট্রো চ্যানেলে সমাবেশ করার জন্য ছুটে ছুটে আদালতে যেতে হত না আয়োজকদের অনুমতি পেলেও পুলিশ এসে চেন আর গার্ডরেল দিয়ে ঘিরে দিত না সমাবেশস্থল বা সময়সারণি হাতে ধরিয়ে মুচলেকা নিত না, এই সময়সীমায় অনুষ্ঠান শেষ না করলে পানীয় জল বা শৌচাগার বন্ধ করে দেওয়া হবে পথচলতি লোকজন কেউ কেউ নিশ্চয়ই চিত্রাভিনেত্রীর মুখ দেখতে এসেছিলেন সেদিনকিন্তু সবাই তাই নন— তাঁরা গলা মেলাচ্ছিলেন সেই সহজ সুরেরশয়তানিতে প্রতুল এতটাই পারতেন এই ঘটনার অল্প কয়েক মাস পরে সেদিনের মঞ্চে উপস্থিত এক যোদ্ধাকে ঘুমন্ত অবস্থায় যৌথবাহিনী গুলি করে মারে ও লাশ বাঁশে ঝুলিয়ে সাংবাদিকদের সামনে ফটোসেশন করে অকালনিহত সেই তরুণের ঘুমের ভিতরেও কি চারিয়ে গিয়েছিল প্রতুলের গান?

এটা ঠিক, বাংলা আধুনিক গানের যে চলনবলন ছিল তাতে কিছুগণসঙ্গীতজাতীয় গান ছাড়া আলাদা অভিজ্ঞান তৈরিই হয়নি, যতদিন না কবীর সুমন নামক এক ভগীরথ বাংলা গানেসুনামি’ ঘটান প্রতুলের গানের শুরু তার অনেক আগেই তাঁরবোকাবুড়োর পাঁচালিবাদাবানল, জ্বলুক দাবানলকিংবাআমাদের যেতে হবেবাসব মরণ নয় সমানগানগুলো একসময় প্রচুর গীত হয়েছে নানা গানের দলে কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া বা অভিঘাত সীমাবদ্ধ ছিল একটা ছোট রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে এই আবহের বদল ঘটে সুমন-উত্তর জমানায়, কেননা তখন মানুষের মধ্যে একটা নতুন গান শোনার চাহিদা তৈরি হয়েছে এতে অভিমান করার কিছু আছে বলে মনে হয় না, একেক যুগ মুহূর্তে এমন ঘটেই থাকে সেদিক দিয়ে প্রতুলের বৃহত্তর পরিচিতি ঘটতে সময় লেগেছে বেশ কিছু বছর ঠিক সেই সময়টায়, উত্তর-বিশ্বায়ন জমানায়, আলাদা করেগণসঙ্গীতঘরানার গানের আর তেমন প্রাসঙ্গিকতা নেই সম্ভবত প্রতুল সেটা বুঝেছিলেন। তাই শঙ্খ ঘোষ, অরুণ মিত্র বা ব্রেশটের কবিতায় সুরারোপের মধ্যে দিয়ে তিনি খুলে দিতে চাইছিলেন অন্য একটা দিগন্ত বাংলা আধুনিক গান যা ঠিক ততটা আর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উত্তাপে হাত-সেঁকা নয়, এই পর্বে আবার আমি প্রেমে পড়ি প্রতুলের যার উপলক্ষ ছিলবাবরের প্রার্থনা এই গানে কী যে অসামান্য এক কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি, তা একমাত্র তিনিই জানেন একই জাদু পেয়েছি অরুণ মিত্রেরআমি এই বয়সে বলছিকবিতায় সুরারোপের দুঃসাহসে আমাদের স্বরলিপিতে কোমল সুরগুলির মধ্যে একটা পরিব্যাপ্ত হাহাকার আছে— সেই শূন্যতাকে কবিতার বিভাসে ও গানের ললিতে এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া সন্দেহ নেই, এক গভীর মনীষার কাজ কিন্তু যত লোকে তাঁরআমি বাংলায় গান গাইশুনে শুনে হিট করিয়েছেন তাঁরা প্রতুলের অন্য নানা কাজ একটু খুঁজে-পেতে দেখবেন

প্রতুলদার গান শেষ সামনাসামনি শুনেছিলাম ২০১৮'এ, প্রয়াত সন্দীপ দত্ত-র লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির বার্ষিক অনুষ্ঠানে। ওঁকে অনুরোধ করেছিলাম, ‘আমাদের যেতে হবেআরও একবার মঞ্চে গাইতে কথা রেখেছিলেন কিন্তু এটাও ঠিক, একেবারে জীবনের শেষ পর্বে এসে তিনি ঠিক কথা রাখেননি আজীবন যে গভীর আদর্শ ও অবনত জীবনের কথা তিনি বলেছেন গানে, বজায় রেখেছেন নিজের এক স্বতন্ত্র সঞ্চারপথ, কোথাও যেন তাঁর সাম্প্রতিক অবস্থান তাঁকে একটু অচেনা আর ঘোলাটে করে দিচ্ছিল আমাদের কাছে সরকারি খেতাব নেওয়া বা সরকারি মঞ্চে গান গাওয়া শিল্পীর নিজস্ব চয়েস— আসল কথা হল তাঁর অবস্থান, তাঁর প্রতিক্রিয়া এটা আমরা সকলের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা করি না কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই করি; প্রতুল মুখোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন লালগড়ের আমলে যেমন রাজ্যের সবকিছু ঠিকঠিক চলছিল না বলেই তিনি নিজের অবস্থান চিহ্নিত করেছিলেন, ২০১১-উত্তর সময়কালেও কি সব কিছু খুব অনায়াস, স্বাভাবিক, ছন্দোময়? গানে যিনি লিখেছিলেনসেই আলোভরা দিন আনতে হবে’, সেই আলোকের কোন ঝর্নাধারা তিনি দেখতে পেয়েছিলেন এই গ্রস্ত সময়ের ভিতর?

আসলে এসবই একটা মস্ত ফাঁদ প্রতুল গান-স্যালুট পেলেন কিন্তু তাঁর গানের কোনও স্বরলিপি আজও তৈরি হল না তাহলে এর পরে কে তাঁর গান গাইবেন? কেমনভাবে গাইবেন? গানের মানুষের জন্য যারাগান স্যালুটবরাদ্দ করেন এগুলো তাঁরা ভাবেন না, ভাবার কথাও নয় তবে কি এইখানেই ফুরিয়ে গেল তাঁর গানের স্বতন্ত্র ধারাদেখেশুনে মনে পড়ে যায় আরেক মুখুজ্যের কথা জোর করে তাঁরদান-করা দেহ’ ছিনতাই করে চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল না!


Friday, 14 February 2025

‘সমস্তটা ছবি হইয়া চোখে পড়ে’

এই দৃশ্যমালার মধ্যেই 

লুকিয়ে আছে ইতিহাসের এক পাঠ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

নিজের ‘জীবনস্মৃতি’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “জীবনের প্রভাতে যে-সকল শহর এবং মাঠ, নদী এবং পাহাড়ের ভিতর দিয়া চলিতে হইয়াছে, অপরাহ্নে বিশ্রামশালায় প্রবেশের পূর্বে যখন তাহার দিকে ফিরিয়া তাকানো যায়, তখন আসন্ন দিবাবসানের আলোকে সমস্তটা ছবি হইয়া চোখে পড়ে।”

যথার্থই তা ছবি আঁকা, ‘ইতিহাস লেখা নয়’।

তখনও (গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশক) পাঠশালার গণিতের ক্লাসে দশমিক প্রথার চল হয়নি; শতকিয়া, কড়াকিয়া, গন্ডাকিয়া, বুড়িকিয়া ইত্যাদির পর সব শেষে নামতা অভ্যাস ও মুখস্থ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে “আমাদের কোনও উর্বরমস্তিষ্ক পূর্বসূরির সৃষ্ট এবং দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকা কুড়ির সংক্ষিপ্ত নামতা বলতে বলতে আমাদের সোল্লাস যাত্রা হত। ছয় ছত্রের সেই কৌতুকাবহ নামতার ছড়াটি ছিল এইরকম— ‘কুড়ি একে কুড়ি, কুড়ি দু-গুণে মুড়ি, তিন কুড়ি ছোলাভাজা, চার কুড়ি খেতে মজা, পাঁচ কুড়িতে শ, ছ-কুড়িতে নেচে নেচে ঘরের পথে চ।’ গৃহে অপেক্ষমান বৈকালিক জলযোগের ছোলামুড়ির সাদর আহ্বান আমাদের নৃত্যপর অবস্থায় গৃহপ্রত্যাবর্তনে প্রবুদ্ধ করত।” যে শান্ত ও অনাহত বাংলার অংশভাক সে অর্থে বাংলা সাহিত্যে তেমন কোনও চিত্তচাঞ্চল্যের উদ্রেক ঘটাতে পারেনি বলে যেন ইতিউতি আক্ষেপ বিশেষ শুনি, সেই রাঢ় বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে (পশ্চিম বর্ধমানের বালিজুড়ি) বেড়ে ওঠা এক বালক ও কিশোর তার ‘অপরাহ্নে বিশ্রামশালায়’ পৌঁছে এইভাবেই আমাদের সন্ধান দেন অজানা আকরের। আমরা ‘ইতিহাস’ পাই না বটে, কিন্তু এক অত্যাশ্চর্য ছবি আমাদের ইতিহাস-বোধে হানা দেয়। বীরেন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি: রাঢ়বাংলার একটি গ্রামের আত্মকথা’ পড়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আমার তেমনই মনে হল।

আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যে অবিশ্রান্ত শব্দ-তালুকে আমাদের যাপন, যেখানে শব্দ-বাক্যের অনর্গল বিষাক্ত উদ্গীরণ ও জালি বয়ান নির্মাণে সকলেই শুধু স্বঘোষিত কবি, লেখক বা বিশ্লেষক নয়, হন্তারকও বটে, বইমেলায় অর্থহীন ঘোরাঘুরি শেষে খালি হাতেই বাড়ি ফিরি, সেখানে আচম্বিতে কখনও কখনও এমন দুর্লভ কিছু বই হাতে এসে পড়ে! আবডালে থাকা এক অসীমালোক যেন ধীরে ধীরে ধরা দেয়; যেন বলে, এইভাবে কি তুমি জানতে? এইভাবে কি কখনও দেখেছ?

অভিশপ্ত সেই ৪৩’এর মন্বন্তরের সময় বীরেন্দ্রকুমারের বয়স মাত্র দশ। কী সমাহিত ছত্রে তিনি বিধৃত করেছেন সে স্মৃতি: “ভালোবাসার অভাবে নয়, সম্ভবত অন্নের এবং অর্থের অভাবেই প্রায় বিনা চিকিৎসায় বাংলা ১৩৫০ সালের মাঘ মাসে (ইংরেজি ১৯৪৪-এর ফেব্রুয়ারি) সরস্বতী পূজার ছ-দিন পরে ভৈমী একাদশী তিথিতে অপরাহ্ন বেলায় আমার মা চলে গেল তার সাধের সংসার আর ভবিষ্যতের সোনার স্বপ্নের মায়া ত্যাগ করে। একটি প্রায়ান্ধকার কক্ষের জীর্ণ বিছানা ছিল মায়ের শেষশয্যা।” শুধু কি মা? “... মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোটোভাইটিও ক্রমশ শীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। মাতৃহীন এই অবোধ শিশুকে নিজের এই শীর্ণতার বোঝা মাত্র তিন দিন বইতে হয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর চতুর্থ দিনের ভোরে সে মায়ের কাছে চলে গেল। ... তিন মাস পরে বৈশাখের এক প্রত্যুষে মাতৃহীনা অনাদৃতা অবহেলিতা আমাদের ছোটোবোন লুদিও মাত্র পাঁচ বছর বয়সে উদরাময়ে আক্রান্ত হয়ে মা-ভাইয়ের অনুগামিনী হল।” কিন্তু তবুও, জীবন কেন থমকে থাকবে! তা থাকে না, কিন্তু এক অন্তর্লীন বিষাদ কি রয়ে যায় না সারা জীবন? যদি বলি, এ বই রাঢ় বাংলার এক অনাস্বাদিত ছবি, সে বলা সম্পূর্ণ হয় না। এক গভীর বিষণ্ণতাও যেন ছেয়ে থাকে এর পল-অনুপলে। আসলে, বিষাদ ছাড়া তো ইতিহাসের পাঠ অসম্পূর্ণ! ছবিও কি তাই? 

পঞ্চাশ পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’ লিখতে বসেছিলেন, কিন্তু জীবনের প্রথম পঁচিশ বছরের আশেপাশেই সে স্মৃতি ছিল আবদ্ধ। বীরেন্দ্রকুমার সম্ভবত ষাটের মধ্যবর্তীতে এসে ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি’ লিখতে শুরু করেন, কিন্তু তিনিও ওই নিজের কুড়ি বছরের ধারেকাছেই এর ইতি টেনেছেন। মনে হয়, যৌবনের প্রারম্ভে পৌঁছে আত্মকথার ইতি হয়। সমাজের বহমান স্রোতে মিশে গেলে আলাদা করে নিজেকে খুঁজে পাওয়া কিছুটা দুষ্কর। আর স্মৃতির কোটায় বাল্য ও কৈশোরবেলা যতটা স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন থাকে ততটা যেন বড়বেলা ধূসর হয়ে যায়। মান্দারবনি কোলিয়ারিতে দৈনিক এক টাকা চার আনা’র বিনিময়ে চুক্তি ভিত্তিক যে কাজে বীরেন্দ্রকুমার তাঁর উনিশ বছর বয়সে নিয়োজিত হয়েছিলেন, সেখানে কাজে কয়েকদিন দেরিতে আসায় (আর্থিক অনটনের কারণে তাঁকে টিউশনি সহ আরও অন্যান্য কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজে সময় দিতে হত) কোলিয়ারির পাঞ্জাবী ম্যানেজার পাঠক সাহেব তাঁকে একদিন ডেকে হিন্দিতে বলেছিলেন, “... তোমার কোলিয়ারির ডিউটির সময় (আসা-যাওয়ার সময় সহ) কোম্পানির কাছে বিক্রিত। তোমার সান্ধ্য টিউশনের সময় ছাত্রদের কাছে বিক্রিত। তোমার নিজের সময় বলতে শুধু রাত্রের ঘুমোবার সময়টুকু। অতএব পড়ার জন্য সময় বাঁচাতে হলে তোমাকে একমাত্র ঘুমোবার সময় থেকে তা সংগ্রহ করতে হবে। ডিউটির সময় থেকে পাঁচটি মিনিটও নয়।” তারপর লেখক নিজেই লিখেছেন, “শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও বলি, এর পর শুধু ডিউটিতে নয়, জীবনের কোনও কাজে পাঁচ নয়, এক মিনিট দেরিও করিনি কোনোদিন। আমার সাতটা ওই দিন থেকে কখনও ছ-টা বেজে একষট্টি মিনিট হয়নি সারাজীবনে।” এখানে এসে আত্মকথনে ছেদ পড়ে। কারণ, তিনি এবার সততই মিশে গেলেন সমাজের বৃহত্তর স্রোতে। কিন্তু তাঁর বালক-কিশোরবেলার বিস্ময়, পর্যবেক্ষণ, গড়ে ওঠা, চারপাশ তাঁকে নিষ্কৃতি দেবে কেন? 

গ্রামীণ অনুষঙ্গে যাত্রাপালার সরব উপস্থিতি এমনকি আমাদের নিজেদের ছোটবেলার মফস্বল ও প্রান্ত-কলকাতার জীবনেও দেখেছি। গত শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে প্রত্যন্ত রাঢ় বাংলায় তা যে অঙ্গে অঙ্গে মাখামাখি ছিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বীরেন্দ্রকুমারের কাছে তা ছিল প্রাণবায়ু। এই নাট্যপ্রেম ও চর্চা তিনি আজীবন চালিয়ে গেছেন। নিজে সুদক্ষ অভিনেতা ছিলেন। গ্রামীণ পালায় প্রচুর অভিনয় করেছেন। সে সব কথা এ বইয়ে আছে। আসানসোলের বিবি কলেজে আইএসসি পড়ার সময় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সহপাঠী ছিলেন, যিনি সে সময়েও চুটিয়ে নাটক করেছেন কিন্তু দুজনের মধ্যে তেমন সখ্য গড়ে ওঠেনি। তবে কলেজে ছাত্র অজিতেশের নাটক দেখে আপ্লুত এক মাস্টারমশাই তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যদি ভবিষ্যতে বড় নাট্যকার হন তবে তাঁকে যেন গ্রিনরুমের ভেতরটা দেখিয়ে আনেন। বীরেন্দ্রকুমারের ভাষায়, “কৌতুকচ্ছলেই সানন্দে প্রতিশ্রুতি দেয় অজিত। স্যারের এই কল্পনা রূপায়িত হয়েছিল কি না আমার জানা নেই। তবে এটিকে বিষয় করে আমি ‘গ্রিনরুম’ নামের একটি নাটিকা লিখে, পাণ্ডুলিপিটি অজিতেশকে উৎসর্গ করেছিলাম পরবর্তীকালে।”

রাঢ় বাংলার এই তথাকথিত নিস্তরঙ্গ জীবনে ১৯৪৭’এর ১৫ অগস্ট আসে। তখন বীরেন্দ্রকুমারের বয়স মাত্র চোদ্দ। লিখছেন, “স্বাধীনতা দিবসে তো এক দিনের ছুটি হয়। প্রথম বছর বোধ হয় আনন্দাতিশয্যের প্রাবল্যে বিদ্যালয়ে (অন্তত আমাদের বিদ্যালয়ে) ছিল দশ দিনের ছুটি।” কিন্তু ওই ১৫ অগস্টই সকালবেলায় ‘পতাকা অভিবাদন পর্বটুকু করে’ একদল ছাত্রের “সমবেত সিদ্ধান্ত হল— এই নিদারুণ অপমানের একমাত্র প্রতিষেধক হাঙ্গার স্ট্রাইক।” কেন? স্বাধীনতার প্রত্যুষে কীসের ‘নিদারুণ অপমান’? সে ছেলেমানুষী কাহিনি পড়ে নিতে হবে গ্রন্থটিতে।

আমার ছেলেবেলায় এমন কিছু আত্মীয়বাড়িতে গিয়েছি যেখানে সন্ধ্যের পর কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে কাজকর্ম সারা হত। কুপি থেকে নির্গত কেরোসিনের গন্ধ বহুদিন নাকে লেগে থাকত। সেই আধো আলো-আঁধারিতে বাড়ির সকলেই কেমন জানি বেশি করে আপন হয়ে উঠতেন। মা-মাসি, দিদিমাদের গল্পে যেন এক অকুতোভয় স্বপ্নপুরী তৈরি হত। মনে পড়বে, ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে ইন্দির ঠাকুরণের রাক্ষসের গল্প বলার সময়ে দেয়ালে ছায়া পড়ার দৃশ্যের কথা। ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি’তে সেই অম্লান স্বপ্নপুরীকে যেন নতুন করে ফিরে পেলাম। যখন বালক বীরেন্দ্রকুমারের মা তাকে জিজ্ঞেস করেন, “ঠিক পরীক্ষাকালীন সময়টাতে ছেলেরা এত পড়ে কেন? পরীক্ষার দিনগুলিতে যদি জীবন-মরণ পণ করে পড়া করতে হবে, তবে সারাবছর পড়াশোনা করল কীসের জন্য?” প্রথমে কথাটিকে খানিক অবান্তর মনে হলেও পরে এটিই তাঁর মাথায় গেঁথে যায় এবং তিনি যতদিন পরীক্ষা দিয়েছেন সেই দিনগুলিতে আর কখনও পড়েননি। ম্যাট্রিকের অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন এক সিনিয়র দাদার কাছে সন্ধ্যেবেলায় গেলে তিনি ভেবেছিলেন আটকে যাওয়া কোনও অঙ্ক এই কিশোর ওনাকে দিয়ে করিয়ে নিতে এসেছে; কিন্তু তা না করে সবিনয়ে তাঁর কাছে গল্পের বই চাইলে তিনি হতচকিত হয়ে যান।

কিছু কিছু জায়গায় বাক্যের জ্যোতি এতই আলোকময় যে, ছবির মতো তা পর পর দৃশ্য রচনা করে চলে। এত খুঁটিনাটি তার বর্ণনা যে পাঠক সচকিতে অনুভব করবেন তাঁর নিজ উপস্থিতি। এই দৃশ্যমালার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক ইতিহাসের পাঠ। এক অজানা বোধও।

পায়ে পায়ে পাঁচালি: রাঢ়বাংলার একটি গ্রামের আত্মকথা। বীরেন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। দীপ প্রকাশন। জানুয়ারি ২০২৫। ২৭৫ টাকা।

 

Thursday, 13 February 2025

ফ্রি ফ্রি ফ্রি

কেনাকাটার সত্যি-মিথ্যে

অমিতাভ গুহ সরকার



প্রতি বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর দেশ জুড়ে চলে নানা উৎসব। মরশুমের গোড়ায় একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো আর প্রতিবারই রাস্তায় মানুষের ঢল নামে কয়েক দিন আগে থেকেই। পুজো যতটা না ধর্মীয় অনুষ্ঠান তার থেকে অনেক বেশি সামাজিক, কলাকাজ এবং ব্যবসায়িক কাজকর্মে থাকে ঠাসা। পুজো মানেই দেদার কেনাকাটা। আর এই কেনাকাটা শুরু হয়ে যায় মাস দুয়েক আগে থেকেই। নানা ধরনের পসরা সাজিয়ে ব্যবসায়ীরাও বাজারে হাজির হন যথাসময়ে। পুজো শুরু হওয়ার আগে থেকেই মাঝারি থেকে বড় শহরগুলি ঢাকা পড়ে ঢাউস বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপনে ঠাসা কয়েকটি পাতা ওল্টানোর পর হদিশ পাওয়া যায় খবরের কাগজের প্রথম পাতার। অনেক বিজ্ঞাপনেই থাকে ছাড়ের বন্যা। একটি কিনলে আরেকটি বিনামূল্যে। কখনও আবার দুটি। এছাড়া বিভিন্ন পণ্যে থাকে দেদার ছাড়। ৮০ শতাংশ বা তার কিছু কম বেশি ছাড়ের হাতছানিও এই বাজারে বিরল নয়। এই ছাড় যেন এখন আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। শুধু দুর্গাপুজোতেই নয়, ছাড় পাওয়া যায় ধনতেরাস, দেওয়ালি, ভাইফোঁটা, ঈদ, বড়দিন, নতুন বছর, ১৫ অগস্ট ইত্যাদির মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। চৈত্র সেল তো বাঙালির জীবনে একটি উৎসব।

মোটা ছাড় পেয়ে জিনিস কিনে অনেকেই বেশ খুশি হন। আবার অনেকে ধন্ধে পড়েন, সস্তায় কিনে ঠকলাম না তো?

কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি জিনিস কিনে বিনামূল্যে আরেকটি পাওয়ার ফাঁদে পড়ে দুটোরই গুণগত মান নিয়ে পরে কিছুটা অসন্তুষ্টি থেকে যায়। ছাড় দেওয়া অনেক পণ্যে আবার বিক্রির পর কোনও পরিষেবা অথবা ‘ওয়ারেন্টি’দেওয়া হয় না। একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, এই মাগ্গি গণ্ডার বাজারে একদম বিনামূল্যে কিংবা মোটা ছাড়ে সত্যিই কি কোনও পণ্য বিক্রি করা সম্ভব? আসলে, ব্যবসার জগতে 'ফ্রি' বলে কিছু হয় না। ব্যবসা কোনও দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। সব কিছুরই কোনও না কোনও মূল্য আছে। সোজা অথবা বাঁকা পথে ক্রেতাকেই এই মূল্য চোকাতে হয়। অনেক সময়ে হোটেলে ঘর নেওয়ার সময়ে বলা হয় ‘ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি', অর্থাৎ, তার জন্যে কোনও দাম দিতে হবে না। সত্যিই কি তাই? আসলে ঘরের দামের মধ্যেই সেঁধিয়ে থাকে প্রাতরাশ বাবদ খরচ। এই কারণে অনেক ক্ষেত্রে বিনা প্রাতরাশে ঘর নিলে দাম কিছুটা কম হয়।

মোটা ছাড় দেওয়ার রেওয়াজ আছে সোনা হীরের গয়নাতেও। না, গয়নাতে নয় তার মজুরিতে। এই ছাড় দেওয়া হয় বিশেষ কিছু দিনকে কেন্দ্র করে এবং বিয়ের মরশুমে। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, হীরে বসানো গয়নাতে অনেক ক্ষেত্রে পুরো মজুরিটাই মুকুব করা হয়। আসলে, সোনার দাম যতটা স্বচ্ছ হীরের ক্ষেত্রে তা ততটা নয়। হীরে কতটা খাঁটি তা যাচাই করাও সহজ কাজ নয়। অর্থাৎ, দাম বাড়িয়ে ছাড় দিলে তা ধরার উপায় নেই। মজুরি মকুব করা হচ্ছে তার মানে এই নয় যে কারিগর কোনও পারিশ্রমিক পাচ্ছে না। 

ভারত এখন দ্রুত হাঁটছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়ার’ পথে। লাফিয়ে বাড়ছে ই-বাজারে কেনাকাটা। রমরমিয়ে বাড়ছে অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টের মতো কোম্পানির ব্যবসা। ডিসকাউন্টের ছড়াছড়ি ই-বাজারেও। নেট খুললেই বিজ্ঞাপনের উপদ্রব। পণ্যের ছবির নীচে তার দাম লিখে কেটে দেওয়া থাকবে। তার নীচে থাকবে আরেকটি দাম যা কেটে দেওয়া দামের তুলনায় অনেকটা কম। পাশে থাকবে আপনি কতটা ছাড় পাচ্ছেন তার শতাংশ। বাজারে যাচাই করলে দেখা যাবে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রকৃত দাম আরও কম। তাছাড়া অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে ছবিতে যে পণ্য অথবা যে রঙ দেখানো হয়, পণ্যটি বাড়িতে পৌঁছনোর পর দেখা যায় তা ঠিকঠাক মিলছে না। নানা অভিযোগ থাকলেও তরুণ প্রজন্ম এই বাজারেই সওদা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

অনেক ব্যাগ-স্যুটকেসের দোকানে ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ ছাড়ের বোর্ড সারা বছরই ঝুলতে দেখা যায়।  এক চশমার দোকানে এক বোর্ড দেখা গেল যেখানে লেখা আছে ‘বিনামূল্যে চশমার ফ্রেম পাওয়া যায়’। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ৪০০০ টাকা দামের একটি বিশেষ লেন্স কিনলে তবেই একটি ফ্রেম বিনামূল্যে পাওয়া যাবে। অনেক ক্ষেত্রে ছাড়ের শর্ত এত ছোট অক্ষরে লেখা থাকে তা খালি চোখে পড়া একরকম দুষ্কর। তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে গাড়ি এবং মোটরবাইকের ক্রেতা টানতে কোনও কোনও মরশুমে দেদার ছাড় দিতে দেখা যায়। একইভাবে মাঝে মধ্যে অস্বাভাবিক ছাড় মেলে টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভের মতো মেয়াদি ভোগ্যপণ্যে। চারদিকে এত ছাড়ের কচকচানিতে ক্রেতা বেচারি বুঝতেই পারে না কোনটা ন্যায্য দাম। একটা জিনিস কিনে সে জিতল না ঠকল।

গত এক দশকে ভালই জনপ্রিয় হয়েছে 'ভ্যালেন্টাইনস ডে'। ভালোবাসার এই বিশেষ দিনটিকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে কেনাকাটাও। সঙ্গে থাকে নানারকম ছাড়ের প্রলোভন। সম্প্রতি আমদানি হয়েছে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ নামে আরও একটি কেনাকাটার বিশেষ দিন। আমেরিকায় ধন্যবাদ দেওয়ার (থ্যাঙ্কস গিভিং) দিনের পরের শুক্রবারকে ও দেশে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলা হয়। এই দিনটিতে চলে দেদার কেনাকাটা। চলে পরের সোমবার পর্যন্ত, যা ‘সাইবার মানডে’ বলে আমেরিকায় পরিচিত। এই ব্ল্যাক ফ্রাইডের কেনাকাটার হুজুগ চালু হয়ে গিয়েছে ভারতেও। দেশের কয়েকটি নামী ব্র্যান্ডের কথায়, এই তিন চার-দিনে অন্য সপ্তাহের তুলনায় তাদের বিক্রি অনেকটাই বাড়ে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে থেকেই শুরু হয়ে যায় ক্রিসমাসের কেনাকাটা। চলে ছাড়ের যুদ্ধ।

ছাড় নিয়ে মানুষ সব থেকে ধন্ধে ওষুধ কেনার ব্যাপারে। বছর দশেক আগেও ওষুধে কোনও ছাড় পাওয়া যেত না। পরে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে খুলতে শুরু করল ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান। বেশ খানিকটা কম দামে এখানে বিভিন্ন রকমের ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম পাওয়া যায়। এরপরেই দোকানে দোকানে ডিসকাউন্ট দেওয়া শুরু হল। প্রথম দিকে তা ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরের দিকে তা ক্রমশ লাগামছাড়া হতে শুরু করল। তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হল বিভিন্ন ওষুধ বিক্রেতার মধ্যে। ছাড় বাড়তে বাড়তে পৌঁছে গেল ৩০ শতাংশে। এখানেই শেষ নয়। কিছুদিন আগে এক বড় ওষুধ বিক্রেতার দোকানের সামনে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের বোর্ড ক্রেতাদের নজর কেড়েছে। এর ঢাউস বিজ্ঞাপন এসেছে খবরের কাগজেও। এতটা ছাড় কী করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে তার যুক্তিও অবশ্য দেওয়া হয়েছে। ওষুধে বিভিন্ন ধরনের ছাড়ে একদিকে যেমন অনেকটাই সাশ্রয় হচ্ছে অন্যদিকে তেমন কিছু মানুষ সন্দিহান হয়ে পড়ছেন। অনেকের মনে প্রশ্ন, এত ছাড়ে যে সব ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে তার গুণগত মান ঠিক আছে তো? অসুখ সারবে তো? খোলা বাজারে ওষুধে এই মাত্রাহীন ছাড় পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমে কিন্তু কোনও ছাড়ই দেওয়া হয় না। রোগীর আত্মীয়দের থেকে ওষুধের গায়ে ছাপা দামের পুরোটাই আদায় করা হয়। একদিকে মাত্রাহীন ছাড় এবং অন্যদিকে ছাড়হীন বিলে সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ।

আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী ওষুধ সহ প্যাকেটজাত এবং বোতলবন্দি বিভিন্ন খুচরো পণ্যের গায়ে তার বিক্রির সর্বাধিক দাম (এমআরপি) লিখতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, সে দাম যদি এতটাই বাড়িয়ে লেখা হয় যেখানে ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি ছাড় দেওয়া সম্ভব হয় তবে তাতে ক্রেতার কোন উপকার হয়? এসব ক্ষেত্রে একই জিনিসের দাম বিভিন্ন দোকানে বিভিন্ন রকম হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকবে। ফলে, অনেক ক্ষেত্রেই এক শ্রেণির ক্রেতারা ঠকবেন। সরকারের ক্রেতা সুরক্ষা দফতর এই ব্যাপারটি একটু তলিয়ে দেখলে ভাল হয়। অনেকেই মনে করেন, দরদামের সুযোগ যেখানে যত বেশি সেখানে ঠকার সম্ভাবনাও তত বেশি। এই কারণে ‘এক দাম’ বোর্ড লাগানো দোকানে কেনাকাটা করতে অনেকে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। পণ্যের, বিশেষ করে ওষুধের মতো অত্যাবশ্যক পণ্যের দামে অনেক বেশি স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। সঠিক দাম সবার জানার অধিকার আছে। এর জন্যে প্রয়োজন হলে আইনের পরিবর্তন করতে হবে।

ডিসকাউন্ট দিয়ে ক্রেতাকে প্রলুব্ধ করা এবং তা দেখে কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়া বা না পড়া আসলে একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা (মাইন্ড গেম)। অনেক ক্ষেত্রেই ডিসকাউন্ট পাওয়ার জন্যে একটি ছোট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। লক্ষ্য, ক্রেতার উপর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা। অনেকেই এই চাপ এড়িয়ে খোলা মনে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এইভাবে কিছু ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা হয়ে যায়। ক্রেতাদের পণ্য কেনার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা এবং ব্যবহার (কনজ্যুমার বিহেভিয়ার) নিয়ে অনেক ভোগ্যপণ্য নির্মাণকারী সংস্থা  নিয়মিত সমীক্ষা চালায়। যাঁদের বেশি উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে তাঁদেরই অনেকে ক্ষুরধার বিজ্ঞাপন এবং ছাড়ের ফাঁদে পা দিয়ে থাকেন। 

অনেক পণ্য বিক্রেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকে। এতে ক্রেতাদের লাভ হওয়ার কথা। প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকতে পণ্যের উৎকর্ষতা বাড়াতে হয়, দামও রাখতে হয় ক্রেতার সাধ্যের মধ্যে। তা না করে কোনও কোনও বিক্রেতা অসাধু পথে পা বাড়ান। এর শিকার হয় ক্রেতা সমাজের একাংশ। বার বার ঠকে সামগ্রিকভাবে বিক্রেতাদের সম্পর্কে আমাদের মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে পারে যেটা বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের দেশে ক্রেতা সুরক্ষা আইন আছে। সেখানে অভিযোগ জানালে অনেক ক্ষেত্রে কাজও হয়। তবে বহু মানুষের কাছে এই প্রক্রিয়াটা অজানা থাকায় অথবা তাঁদের অনীহার কারণে ঠকা সত্তেও অভিযোগ জমা পড়ে না। মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারটি নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো আশু প্রয়োজন।


Tuesday, 11 February 2025

ডেমোক্লিসের তরবারি

এক অসম যুদ্ধের পরিণতি

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

দিল্লি নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ পেতেই জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী এবং ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম নেতা ওমর আবদুল্লা এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট দিয়েছেন: ‘অউর লড়ো আপস মে’। দেখাই গেল, সাম্প্রতিক হরিয়ানা ও দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম দুই মুখ্য শরিক আপ ও কংগ্রেসের মধ্যে ন্যূনতম কোনও আসন সমঝোতা তো হয়ইনি, উপরন্তু, পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছে এবং দুই রাজ্যেই বেশ ভালোরকম ভাবে পরাজিত হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের বিধানসভা নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। তাহলে ইন্ডিয়া জোটটা তৈরি হল কেন? ওমর আবদুল্লার পোস্টে তেমনই যেন এক প্রশ্ন লুকিয়ে।

দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল, অন্তত ১৪টি বিজেপির জেতা আসনে তাদের জয়ের মার্জিন থেকে কংগ্রেস বেশি ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ, কংগ্রেস ও আপ’এর প্রাপ্ত ভোট বিজেপির থেকে বেশি। এই হিসেব দিয়ে কেউ কেউ বলছেন, যদি কংগ্রেস ও আপ’এর মধ্যে প্রাক-নির্বাচনী সমঝোতা হত, তাহলে বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে তেমন সমঝোতা করেও তো একটি আসনেও কংগ্রেস বা আপ জিততে পারেনি! বুঝতে হবে, জোটের ভোটে পাটিগণিতের হিসেব কাজ করে না; তা এমন এক রসায়ন, প্রত্যক্ষ রাজনীতির প্রবহমানতাতেই এর অনুশীলন। তাই, কংগ্রেস-আপ জোট হলেই এই নির্বাচন যে জেতা যেত তেমন কোনও নিশ্চয়তা যেমন দেওয়া যায় না, তেমনই আপ হয়তো একা লড়েও জিততে পারত। আসলে, আপ ও কংগ্রেসের মধ্যে এতটাই রেষারেষি যে, যদি জোট হত তাহলে হয়তো দু’ দলের পুরো ভোট পরস্পরের বাক্সে না পড়ে বিজেপির ডালিতেও যেতে পারত। লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে কতকটা তেমনই হয়েছে; যা আমরা পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ও কংগ্রেস জোটের মধ্যে দেখি। বরং বলা ভাল, এই অসম নির্বাচনী লড়াইটা হয়েছে এক অমিত শক্তিধারী কেন্দ্র’র সঙ্গে এক অর্ধ-রাজ্যের, যে রাজ্যকে গত ২-৩ বছর ধরে নানা অজুহাত ও ধমকি দিয়ে প্রায় অকেজো করে ফেলা হয়েছিল।

দিল্লিতে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে (লেফট্যান্যান্ট গভর্নর না রাজ্য সরকার)— এই সংক্রান্ত একটি মামলায় তা নির্বাচিত সরকারের ওপরেই ন্যস্ত বলে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নস্যাৎ করতে কেন্দ্র থেকে প্রথমে অর্ডিন্যান্স ও পরে একটি আইন পাস করা হয়— The Government of National Capital Territory of Delhi (Amendment) Act 2023 বা GNCTD Act। এই আইনের বলে দিল্লির লেফট্যান্যান্ট গভর্নরকে (এলজি) যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয় রাজ্য সরকারের ওপর খবরদারি করার জন্য। বলা হয়, রাজ্য সরকারের সমস্ত কাজকে এলজি’র অনুমোদন নিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। অনতিবিলম্বেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গুজরাতের বিজেপি নেতা বিনয় কুমার সাক্সেনাকে এলজি পদে নিয়োগ করে। এই লোকটি তাঁর চেয়ারে বসেই আপ সরকারের অগণিত কার্যক্রমের ওপর তদন্তের নির্দেশ দেন এবং খুব সুচতুরভাবে জনপ্রিয় মহল্লা ক্লিনিকের ওপরে তাঁর প্রথম আক্রমণ নামিয়ে আনেন। এই আইনের বলে প্রতি পদে এলজি কেজরিওয়াল সরকারকে প্রায়-অথর্ব করে ফেলে। এমনকি দিল্লির পুরসভাকেও এই আইনের অধীনে এনে নাগরিক পরিষেবা থেকে জরুরি কাজকর্ম সব কিছুকে ধীরে ধীরে শ্লথ ও ক্রমেই অচল করে দেওয়া শুরু হয়। রাজ্যের প্রায় সমস্ত কাজকর্ম স্তব্ধ হয়ে যায়। এই স্তব্ধতা আসলে ছিল দিল্লিবাসীর মাথায় বন্দুক ধরে এই বার্তাটিই দেওয়া যে, আপ’কে তাড়াও না হলে সব নরক গুলজার করে দেব; তার সঙ্গে আপ’এর নেতাদের ওপর ইডি ও সিবিআই’এর জোড়া হানা। বলাই বাহুল্য, GNCTD আইন আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করার প্রথম প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ।

তবে এটাও ঘটনা, আপ সরকারের কিছু কিছু পদক্ষেপে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছিল। বিশেষ করে সরকারি টাকায় বিলাসবহুল মুখ্যমন্ত্রীর গৃহ (শিস মহল) নির্মাণ কেজরিওয়ালের মাফলার-ভাবমূর্তির কিছুটা হলেও ক্ষতি করেছে। তবে অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা যে বিপুল বিলাসব্যসনে নিজেদের আপ্যায়িত রাখেন সে তুলনায় এই ঘটনাটি নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু গোদি মিডিয়া ও বিজেপির চিল-চীৎকারে এই অপব্যয়কে এক তুঙ্গ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার উপর একে একে শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন জেলবন্দী করে রাখা সরকার ও দলের পক্ষে প্রভূত ক্ষতিকারক হয়েছে। শীর্ষ আদালতও বহুবার এ ব্যাপারে তদন্ত এজেন্সিগুলোকে তুমুল ভর্ৎসনা করেছে। কিন্তু দানবীয় পিএমএলএ এমনই এক আইন যেখানে জামিন পাওয়াটা শবরীর প্রতীক্ষার চেয়েও দীর্ঘ। এছাড়াও, কেন্দ্রীয় বাজেটে ১২ লাখ টাকা অবধি করমুক্তি ও এলাহী বিহার প্যাকেজ, অষ্টম বেতন কমিশনের ঘোষণা, নানারকম সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প (যেগুলোকে বিজেপি এতদিন ‘রেউড়ি’ বলে কটাক্ষ করেছে) ইত্যাদি মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশ ও পূর্বাঞ্চলীয় মানুষজনকে (মূলত বিহারী) প্রভাবিত করেছে। ফলে, ভোটের শতকরা হিসেবে ২০২০ সালে আপ’এর প্রাপ্ত ভোট এবারে ১০ শতাংশ নেমে গেছে; যদিও এত কাণ্ডের পরেও শেষাবধি বিজেপি ও আপ’এর ভোটের ফারাক কিন্তু দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ শতাংশে।

এবারের ভোটে আরও একটি কৌশল বিজেপি কাজে লাগিয়েছে-- হিন্দুত্বের রাজনীতির চেয়ে কেজরিওয়ালের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প রাজনীতির গুরুমারা বিদ্যার প্রয়োগ। ওদিকে কংগ্রেসের একটাই ক্লিশে বাণ— জাতপাতের সেনসাস ও সংবিধান বাঁচানোর আহ্বান— যে অতি ব্যবহারে ইতিমধ্যেই ভোঁতা হয়ে গেছে তা কে বালক রাহুলকে বোঝাবে! তবে কংগ্রেস খুব খুশি আপ’এর পরাজয়ে। অবশ্য এ কথা ক্রমশ প্রকাশ্য যে, টাকাপয়সা দিয়ে এমএলএ কেনাবেচা ও রাজ্যপাল মারফত বিরোধী রাজ্য সরকারগুলিকে হেনস্থা করার পাশাপাশি বিজেপি এখন ভোটার লিস্টে মূলত অনলাইনে রাতারাতি লক্ষ লক্ষ ভুয়ো নাম অথবা অন্য রাজ্যের দলীয় ভোটারদের নাম ঢুকিয়ে এক নতুন ধরনের কারচুপি বা রিগিং ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। মহারাষ্ট্র থেকে এর সূত্রপাত, দিল্লিতেও তা ব্যাপক ভাবে কার্যকর করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এই অভিযোগের জবাবে নির্বাচন কমিশন অদ্ভুত ভাবে নীরব। কিন্তু এই ঘটনা যদি সত্যি হয় তবে তা নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের ন্যূনতম উপাদানগুলিকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।    

আশ্চর্যের বিষয় হল, GNCTD আইন নিয়ে ইন্ডিয়া জোট তো দূর অস্ত, কোনও বিরোধী দলও সেভাবে সোচ্চার হয়নি। যেন, বিষয়টা কেজরিওয়ালের মাথাব্যথা, অতএব তিনি বুঝে নিন। ঠিক যেমন, পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদান যে বেশ কিছু বছর ধরে বন্ধ, সে ব্যাপারে তৃণমূল ছাড়া ইন্ডিয়া জোটের বাকী দলগুলির কোনও হেলদোল নেই। বরং, কেউ কেউ বিজেপির সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে বলতে থেকেছে, চুরি হয়েছে তাই বন্ধ করেছে, ভালই করেছে। ফলে, ইন্ডিয়া জোট কার্যত ভেস্তে গিয়েছে। দীর্ঘদিন এই জোটের কোনও বৈঠক নেই। আঞ্চলিক দলগুলি নিজ শক্তির জোরে, কোথাও কোথাও স্থানীয় স্তরে জোট করে বিজেপির আগুয়ান ফ্যাসিবাদ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংসের পরিকল্পিত কার্যক্রমকে মোকাবিলার চেষ্টা করে চলেছে। লড়াইটা দিনে দিনে আরও দুরূহ হয়ে উঠলেও হয়তো আশার দিকও কিছু কিছু আছে।

এবার আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের পালা। বিহারে ইতিমধ্যেই এক মহাগঠবন্ধন মোটামুটি পাকাপোক্ত ভাবে বেশ কয়েক বছর ধরে অটুট আছে। এই মোর্চায় আরজেডি’র পাশাপাশি সিপিআই(এমএল) লিবারেশন’এর ভূমিকা সমুজ্জ্বল। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরেই লিবারেশন’এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, এই মহাগঠবন্ধন ‘ভিআইপি’ দলের যোগদানে আগামী নির্বাচনে বিজেপি’কে হারাতে আরও মজবুত ও উদ্দীপ্ত হয়েছে। আগামী ২ মার্চ পাটনার গান্ধী ময়দানে #বদলোবিহারমহাজুতন’ (বিহারকে বদলাতে জোটবদ্ধ হও) ডাক দিয়ে এক ঐতিহাসিক ও বিশাল জনসমাবেশ হতে চলেছে। দেখা যাক, তা কোনও কার্যকরী দিশারী হয়ে উঠতে পারে কিনা। তবে পশ্চিমবঙ্গে তেমন কোনও জোটের আশা আছে কিনা জানি না, কিন্তু কংগ্রেস ও তৃণমূল যদি ইন্ডিয়া জোট হিসেবে একত্রে লড়ে তবে মালদহ ও মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস কিছু আসন পেতে পারে শুধু তাই নয়, বিজেপি এই দুটি জেলায় পাওয়া আসন হারাতেও পারে।

শুধু আপ দল বা তাদের সরকার নয়, গোটা দিল্লিবাসীর মাথার ওপর এবার রাখা ছিল ‘ডেমোক্লিসের তরবারি’। GNCTD আইন দিয়ে দিল্লি সরকারকে পঙ্গু করে দিল্লিবাসীদের এমনভাবে জর্জরিত করে ফেলা হয়েছিল যে, যদি না তারা আপ’কে গদিচ্যুত করে, তাদের নিত্য জীবনকে আরও তছনছ করে দেওয়ার বার্তা তাতে সুপ্ত ছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশ যারা আপ’এর ভোটার, তারা শঙ্কিত হয়ে পড়ে, এই লাগাতার অসহ্য অব্যবস্থার মুখে তারা নিজেদের দৈনন্দিনতাকে বাজি রাখতে রাজী ছিল না। তাদের শ্রেণি অবস্থান বিজেপির পক্ষ নেয়। সব মিলিয়ে, এই সামগ্রিক ফ্যাসিবাদী আইনি আক্রমণকে আপ মোকাবিলা করে উঠতে পারেনি। মনে রাখতে হবে, দিল্লিকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা না দিলে ‘ডেমোক্লিসের তরবারি’ থেকে দিল্লিবাসীর মুক্তি নেই, যা অন্যান্য বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির ওপরেও নানা আইনি আঙ্গিকে নেমে আসছে।

           

Saturday, 8 February 2025

বন্ধু 'Dolan' যখন শিকল পরায়

অস্ত্র কেনার চাপ?

কল্যাণ সেনগুপ্ত



আশাকরি কেউ ভোলেননি, অতীতে আমেরিকা সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের সমাবেশে ট্রাম্পের হয়ে শ্লোগান তুলেছিলেন-- 'অব কি বার ট্রাম্প সরকার'। কোনও একজন রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে এভাবে  অপর একটি রাষ্ট্রের নির্বাচন প্রার্থীর হয়ে খোলাখুলি প্রচার করা, সম্ভবত নজিরবিহীন। কিন্তু তিনি নরেন্দ্র মোদী, কোনও ছেদো যুক্তির ধার তিনি ধারেন না। তিনি তাঁর বন্ধু ট্রাম্পের জন্য প্রচার করবেন, এটাই স্বাভাবিক। সেখানে প্রোটোকল বা আইনি বিধিনিষেধের তিনি পরোয়া করারও প্রয়োজন মনে করেন না। যদিও এত কাণ্ডের পর ট্রাম্প কিন্তু সেই নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। আর এবার সেই ট্রাম্পই ভোটে জিতেছেন, মোদীর প্রকাশ্য ভোট প্রচার ছাড়াই।

আমেরিকা সফরে গিয়ে সেখানকার ভারতীয়দের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে যেভাবে সংকীর্ণ দলীয় প্রচার করেছেন, তাও এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সেই সমাবেশকে প্রায় দলীয় সভায় পরিণত করা এবং সেখান থেকে মোদী বন্দনায় 'হাউডি মোদী' শ্লোগান তুলে অতি সংগঠিত রূপে ও কৃত্রিম উপায়ে মোদীর জনপ্রিয়তাকে উন্নীত করার অপচেষ্টা আমরা প্রত্যেকেই জেনেছি। ওই সভায় আগত প্রায় সবাই ছিল অবৈধরূপে আমেরিকায় বসবাসকারী এবং মূলত গুজরাতবাসী সহ মোদীভক্ত ব্যবসায়ী তথা বিশেষ সাহায্য প্রত্যাশীদের ভিড়। এখন বোঝা যাচ্ছে, এদের কারণেই ট্রাম্পের প্রতি মোদীর এত ভালোবাসা; এবং এদের কারণেই মোদী একদা জিগির তুলেছিলেন যে, এইসব অনাবাসীদের মধ্যে ইচ্ছুকদের আমাদের ভোটার লিস্টে নাম তুলে অনলাইন ভোটের সুযোগ করে দিতে হবে। পরে অবশ্য এ নিয়ে আর বেশি উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি, হয়তো আইনি সাত পাঁচ ভেবে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, এই যে বলা হয় গুজরাত হচ্ছে শিল্পোন্নত ও সর্বাধিক সমৃদ্ধ ও সুখী রাজ্য, তাহলে কেন এত বেশি সংখ্যায় গুজরাতবাসী রুজি-রোজগারের আশায় আমেরিকায় গিয়ে নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে মরিয়া? ঐতিহাসিক ভাবে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই গুজরাতের অধিবাসীদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে এবং স্বাধীনোত্তর ভারতের অত্যধিক ক্ষমতাশালী জাতীয় নেতা বল্লভভাই প্যাটেলের অকৃত্রিম সহায়তায় গুজরাতিরা ব্যবসার ক্ষেত্রে বরাবরই এগিয়ে ছিল। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসি জমানায় সফল মুখ্যমন্ত্রী রূপে চিমনভাই প্যাটেলের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। অতঃপর কালের নিয়মে কংগ্রেসি জমানার শেষে বিজেপি শাসন চালু হয় এবং দলীয় নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে অবশেষে শাসন ক্ষমতা মোদীর করায়ত্ব হয়। এর আগে শুধুমাত্র দলের অন্দরমহলেই তাঁর পরিচিতি ছিল আদবানীজীর অনুগামী রূপে। 

গুজরাতের দায়িত্ব পেয়েই তিনি বুঝলেন, এখানে টিকে থাকতে হলে তাঁকে আগে বিভিন্ন সাংগঠনিক কাঁটাকে দুর করতে হবে এবং সে জন্য চাই একজন বিশ্বস্ত বুদ্ধিমান সহযোগী। কথায় আছে, রতনে রতন চেনে...। ফলে, অচিরেই তিনি বেছে নিলেন গুরুত্বের মাপে যথেষ্ট পিছিয়ে থাকা অমিত শাহকে এবং অনেকখানি তুলে এনে বানালেন তাঁর মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ধীরে ধীরে তৈরি হল সংগঠনকে পুরোপুরি কব্জা করে দখলে আনার রোডম্যাপ, যেখানে কেউ ট্যাঁ-ফু করার সুযোগ পাবে না। প্রশাসনের মধ্যেও বাছাই করা আমলাদের নিয়ে শুরু হল মোদীর নেতৃত্বকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করার অভিযান। ঘটে গেল সাবরমতি এক্সপ্রেসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা, ফলে বহু হিন্দু সাধু ও ধার্মিক মানুষদের মৃত্যু এবং এরই ফলস্বরূপ এক ভয়াবহ দাঙ্গা; স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে যা অন্যতম এক অতীব কলঙ্কজনক অধ্যায়রূপেই চিহ্নিত হয়ে আছে। অবশ্য এটি দাঙ্গা না গণহত্যা, সে প্রশ্নের সহজ উত্তর আজও মেলেনি। প্রশাসন বা দলে যাঁরাই এই ঘটনার সামান্যতম বিরোধিতা করেছেন, তাঁরাই হয় জেলে গেছেন নয়তো বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন (অনেক বিচারাধীন বন্দী জামিন পাওয়ার পরপরই প্রাণ হারিয়েছেন)। এই সংক্রান্ত বিচার পদ্ধতির জন্য নির্দিষ্ট এক বিচারপতিকেও শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারাতে হয়েছে বলে ভয়ঙ্কর অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছিল।

এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং বিজেপির ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু বিজেপি দলের দুই শিক্ষিত ও যোগ্য প্রার্থীদ্বয় সুষমা স্বরাজ ও অরুণ জেটলি'র মধ্যে কোনওপ্রকার সমঝোতা না হবার ফলে হঠাৎই শিকে ছিঁড়ল মোদীর ভাগ্যে, বলা যায় অপ্রত্যাশিতভাবেই। এর অন্যতম বড় কারণ, ফান্ডিং'এর নিশ্চয়তা প্রদান। ফলে, দল তাঁকেই পিএম পদপ্রার্থী বানালো এবং জাতীয় ক্ষেত্রেও আরএসএস নির্দেশিত হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় বিচারকে সামনে এনে ও নানা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জয়কে সুনিশ্চিত করল। 

কিন্তু এবার মোদীর ভাগ্য কিঞ্চিৎ খারাপ, তাই বন্ধু(!) ট্রাম্প ও তাঁর সরকার তাঁকে যথেষ্ট বিপদে ফেলে দিয়েছে। যে সাহস এক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র কলম্বিয়া দেখাতে পারল, অর্থাৎ পরিষ্কার বলে দিল, তাদের দেশের নাগরিকদের হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা থাকলে সেই বিমানকে তারা মাটিতে নামতে অনুমতি দেবে না; দেড়শো কোটি মানুষের দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদীজী সেটা বলতে পারলেন না। কারণ, ট্রাম্প যদি ক্ষেপে যায় তো মোদীর 'সাড়ে সব্বোনাশ' হয়ে যাবে। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর কোনওক্রমে ম্যানেজ করে যেখানে ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর একটা আপাতত সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছেন (সম্ভবত ১২-১৩ ফেব্রুয়ারি), সেখানে এক সামরিক বিমানে হাতে-পায়ে শিকল বেঁধে ভারতীয়দের ফেরত পাঠানোর বিরোধিতা করতে গিয়ে আরও বড় বিপর্যয়ের সম্ভাবনাকে তো আমন্ত্রণ জানানো যায় না!

ট্রাম্প সাহেব মোদীকে আদৌ বন্ধু ভাবেন কিনা, সেটা মোদীজী না বুঝলেও অনেকেই বোঝেন। কিন্তু ট্রাম্প এখন বিশ্বকে কড়া বার্তা দিতে বেছে নিলেন তাঁর বাধ্য 'মোদীর দেশ' ভারতকেই। রাষ্ট্রপতি-অভিষেক অনুষ্ঠানে আসার জন্য মোদীকে ফোন তো করলেনই না, তাও বা যে ফোনটা করলেন তা আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্র কেনার চাপ দিয়ে। ট্রাম্প যে এভাবে বন্ধুকৃত্য সারবেন, কেউ ভেবেছিল? সবার মনে আছে, ২০১৯'এ ট্রাম্পের ভারত সফর উপলক্ষ্যে চারদিকে সাজোসাজো রব, চতুর্দিকে দারিদ্র্য ঢাকতে লাগানো হচ্ছে কাপড়ের আড়াল এবং ট্রাম্পকে খুশি করতে নানাবিধ আয়োজন। তবে তিনি আদতে খুশি হয়েছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু বারংবার দুই বন্ধুর আলিঙ্গনের ছবি আমরা সবাই দেখে ধন্য হয়েছি। ঠিক সেই সময়ের কিছু পূর্বেই বিশ্বত্রাস করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, কিন্তু ট্রাম্পের আতিথেয়তায় কোনওরূপ বিঘ্ন না ঘটাতে বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। ততদিনে রোগের প্রকোপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, ট্রাম্প বিদায়ের অব্যবহিত পরেই কোনওরকম সময়-সুযোগ না দিয়েই দুম করে তড়িঘড়ি লকডাউন ঘোষণা করা হল। এর ফলে বিভিন্ন প্রদেশে কর্মরত গরিব শ্রমিকরা পড়লেন চূড়ান্ত বিপাকে এবং হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘ অবর্ণনীয় কষ্ট ও অজস্র প্রাণহানির চূড়ান্ত সাক্ষী আমরা হয়েছি অসহায়ভাবে। এ হেন ট্রাম্প যদি এমন দুর্ব্যবহার করে বন্ধু(!) মোদীকে এতখানি বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দেন, তাহলে মোদীজী একে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিই বা বলবেন!

ট্রাম্প খুব ভালো ভাবেই জানেন যে, আমেরিকায় অবৈধভাবে বসবাসরত ভারতীয় অভিবাসীদের সবাইকে ফেরত পাঠালে ভারত সরকার তথা মোদী খুবই বিপদের সম্মুখীন হবেন। জমি সম্পত্তি সব বেচে দিয়ে প্রায় কোটি টাকার বিনিময়ে বেআইনি চক্রের মাধ্যমে বহু মানুষ পরিবার সহ আমেরিকায় পাড়ি দেয়। তারা স্বপ্নেও ভাবেনি এরকম পরিস্থিতি কখনও তৈরি হতে পারে। ঘটনা হল, এইসব আজ নতুন নয়, চলছে যুগ যুগ ধরেই। কিন্তু অতীতের কোনও সরকার এসবের থেকে মুনাফা তোলার চেষ্টা করেনি। কিন্তু আমাদের মোদীজী হলেন এক ব্যতিক্রমী দুঃসাহসী। তাই তাঁর এখন মুখ পুড়ছে, তড়িঘড়ি ছুটতে হচ্ছে ট্রাম্পকে বিরত করতে। শোনা যাচ্ছে, আরও ৪০০+ লোকজনের তালিকা ইতিমধ্যেই প্রস্তুত। কিন্তু ট্রাম্প ভারতকে ছাড় দেবেন কি না, বা এমনতর চূড়ান্ত অপমানের হাত থেকে রক্ষা করবেন কি না, সেটা জানেন শুধুই স্বঘোষিত ঈশ্বররূপী ট্রাম্প। 

অবশ্য আরও একটি সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, এর বিনিময়ে প্রায় দেড়শো কোটির মানুষের বিশাল বাজারে এলন মাস্ক'এর মতো বন্ধুদের স্বার্থে বেশ কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেবেন ট্রাম্প, যা হয়তো এতদিন সম্ভব হয়নি; কিংবা বিনা প্রয়োজনে পুরাতন মডেলের গুদামজাত অবিক্রিত অস্ত্রশস্ত্র সহ প্রভুত গোলাবারুদ বা অন্যান্য প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম আমাদের দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে। মোদী ও ট্রাম্প দুজনেই জানেন, ক্ষমতা থেকে অবসর গ্রহণের আগে এটাই সম্ভবত তাঁদের লাস্ট ইনিংস। অর্থাৎ, আগামী দিনে কী ঘটতে চলেছে, সে বিষয়ে যথেষ্ট শঙ্কায় থাকা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই।

তবে যে অমোঘ প্রশ্নটির জবাব মানুষ চাইবেই তা হল, যিনি নিজেকে বিশ্বগুরু বলে চ্যালা-চামুণ্ডাদের দিয়ে প্রচার করে থাকেন, সেই ১৫০ কোটির মানুষের দেশকে এভাবে অপমানিত করার সাহস ট্রাম্প সাহেব পান কোথা থেকে? কেউ অন্যায় করলে বিচার মারফত তার শাস্তির বিধান আছে, কিন্তু বিদেশি অসামরিক নাগরিককে শিকল পরিয়ে এ হেন লাঞ্ছনা ও অত্যাচার শুধু সেই ব্যক্তিকেই বিপর্যস্ত করে না, তা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের পক্ষে অত্যন্ত অমর্যাদাকর। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাহস নেই নিজ দেশের নাগরিকদের প্রতি এই অবমাননাকর অপমান ও হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর। ধিক! যদিচ, এই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এবং জনশ্রুতিতে আদানি'র প্রোমোটার মানুষটির দম কতখানি, সে বিষয়ে সম্যক ধারণা ট্রাম্পের অবশ্যই আছে। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, এমনটা নতুন নয় বহু বছর ধরেই চলছে। কিন্তু সুকৌশলে যে কথাটা এড়িয়ে গেলেন সেটি হল, ব্যয়বহুল যুদ্ধবিমানে চাপিয়ে এরকম অপমানজনক প্রত্যর্পণ আগে কেউ কখনও দেখেছে না শুনেছে? এবার বিশ্বগুরু নরেন্দ্র মোদী আমেরিকার নয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সকাশে কি বলেন বা মুখরক্ষার জন্য কী আবেদন নিবেদন করেন, সেটাই জানার। কেউ কেউ মজা করে বলছেন, হয়তো কোনওভাবে ট্রাম্প সাহেবের কানে গেছে যে মোদীজী নিজেকে বিশ্বগুরু বলে প্রচার চালাচ্ছেন এবং সম্ভবত সেটি ট্রাম্প সাহেবের হজম হয়নি।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বগুরু নরেন্দ্র মোদীর চরিত্রের মিল অনেক। দুজনেই উগ্র জাতীয়তাবাদের আবেগে দেশবাসীকে ভাসিয়ে নিয়ে নিজেদের কাজ হাসিলে দক্ষ। ট্রাম্প ও মোদী দুজনেই দেশের মূল সমস্যার সমাধানে আগ্রহী নন, স্রেফ স্বীয় সাফল্যে বিশ্বাসী বা আগ্রহী। সমস্যাসঙ্কুল এই দুনিয়ায় ট্রাম্প আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু মোদী আমাদের দেশের কর্ণধার। তাঁর কোনও ভুল পদক্ষেপ দেশের মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর। ফলে, তাঁর কৃত অন্যায়গুলিকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।