Saturday, 5 October 2024

নারী শ্রমিকদের লড়াই

শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল পাহাড়

অতনু চক্রবর্তী



আবার উত্তাল হল পাহাড়। দীর্ঘ আট বছর পর পাহাড় আবার দেখল সর্বাত্মক বনধ। তাও আবার মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের মাঝখানে। এবার বনধ ডাকা হয়েছিল চা বাগান শ্রমিকদের পুজো বোনাসের দাবিতে, যৌথ মঞ্চের পক্ষ থেকে। দার্জিলিং পাহাড়ের চা বাগিচার নারী শ্রমিকদের বর্ণময় পোশাক ও বিভিন্ন পাহাড়ি রাস্তা ধরে স্লোগান মুখরিত দৃপ্ত মিছিল, উত্তোলিত মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আবার চা বাগিচার অ্যাজেন্ডাকে সামনে নিয়ে এল। 

পর্যটনের ভরা মরশুমে পাহাড়ে প্রবল বৃষ্টির সাথে নানা জায়গায় নেমে আসা ধস, চা বাগানে কর্মবিরতি গোটা শৈল শহরে এখন যেন নিত্যদিনের ছবি। প্রতিবারের মতো এবারেও চা বাগিচার মালিকদের সাথে  শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর অনেকগুলো বৈঠক, বিস্তর দর কষাকষির পর রাজ্য শ্রম দফতরের মধ্যস্থতায় ১৬ শতাংশ বোনাস ঘোষিত হয়। এই বোনাস ঘোষণার পরেই পাহাড়ের চা বাগিচার শ্রমিকরা বেঁকে বসেন। তাঁরা ২০ শতাংশ বোনাসের দাবিতে শুরু করেন আন্দোলন। ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারটে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়। ওইদিন, অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকটি ভেস্তে যাওয়ার পর ৩০ সেপ্টেম্বর ১২ ঘন্টার বনধের ডাক দেয় আটটি ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ মঞ্চ। সেই সময় উত্তরবঙ্গ সফররত মুখ্যমন্ত্রী 'বনধ হচ্ছে না ' বলে বিবৃতি দিলেও বনধ হয় সর্বাত্মক। রাজ্য শ্রম দফতর দার্জিলিং চা শিল্পকে অবিলম্বে ১৬ শতাংশ বোনাস প্রদানের জন্য ১ অক্টোবর অ্যাডভাইজারি পাঠালে ইউনিয়নগুলি সম্মিলিতভাবেই তা সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করে বনধের ডাক দেয়। তাদের দাবি, তরাই ডুয়ার্সের বাগানগুলোর তুলনায় দার্জিলিং'এর চা থেকে অনেক বেশি মুনাফা আসে। তাই, বোনাসের ক্ষেত্রে তরাই ডুয়ার্সের সাথে সমতা বজায় রাখার যে যুক্তি সরকার দিয়েছে, তা পাহাড়ের ইউনিয়নগুলো মানতে প্রস্তুত নয়। 

দার্জিলিং পাহাড়ের ৮৭টি বাগানে বোনাস নিয়ে ত্রিপাক্ষিক আলোচনার সময় মালিকরা জানায় ২০ শতাংশ বোনাস দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ বোনাসে তারা রাজি হয়। এরপর থেকে পাহাড়ের  চা শিল্পে অশান্তি নেমে আসে। বনধ, কর্মবিরতি শুরু হয়ে যায়। জয়েন্ট ফোরাম'এর ডাকে ধর্মঘটকে জিটিএ'র চিফ একজিকিউটিভ অনীত থাপারের দল 'ভারতীয় জনতা প্রজাতান্ত্রিক পার্টি' সক্রিয় সমর্থন করে। 

ডুয়ার্সের নাগেশ্বরী ও কিলকোট চা বাগানের নারী শ্রমিকরাও ন্যায্য বোনাসের দাবিতে প্রতিবাদে মুখর হন। পিএফ-গ্রাচুইটির পর এবার এই দুই বাগানে ন্যায্য বোনাসের দাবিও বাগানগুলির পরিচালন সমিতি মানতে প্রস্তুত নয়। চা বাগানের পরিচালন সমিতির সিদ্ধান্ত হল, যে বাগানগুলো বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে সেখানে ৯ শতাংশ, আর যেগুলো চালু সেখানে ১৬ শতাংশ বোনাস দেওয়া হবে। কিন্তু, উল্লিখিত বাগান দু'টি চালু থাকলেও মেরিকো কোম্পানি সেখানে ৯ শতাংশের বেশি বোনাস দিতে প্রস্তুত নয়। এমনকি এ নিয়ে শ্রমিকদের সাথে আলাপ আলোচনার জন্যও তারা রাজি নয়। এই দুই বাগানের শ্রমিকদের দাবি, মালিকপক্ষ বিগত দিনে যথেষ্ট মুনাফা পেয়েছে, তাই তাদেরও ২০ শতাংশ বোনাস পাওয়া উচিত। এই দুটি বাগানের নারী শ্রমিকরা মেটালি থানা ঘেরাও করেন, প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ৮ কিলোমিটার পথ ধরে মিছিল করেন, কিছু জায়গায় পথ অবরোধও করা হয়।

এ কথা ঠিক, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, চা গাছগুলোতে এক ধরনের পোকা প্রভৃতি কয়েকটি কারণে চা পাতার উৎপাদনশীলতা বেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, দার্জিলিং'এ বহুজাতিক সংস্থাগুলো নিত্য নতুন চা বাগিচা কিনে নিচ্ছে, মালিকানারও হাত বদল হচ্ছে। শ্রমিকদের প্রশ্ন, চা শিল্প যদি রুগ্ন হয়, তবে নতুন নতুন বাগান হস্তগত করতে বহুজাতিকেরা কেন পিছপা হচ্ছে না! ২০২২ সালে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি এক রিপোর্টে জানায়, 'চা বাগিচার শ্রমিকদের নিদারুণ দুর্দশা ও অমানবিক জীবন ধারণের মান মনে করিয়ে দেয় ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ চা মালিকদের আমল। এরা আজও বাঁধা মজুরের মতো দিন যাপন করে।... দার্জিলিং'এর চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দেশের সমস্ত শিল্প শ্রমিকদের চেয়ে সবচেয়ে কম!' উচ্চমূল্যে রফতানিকৃত দার্জিলিং'এর চা পাতা বিপুল মুনাফা কামালেও শ্রমিকদের মজুরি আজও রয়ে গেছে তলানিতে। 

দেশে চা সহ বাগিচা শিল্পে মজুরির প্রশ্নে রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে বিস্তর তফাত। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে চা বাগিচা রয়েছে। এখানকার উৎপাদনশীলতা দক্ষিণী রাজ্যগুলোর সমান হলেও দক্ষিণ ভারতের তুলনায় উত্তর-পূর্ব ভারতের উৎপাদিত চায়ের নিলাম মূল্য দক্ষিণের রাজ্য থেকে অনেক বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, দক্ষিণ ভারতের তুলনায় উত্তর-পূর্ব ভারতে চা শিল্পের মজুরি অনেক কম, প্রায় অর্ধেক! 

এ রাজ্যে চা শিল্পের ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষের সাথে রাজ্য শ্রম দফতর পরের পর বৈঠক করার পর অবশেষে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হয় দৈনিক ২৫০ টাকা। অন্তর্বর্তীকালীন এই দৈনিক মজুরি মালিকপক্ষ মানতে অস্বীকার করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু হাইকোর্ট মালিকপক্ষের এই আবেদন খারিজ করে ১ আগস্ট থেকেই নতুন মজুরি কার্যকরী করার আদেশ দেয়। গত বছরের সাপেক্ষে এই অন্তর্বর্তীকালীন মজুরি বৃদ্ধি হয় মাত্র দৈনিক ১৮ টাকা! অসমে ২০২২ সালে ২৭ টাকা মজুরি বৃদ্ধি হয়, ফলে ১ আগস্ট থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তা হয়ে দাঁড়ায় ২৩২ টাকা, আর বরাক উপত্যকায় হয় ২১০ টাকা। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, যা ক্ষমতায় আসার পর তারা কিছুটা পালন করতে বাধ্য হয়।

এবার দেখা যাক, দক্ষিণ ভারতে চা শ্রমিকরা কত মজুরি পান। কেরলে এই মজুরি দেশের মধ্যে সর্বাধিক (৪২১.২৬ টাকা)। তারপর তামিলনাড়ু (৪০৬.৮০ টাকা), কর্নাটক (৩৭৬.৭৮ টাকা)। বিহার ও ত্রিপুরায় মজুরি সর্বনিম্ন: যথাক্রমে ১৭৫ ও ১৭৬ টাকা। বোঝাই যাচ্ছে, দক্ষিণী রাজ্যগুলোর তুলনায় উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর মধ্যে মজুরির প্রশ্নে রয়েছে আসমান জমিন পার্থক্য। তা সত্ত্বেও এ রাজ্যগুলোর মালিকপক্ষ লোকসানের অজুহাতে মজুরি বৃদ্ধিতে সম্মত নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০০- ২০১৫ পর্যন্ত এ রাজ্যের ডুয়ার্স অঞ্চল দেখেছিল ১৪০০ অনাহার মৃত্যু, আজও বহু শ্রমিক অর্ধাহারে অপুষ্টিতে ক্ষীণ দেহে কাজ করতে বাধ্য হন।

অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক শোভার বেষ্টনীতে নারী শ্রমিক প্রধান এই চা শিল্পের শ্রমিকরা সমস্ত দিক থেকে বঞ্চিত। মজুরির ক্ষেত্রে প্রকট লিঙ্গ অসাম্য, সমস্ত সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চনা, সামাজিক সুরক্ষাহীন এই অগণন নামহীন অবয়বহীন নারী শ্রমিকদের অমানুষিক শ্রমে উৎপাদিত চা পাতা বিশ্ব বাজারে 'ভারতের শ্যাম্পেন' হিসাবে খ্যাত। তাঁদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট চোখের জল আমরা শহুরে মধ্যবিত্তরা ঠাহর করতে পারি না। সকালে চায়ের প্রতিটি চুমুকের অন্তরালে চোখের জলের এই বেদনা আমরা কবে বুঝব?


1 comment:

  1. আসামের ব্যাংক ভ্যালিতে চা বাগানে কাজের সুবাদে জানি কি নিদারুন বৈষম্য ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় এদের জীবন অতিবাহিত হয়। এরা প্রকৃত অর্থে প্রান্তিক জনজাতি।এবং চরম শোষণের বেড়াজালে।। ট্রেড ইউনিয়ন গুলো মালিক ও সরকারের সাথে আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যর্থ। ফলে বন্ধ হ্ওয়ার মুখে চাবাগান।
    বর্তমান লেখাটি প্রাসঙ্গিক এই সংকট কালে।।
    অসিত।

    ReplyDelete