গাছ বাঁচাও ঐতিহ্য বাঁচাও
সুমিত
১৯৭১ সালে
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রখ্যাত আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যশোর রোড নিয়ে
একটি অনবদ্য কবিতা লিখেছিলেন: September on Jessore Road। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আগত
লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা এবং অপরিসীম যন্ত্রণার চিত্র কবিতাটিতে
ফুটে উঠেছিল। প্রায় তিন দশক পরে, ওই কবিতাটি অবলম্বন করেই মৌসুমী ভৌমিক তাঁর
বিখ্যাত গান রচনা করেন 'যশোর রোড':
‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে
শত শত শত মানুষের দল
যশোর রোডের দু’ ধারে বসত
বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল
কাদামাটি মাখা মানুষের দল
গাদাগাদি
করে আকাশটা দেখে…’
কাদামাটি-মাখা
অগুনতি মানুষের ভিড় সেই সময় আশ্রয় নিচ্ছে যশোর রোডের দু’ধারে শতাব্দী প্রাচীন
বৃক্ষরাজির তলে। চিরসবুজ মেহগনি, বট, অশ্বথ, শিশু গাছের নীচে। বাঁশের ছাউনি বেঁধে,
দরমার দেয়াল তুলে। যশোর রোড ও তার আশেপাশের নানান জায়গায়- চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগর,
গোবরডাঙা, মছলন্দপুর, হাবড়া, বাণীপুর, গাইঘাটা, অশোকনগর, বারাসাতে অসংখ্য শরণার্থী
শিবির। পাশাপাশি গড়ে উঠছে একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পগুলিও। যশোর রোড ধরেই
বন্দুক কাঁধে মুক্তিসেনানিরা জীবন হাতে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন। সে এক দুরন্ত
সময়; যে সময়ের অংশীদার এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষী যশোর রোডের ওই গাছগুলি।
সেই
সময়টাকে, সেই ইতিহাসটাকে আজ মুছে দেবার এক গভীর চক্রান্ত চলছে। এ বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি
ভারতের উচ্চতম আদালত বিনা অপরাধে যশোর রোডের ঐতিহ্যবাহী ৩৫৬টি গাছের মৃত্যুদণ্ড
ঘোষণা করেছে। সড়ক প্রশস্তকরণের তাগিদে, উন্নয়নের নামে। আসলে, পুঁজির স্বার্থে,
মুনাফার পাহাড় গড়ার লক্ষ্যে।
১১২ নম্বর
জাতীয় সড়ক যশোর রোডের প্রশস্তকরণ এবং তার জন্য ৪,০৩৬টি গাছ কাটা পড়ার খবর প্রথম
জানা যায় ২০১৪-১৫ সালে সংবাদমাধ্যম মারফত। যানজট এড়াতে বারাসাত-চাঁপাডালির মোড় থেকে
বনগাঁ পর্যন্ত ৬০-৭০ কিলোমিটার সড়কের মোট পাঁচটি জায়গায় রেল ওভারব্রীজ (hump) গড়তে
হবে এবং তার জন্যই নাকি এই প্রশস্তিকরণের প্রয়োজন। গাছ কাটা হবে খবর পেয়ে স্বভাবতই
স্থানীয় সংবেদনশীল মানুষজন এবং পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা উদ্বিগ্ন, আশঙ্কাগ্রস্ত
হয়ে পড়েন। দানা বাঁধতে শুরু করে গাছ কাটা বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন। RTI করা হয় সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলিতে, স্থানীয় বিধায়ক ও
সাংসদের কাছে। পরিতাপের বিষয়, আজও সেই RTI-এর কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। এরপর ২১
ফেব্রুয়ারি ২০১৭ গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (APDR)
কলকাতা হাই কোর্টে Trees (Protection and Conservation in
Non-forest Areas) Act, 2006 অনুসারে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের
করে।
কয়েকদিন
পরেই, ২রা এপ্রিল বনগাঁ পৌঁছে যায় রাজ্য সরকারের গাছ কাটার দল। আন্দোলনকারীরা
ছুটে যান। যারা গাছ কাটতে এসেছিলেন তারা কোনও কাগজ দেখাতে পারেন না। ফিরে যেতে হয়
তাদের। কিন্তু ২১ এপ্রিল হাবড়ায় ও ২২ এপ্রিল অশোকনগরে আবার চালু হয় বৃক্ষ নিধনের
আয়োজন। আবার ছুটে যান প্রতিবাদীরা। বেশ কিছু স্কুলের ছাত্রী-ছাত্ররাও যোগ দেয় এই
প্রতিবাদে। ‘চিপকো’ আন্দোলনের ঢং’য়ে তারা গাছগুলিকে জাপটে জড়িয়ে ধরে।
কবিতায়-গানে-নাটকে, উৎসবের মেজাজে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে গাছ কাটা বিরোধী আন্দোলন। গাছ
বাঁচানোর আন্দোলন পরিণত হয় এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। ২৩ এপ্রিল তৈরি হয় ‘যশোর রোড
গাছ বাঁচাও কমিটি’।
এই কমিটিও
হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়। প্রথমে হাই কোর্ট গাছ কাটায় স্থগিতাদেশ জারি করে। কিন্তু ৩১
আগস্ট ২০১৮- ৩৫৬টি গাছ কাটার অনুমতি দেয়। প্রতিবাদীরা বাধ্য হয় সুপ্রিম কোর্টে
যেতে। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সুপ্রিম কোর্ট গাছ কাটায় আবার স্থগিতাদেশ জারি করে। প্রায়
সাড়ে চার বছর ধরে APDR ও ‘গাছ বাঁচাও কমিটি’র করা
দু’টি মামলা একত্র করে শুনানি চলতে থাকে। পক্ষে-বিপক্ষে দুই যুযুধান আইনজীবী–
গাছ-কাটা বিরোধীদের হয়ে প্রশান্ত ভূষণ এবং রাজ্য সরকারের তরফে অভিষেক মনু সিংভি–
আদালতে যুক্তি-প্রতিযুক্তির জাল বিস্তার করেন। অবশেষে, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সুপ্রিম
কোর্টের বিচারপতি বি আর গাভাইয়ের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয় এবং ৩০৬টি গাছ কাটার
(ইতিমধ্যে ৫০টি গাছের মৃত্যু হয়েছে) হাই কোর্টের আগের নির্দেশকেই বহাল রাখে।
সুপ্রিম
কোর্টের রায়ে গাছ কাটার পক্ষে প্রধানত যে দু’টি কারণ উচ্চারিত হয়েছে তার প্রথমটি
অবশ্যই যানজট। যশোর রোড বর্তমানে ২৫-৩০ ফুট চওড়া, পাঁচটি রেল ওভারব্রিজ গড়তে একে
১২০ ফুট চওড়া করতে হবে। তা না হলে দ্রুত ট্রাক চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে, যার
ফলে নিকটবর্তী বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
হবে। এই যুক্তি মানবেন না যারা যশোর রোড এবং বাংলাদেশ সীমান্ত পোস্টগুলির সঙ্গে
সুপরিচিত। তাদের মতে, যানজটের আসল কারণ ঘুষের দর-কষাকষির জন্যে বর্ডার পোস্টগুলিতে দিনের পর দিন আটকে থাকা
শ’য়ে শ’য়ে ট্রাক। যে কোনও দিন ঠাকুরনগর থেকে পেট্রাপোল,
বেনাপোল বর্ডার পরিদর্শন করলেই এ দৃশ্য দেখা যাবে। ট্রাকগুলি সাধারণত পচনশীল পণ্য–
চাল, ডাল, চিনি, সবজি, ফল– বয়ে নিয়ে আসে এবং দীর্ঘদিন আটকে থাকার ফলে রফতানি বাণিজ্য
বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানকার পার্কিং লটগুলি কৃষিজমি দখল করেই গড়ে উঠেছে এবং
এখানে চলে স্থানীয় মস্তান রাজ ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকাদের দাদাগিরি। তাই, যানজটের
সাথে গাছের কী সম্পর্ক!
বলা হয়েছে,
যশোর রোড সংকীর্ণ হবার জন্য রুগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত কলকাতার হাসপাতালে পৌঁছতে
পারছে না। কেউ কি এ প্রশ্ন করছেন যে চিকিৎসার জন্য কেন কলকাতায় ছুটে আসতে হবে!
স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও কেন বনগাঁ, মছলন্দপুর, হাবড়া, বারাসাত ইত্যাদি জায়গায় সুচিকিৎসার
বন্দোবস্ত হল না!
সুপ্রিম
কোর্টের রায়ে গাছ কেটে ফেলার আরেকটি বড় যুক্তি হল বড় বড় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে এ পর্যন্ত
৬০০ লোকের নাকি মৃত্যু হয়েছে এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। এই দুর্ঘটনাগুলি কোন সময়ে
অর্থাৎ কবে থেকে কবে তার কোনও উল্লেখ নেই। নিহত ও আহতদের নামধামের কোনও তালিকাও
দেওয়া হয়নি। তাই মনে করা হচ্ছে, এটা একটা মনগড়া তথ্য ব্যতীত আর কিছু নয়। দেশের
সর্বোচ্চ আদালতের কাছে প্রমাণ কিংবা সূত্র ছাড়া এ ধরনের তথ্য পরিবেশন কোনওভাবেই মেনে
নেওয়া যায় না। ‘গাছ বাঁচাও কমিটি’ দাবি করছে, এই ৬০০ মানুষের তালিকা প্রকাশ করা হোক
এবং নিহত-আহত পরিবারগুলিকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। তারা মেনে নিয়েছে যে
মাঝেমধ্যে ডাল ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে ঠিকই কিন্তু তা ঘটে গাছ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে,
যার দায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় উভয় সরকারের ওপরেই বর্তায়।
সুপ্রিম
কোর্টের রায়ে অবাক হবার কিছু নেই। ইদানিং কালে দেখা যাচ্ছে, দেশের বিচারব্যবস্থা
ক্রমাগত সর্বগ্রাসী বিশ্ব পুঁজির আজ্ঞাবহ হয়ে উঠছে, উন্নয়নের নামে কর্পোরেট লুঠতরাজকে
মদত দিচ্ছে। জল-জঙ্গল-জমি জোর করে কেড়ে নেওয়া, প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্র
অবলীলায় ধ্বংস করা, আদিবাসী মানুষের জীবন ও জীবনধারাকে বিপন্ন করে তোলা, সব কিছুকেই
বিনা প্রশ্নে তারা সায় দিয়ে চলেছে। আমাদের রাজ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। পুরুলিয়ার
অযোধ্যা (মারাং বুরু) পাহাড়ে ঠুড়গা বিদ্যুৎ প্রকল্প মামলায় হাই কোর্টের জনবিরোধী
রায় সে কথাই প্রমাণ করে। দেওচা-পাঁচামী মামলারও একই পরিণতি হবে বলেই মনে হয়।
যশোর রোডের
প্রশস্তিকরণ আসলে একটি আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রকল্প। ২০,৫৩৭ কিলোমিটার এশিয়ান
হাইওয়ে গড়ে তোলা হবে এখান থেকেই- যা একদিকে যাবে বাংলাদেশ, মায়ানমার, কাম্বোডিয়া
হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব চিনের সাংহাই পর্যন্ত, আরেক দিক চলে যাবে মধ্য এশিয়া। এশিয়ান
ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক এই সড়ক প্রকল্পের মূল পৃষ্ঠপোষক। উল্লেখযোগ্য, উত্তর ২৪-পরগণা
জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় মাটির নিচে তেলের খনি পাওয়া গিয়েছে– বেঙ্গল বেসিন- যার ওপর
দিয়েই চলে গেছে যশোর রোড। এখানেই পুঁজির কাছে যশোর রোডের গুরুত্ব। আন্তর্জাতিক
অয়েল করিডর-এর কেন্দ্রস্থল হতে চলেছে যশোর রোডই। তাই যশোর রোডের গাছগুলি আক্রান্ত,
তাদের মাথার ওপর ঝোলানো হয়েছে মৃত্যু পরোয়ানা।
একটু ভেবে
দেখা যাক। আসলে, মৃত্যু পরোয়ানাটা যে আমাদের মাথার ওপরেও তা আমরা বুঝেও বুঝি না। পুঁজিবাদী
উন্নয়নের চাকচমক দেখে আমরা ভুলে যাই এক একটি গাছ বিপুল অক্সিজেনের সম্ভার। কোভিড
মহামারির সময় হা-হুতাশ করেছি অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য, অথচ গাছ কাটা হলে আমরা
নির্লিপ্ত। আমরা ভুলে যাই আমরা নিঃশ্বাস ফেলে যে কার্বন-ডাইঅক্সাইড ছাড়ি গাছই তা
শুষে নেয়। যা কার্বন নিঃসরণ কিছুটা হলেও কমিয়ে দেয়। আজ জলবায়ু বিপর্যয়ের মুহূর্তে গাছই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র
অবলম্বন।
গাছ বর্ষার
জল ধরে রাখে, মাটিকে উর্বর করে তোলে। গাছ ছায়া দেয়, গ্রীষ্মের দাবদাহে পরিবেশ শীতল
করে, তাপমাত্রা কমিয়ে আনে, প্রখর রোদে গাছের নিচেই আমরা আশ্রয় পাই। আশ্রয় পায় আরও
কত শত প্রাণী জগতের বাসিন্দারা। কত পাখি বাসা বাঁধে; গাছের ডালে বাস করে বাদুর,
বাঁদর, ছুটে বেড়ায় কাঠবিড়ালি; কত প্রজাপতি, মাকড়সা; কত ক্ষুদ্র প্রাণী, কত অনুজীব
থাকে গাছকে জড়িয়ে; কত পরজীবী উদ্ভিদ। প্রতিটি গাছই অনন্ত জীববৈচিত্রের আধার। গাছের
নিচেই আবার গড়ে ওঠে চায়ের দোকান, চুল কাটার সেলুন, আড্ডার ঠেক। জীবনের স্রোত বয়ে
চলে গাছেরই তলায়। গাছ ছাড়া এই পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকা দায়। তার মৃত্যু পরোয়ানা মানে
পৃথিবীর মৃত্যু ঘোষণা।
উল্লেখ্য, মামলা
চলাকালীন সুপ্রিম কোর্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি সার্ভে টিম পাঠায় যশোর রোডে।
তারা একটি ১৬১ পাতার রিপোর্ট পেশ করে। সেই রিপোর্টের একটি অংশ:
‘আকার,
আকৃতি, গঠন, প্রস্থ, উচ্চতা, ঘের, বয়স, বাস্তুতান্ত্রিক মূল্য, অনন্য প্রজাতির
বৈশিষ্ট, ঐতিহাসিক ও নান্দনিক মান দেখে মনে হয় গাছগুলি হেরিটেজ তকমা পাবার যোগ্য।’
যশোর রোডের
গাছ বাঁচানোর লড়াইটা ঐতিহ্য বাঁচানোরও লড়াই।