Friday, 31 January 2025

পুণ্যকুম্ভে শূন্যকুম্ভের আস্ফালন

আদিত্যনাথের প্রাণঘাতী রাজনীতি!

অরুণাভ বিশ্বাস



আয়োজনের কোথাও 'খামতি' নেই। 'খামতিহীন আয়োজনের' প্রচারের‌ও কোন‌ও কমতি নেই। গত এক মাস ধরে সবাই শুনে আসছে ১৪৪ বছর পরে নাকি কী এক সৌরজাগতিক ঘটনার (আদতে বৃহস্পতি, রবি ও চন্দ্রের এক সরলরেখায় আসা) সমাপতন! কিন্তু ঘটনাটা ঠিক কী সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণাসম্পন্ন লোকজন যদিও সেভাবে চোখে পড়ছে না। তাই বলে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে মহাকুম্ভ নিয়ে প্রচারের কিছু আর বাকি নেই। বায়ো-টয়লেট থেকে ফাইভ-স্টার তাঁবু, অদ্ভূতাচারী নানারকম তথাকথিত বাবাজী বা মাতাজীর কর্মকাণ্ডের ছোট ছোট ভিডিও, ড্রোন ক্যামেরায় তোলা লংশট, লংশটে পুণ্যস্নানে জাতপাত ভুলে অগণিত মানুষের এক‌‌ই গঙ্গাজলে অবগাহন বা ডুবস্নান– সব‌ই প্রচারিত হয়েছে ফলাও করে। সে সব আমরা প্রায় এক মাস ধরে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। অথচ এসব‌ যে আদতে তথাকথিত হিন্দু ধর্মের এক অসহ্য গর্বোদ্ধত প্রচারসর্বস্বতা, তা তাকিয়ে থাকলেও দেখতে পাইনি কেউই। এই প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক পরপর কয়েকটি অনভিপ্রেত ঘটনা বুঝিয়ে দিল উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকারের ফাঁপা আস্ফালন।

প্রচার হয়েছিল এক‌ই গঙ্গাজলে শূদ্র থেকে ব্রাহ্মণের পুণ্যস্নানকে নিয়ে। কোটি কোটি লোকের সমাগমকে বলা হয়েছিল ভারতের এক মহামিলনের জয়গান। সোশাল মিডিয়ায় মিম ছড়িয়ে প্রচার হয়েছিল জাতপাত নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষের একত্র স্নানে বামপন্থীরা নাকি ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না। অথচ কেউ ভেবে দেখিনি, বাতানুকূল বিলাসবহুল তাঁবু, পৃথক ভিআইপি করিডর, স্পেশাল সিকিউরিটি ইত্যাদি তীর্থযাত্রার কায়িক ক্লেশের ধারণাকে স্বীকার করে না। তা আদতে ব্রাহ্মণ-শূদ্র বিভেদকেই মান্যতা দেয় এমনভাবে যেখানে ধর্ম-বর্ণ ভিত্তিক জাত বিভাজন আসলে টাকার গরমে বা ক্ষমতার দর্পে আর্থ-সামাজিক শ্রেণি বিভাজনে পর্যবসিত হয়েছে।

অন্যদিকে শূদ্রদের যদি পুণ্যস্নানে বাধা দিতে হত তাহলে তো পুণ্যস্নানের মূল ভিত্তিই নড়ে উঠত এই মর্মে যে শূদ্রের স্নানের ফলে 'গঙ্গা মাঈয়া ভী ময়লি হো জাতি হ্যায়।' তাহলে আর এত ঝামেলা করে স্নানের কী দরকার! কাজেই বাধ্য হয়ে ব্রাহ্মণ আর শূদ্রদের এক ঘাটে স্নান করতে হয়েছে‌। তাই এটা যোগী আদিত্যনাথের প্রচারে যত‌ই কাজে আসুক সত্যটা নিহিত আছে স্নানের ধর্মীয় উপচারেই। কারণ, তা না হলে পতিতপাবন গঙ্গার ধারণাটাই সে ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়ে যেত। এ অনেকটা লাইসেন্সড একাত্মতা– সনাতনীরাই বিভেদ করেছে বর্ণাশ্রমে, আবার তারাই একাত্মতার প্রচার করছে পুণ্যস্নানের শাঁখের করাতে পড়ে।

গত ১৯ জানুয়ারি কুম্ভমেলার তাঁবুতে আগুনের লেলিহান শিখা সকলে দেখেছি। কিন্তু পুণ্যস্নানের সমারোহে ধর্মগ্ৰন্থ ছাপানোর প্রকাশক গীতা প্রেসের তাঁবুতেই আগুন লেগে যাওয়াটা কীসের ইঙ্গিত বহন করে তা স্নানে পুণ্যবান পুণ্যার্থীরা ভালো বলতে পারবেন। কলকাতায় বসে আমার এ নিয়ে মন্তব্যের অবকাশ নেই। কিন্তু এটুকু বলা যায়, অগ্নি নির্বাপণের আগাম পরিকাঠামো যথাযথ ছিল না এবং দাহ্য-দাহকের পৃথক উপস্থিতির প্রাথমিক শর্ত মানা হয়নি। আগাম নজরদারির অভাব ছিল স্পষ্ট। না হলে মুহূর্তে আগুন অতটা ছড়াতো না। এ বিষয়ে বাম আমলে কলকাতা ব‌ইমেলার ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া মনে পড়ছে। কুম্ভ হোক বা ব‌ইমেলা– অগণিত মানুষের আবেগ যেখানে জড়িয়ে সেখানে প্রশাসনের তরফে আর‌ও দায়বদ্ধতা আশা করে নাগরিক সমাজ। যোগী আদিত্যনাথের পিআর টিম এই দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রেখেছিল কি?

‘মেলা মানে মিলন’-- সে কথা আমরা উচ্চ প্রাথমিক স্তর থেকে মেলা নিয়ে বাংলায় রচনা লিখতে লিখতে কথাটাকে ক্লিশে বানিয়ে ফেলেছি। যদি ধরেও নেওয়া হয় কুম্ভ মেলা সনাতন ধর্মের একান্ত নিজস্ব একটি মেলা যেখানে একাধিক ভিন্ন সনাতনী আখড়ার সাধু-সন্তরা মিলিত হন, তবুও এইখানে মনে রাখতে হবে, তথাকথিত ‘হিন্দুধর্ম’ বলতে মনোলিথিক কোন‌ও ধর্মমতকে বোঝায় না। তা বোঝায় শাক্ত শৈব বৈষ্ণব গাণপত্য ইত্যাদি নামধারী নানা ধর্মমতের এক বহুত্ববাদী আস্তিক্য ধারার সমষ্টিকে যার সাথে নাস্তিক্যবাদের আপাত বিরোধ থাকলেও সরাসরি সংঘাতের কোন‌ও অবসর নেই। কারণ, পরমতসহিষ্ণুতা সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী তো নয়‌ই, এমনকী নাস্তিকতা বা বিবিধ নাস্তিক্য দর্শন তথা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন‌ও কিন্তু সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যেই পড়ে। তা সত্ত্বেও কেবল মনুবাদী বা গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুদের চক্ষুশূল হল নাস্তিক্যবাদ।

পূর্বোক্ত অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতার‌ই এক অনভিপ্রেত প্রক্ষেপ দেখা গেল এবারের কুম্ভমেলায় যেখানে নিছক কুসংস্কার বিরোধী একটি মঞ্চের পক্ষে ভাড়া নেওয়া তাঁবুতে নাগা সন্ন্যাসীদের বেশধারী কিছু বাবাজী ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এবং ধর্মগ্ৰন্থ, পুস্তিকা বা প্রচারপত্র ছিঁড়ে, মাটিতে ফেলে স্তুপাকার করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে। অথচ সূত্রে প্রকাশ, আচার্য প্রশান্তের উক্ত মঞ্চটি আদপে ধর্মাচরণের বিরুদ্ধে বা নাস্তিকতার সপক্ষে কোন‌ও প্রচার করছিল‌ই না। চরিত্রগতভাবে তা ছিল মূলত ধর্মীয় গোঁড়ামিকে আশ্রয় না করা একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের তরফে পরিচালিত তাঁবু। এতেও হিন্দুত্ববাদী (প্রকৃতপক্ষে মনুবাদী বা ব্রাহ্মণ্যবাদী) সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আপত্তি ও তৎপরবর্তী ঘৃণা ও হিংসা প্রাধান্য পেল। যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন এর প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণের কোন‌‌ও ব্যবস্থা করেছে কি না জানা নেই। ধর্মগ্ৰন্থ পোড়ানোর মতো গুরুতর অপরাধের কোন‌ও শাস্তি হল না, অথচ নালন্দার বৌদ্ধ মহাবিহার মুসলিম শক্তির আগ্ৰাসনে কীভাবে আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল তা ফলাও করে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস প্রচার করে থাকে, বৌদ্ধমতাবলম্বী ও তাদের উপাসনাস্থল বা মহাবিহারগুলির ওপর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের তরফে চলা চরম আক্রোশ তথা হিংসার ইতিহাস গোপন রেখে। যাই হোক, এই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং তৎপরবর্তী রাজধর্ম পালনের অনীহা কিন্তু পুণ্যকুম্ভের মিলনস্থলকে অপবিত্র‌ই করেছে। পরিচ্ছন্নতাই পবিত্রতা। মেলার আয়োজকরা যেখানে তাঁবুর অনুমতি দিয়েছিলেন সেখানে এই বিভেদকামী আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া অপরিচ্ছন্ন বা অস্বচ্ছ প্রশাসনের দিকে ইঙ্গিত করে। মনে রাখতে হবে, ‘মেলা’ (অর্থাৎ সামাজিক মিলন বা সমসত্ব সংমিশ্রণ) এবং ‘বিভেদ’ (এ ক্ষেত্রে হিন্দুধর্মের‌‌ই নানা সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর পার্থক্য) এক সাথে যায় না।

এই লেখা যখন লিখছি তখন কুম্ভে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। শেষ খবর অনুযায়ী, তা ৪০'এর কাছাকাছি। গোদী মিডিয়ার আস্ফালন, ফেক নিউজ, ফেক ভিডিও, ফেক ছবি (একটা নমুনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না যেখানে একটি সোশাল মিডিয়া পোস্টে দেখা যাচ্ছে ট্রাম্প-মাস্ক-পুতিন ত্রয়ীকে পুণ্যস্নান করতে) ইত্যাদির পসরা পেরিয়ে ক্রমশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিডিয়ার খবর সামনে আসছে। বেআব্রু হয়ে পড়ছে ৮,০০০ কোটি টাকা (প্রকৃতপক্ষে ৭,৫২৫ কোটি প্রায়) সরকারি ব্যয়ে নির্মিত পরিকাঠামোর ফাঁক-ফোকর। একের পর এক ভিআইপি'র (যার মধ্যে কেন্দ্রীয় স্তরের নেতামন্ত্রী থেকে শুরু করে বলিউড অভিনেতা বা মডেল এমনকী কোল্ডপ্লে ব্যান্ডের লিড সিঙ্গার‌ও আছেন) সেবায় নিয়োজিত আদিত্যনাথের পুলিশ ও প্রশাসন সাধারণ পুণ্যার্থী মানুষের ঢলকে গুরুত্ব‌ই দেয়নি। যাতায়াতের রাস্তা একমুখি ও দ্বিমুখি থাকার সুস্পষ্ট নির্দেশ সব জায়গায় ছিল না এবং যেখানে যেখানে ছিল সেখানে এমন পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল না যাতে জনস্রোতের অভিমুখকে সেই অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারত। সন্ত প্রেমানন্দজীর অভিযোগ, আখাড়াগুলোর তরফে বারবার সেনা নামানোর অনুরোধ থাকলেও সম্ভবত আদিত্যনাথের মেগালোম্যানিয়ার কারণে সেনাকে তলব করা হয়নি। ১৫ লাখ পুণ্যার্থী পিছু ১,০০০ মতো পুলিশকর্মীর উপস্থিতি অত্যন্ত অপ্রতুল। মেলামুখি ট্রাফিক জ্যাম‌ও ছিল চোখে পড়ার মতো। তারপরেও ভিড় নিয়ন্ত্রণের তুঘলকী সিদ্ধান্তে ৩০টি পন্টুন ব্রিজের অধিকাংশকে বন্ধ রেখে, একেকটা দিন একেকটাকে খুলে, ভিড়কে এক জায়গায় আটকে রেখে ড্রোন শট নিয়ে প্রচার করা হয়েছে, অন্যদিকে ভিআইপিরা তুলনায় ফাঁকা সঙ্গম স্থলে শৌখিন পুণ্য অর্জন করেছেন। স্নানের ঘাটে এগোতে না পারা এবং স্নান সেরে ফিরতে না পারা বিভ্রান্ত পুণ্যার্থীদের বাধ্য হতে হয়েছে মালপত্র সমেত ওখানেই শুয়ে থাকতে। এরপর যখন ভিআইপি আগমনে পন্টুন ব্রিজ খোলা হয় তখন ধৈর্যের বাঁধভাঙা মানুষজন বন্যার মতো ব্যারিকেড ভেঙে হুড়োহুড়ি করতে শুরু করে এবং শুয়ে থাকা মানুষজন পদপিষ্ট হয়। আগুনে ঘিয়ের মতো কাজ করে নাগা সন্ন্যাসীদের দল বেঁধে স্নান করতে আসার গুজব।

মানুষকে নিয়ে মেলা, মানুষের জন্য মেলা, মানুষের মেলা– সম্ভবত আত্মপ্রচারপ্রিয় আদিত্যনাথের সরকার ও প্রশাসন সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিল। মাটিতে পা ছিল না, তাই এত ড্রোনশটের ছড়াছড়ি। মেলায় কারোর মা, কারোর শ্বাশুড়ি মারা গিয়েছেন– সে আর্তনাদ কানে শোনা যায় না। মরদেহ পদপিষ্ট হয়ে পরিচ্ছদহীন হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। মা-মাটি-মানুষের এই অপমান বঞ্চনা আর অবমাননার দায় আর যাই হোক প্রশাসনের তরফে হাজার ক্ষমা স্বীকার বা দোষারোপেও স্খলিত হ‌ওয়ার নয়। এ দায় ও দোষ সম্পূর্ণতই আদিত্যনাথ প্রশাসনের।

লেখাটা শুরু করেছিলাম পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর খবর শুনে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায়। সেই মৃত্যুর মিছিল এতক্ষণে বেড়ে ৪০ প্রায়। এই অবস্থায় লেখা শেষ করার আগেই আবার আগুন লাগার খবর। এবারে মূল মেলা চত্বরের বাইরে হলেও তার‌ও দায় প্রশাসনের। কারণ বারবার দাবি করা হচ্ছে নাগেশ্বর ঘাটের কাছে সম্ভবত জুনা আখাড়ার তরফে কিছু অননুমোদিত ছোট ছোট তাঁবু ছিল যাদের ১৯টিতে আগুন লেগেছে।



সৌভাগ্যক্রমে এ ক্ষেত্রে হতাহতের খবর নেই। কিন্তু অননুমোদিত তাঁবুগুলোকে প্রশাসন কেন খুলে ফেলতে বাধ্য করেনি তার কোন‌ও সদুত্তর নেই। ঠিক যেমন সদুত্তর পাওয়া যায়নি গীতা প্রেসের তাঁবুতে লাগা আগুন কীভাবে অত অল্প সময়ে একশর মতো ছোট ছাউনি এবং ১০টা বড় প্যাভিলিয়নকে (যদিও হাস্যকর সরকারি সূত্রানুযায়ী সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ৮-১০টা তাঁবু) গ্ৰাস করে ফেলল সেই প্রশ্নের।

বিশ্বের বৃহত্তম গণসমাবেশের আয়োজনে আদিত্যনাথের প্রশাসনের হয়তো চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু ২ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হ‌ওয়ার আস্ফালন কীসের তা বোঝা গেল না। আদতে তো ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো সরকারের খাতায় আসবে। বাদবাকি সবটাই তো ধর্মকে কেন্দ্র করে ব্যবসা। তা নিয়ে এত প্রচার একদম‌ই বেমানান। তাই উত্তরপ্রদেশ সরকার ও প্রশাসনের সমালোচনা ততটাই প্রাপ্য যতটা প্রশাসন নিজে উদ্যোগী হয়ে নিজ সাফল্য বা আত্মগরিমার প্রচারে ব্যস্ত ছিল। নিজের প্রশংসা নিজে করলে, নিজের পিঠ নিজে চাপড়ালে, নিজের কলার নিজে তুললে, মনে রাখতে হবে, নিজের কান নিজে মুলে নিজেই নিজেকে ওঠবোস করানোর সময়‌ও আসবে।


Tuesday, 28 January 2025

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্বযুদ্ধ!

কার হাতে রথের রশি?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত ২০ জানুয়ারি যেদিন ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নিলেন, সেদিনই বিশ্বের অপর প্রান্তে চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্টার্ট-আপ DeepSeek আন্তর্জাতিক বাজারে উন্মোচিত করল DeepSeek-R1 নামক একটি LLM বা Large Language Model (চলতি ভাষায় ‘চ্যাটবট’)। তারপরই হৈচৈ কাণ্ড! দেখা গেল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই নতুন উদ্ভাবন -- যা মাত্র ৫.৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি করা হয়েছে -- বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলগুলিকে টপকে যেতে সক্ষম। এমনকি স্যাম অল্টম্যানের OpenAI ও তাদের ChatGPT অথবা গুগল’এর ‘জেমিনি’র বাগাড়ম্বরকেও এখন বেশ স্তিমিত দেখাচ্ছে।

DeepSeek-R1'এর আবির্ভাব সিলিকন ভ্যালির হাই-টেক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শুধুমাত্র হতবাক করেনি, বলা ভালো, বিশ্বের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এতদিন মার্কিন দেশের টেক দৈত্যদের যে আধিপত্যের কথা বড়াই করে বলা হত এবং সেই আধিপত্যকে বজায় রাখতে তাদের তরফে নানারকম বাণিজ্যিক বিধিনিষেধও বেশ সগৌরবে চালু ছিল, সে সবেরও থোতামুখ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, বড় বড় টেক দৈত্যরা যেখানে AI LLM’এর পিছনে এ তাবৎ বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, সেখানে DeepSeek মাত্র কয়েক মিলিয়নে এই অভিনব কাণ্ডটি ঘটিয়ে ফেলেছে; কেবলমাত্র তাই নয়, জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধানে, উন্নতমানের কোডিং লেখায়, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার ও বিশ্লেষণে, তুখোড় বাণিজ্যিক বুদ্ধিতে, দুরন্ত সৃজনশীলতায় এবং সর্বোপরি শিখে-পড়ে নেওয়ার অসামান্য ক্ষমতায় সে সক্ষম ও পারদর্শী। উপরন্তু, তাকে পাওয়া যাচ্ছে একেবারেই বিনামূল্যে এবং সে open-sourced (অর্থাৎ, যে কেউ তার উপরে আরও বিদ্যে ফলাতে পারে)।

এই প্রযুক্তির আবির্ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে এক নতুন প্রতিযোগিতার সূত্রপাত শুধু নয়, কেউ কেউ বলছেন, এক নবতর যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্বযুদ্ধ; অনেকটা সেই ৫০’এর দশকের ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধের’ মতো। ফারাক, এখানে যুদ্ধাস্ত্রের ঝনঝানানি নেই, আছে প্রাযুক্তিক বুদ্ধিতে দখলদারির নানান কলাকৌশল। তা এতটাই ব্যাপ্ত যে, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাগতিক অস্তিত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বলয়ে অনুপ্রবেশ ও দখলদারিতেই তার আধিপত্য ও বাণিজ্যিক সাফল্য। বলাই বাহুল্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন জাতীয় শক্তির একটি মূল উপাদান এবং এই প্রযুক্তির নেতৃত্ব দখল করার জন্য দেশগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আজ আমেরিকায় এলন মাস্ক সহ প্রায় সমস্ত টেক দৈত্যের কর্ণধারদের যে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের পাশে সদাই দেখা মিলছে, তা সেই দ্বৈরথেরই ইঙ্গিত। এই প্রতিযোগিতার কী পরিণতি হবে এবং এর ভবিষ্যৎই বা কী, তা এখনও অজানা।

আশ্চর্যের হলেও সত্যি, এত স্বল্প ব্যয়ে DeepSeek-R1’এর এই অভূতপূর্ব উত্থানে দুনিয়া জুড়ে এক ঝড় উঠেছে। ChatGPT’কে ছাপিয়ে সে এখন অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে। মাইক্রোসফট’এর সিইও সত্য নাদেলা জানিয়েছেন, DeepSeek-R1’কে আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। পাশাপাশি, DeepSeek-R1’এর অভিঘাতে স্টক মার্কেটে ধসে পড়ছে বড় বড় টেক দৈত্যরা-- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চিপ-নির্মাতা সংস্থা Nvidia’র পতন প্রায় ১৮ শতাংশ, যার আর্থিক মূল্য ৫৬০ বিলিয়ন ডলার (এখন পর্যন্ত এত বড় পতন শেয়ার বাজারের ইতিহাসে নাকি দেখা যায়নি)। এই পতনের বিশাল অর্থমূল্য রিলায়েন্স, টিসিএস ও এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের একযোগে মোট বাজার মূল্যের সমান। অবশ্য, শেয়ার বাজারের এই পতন থেকে কেউই বাদ যাচ্ছে না— মেটা, মাইক্রোসফট, গুগল’ও ধাক্কা খেয়েছে। মুখ্য কারণ দাঁড়াচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত কোম্পানিগুলিকে আরও একবার মূল্যায়ন করে বুঝে নিতে চাইছেন, এতদিনের এত বিপুল পরিমাণে তাঁদের লগ্নি আদপে কতটা ঘরে ফেরত আসবে! DeepSeek-R1 যদি এত স্বল্পমুল্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অতি-উন্নত ব্যবহারকে সম্ভব করতে পারে, তাহলে এই ক্ষেত্রে এতদিনের বিপুল পরিমাণের অতি-বিনিয়োগ কোন কম্মে লেগেছে? এমত ভাবনা-চিন্তা কিন্তু অর্থনীতিকে ওলটপালট করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। খেয়াল রাখতে হবে, ট্রাম্প রাষ্ট্রপতির আসনে বসেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘প্রজেক্ট স্টারগেট’ প্রকল্পে ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠছে, তা কি এখন অথৈ জলে পড়ে গেল? এই ভাবনা অমূলক কিছু নয়!

কেন সকলে DeepSeek-R1’এর উত্থানে ঘাবড়ে গেছে?

এক) এদের অতি-সস্তায় (যা বড় বড় টেক কোম্পানির খরচের ভগ্নাংশ মাত্র) উন্নতমানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি নির্মাণে বাকী কর্পোরেটরা আশঙ্কিত;

দুই) শুধুমাত্র কম খরচের দিক থেকে নয়, DeepSeek-R1’এর যুক্তিবুদ্ধি এবং সমস্যা সমাধানে নিপুণতা ও পারদর্শিতা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তাদের বড়সড় সুবিধা করে দিচ্ছে;

তিন) দেশ হিসেবে চীনের হাতে তাদের দেশিয় সংস্থার এই সাফল্যটি চলে আসায় মার্কিন-চীন সম্পর্কের বলয়ে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বড়সড় রদবদল ঘটতে পারে;

চার) নিজে নিজে শিখে-পড়ে নিতেও DeepSeek-R1 আরও বেশ পারদর্শী;

পাঁচ) এমন একটি উদ্ভাবনের ফলে উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট বেড়ে যাবে যা আবার হয়তো চাকরি ফুরিয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাকে আরও ব্যাপক করবে।

মোদ্দা কথায়, খুব কম খরচে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদগত অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও উচ্চদক্ষতা সম্পন্ন একটি চ্যাটবট (LLM) যদি পাওয়া যায়, দীন-দুনিয়ার প্রায় সমস্ত কাজই যদি সে করতে পারঙ্গম হয়, তাহলে তাকে যে প্রতিপক্ষের অর্থশক্তির ধমকানির সামনে পড়তে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তৎসত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে দেখা গেল যে অর্থ-প্রাবল্য কিছুটা পিছু হঠল। অর্থাৎ, বড় বড় বিনিয়োগকারীরা ভাবতে শুরু করলেন, তারা কি এতদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পিছনে অযাচিত অর্থ ব্যয় করেছেন? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি এমন এক ব্যবস্থা হয়ে উঠতে পারে না যেখানে স্বল্পমূল্যে তাকে অত্যন্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন করে তোলা যায়? এমনকি তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যবহারের জন্য তাকে open source হিসেবে বাজারে ছাড়া যায়! DeepSeek-R1 ঠিক এই অসাধ্যসাধনকেই সম্ভব করেছে। আর এখানেই যেন এক বাঁক-ঘোরানো মোড় উপস্থিত! যা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও অর্থনীতির ওপর এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে চলেছে।

হয়তো তার প্রমাণও মিলছে। ইতিমধ্যেই DeepSeek-R1’এর ওপর শুরু হয়ে গেছে ব্যাপক ‘গোলাবর্ষণ’। সাইবার দস্যুরা তাকে ঘিরে ধরে তার উপর পরপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে, আপাতত তারা নতুন ‘User Registration’ করতে পারছে না। যারা এই মুহূর্তে চাইছেন user id তৈরি করে সেখানে বিচরণ করতে, তাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে সে আত্মরক্ষায় সক্ষম। তাই তাকে কোনওভাবেই অকেজো করে দেওয়া যায়নি। তবে এর অন্য একটি বিপদও আছে। চীনের আভ্যন্তরীণ কোনও বিষয়ে DeepSeek-R1’কে প্রশ্ন করলে সে কিছু জানে না বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, এই প্রযুক্তির প্রাপ্ত ট্রেনিং’এর মধ্যে self-censorship’এর উপাদানও বেশ জোরালো ভাবে পুরে দেওয়া আছে। তার মানে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও এমন এক ন্যারেটিভ গড়ে তুলতে পারে যা অর্ধসত্য বা ইচ্ছাকৃত ভাবে অজানা। অবশ্য এই ফাঁকেই মনুষ্য-চৈতন্যের বাস, যেখানে শেষ বিচারে সে যন্ত্রের ওপর বিরাজ করে। সে অন্য প্রসঙ্গ।

আপাতত শেয়ার বাজারে Nvidia’র পতনের (উপরে উল্লিখিত) পাশাপাশি Nasdaq’এর সুচক ৩ শতাংশ পড়ে গেছে যার অর্থমূল্য ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এমনকি যে সব কোম্পানি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিকাঠামোর জন্য বিদ্যুৎ সরঞ্জাম সরবরাহ করে— যেমন, Siemens Energy, Schneider Electric-- তাদেরও শেয়ার মূল্য যথাক্রমে ২০ ও ৯ শতাংশ পড়ে গেছে। ফলে, এতদিন উচ্চমূল্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চিপ বিক্রির যে রেওয়াজ ছিল তার হয়তো ইতি হতে পারে। অনেক কম খরচে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নাগাল পাওয়াটা এখন সম্ভবত আর অলীক ঘটনা নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নামে কতিপয় কর্পোরেট দৈত্যের তুমুল মুনাফা লুঠের যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল তার অবসান হয়তো সময়ের অপেক্ষা মাত্র। উল্লেখ্য, OpenAI যেখানে কাজ করে ৪,৫০০ কর্মচারী নিয়ে, DeepSeek সেখানে মাত্র ২০০ জনকে দিয়ে এই অসাধ্যসাধন করতে পেরেছে!

নিঃসন্দেহে DeepSeek প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির জগতে এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও ফলাফল কোনদিকে আমাদের নিয়ে যাবে তার দিকে আপাতত তাকিয়ে থাকাটাই শ্রেয়। তবে আমরা কি বলতে পারি, এইসব টানাপোড়েনে অবশেষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন ক্রমেই সাধারণেরও হাতের নাগালের মধ্যে?

 

Friday, 24 January 2025

ব্যক্তি হিংসা থেকে সমবেত হিংসা?

গোপন হিংসার গলা সাধা

প্রবুদ্ধ বাগচী 



বন্দুক লাও, সড়কি লাও, মশাল লাও — লাও তো বটে, আনেটা কে! যাঁর ওপর আনার দায় ছিল তিনি বলে দিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের সাজা প্রচলিত আইনের ব্যাকরণের সঙ্গে মেলে না। এই আইন তিনি তৈরি করেননি। বৃহত্তর গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত আইনসভা সেই সব আইনের বিধি লিখেছে। তাহলে তো এই আইন তৈরির পদ্ধতির মধ্যে আমরাও উপস্থিত আছি, এই যারা আজকে বলছি অপরাধীর কেন ফাঁসির সাজা হল না। তাহলে কি আমরা নিজেদেরই রচিত বিধিকে নিজেরাই ভেঙে ফেলতে আজ গলা তুলছি? যিনি সাজা দিয়েছেন তিনিও নিছক একজন সরকারি চাকুরে, তাঁর নিয়োগপত্রে সই করেছেন রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতি, তাঁরাও আমাদের সংসদীয় কাঠামোর প্রত্যঙ্গ— যে সংসদীয় কাঠামোকে মজবুত করতে আমরা প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের লাইনে দাঁড়াই। তবে কি একটা ঘৃণ্য অপরাধের উপযুক্ত তদন্ত ও শাস্তি চাইতে গিয়ে নিজেদেরই তৈরি আইনসভা ও বিচারব্যবস্থার বিপরীত একটা মঞ্চে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা? চেয়েছিলাম বিচার, চেয়েছিলাম উপযুক্ত তদন্ত, দোষী বা দোষীদের শাস্তি, কিন্তু তার মানে কি আমরা নিজেরাই ঠিক করে দেব কী সাজা হবে সেই অপরাধীর? 

মনে পড়ে জঙ্গলমহলের সেই স্কুল মাস্টারমশাইটির কথা, পড়ুয়াদের কাছে তিনি ছিলেন বড় প্রিয়। একদিন স্কুল চলার সময় এল ঘাতক বাহিনী, ক্লাসঘরের মধ্যে তাঁকে রক্তাক্ত করে ফুঁড়ে দিয়ে গেল তাঁর কিশোর ছাত্রছাত্রীদের চোখের ওপর। তারপর লাল কালিতে পোস্টার লিখে জানিয়ে দেওয়া হল, শাসক দলের হয়ে কাজ করার জন্য তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। মাওবাদীদের এইটাই নাকি রীতি। তাঁদের বিচারে অপরাধীর এই সাজাই নাকি প্রাপ্য। আবার, বিনপুরের সেই শালমহুয়ার জঙ্গলে লুকিয়ে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল যে মাওবাদী স্কোয়াড, রাতে মাথার কাছে অস্ত্র রেখে ঘুমিয়েছিলেন তাঁরা ক’জন। যৌথ বাহিনীর জওয়ানরা ঘুমন্ত গেরিলাদের হত্যা করে তাঁদের শবদেহ বাঁশের গায়ে ঝুলিয়ে বেঁধে চিত্র সাংবাদিকদের সামনে ক্যামেরার পোজ দিয়েছিলেন। দুটো হত্যার কোনওটারই সুবিচার হয়েছে বলে জানা নেই। হলেই বা, কী হতে পারত সেই বিচারের রায়? 

এই রাজ্যের ইতিহাসে ষাট ও সত্তরের দশক জুড়ে ব্যাপ্ত হননের কাল। শুধু রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে-প্রতিদ্বন্দ্বে ঘটে গেছে কত না খুন, নিছক সন্দেহের বশে পুলিশবাহিনী নির্বিচারে নিকেশ করে দিয়েছে নির্দোষ তরুণ-তরুণীদের। কারও কি বিচার হয়েছে? তার অর্থ কি এই যে এই প্রতিটি হত্যার সাজা দিতে গিয়ে টানা ছ’ বা আট মাস চালু রাখতে হত ফাঁসির মঞ্চ? একেকটি নির্বিচার হত্যার পাল্টা আরেকটা করে আখ্যান!

অপরাধ ও অপরাধীর বিষয়ে রাষ্ট্রের একটা মনস্তত্ব থাকে। থাকে তার সাজা দেওয়ার বিবিধ বিধান। কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণার আওতায় কয়েক দশক হল 'কারাগার' শব্দটি পালটে ফেলে নাম দেওয়া হয়েছে ‘সংশোধনাগার’, অর্থাৎ, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর মানসিকতা সংশোধনের একটা প্রয়াস জারি থাকবে রাষ্ট্রের পক্ষেই। এর যে ইতিবাচক ফল কিছু হয়নি তা নয়। অনেকেই হয়তো জানেন, একদা কলকাতার কুখ্যাত ‘সাট্টা ডন’ ও বউবাজার বিস্ফোরণ মামলার মূল চক্রী রশিদ খান এখন প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে বন্দিদের ছবি আঁকা শেখান। সারদা চিটফান্ড মামলার বিচারাধীন বন্দিনী দেবযানী মুখোপাধ্যায় দমদম সেন্ট্রাল জেলে সহবন্দিদের শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেছেন। যাঁরা মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডালজীবন’ পড়েছেন, তাঁরা জানেন তাঁকে জেলের ভিতর প্রথম শিক্ষার পাঠ দিয়েছিলেন এক যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক, না হলে তাঁর লেখক হয়ে ওঠা হত না। ‘মুক্তধারা’ নামক খ্যাত বাংলা চলচ্চিত্রটি তৈরি হওয়ার আগেই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের নিয়ে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ মঞ্চস্থ করে আমাদের অবাক করে দিয়েছিলেন অলকানন্দা রায়; মানুষের দাবিতে সেই নাট্য মঞ্চায়িত হয়েছিল রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহে। ঠিক ওই সময়েই অলকানন্দা রায়ের বাড়িতে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আঠারোটা খুনের অপরাধে ‘বন্দি’ নাইজেল ওকারা ওরফে ভিকির সঙ্গে। সে বলেছিল, কীভাবে অলকানন্দা রায় তাকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন, সে এখন তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকে। শুনিয়েছিল, কীভাবে রবীন্দ্র সদনের ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে বিশাল মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে সে ডুকরে কেঁদে উঠে নিজেকে পরিশুদ্ধতর করতে চেয়েছিল একদিন। এগুলো নিছক রোমাঞ্চিত তথ্য নয়, এসবের ভিতরে একটা নিখাদ মানবিকতার আখ্যান আছে, রয়েছে এক লুকিয়ে থাকা আলো। সম্ভবত গোটা সামাজিক রাজনৈতিক পরিসর জুড়ে একটা সংগঠিত চেষ্টা চলছে সেই আলোটাকে যাতে প্রতিহিংসার ঠুলি পরিয়ে অন্ধ করে দেওয়া যায়। অপরাধের চরিত্রের থেকে বেশি নজর অপরাধীর দিকে সরে গেলে এর বেশি কিছু হওয়ারও ছিল না। গত দুই দশকে প্রশাসন ও আইনসভার ক্লীবত্বের ফাঁক দিয়ে বিচারব্যবস্থার ওপর কি বাড়তি এক প্রত্যাশা তৈরি করে ফেলেছি আমরা? রাখলে বিচারপতিরাই রাখবেন না হলে নয়! আর আমাদের প্রত্যাশার প্রতি ‘সুবিচার’ করতে না পারলেই আমরা তাঁদের আদ্যশ্রাদ্ধ করার লাইসেন্স পেয়ে যাব? 

ফরাসি বিপ্লবের আগে সে দেশে কেউ আত্মহত্যা করলে শবদেহকে নগ্ন করে উল্টো করে টাঙিয়ে প্রকাশ্যে তার অন্ত্যেষ্টি করা হত; কারণ, আত্মহত্যা ছিল অপরাধ। মধ্যযুগে গিলোটিন, পরে ইলেক্ট্রিক চেয়ার হয়ে মুণ্ডচ্ছেদ-- এই ধরনের বিভিন্ন সাজার কথা আমরা শুনেছি। নরহত্যাকে প্রায় ‘ধ্রুপদী শিল্পের’ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল মুসোলিনী-হিটলার, প্রতিক্রিয়ায় মুসোলিনীর প্রকাশ্য রাজপথে ফাঁসি হয়। এ দেশের মধ্যযুগের ইতিহাসেও এ ওঁর মুণ্ডু কেটে আরেকজনকে ‘উপহার’ পাঠাচ্ছেন এমন সব হিংস্র কাহিনির কথা যে আমরা শুনিনি তা নয়। অবশ্য আমাদের পুরাণের আখ্যানে দেবদেবীদের যে সব ‘সাজা দেওয়ার’ ছড়ানো ইতিহাস সেখানে প্রতিহিংসার চাপ বড়ই বেশি। কথায় কথায় ভস্ম করে দেওয়া, ধ্বংস করে দেওয়ার প্রবণতায় নিষ্ঠুরতার ছায়া দীর্ঘ। 

তবে মানবসভ্যতা তো ইতিহাস থেকেই শিক্ষা নেয়, তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের দুনিয়ায় বেশিরভাগ দেশে মৃত্যুদণ্ডের সাজা রদ হয়ে গেছে। 'চোখের বদলে চোখ' নিয়ে যে ঘৃণ্যতম অপরাধের প্রবণতা রুখে দেওয়া যায়, সংখ্যাগুরু বিশ্ব এই তত্ত্বকে তামাদি ঘোষণা করে দিয়েছে অনেক কাল আগেই। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কালোবাজারীদের ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসি দেওয়ার নিদান দিলেও কার্যত তার প্রভাব লবডঙ্কা ছাড়া কিছুই নয়। অপরাধ-বিজ্ঞান নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদেরও সমীক্ষা ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ এই যে, মৃত্যুদণ্ডের সাজার সংস্থান কোনও অপরাধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ‘ডেটারেন্ট ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করে না। আর তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো এই দেশে নারীদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া হাজারও অপরাধের খতিয়ান। তার পরেও আমরা 'ফাঁসি ফাঁসি' করে এমন বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছি কেন? আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর কেবলই কি হননের জোয়ার-ভাঁটা? আমরা কি চাই আমাদের সমবেত হিংসার বাষ্প ফেটে পড়ুক বিচারের পাতায় পাতায়? 

আদালতের যে রায় নিয়ে এত কথা, সেখানে কিন্তু সব থেকে বড় ভরসার কথা এইটেই, আদালত সমস্ত সাক্ষ্য, তথ্যপ্রমাণ ও ফরেনসিক রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে তা হল-- এই জঘন্যতম অপরাধটি একজন অপরাধীই সংগঠিত করেছে। তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বিচারপতি বলেছেন, সিবিআই'এর তদন্তকারী অফিসার প্রাপ্ত তথ্য ও প্রামাণ্য নথির ওপর ভিত্তি করে একটি 'চেইন অফ ইভেন্টস' তৈরি করেন। সেই 'চেইন'কে অনুসরণ করে মাননীয় বিচারপতি সমস্ত তথ্যাদি ও ঘটনাক্রমকে খতিয়ে দেখে এবং আনুষঙ্গিক জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়ায় ১৭২ পাতার রায় দেন। সেখানে তিনি সমস্ত খুঁটিনাটি বর্ণনা ও বিশ্লেষণ পেশ করে এবং ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলার (মনোজ ও অন্যান্য বনাম মধ্যপ্রদেশ সরকার) রায়ে উল্লিখিত 'বিচারকে রক্তের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠা'র মানসিকতার বিরোধিতার প্রসঙ্গ পেড়ে লেখেন, আরজিকরে সংগঠিত অপরাধ নিকৃষ্ট ও ভয়ঙ্কর, তবুও তিনি অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড নয় আমৃত্যু কারাবাস ও সংশোধনের প্রক্রিয়ার পথ ধরে চলার আদেশ দিচ্ছেন। 

আমরা কি ফাঁসি চাই, না অপরাধের উপযুক্ত তদন্ত ও প্রতিটি দোষীর আইনানুগ সাজা? নিজেরা সাজা ঠিক করে আইনের কাছে তার অনুমোদন আদায় করার মাধ্যমে আমরা কি আসলে পুরো বিষয়টাকেই গুলিয়ে দিয়ে সম্প্রচার করছি নিজেদের মধ্যে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা হিংসা ও আগ্রাসনের? অথচ হাতের কাছে হাজির ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভুল সাজা’র উদাহরণ। আফজল গুরুকে ফাঁসিতে চাপাবার আগে কার্যত তাঁর কোনও বিচারই হয়নি, এই তথ্য পেয়েছি কোভাড গান্ধির ‘ফ্র্যাকচার্ড ফ্রিডম’ বইতে। আবার, নিম্ন-আদালতের ফাঁসির সাজা উচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে গেছে এমন উদাহরণ প্রচুর। আর বিলকিস বানু-র ‘ধর্ষক’দের রাষ্ট্রের তরফে মুক্তি দিয়ে ফুলমালা সহ সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছে, এই তথ্যও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। সদ্য মুক্তি পাওয়া সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা-কাহিনি ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’এ আমরা খুঁজে পাই এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে যিনি নিজের চাকুরি জীবনে বেশ কিছু মৃত্যুদণ্ড নিয়ে রীতিমতো অনুতপ্ত। পরিচিত বাংলা ছবি ‘সবার উপরে’ও আমরা পেয়েছি এক ভুল বিচারের গল্প। আসলে বিষয়টা এই যে, সমাজে, সাহিত্যে বিচারের পাশাপাশি ‘অন্যায্য’ বিচারেরও একটা উপস্থিতি আছে। বিশেষ করে, একটা পর্যায়ে এসে এই ধরনের বিচার খুব সূক্ষ্ম ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। তাই যাকে বলে নিবিড় পর্যবেক্ষণ বা ক্লোজ স্ক্রুটিনি তার গুরুত্ব খুব বেশি। নিম্ন আদালতের বিচারক এ ক্ষেত্রে যে রায় লিখেছেন তাতে এই নিবিড়তার ছায়া খুব প্রত্যক্ষ। 

আমরা কেউ মূল চক্রীদের অপরাধ কমিয়ে দেখানোর পক্ষপাতী নই। অপরাধীরা উপযুক্ত সাজা পাক এইটিই আমাদের উদ্দেশ্য ও বিধেয়। কিন্তু গণ-আদালতে নিজেদের মতো বিচার করে সাজা দেওয়ার প্রলোভন কেন আমাদের এমনভাবে খেপিয়ে তুলেছে তার হদিশ পাওয়া মুশকিল। এক সময় রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে গণধোলাইয়ের প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল, সেই সময় কবীর সুমন ‘কাঁদতে দে’ শিরোনামে একটি গান বেঁধেছিলেন। সেখানে ছিল গণপ্রহারে ক্ষতবিক্ষত এক ছেলের চোখে দেশলাই জ্বেলে দেওয়ার বর্ণনা। ব্যক্তি হিংসার থেকেও সমবেত হিংসার দাপট ও তাপ অনেক বেশি বিপজ্জনক। এক নারকীয় অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় নিজেরা প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে জড়িয়ে গিয়ে আমরা কি তাহলে প্রতিদিন একটু একটু করে খুনি হয়ে উঠছি?


Monday, 20 January 2025

ন্যায়বিচার চাই, না ক্যাঙারু কোর্ট?

অপরাধী সঞ্জয় রায় কি 

ঘোলাজলে সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে?

মালবিকা মিত্র



২০ জানুয়ারি ভরা এজলাসে সিবিআই ও নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবীদের ফাঁসির দাবিকে অগ্রাহ্য করে শিয়ালদহ আদালতের বিচারপতি দোষী সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাবাসের সাজা দিয়েছেন। বিচারপতি জানিয়েছেন, তাঁর কাছে সঞ্জয় রায়ের অপরাধ 'বিরলের মধ্যে বিরলতম' বলে মনে হয়নি। কেন? এই প্রশ্ন উঠবে। বলাই বাহুল্য, তিলোত্তমার ধর্ষণ ও খুনের তদন্ত, তার বিচার প্রক্রিয়া এবং অবশেষে শাস্তি প্রদান নিয়ে কেউ কেউ সন্দিহান ও ক্ষুব্ধ। খবরে প্রকাশ, এইসব বিষয়ে ২২ জানুয়ারি ও ৫ ফেব্রুয়ারি যথাক্রমে সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্টে শুনানিরও সম্ভাবনা আছে। খুব স্বাভাবিক যে, নানাজনের নানা মতের মতোই এই নৃশংস ঘটনাটির ক্ষেত্রেও লোকজনের নানারকম পর্যবেক্ষণ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বোধ ভিত্তিক মতামত সমাজ পরিসরে গত ৫-৬ মাস ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে যেমন বড় বড় সব মিথ্যাচার ও গুজব আছে, আবার কিছু কিছু প্রশ্নের যাথার্থ্যও আছে। 

গত ১৮ জানুয়ারি শিয়ালদহ আদালতে সঞ্জয় রায়কে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করার পর পরিচিতজনদের কাছ থেকে কয়েকটা মেসেজ পেলাম। সেগুলো উল্লেখ করেই কথা শুরু করি-- 

১) বিচার আমাদের দেশে হতে দেখেছেন?  বিজেপি তো বলেই দিয়েছিল এজেন্ডা রামমন্দির বানানো। পাবলিক তো তাতেই ভোট দিল। আর টিএমসি? টিএমসি বিজেপির ভালবাসা (সেটিং)? মোদী হচ্ছে মমতার রক্ষক। দুটোই বজ্জাত। তাই এসব আদালতের রায়ে কোনও ভরসা নেই; 

২) বিচার আর বিশেষ কী হবে? মোদি-মমতা সেটিং। সিবিআই কলকাতা পুলিশের ঢেকুর তুলছে। অধিকাংশ তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়ে গেছে। দায়িত্ব নেওয়ার আগে কলকাতা পুলিশ পাঁচদিন সময় পেয়েছে। কলকাতা পুলিশ তার ভেতরে সব সেরে ফেলেছে। এখন সঞ্জয় বলির পাঁঠা। ও আর একটা ধনঞ্জয়। পেছনের পর্দার আড়ালের কারিগররা অধরাই থেকে যাবে। হাওয়াই চটি আর সাদা শাড়ির আড়ালে সবাই সাদা; 

৩) ভদ্রলোকের এক কথা। একবার বলে দিয়েছি, সঞ্জয় রায়কে আরজিকর কাণ্ডে দোষী মানি না। ব্যাস। এক কথা। বলে দিয়েছি গণধর্ষণ। ব্যাস। যা বলেছি, বলে দিয়েছি। এখন সুপ্রিম কোর্ট বললেও মানবো না। অপরাধী একমাত্র বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার, নিতান্ত কোনও মন্ত্রীর ঘর থেকেই বেরতে হবে। 

প্রতিক্রিয়াগুলো প্রাপ্তির অপেক্ষা করছিলাম। প্রথম দুটি প্রতিক্রিয়া আমার একদা ট্রেন পথের সহযাত্রী একজন শিক্ষিকা এবং আর একজন সরকারি কর্মচারী আর তৃতীয় প্রতিক্রিয়াটি আমার ছাত্রের। ও সাংবাদিক হিসেবে বেশ সুনাম করেছে। 

সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় দেখলাম, আগের দিনও সমাজ মাধ্যমে দেখেছিলাম, অভয়ার বাবার উক্তি, 'ভরসা রেখেছিলাম, পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন', তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে ১৮ জানুয়ারি  বিচারপতিকে বলেছেন। অবশ্য ইনি আগে একাধিকবার সিবিআই'এর তদন্ত প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখতে পারেননি বলে জানিয়েছিলেন। অমিত শাহ'র সঙ্গেও দেখা করতে চেয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে ভরসা রাখতে পারেননি। 

এ ক্ষেত্রে মৃতার পরিবারকে প্রথমেই আলোচনার বাইরে রাখা উচিত। কারণ, এই ধরনের পরিস্থিতিতে বহু মানুষ উপদেশ দেয়। অমুক ডাক্তার ভালো, অমুক ডাক্তার খারাপ; কী সর্বনাশ, এ তো আমার ননদের ছেলেকে প্রায় প্রাণে মেরে ফেলেছিল! ডাক্তার পাল্টাও, একবার পীরের থানে গিয়ে দেখতে পারো, একটু আয়ুর্বেদ করাও। অর্থাৎ, পরিবারে যখন কারও দুরারোগ্য ব্যাধির সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং চিকিৎসায় বিশেষ ফল হচ্ছে না, তখন অজস্র মতামত পরিবারকে চালিত করে। এ ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে, এক কথায় তাঁরা প্রতারিত। কখনও বিকাশবাবুকে পরিত্রাতা ভাবছেন, আবার পরক্ষণে বিকাশবাবুকে ছেড়ে বৃন্দা গ্রোভারকে ধরেছেন এবং শেষে তাঁকেও ছেড়েছেন। ভিকটিমের পরিবারের এ হেন আচরণ সমালোচনার ঊর্ধ্বে। কিন্তু প্রশ্নটা হল, আশেপাশে যাঁরা সহানুভূতির মুখোশ পরে কথা বলছেন, মতামত দিচ্ছেন, তাঁরা গোল বাঁধাচ্ছেন। 

প্রসঙ্গত বলে রাখি, সিবিআই'এর প্রথম চার্জশিটের প্রেক্ষিতেই ১৮ই জানুয়ারির এই রায়দান। সিবিআই তার সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট এখন পর্যন্ত দেয়নি। জানি না এর পরেও তা দেওয়ার সুযোগ আইনে থাকে কিনা। সিবিআই নিজে কিন্তু জানিয়েছে তথ্য প্রমাণ লোপাটের কথা। অতএব, এই মামলায় রায় হলেও উচ্চ আদালতে গিয়ে দোষী সাব্যস্ত সঞ্জয় রায় কিন্তু শুরু থেকেই একটি মোক্ষম অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করবে। তা হল, তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়েছে। তাহলে সে ক্ষেত্রে সত্যতা, যথার্থতা যাচাই হবে কীভাবে? অতএব উচ্চ আদালতে সঞ্জয়ের শাস্তি লঘু হবার সম্ভাবনা সিবিআই করে রেখেছে।

আমার প্রশ্নটা অন্যত্র। বহুদিন যাবৎ শুনে এসেছিলাম, 'তথ্য প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা' শব্দটি। এই চেষ্টার কারণে সাজার কথাও শুনেছি। অর্থাৎ, তথ্য প্রমাণ আছে, পাওয়া গেছে। সেগুলো লোপাট করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এখন অভয়া মামলায় নতুন শব্দটা শুনলাম 'তথ্য প্রমাণ লোপাট হয়েছে'। কী তথ্য প্রমাণ? সেটা কারও জানা নেই, কারণ সেটা তো লোপাট। এই যে একটা ধরে নেওয়া তথ্য প্রমাণ, যা কারও জানা নেই এবং সেটা লোপাট হয়ে গেছে, এটা শুনে আমার কাছে ছেলেমানুষী যুক্তি মনে হয়েছে।

ঘুম ভেঙ্গে বাচ্চার বায়না, আমার পাতাতি'টা কোথায় গেল? বাড়ির লোক বোঝে না, পাতাতি, সেটা কী? বাচ্চা কী বলে? ওই যে সেই তা। আমার ছিল পাতাতিটা কোথায় গেল? বড়রা এটা সেটা এনে দেখায়, এইটা? ওইটা? কোনটা? আমার পাতাতিটা। কথা হল, পাতাতি বস্তুটা কী? এটা তো আগে জানতে হবে। যদি সেটাই জানা না থাকে, তাহলে কোথায় গেল, লোপাট হল কীভাবে, কে লোপাট করল জানব কীভাবে? তথ্য প্রমাণ যেহেতু লোপাট হয়ে গেছে, অতএব ওটা আর জানা সম্ভব না। এ যেন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। এত নিপুণ নিখুঁত যে শত্রুপক্ষ টের পায়নি, গাছপালা পাহাড় নদী পশুপাখি কেউ টের পায়নি, অপারেশন হয়ে গেছে। কেউ জানে না শুধু কর্তামশাই জানেন, হইছে হইছে জানতি পারো নাই। তার কোনও চিহ্ন কোথাও পড়ে নেই। 

সিবিআই'এর বিরুদ্ধে অভিযোগ! সেটার মানে বুঝতে পারি। সেই যদি কলকাতা পুলিশের তদন্তের ন্যায্যতাই স্বীকৃত হয়, তাহলে সিবিআই চেয়ে লাভ কী হল? লক্ষ্যটা ছিল কলকাতা পুলিশ দোষীদের আড়াল করছে, এটা প্রতিষ্ঠা করা। তাই সিবিআই। সেই সিবিআই বিস্তর ক্রস-চেকিং করে এখন কলকাতা পুলিশের তদন্তকেই যথার্থ বলে গ্রহণ করেছে। সমস্যা হল, অভয়ার বিচারের নামে যারা হইচই চেয়েছেন তাদের কাছে এটা মেনে নেওয়া খুবই অসুবিধাজনক। কতবার কত ভাগে লালবাজার অভিযান হল। বিনীত গোয়েলকে শিরদাঁড়া উপহার দেওয়া হল। এখন সিবিআই তদন্তকে মেনে নেওয়া হলে কলকাতা পুলিশকেই মেনে নেওয়া হয়। মানে হাওয়াই চটিকে মেনে নেওয়া হয়। তাহলে 'চটিচাটা' শব্দটা বসবে কোথায়? নতুন শব্দ আসবে 'থুতুচাটা'।

আমার বেশ মজাই লেগেছে। ধরুন, ডাক্তারবাবু ফুসফুসের সংক্রমণ দেখেছেন এবং কিছুটা ফ্লুইড জমেছে; সেই ফ্লুইড বিপজ্জনক কিনা পরীক্ষা করানোর জন্য দুটি ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হল। দুটি ল্যাবের রিপোর্টই নির্দোষ বলে ঘোষণা করল। রোগীর বাড়ির লোকেদের প্রতিক্রিয়া, তাহলে এসব পরীক্ষা করে কী লাভ হল, খালি খালি দু' জায়গায় পয়সা খরচ। ব্যাপারটা যেন, একটা জটিল প্রাণঘাতী রোগের তথ্য ধরা পড়লে পয়সাটা সার্থক হত। ক্রস-চেক তো পরীক্ষার রিপোর্ট নির্ভুল করার জন্য করা হয়। যদি ক্রস-চেকের উদ্দেশ্যই হয় ক্যানসার ধরা, তাহলেই সমস্যা। 

পাঁচ দিন বাদে সিবিআইকে হস্তান্তর, এটা নাকি খুব বিলম্বিত। ততদিনে কলকাতা পুলিশ তথ্য প্রমাণ লোপাট করে ফেলেছে। তা আমার প্রশ্ন, কবে কোথায় ঘটনার প্রথম দিনে প্রথম ঘণ্টায় সিবিআই দায়িত্ব নিয়েছে? যে কোনও ঘটনায় ফার্স্ট ইনফরমেশন রেকর্ডেড হয় তো লোকাল থানায়। তাহলে তো রাজ্যের পুলিশি ব্যবস্থাটা তুলে দেওয়া উচিত। কারণ, সিবিআই'কে প্রথম ঘন্টায় প্রথম মিনিটেই দায়িত্ব দিতে হবে। সিবিআই নিজের দুর্বলতা ও অপদার্থতা ঢাকতে এই সূত্রটিকে কাজে লাগায়, তথ্য প্রমাণ লোপাট হয়ে গেছে। তাই যদি হয়, দায়িত্ব না নিলেই পারেন। এ তো সেই ডাক্তার, আগেই বলে রাখেন, বড় দেরি করে এনেছেন, রোগীকে প্রায় মেরে এনেছেন। এসব বলে নিজের সম্ভাব্য ব্যর্থতাকে আগেই সেফগার্ড দেওয়া।

এর সঙ্গে বলতে হয় সেটিং তত্ত্ব। ধরেই নিলাম, যারা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তাদের সেটিং তত্ত্ব সঠিক। এই তত্ত্বটা ২০১৪ নির্বাচন থেকেই শুরু হয়েছিল। আর প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল ২০১৯, ২০২১, ২০২৪ সালে। সেটিং তত্ত্বের প্রবক্তাদের বলি, পশ্চিমবাংলায় ধরে নিলাম বিজেপি এবং তৃণমূলের সেটিং আছে। তাহলে তো এ কথাও মানতে হয়, পশ্চিমবাংলার ৮০/ ৯০ শতাংশ জনমত এই সেটিং'এ প্রভাবিত। বিরোধী কংগ্রেস, বাম ও অতি বামদের সম্মিলিত জনসমর্থন ১০ শতাংশেরও কম। ১০ শতাংশের বিরুদ্ধে ৯০ শতাংশের সেটিং? একবার ভেবে বলবেন। ২০১৬ সালেও কংগ্রেস ও বামেরা প্রায় ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সেই ভোটটা নেমে ৪ থেকে ৬ শতাংশ হল কীভাবে? আর বিজেপির ভোটটা ১০/১২ শতাংশ থেকে ৩৬/৩৮ শতাংশ বাড়ল কী করে? কার সাথে কার সেটিং হল? 

নির্বাচনের ফলাফল থেকে শুরু করে আরজিকর কাণ্ড, আনিস থেকে সন্দেশখালি-- সর্বত্র কল্পনার পোলাওয়ে ঘি ঢেলেছেন। ঘি'এর কোনও মাপ থাকেনি। এখন বাস্তবে পোলাওয়ের অস্তিত্ব না দেখে সেটিং বলা ছাড়া আর কী উপায় থাকতে পারে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে ভাবের ঘরে এত কাহিনির জন্ম হয়ে গেছে যে সেই ভাব বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে, এক বিরাট স্বপ্নভঙ্গ ও হতাশা। এই স্বপ্নভঙ্গ-হতাশার ব্যাখ্যা একমাত্র সেটিং ও তথ্য প্রমাণ লোপাট তত্ত্বের মধ্যেই আশ্রয় খুঁজবে, এটাই স্বাভাবিক।

সঞ্জয় রায়কে যে ১১টি অকাট্য প্রমাণ হাজির করে সিবিআই অভিযুক্ত সাব্যস্ত করে চার্জশিট দিয়েছে, সেগুলো এখন পর্যন্ত কেউ খণ্ডন করেননি। এবার অভয়া মঞ্চের দাবি হিসেবে আমি মেনে নিচ্ছি যে, নেপথ্যে আরও অনেকের হাত আছে এবং তথ্য প্রমাণ লোপাট হয়েছে। কিন্তু হাওয়ায় ভাসানো এই কথা পথসভায় দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে বলা যায়, আদালতে বলতে গেলে, কারা এর পেছনে আছে, কারা লোপাট করেছে, কীভাবে করেছে, হলফনামা দিয়ে বলতে হবে। তা না হলে সংবাদ মাধ্যমের সান্ধ্য মজলিসে বাজার গরম করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই এগোবে না। যারা এত জোর দিয়ে বলছেন আরও অনেকে যুক্ত আছে, তারা একবার নামগুলো বলছেন না কেন সিবিআই'এর কাছে বা আদালতে দাঁড়িয়ে! 

এখনও যুক্তি হিসেবে সেই সুবর্ণ গোস্বামীর 'দেড়শো গ্রাম বীর্য' কখনও একজন ধর্ষকের উপস্থিতি প্রমাণ করে না। কিন্তু কথা হল, দেড়শো গ্রামের তত্ত্বটাই তো ভুয়ো। এর ফলে অভয়ার বিচার প্রক্রিয়া মসৃণ ভাবে অগ্রসর তো হবেই না বরং অপ্রমাণযোগ্য কিছু যুক্তি এনে বিচার প্রক্রিয়াকে ধোঁয়াটে করে দেওয়া হবে। অভয়া মঞ্চের জাস্টিস'এর দাবিদারদের কাছে তাই সবিনয় নিবেদন, আপনাদের কাছে যা তথ্য আছে সেগুলি অনুগ্রহপূর্বক আদালতে পেশ করুন। ডোরিনা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে সেগুলো তথ্য যুক্তি প্রমাণ ছাড়া পেশ করবেন না। এর ফলে অভয়া মঞ্চ সম্পর্কে সাধারণ মানসে সন্দেহের বাতাবরণ সৃষ্টি হচ্ছে। 

এমনিতেই জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির সময়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রদত্ত তালিকা অনুযায়ী এক বিরাট সংখ্যক ডাক্তার স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডে বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা করেছেন, অভয়ার জাস্টিসের দাবিতে কোটি কোটি টাকা তহবিল সংগ্রহ হয়েছে, এমনকি কোনও কোনও জুনিয়র ডাক্তার নেতার অনৈতিক ভুয়ো ডিগ্রি ভাঁড়িয়ে বেআইনি প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অভিযোগ উঠেছে, ধর্না মঞ্চে কর্পোরেট হাসপাতাল ও ওষুধ কোম্পানির ঢালাও অর্থ ব্যয় হয়েছে-- এসবই জনমানসে অস্পষ্টতা তৈরি করেছে। 'এর মধ্যে আরও অপরাধী আছে' এই প্রমাণবর্জিত কথা, 'তথ্য প্রমাণ লোপাট' প্রসঙ্গ অভয়ার সুবিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে বলেই আমার বিশ্বাস।

তবুও তিলোত্তমার বিচারে অপরাধী শাস্তি পেয়েছে। সিবিআই'এর যদি 'সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট' বলে কিছু থেকে থাকে তা তারা আদালতে পেশ করুক। আরও কেউ অপরাধী থাকলে তারাও তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় উন্মোচিত হোক। কিন্তু তা ন্যায়বিচারের পদ্ধতি মেনেই; ক্যাঙারু কোর্ট বা গোদি মিডিয়ার যুক্তিহীন সান্ধ্য জলসায় নয়। 


Tuesday, 14 January 2025

ধৈর্যের পরীক্ষা!

কৃষক আন্দোলন 

অভূতপূর্ব মোড় নিতে পারে 

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



কৃষকদের আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হয়েছে গত বছরের গোড়া থেকেই। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের যা মতিগতি, তাতে আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষকদের দিল্লি অভিযান অনিবার্য হয়ে উঠেছে।  দেশের অন্ন যাঁরা জোগান, মোদী সরকার তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পর্যন্ত নারাজ। আর আদালতের ভূমিকাও স্যালুট করার মতো নয়; শীর্ষ আদালতের যত আগ্রহ সড়ক থেকে আন্দোলনরত কৃষকদের হঠিয়ে পরিবহন যাতায়াতের সুবিধা করে দেওয়ায়, ততটা আগ্রহ নেই কৃষকদের মূল দাবিগুলোর সুষ্ঠু সমাধানে সরকারকে বাধ্য করানোয়। তা সত্ত্বেও কৃষকরা এখনও পর্যন্ত প্রশংসনীয় ধৈর্য দেখাচ্ছেন। কিন্তু এই  ধৈর্য কতদিন থাকবে আমার গভীর সন্দেহ আছে। যে কোনও সময়ই মাটির এই মানুষগুলো আক্রমণাত্মক হতে পারেন। এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে, যে কোনও সময় কৃষক আন্দোলন চমকপ্রদভাবে অন্য চেহারা নিতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, গত তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবাদী দু'জন কৃষক নেতা আত্মঘাতী হয়েছেন। 

তবে এটাও ঘটনা, কেন্দ্রের মোদী সরকারকে গত দশ বছরে যদি কোনও গণআন্দোলন বিব্রত করে থাকে, সেটা কৃষক বিক্ষোভ। ২০২১ সালে কৃষকদের আন্দোলনের জেরে কৃষি আইন প্রত্যাহারও করতে হয় কেন্দ্রকে। কিন্তু তারপরও সমস্যা মেটানো যায়নি।

২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও মোদীর যে ৪০০ পূরণের স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়েছে, তার অন্যতম কারণ কৃষকদের দুর্মর আন্দোলন। এখনও পঞ্জাব-হরিয়ানার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কেন্দ্র বিরোধী বিক্ষোভে কৃষকরা। কৃষক নেতা জগজিৎ সিং দাল্লেওয়াল এখনও অনশনে। কৃষকরা এখন পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছেন। হরিয়ানা, রাজস্থান আর উত্তরপ্রদেশে কৃষকরা বিক্ষোভের সূত্রপাত করেন। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনে মোট ৫ জন নিহত আর ১০ জনের মতো বিক্ষোভকারী জখম হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অনেক কৃষককে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে আর আন্দোলনরত কৃষকদের বিরুদ্ধে বহু এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছে। কৃষকরাও বেশ কয়েকবার অহিংস পথে দিল্লি সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টা করলেও সতর্ক দিল্লি পুলিশ নানাভাবে তাঁদের বাধা দেয়। মন্থর গতিতে আন্দোলন ২০২৪ জুড়ে চললেও গত ডিসেম্বরে এটি একটি নতুন মাত্রা অর্জন করে। সংযুক্ত কৃষক মোর্চা (অরাজনৈতিক)  আর ক্রান্তিকারী কৃষক মোর্চা গত ৬ ডিসেম্বর দিল্লি অভিযানের ডাক দিতেই আন্দোলন তীব্রতা পায়। পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে ধারাবাহিক প্রতিবাদ শুরু হয়।

মোদীর প্রতিশ্রুতির পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কৃষকদের আন্দোলনের প্রথম পর্যায়টি স্থগিত করার ডাক দেয় সংগঠনগুলোর সংযুক্ত কমিটি। কিন্তু যেদিন থেকে মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার দ্বারা প্রতারিত হওয়া টের পান কৃষকরা, শুরু হয় ফের আন্দোলন। তিনটি বিতর্কিত খামার আইন প্রত্যাহার ও সরকার তাদের অনেক দাবিকে বাস্তবায়িত করার আশ্বাস দেওয়ার পরে কৃষকরা ন্যায্যত অনুভব করেছিলেন তাঁদের দাবি পূরণ হবে। কিন্তু কৃষক সংগঠনগুলো বলছে, আশ্বাস পূরণ হয়নি। ২০২১'এর আন্দোলনে ৭৫০ জন কৃষক প্রাণ হারিয়েছিলেন আর কৃষকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছিল।

সম্প্রতি দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখর কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানকে এই প্রসঙ্গে তিরস্কার করেন। তিনি ওই প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে চৌহানকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন, কেন কেন্দ্র প্রতিবাদী কৃষকদের সঙ্গে কথা বলছে না। তিনি বলেন, 'প্রতিটি মুহূর্ত আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি হিসাবে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, দয়া করে আমাকে বলুন, কৃষকদের কোন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল আর কেন তা পূরণ করা হয়নি? প্রতিশ্রুতি পূরণে আমরা কী করছি? গত বছর একটা আন্দোলন হয়েছিল, আর এই বছরও একটা আন্দোলন হয়েছে। সময় চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা কিছুই করছি না।' উপরাষ্ট্রপতি এমনকী জগজিৎ সিং দাল্লেওয়ালের প্রসঙ্গও টানেন। ধনখর কেন্দ্রকে স্পষ্ট সতর্ক করেছিলেন যে সরকার তার নিজের লোকদের সঙ্গে লড়াই করতে পারে না বা তাদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে না যেখানে লড়াই করা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। সেদিন উপরাষ্ট্রপতি নিজেকে কৃষক পরিবারের সন্তান বলে দাবি করে খুল্লামখুল্লা বলেন, 'আমরা এই ধারণা নিয়ে বসে থাকতে পারি না যে তাদের সংগ্রাম ক্রমে সীমিত হবে আর তারা শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আমাদের ভারতের আত্মাকে বিরক্ত করা উচিত নয়, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করা উচিত নয়। আমরা কি কৃষক সমাজ ও সরকারের মধ্যে একটি সীমানা তৈরি করতে পারি? যাদের আমাদের আলিঙ্গন করতে হবে তাদের দূরে ঠেলে দেওয়া যাবে না।' ভারতের উপরাষ্ট্রপতির এইসব মন্তব্য কৃষকদের আন্দোলনের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতাকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। আন্দোলন এসে পড়েছে ২০২৫-এ। প্রতিবাদী জগজিৎ সিং দাল্লেওয়ালের অনশন ৪৯ দিনে পড়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। উদ্বিগ্ন সুপ্রিম কোর্ট আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'কেন আপনার ক্লায়েন্ট একটি বিবৃতি দিতে পারে না যে প্রকৃত দাবিগুলি বিবেচনা করবে আর কৃষকদের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমাদের দরজা খোলা আছে?' এরপরও কিছুই এগোয়নি। 

কৃষকদের বিক্ষোভ ও তাঁদের নেতা জগজিৎ সিং দাল্লেওয়ালের অনশনের কথা বিবেচনা করে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের সঙ্গে কথা বলে একটি সমাধান খুঁজে বের করার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ আদালতের বিচারপতি। এই কমিটি কৃষি ও অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। কমিটির কাজ কৃষকদের সমস্যা আর দাবিগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা।

কিন্তু কৃষক সংগঠনগুলি এই কমিটির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নিতে অস্বীকার করে। যার ফলে পরিস্থিতি স্থবির হয়ে আছে। কৃষক সংগঠনগুলোর বক্তব্য, এই সমস্যা ও সঙ্কট আদালতের বিষয় নয়, এটা সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি ও সদাশয়ের ওপর নির্ভর করছে। কিষাণ মজদুর মোর্চা (কেএমএম) ও কিষাণ মজদুর সংগ্রাম কমিটির (কেএমএসসি) সমন্বয়কারী কৃষক নেতা সারওয়ান সিং পান্ধের সাফ কথা, 'এটা আদালতের বিষয় নয়। আমাদের দাবি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে, আর সরকারের নিজেই আলোচনার জন্য এগিয়ে আসা উচিত।' তিনি অভিযোগ করেন যে কৃষকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে এই বৈঠক ডাকা হয়েছিল আর কমিটি এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের সামনে তাদের সুপারিশ পেশ করেছে। পান্ধের আরও অভিযোগ, কমিটি কিছু নিয়ম আর শর্ত দিয়েছে, যে কারণে কৃষকরা বৈঠক না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যদিকে সরকার পক্ষের অভিযোগ, অনশনরত কৃষক নেতা জগজিৎ সিং দাল্লেওয়ালের অবস্থা ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ করার চেষ্টা করা হচ্ছে; চূড়ান্ত একটা কিছু ঘটে গেলে কৃষকরা সেন্টিমেন্টাল ইস্যু করে ফয়দা লুঠতে চায়। 

বাস্তব ঘটনা হচ্ছে, ব্যাপারটা কিন্তু দাল্লেওয়ালেই সীমাবদ্ধ নয়। গত বৃহস্পতিবার শম্ভু সীমানায় বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন আন্দোলনরত ৫৫ বছর বয়সী কৃষক নেতা রেশম সিং। ঘটনাটি জানতে পেরে তাঁর সতীর্থরা দ্রুত তাঁকে পাতিয়ালার রাজেন্দ্র হাসপাতালে নিয়ে যান। দুপুরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত কৃষক নেতা পঞ্জাবের তরন তারন জেলার পাছবিন্দের বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি আন্দোলনরত সতীর্থদের সঙ্গে বসেছিলেন। তখনই আচমকা বিষ খেয়ে নেন ৫৫ বছরের ওই প্রৌঢ়। আন্দোলনকারী  কৃষকদের অভিযোগ, মোদী সরকারের ওপর ক্ষোভ থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওই কৃষক। রেশম সিংয়ের আত্মহত্যা গত তিন সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ঘটনা।

গত ১৮ ডিসেম্বর শম্ভু সীমানায় আত্মহত্যা করেছিলেন রণযোধ সিং নামে এক কৃষক নেতা। রবিবারই খানাউড়ি সীমানায় আন্দোলনরত এক বয়স্ক কৃষি শ্রমিক মারা গিয়েছেন। ফরিদকোটের এই কৃষি শ্রমিককে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। 

নভেম্বরের শেষ থেকেই দফায় দফায় শম্ভু সীমানা থেকে দিল্লির উদ্দেশে মিছিল করে এগোনোর চেষ্টা করেছেন কৃষকরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে তৈরি ছিল প্রশাসনও। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ভোর থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা। এলাকায় জারি হয়েছিল ১৬৩ ধারা। কৃষকরা ব্যারিকেড টপকে এগোতে গেলে তাঁদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বাধে পুলিশের। ছোড়া হয় জলকামান, কাঁদানে গ্যাস। তাই বার বারই কৃষকদের 'দিল্লি চলো' অভিযানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি), কৃষি ঋণ মকুব, পেনশনের ব্যবস্থা ও বিদ্যুতের বিল না-বাড়ানোর মতো বেশ কয়েকটি দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কৃষকদের এই আন্দোলন চলছে। গত বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে দিল্লি লাগোয়া পঞ্জাব আর হরিয়ানার শম্ভু ও খানাউড়ি সীমানায় সংযুক্ত কিষান মোর্চা (অরাজনৈতিক) ও কিষান মজদুর মোর্চার ব্যানারে অবস্থানে বসে রয়েছেন কৃষকরা। ২৬ নভেম্বর থেকে কৃষক নেতা জগজিৎ সিং দাল্লেওয়াল আমরণ অনশন শুরু করার পর আন্দোলন নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে কিছুটা মলম লাগাবার গরজে বছরের প্রথম দিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের শেষে নিজেদের কৃষকদরদী প্রমাণ করার জন্য বড় ঘোষণা করে মোদী সরকার।

'প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা প্রকল্প'কে এবার ঢেলে সাজাতে চাইছে কেন্দ্র। এই লক্ষ্যে ৬৯,৫১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করার কথা জানানো হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণের জন্য ৮০০ কোটি টাকার তহবিলও গড়ছে সরকার। কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত অত্যন্ত জরুরি ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি)) সার উৎপাদনকারীদের জন্য বিপুল অঙ্কের বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রীসভা। নতুন এই এককালীন বিশেষ প্যাকেজের অধীনে মোট ৩,৮৫০ কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া হবে। উল্লেখ্য, এর আগে এই সারেই এনবিএস ভর্তুকি ছিল। তার ওপরে এই বিশেষ প্যাকেজের মাধ্যমে অতিরিক্ত ভর্তুকি দেবে কেন্দ্র।

কিন্তু কৃষকরা তাঁদের দাবিতে অনড়। উত্‍পাদিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি গ্যারান্টি আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত তাঁরা সরছেন না। জগজিৎ সিং দাল্লেওয়ালের ধনুকভাঙা পণে যতটা বিচলিত শীর্ষ আদালত বা দেশের সংবেদনশীল মানুষ, তার ন্যূনতম ছাপ নেই নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সতীর্থদের। তারা ভাবছে, ওই মলমেই কাজ হবে। 

কৃষকরা যে কতটা চড়া মেজাজে আছেন, তা বোঝা গেল দিলজিৎ দোসাঞ্জের ব্যাপার নিয়ে। নতুন বছরের সূচনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেন দিলজিৎ, এরপরই প্রতিবাদী কৃষক নেতাদের তীব্র সমালোচনার শিকার হন এই পঞ্জাবি তারকা। মোদীর সাথে দিলজিৎ দোসাঞ্জের বৈঠক নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে কৃষকরা গায়কের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দিলজিৎ দোসাঞ্জ মোদীর সঙ্গে তাঁর বৈঠককে নতুন বছরের ‘দুর্দান্ত শুরু’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, অন্যদিকে ‘নম্র সূচনা থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ তারকা হিসাবে দিলজিৎ-এর উত্থানের প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর পালটা প্রতিবাদী কৃষকদের কথা, 'দিলজিৎ যদি সত্যিই কৃষকদের কথা ভাবতেন, তাহলে শম্ভু সীমান্তে দাল্লেওয়ালজীর লড়াইকে সংহতি জানিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন, আমাদের উদ্বেগ শুনতেন আর তাঁর আগের বক্তব্যেই অটল থাকতেন। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে দেখা করায় ওঁর উদ্দেশ্য নিয়েই সংশয় দেখা দিচ্ছে।' প্রতিবাদী কৃষকরা এসব কথা নিছক অভিমান থেকে বলছেন না। আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০২০ সালে দিলজিৎ দোসাঞ্জ কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন, কেন্দ্রকে তাঁদের দাবি পূরণের আহ্বান জানিয়েছিলেন আর কৃষকদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন। ওই বছরই দিলজিৎ ইনস্টাগ্রামে কৃষকদের সমর্থনে এই পোস্টটি করেছিলেন: ‘২৫ সেপ্টেম্বর। আমরা সবাই কৃষক সমাজের পাশে দাঁড়াব। পঞ্জাবের সব বয়সের মানুষ কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।' কৃষকদের ভাষায় সেই দিলজিৎ এখন 'গদ্দার'।

আগামী দিনে এই কৃষক আন্দোলন এক ব্যাপক অভ্যুত্থানের চেহারা নিতে পারে। দাল্লেওয়ালজীর অনশন দেশবাসীকে এক বিপুল উৎকণ্ঠায় রেখেছে।


Saturday, 4 January 2025

'ফেল প্রথা'য় এত উৎসাহ কেন?

ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী

মালবিকা মিত্র



'সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।

কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে

সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা

কে বলিতে পারে আর; ...

 

সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর

স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,

শরীরে মাটির গন্ধ মেখে, 

শরীরে জলের গন্ধ মেখে,

উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে

চাষার মতন প্রাণ পেয়ে

কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?'

--বোধ/ জীবনানন্দ দাস।


এ এক অদ্ভুত সমাজ, যেখানে পারফিউমের নাম এনভি অথবা সিক্রেট। অর্থাৎ, সকলের তরে নয়। এটা বিশেষের জন্য এবং যিনি এটার ভোক্তা তার গর্ব এটা। সেই যে একটা বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন ছিল 'নেবার্স এনভি ওনার্স প্রাইড'। এমন একটা সমাজে সকলের মতো, সকলের সঙ্গে, সকলের তরে-- এ কথাগুলো খুবই মামুলি, বস্তাপচা, ব্যাকডেটেড। এ সমাজে 'যো জিতা ওহি সিকান্দার'। তাহলে কাউকে তো হারতেই হবে, তবেই কেউ জিততে পারবে। আর হার-জিতের এই খেলাতে জীবনকে মাপা হবে-- কে সফল কে ব্যর্থ। তাহলে বলুন দেখি, পরীক্ষা হবে আর পাশ ফেল থাকবে না, এ কি কখনও হয়! উত্তমর্ণ আর অধমর্ণ দেগে দিতে হবে না? তবেই তো সিকান্দার কে, চেনা যাবে। 

২০০৯ সালে দেশ জুড়ে প্রণয়ন করা হয়েছিল শিক্ষার অধিকার আইন। সেই আইন অনুসারে, ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতিটি শিশুর বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত শিশুর শিক্ষা সম্পূর্ণ করার দায় রাষ্ট্রের। সরকার পরিচালিত কোনও স্কুলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে না পাশ-ফেল প্রথা। এরপর ২০১৮ সালে মোদী সরকার পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। ওই বছরই লোকসভায় এবং পরের বছর (২০১৯) রাজ্যসভায় গৃহীত হয় সংশোধনী বিল (যদিও স্কুলশিক্ষার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে রাজ্যগুলি)। ইতিমধ্যেই ১৬টি রাজ্য এবং দু’টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল কেন্দ্রের নীতি অনুযায়ী পাশ-ফেল প্রথা চালু করেছে। 

এবারে গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে লাগু হয়েছে 'Right to Free Compulsory Child Education Amendment Rules 2024' যা মোতাবেক পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির অন্তে পরীক্ষায় যদি কোনও ছাত্র ফেল করে, তাকে দু' মাসের মধ্যে আরও একবার পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে; কিন্তু তারপরেও যদি কেউ ফেল করে তাহলে তাকে উক্ত শ্রেণিতে আটকে দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ এখনও এই সিদ্ধান্ত না নিলেও সম্ভবত নেওয়ার পথে।

এ তো শুধু কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, তাদের শিক্ষানীতি-- এসবের দিকে আঙ্গুল তোলার বিষয় নয়। তা করলে দায় এড়ানো যায় মাত্র। ওই যে এআইডিএসও, যারা কত দশক ধরে দাবি করে চলেছে প্রাথমিক স্তরে পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনতে হবে; বিদ্যালয়ে যান, বহু শিক্ষক, বা বলতে পারেন প্রায় সব শিক্ষক মনে করেন, পাশ-ফেল নেই বলে পড়াশোনা লাটে উঠেছে। অভিভাবকরা মনে করেন, পাশ-ফেল নেই বলে ছাত্রদের মধ্যে পড়ার তাগিদ নেই। শিক্ষকের ভেতরও পড়ানোর তাগিদ নেই, কারণ, শিক্ষকের সাফল্যের মাপকাঠি তো ওই পাশ-ফেল। 

আসুন একটু খুঁটিয়ে বিচার করে দেখি। পাস কি ছিল না? গ্রেডেশন ছিল তো। এ, এ প্লাস, ডাবল এ, বি, বি প্লাস, সি, সি প্লাস, আর ডি মানে ছিল নন-কোয়ালিফাইড, দুর্বলতম চিহ্নিত করা। তাহলে কেন পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন আসছে, ছিলই তো। যেটা ছিল না, 'ফেল' শব্দের অর্থটা একটু পরিবর্তিত হয়েছিল। দুর্বলতমকে চিহ্নিত করা হত কিন্তু তাকে শিক্ষার চলন্ত গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হত না। তোমার দ্বারা হবে না, তুমি এ গাড়ি থেকে নেমে যাও, এটা ছিল না। তাকে বলা হত, এই বিষয়গুলো আরেকটু যত্ন নাও না হলে পরের ক্লাসে তুমি এগোতে পারবে না, উচ্চ বুনিয়াদির গণ্ডি পেরতে পারবে না। একটা স্তর পর্যন্ত সেই দুর্বলতম শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে চলা হত। এর ফলে তার মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করত না। অনিবার্য ড্রপ-আউট ঘটত না। বিদ্যালয় শ্রেণি কক্ষ, শিক্ষক, ছাত্র, বন্ধুবান্ধব, এই সামগ্রিক পরিবেশে তার সামাজিক কিছু একটা অর্জন হত। আর হয়তো কিছু কিছু পুঁথিগত শিক্ষাও অর্জন হত। 'ফেল' প্রথা চালু করে তাকে ড্রপ-আউট হতে বাধ্য করা হল। 

বহুবারের চর্চিত বহু লেখায় কথিত উদাহরণটি আর একবার বলতে হয়। যে ছাত্রটি ফেল প্রথা না থাকার ফলে সকল বিষয়ে শূন্য, তিন, পাঁচ, এরকম নম্বর পেয়ে দিব্যি পরের ক্লাসে উঠে যায়, সেই ছেলেটিকে খেলার মাঠে দেখেছি ক্লাশ লিগে মাঠের পাশে এক্সট্রা প্লেয়ার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজনায় ছটফট করছে। হঠাৎই ওদের সতীর্থের একটা সজোর ক্রস সেন্টার ফাঁকা বক্সের সামনে ওরই আরেক বন্ধু নাগাল পেল না। সকলেই হায় হায় করল, ইস একটু পা ঠেকালেই অনিবার্য গোল। কিন্তু সাইড লাইনের পাশে দাঁড়ানো ফেল করা ছাত্রটি বলল, না স্যার, বলটায় যা পাঞ্চ ছিল ওটা অনেক জোরে ঘোরাতে হত, তবে গোলে থাকত, ঠেকালে ওটা বাইরেই চলে যেত। একটা প্রচণ্ড গতিতে ধাবমান বস্তুকে তার ডিরেকশন চেঞ্জ করানোর জন্য বা ৯০ ডিগ্রি ঘোরানোর জন্য কতটা শক্তি প্রয়োজন, অঙ্কে ও জানে না। কিন্তু খেলার মাঠে বাস্তবে সেটা জানে। 'ফেল' চালু করলে মাঠে এই ছেলেটাকে আমি মিস করতাম। পড়াশোনায় মন নেই যে ছেলেটার, সে কিন্তু বাড়তি শক্তি প্রয়োগ না করেই অবলীলায় মাঠের বাইরে ছক্কা হাঁকায়। নিজের অজান্তে মাটি থেকে ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বলটাকে রাখে অঙ্ক না জেনেই। 

শুধু তো 'ফেল' বন্ধ করা ছিল না। বলা হল, সবচেয়ে পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে রেমিডিয়াল ক্লাস হবে। যে ছাত্র যে বিষয়ে পশ্চাদপদ, তাদের নিয়ে গ্রুপ করে রুটিনে রেমিডিয়াল ক্লাস রাখা হত। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বিদ্যালয়ের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ শিক্ষকরা ক্লাস রুটিনে রেমিডিয়াল ক্লাসগুলোর দায়িত্ব নিত। কারণ, তাদের দর্শন হল, পরের ছেলে পরমানন্দ/ যত গোল্লায় যায় ততই আনন্দ। অতএব, ক্লাস রুটিনে শেষের দিকে থাকবে রেমিডিয়াল ক্লাস। আর সেই ক্লাসগুলি কার্যত কখনই নেওয়া হবে না। আরেকটা প্রবণতাও দেখেছি, শিক্ষকরা রেমিডিয়াল ক্লাস নিতে হবে এই আশঙ্কায় সেই অতিরিক্ত দায়িত্ব এড়ানোর জন্য নিজেরা আগেই ঠিক করে নিল, পরীক্ষায় কাউকেই কোনও বিষয়ে 'ডি' দেখানো হবে না। তাহলে রেমিডিয়াল ক্লাসেরও দরকার হবে না। ফলে, শিক্ষক যদি হন রাজহংস, তাহলে যেভাবেই দাও না কেন, উনি ঠিক নিজের মতো করে দুধটুকু খেয়ে নেবেন, জল পড়ে থাকবে। 

আমি নিজে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যুক্ত ছিলাম যেখানে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ড্রপ-আউট ছাত্রদের খুঁজে আনা হত তথাকথিত পশ্চাৎপদ পাঁচটি জেলা থেকে-- বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও হাওড়া-হুগলির প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। লক্ষ্য ছিল, একটি নতুন সিলেবাস তৈরি করে ওই ছাত্রদের প্রথম এক বছর সমস্ত বিষয় যা বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় তার যুক্তিভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হবে কিন্তু বিদ্যালয়ের পরীক্ষার সিলেবাসটি অনুসরণ করা হবে না; দ্বিতীয় বছর ওই ছাত্রদের নবম ও দশম শ্রেণির সিলেবাস অনুসরণ করে পড়ানো হবে। ওই এক বছরেই তারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। স্থানীয় একটি স্কুল এ কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। মোট কুড়িজন এসেছিল। দু' বছর পর তারা প্রত্যেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হল, কেবল একজন ছাড়া। পরের ব্যাচে (২০+১)=২১ জন বসল, সকলেই পাস করল। ক্লাস সিক্সের ড্রপ-আউট ছাত্র, সে মাত্র দু' বছরে মাধ্যমিক পাস করেছে। যারা 'ফেল প্রথা' চালু করার প্রশ্নে এত সরব, তারা ভেবে দেখবেন আমাদের ওই প্রজেক্ট কীভাবে সম্ভব হয়েছিল। আমার নিজের কাছেই এটা ছিল অবিশ্বাস্য। 

শিখন পর্বের একটা স্তর পর্যন্ত তুমি ফেল, তুমি ব্যর্থ, তোমাকে দিয়ে হবে না, এ কথা বলা যায় না। শিশুকে কতবারের চেষ্টায় হাঁটতে হবে, এটা নির্দিষ্ট করা যায় না। কতবারের চেষ্টায় গাছে উঠতে পারবে, এটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় না। শিশু কতবারের চেষ্টায় মা-বাবা শব্দগুলি বলতে শিখবে, তা নির্দিষ্ট করা যায় না। ঠিক একই কারণে উচ্চ বুনিয়াদি স্তর পর্যন্ত এই সমগ্র আট বছর শিশুর কাছে একটা প্যাকেজ; এর মধ্যে কেউ ৩০ শতাংশ কেউ ৬০ শতাংশ কেউ ৮৫ শতাংশ শিখবে। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় যে সমস্ত বিষয় বোধগম্য হত না, পাঁচ বছর পর সেগুলোই বোধগম্য হচ্ছে। এটাই বাস্তব। আমার মনে আছে, একটি বই হাতে এসেছিল, যেটা পড়ে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ফলে, ১০-১২ পাতার বেশি এগোতে পারিনি। ভাষা ও যুক্তি, কোনওটাই বোধগম্য ছিল না। একজন শিক্ষককে আমি সে কথা বলেছিলাম। সঙ্গে এটাও বলেছিলাম, আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন? সেই শিক্ষক বলেছিলেন, যেখানে আটকে গেছ সেটাকে উপেক্ষা করেই পরের অংশে এগিয়ে যাও। এভাবে ছোটখাটো বাঁধাগুলো পেরিয়ে যাবার পর এক সময় দেখবে, আগের না বোঝা অংশগুলো তোমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে। ঠিক এই কারণেই, কোথাও আটকে গেলেই তুমি ব্যর্থ, তুমি ফেল, তুমি ড্রপ-আউট, তোমাকে দিয়ে হবে না, এই নীতি শিখন পদ্ধতির পরিপন্থী। 

আমার বিশ্বাস, ফেল করানো ও তাকে শিক্ষা প্রণালী থেকে ছেঁটে ফেলা গণশিক্ষার পরিপন্থী। একবার ভাবুন, প্রথম প্রজন্মের যে ছাত্র বিদ্যালয়ে এল, সে তো সফলভাবে শিক্ষা প্রণালীর সঙ্গে অভিযোজন করতে পারবে না। এটাই স্বাভাবিক ধরা আছে। জানা আছে। আমাদের ঘরের সন্তানটি বিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ফিরেও মা-বাবা কাকা পিসি দাদু ঠাকুমা বন্ধুবান্ধব পাড়ার কাকা পিসি মামা মাসি সকলের সাহচর্যে শেখে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা গৃহের চৌহদ্দিতেও চলতে থাকে। ফলে, সে কৃতকার্য হবে পাশ করবে, ওটাই তো স্বাভাবিক। আর প্রথম প্রজন্মের যে শিশুটি বিদ্যালয়ে পড়তে এল, তার কাছে বইয়ের ভাষা বিমূর্ত, ওই ভাষায় সে কথা বলে না। পরিবারের কেউ বলে না। বিষয়বস্তু বিমূর্ত, তার প্রাত্যহিক জীবন চর্চার বিষয় নয়। বাড়ি ফিরে যে পরিবেশ, সেখানেও তার বিদ্যালয়ের শিক্ষা বিষয়ক চর্চার সুযোগ নেই। ও তো ড্রপ-আউট হবার জন্যই এসেছে। আমার সন্তানের নৌকা চড়ায় আটকে গেলে পরিবারের সকলে মিলে সেই নৌকা ঠেলে দিই। নৌকা তরতর করে এগিয়ে যায়। কিন্তু প্রথম প্রজন্মের ছাত্র, তার নৌকাটি আটকে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বাড়িতে সেটাকে কেউ ঠেলে দেওয়ার নেই। ফলে, বিদ্যালয়ের দায়িত্ব তাকে কিছুতেই ড্রপ-আউট হতে না দেওয়া। খাবার দিয়ে, পোশাক দিয়ে, নানা আর্থিক সহায়তা দিয়ে, সাইকেল, জামা জুতো দিয়ে, ওর মনের মতো বইপত্র তৈরি করে, ওকে ধরে রাখাটাই কাজ। ফেল পদ্ধতি এসে গণশিক্ষার এই কাজটাকেই ধ্বংস করতে চাইছে। 

যে সব মানুষ পাশ-ফেল উঠে গেল, সব গেল, সব গেল করে চেঁচিয়েছেন, তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন, ইঞ্জিনিয়ারিং'এর এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ৬৮ হাজার, ৭২ হাজার স্থান পেয়েও ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। এখন তো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আসন ফাঁকা পড়ে থাকে। পুরো প্যানেল শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ, শেষতম ব্যক্তিও ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে। আর ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় ফেল করে অকৃতকার্য, এমনটাও শোনা যায় না। ডাক্তারি পরীক্ষায় এমবিবিএস'এ ফেল শুনেছেন নাকি? আর ডাক্তারির পিজি এন্ট্রান্সে যারা অংশ নেয়, তারা সকলেই পিজিতে চান্স পায়। প্যানেলের শেষ ব্যক্তিটিও। শুধু পছন্দের মতো বিষয় পায় না হয়তো। কই, এ নিয়ে তো কোনও হইচই নেই? আসলে এখানেই সমস্যা। ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হতে আসে আমারই ঘরের ছেলেমেয়েরা। আমরাই তার বেনিফিশিয়ারি গ্রুপ। অতএব, এখানে পাশ ফেল না থাকা সমস্যা না। কিন্তু সরকারি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তর ও উচ্চ বুনিয়াদি থেকে পাশ-ফেল চালু না করলে, প্রান্তবাসী, সমাজের অন্ত্যজ জন প্রবেশাধিকার পেয়ে যাবে। একলব্যের মতো, ঘিনুয়ার মতো, বাঘারুর মতো, কোগার মতো সহজ মানুষগুলোকে শুরু থেকেই শিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশাধিকার দেওয়া যাবে না এবং একালের দ্রোণাচার্যরা তাই 'ফেল ব্যবস্থা' চালু করার জন্য এত সোচ্চার। 

বন্ধু বলল, শুধু সামাজিক দিকটাই দেখলে। অর্থনীতিটা ভাবো একবার। নিম্ন স্তরে বুনিয়াদি শিক্ষায় সরকারি স্কুলগুলিতে দরিদ্রতম মানুষ পড়তে যায়। ওখানে রাজকোষের পয়সা যাতে না ব্যয় হয় সেটা লক্ষ্য। কোটি কোটি প্রান্তবাসীকে ন্যূনতম শিক্ষা দেওয়ার খরচটুকু করা যাবে না আর উচ্চশিক্ষায় সরকারি কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কৌলিন্যের শীর্ষে। সেখানে উচ্চবিত্ত প্রবেশাধিকার পায়। অতএব, ওখানে পাশ-ফেল'এর বিষয়টা রাখা চলবে না। তাহলে বেসরকারি কলেজ ছাত্র পাবে কোথায়, আর ব্যবসাই বা জমবে কী করে। কেপিসি হলদিয়াকে ছাত্র পেতে হবে তো। তাই, ওখানে সকলেই পাশ। 

'মানুষ বড় বেশি গেলে, এত খেলে চলে' বের্টোল্ড ব্রেখটের সেই কবিতা। গরিব মানুষের জন্য রাজকোষ খুলে দিলে পেটুক জনতা সব শেষ করে দেবে। অতএব, রাজকোষের যা কিছু তা বরাদ্দ থাকবে দুধে ভাতে ঘিয়ে, হলুদ মাখা গায়ের জন্য সংরক্ষিত। সেখান থেকে নিচের তলায় ফিলট্রেশন পদ্ধতিতে যেটুকু চুঁইয়ে চুঁইয়ে পৌঁছবে সেটাই ওদের পক্ষে যথেষ্ট। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণার ঠিক বিপরীতে এই অর্থনৈতিক ধারণার অবস্থান। সকলকে নিয়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছনো যায় না। তাই, বাছাই করা অল্প কিছুকে নিয়ে শিখরে আরোহন করার অর্থনীতি।