চরম বৈষম্য ও বঞ্চনার খেলা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
দেখাই যাচ্ছে, কাশ্মীর থেকে
কন্যাকুমারী, মুম্বই থেকে ইম্ফল- দেশের সরকার ইডি, সিবিআই, আয়কর দফতর, এনআইএ,
ইউএপিএ ইত্যাকার নানাবিধ এজেন্সি, আইন ও উর্দিধারীদের নিয়ে বিরোধীদের ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়েছে। যেন, যা কিছু অপরাধ, যা কিছু দুর্নীতি, সব তথাকথিত বিরোধী দল বা ব্যক্তিদেরই
অপকর্ম মাত্র। এইসব কাজে শাসকদের কেউ কোথাও ‘যুক্ত নয়’! মনে পড়ে যাচ্ছে, ১৯৭৫ সালে
জরুরি অবস্থা জারির প্রাক্কালেও এই ছবিটাই বহুলাংশে দেখা গিয়েছিল।
ঘটনা এই যে, আমাদের দেশের কোনও রাজনৈতিক
দলই ধোয়া তুলসিপাতা নয়। হয় দুর্নীতি, নয়তো কাজে অপারদর্শিতা বা পদ্ধতিগত ত্রুটি
অথবা জনবিরোধী নীতি, নচেৎ ক্ষমতার সন্ত্রাস এমনতর বিবিধ পঙ্গুতা ও জরায় এরা বরাবর কমবেশি
আক্রান্ত। কিন্তু আজ যেন হঠাৎই দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসক ছোটবড় যে কোনও বিরোধী
পদস্খলন, দুর্নীতির গন্ধ পেলে তো কথাই নেই, এমনকি মিথ্যা অভিযোগ এনেও সর্বতোভাবে
শুধুমাত্র বিরোধী দলগুলির ওপরই সারা দেশ জুড়ে এজেন্সি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এমন
নগ্ন আক্রমণ আগে কখনও দেখা যায়নি। এ বিষয়ে তাদের কোনও চক্ষুলজ্জারও বালাই নেই: হাজার অপরাধেও নিজেদের দল ও চরম দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের আড়াল
করতে তারা বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত নয়। তারা যে কতবড় নির্লজ্জ তা আমরা সদ্য সদ্য দেখলাম- স্বাধীনতা
দিবসে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের আজীবন সাজাপ্রাপ্তি থেকে গুজরাত সরকার কীভাবে বেহায়ার
মতো মুক্তি দিল।
অবশ্যই এমনটা ভাবারও কোনও কারণ নেই
যে, বিরোধী দলগুলির নেতারা কোনও বড়মাপের দুর্নীতি করেনি। করেছে, অবশ্যই করেছে।
বিশেষত পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডল প্রভৃতি সম্পর্কে যে সমস্ত অভিযোগ উঠে
এসেছে, তাকে আপাত-মান্যতা না দেওয়ার কোনও কারণ নেই। আমরা বহুদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গে
নানাবিধ দুর্নীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নজির চলতে-ফিরতে টের পাচ্ছিলাম। হয়তো,
আমাদেরও অনেকেই সেই সব দুর্নীতির ঘোরতর শিকার। স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে যে
দুর্নীতি হয়েছে, লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দেওয়া হয়েছে, তা
শাক দিয়ে ঢেকে রাখার উপায় নেই। আদালতের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে তা এখন দিনের আলোর মতো
উদ্ভাসিত। তাই, যে কারণে বা উদ্দেশ্যেই হোক, তদন্ত যে শুরু হয়েছে, ফলে, কিছু
কার্যকরী ফলাফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি, উচ্চপদস্থ নেতারা জেলবন্দী হচ্ছেন, তা হওয়ারই
ছিল, হয়ে ভালই হয়েছে। আইনের বিচারে ভবিষ্যতে যদি অন্যতর কিছু প্রকাশ পায় তবে তা
নিশ্চয়ই এক নতুন মাত্রা নিয়ে আসবে; যদিও তা অভূতপূর্ব কিছু নয়। কারণ, আমরা তো আগেও
দেখেছি, শাসকেরা কতশত মিথ্যা অভিযোগে বিরোধীদের নিকেশ করেছে। তাই, এই হেনস্থা
হওয়ার ঝঞ্ঝাটটা রাজনীতিবিদদের বহন করতেই হয়, তা নিয়ে আক্ষেপ করে লাভ নেই। কিন্তু
শুধুমাত্র সেটুকু বললে গল্পের অর্ধাংশটা অধরা থেকে যায়, যা এক গভীর গেমপ্ল্যানের
অংশ।
একদিকে যেমন দুর্নীতির দায় বিরোধীদের
অনেকেরই আছে, বহুবার বহু বিরোধী নেতা দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছেন, অন্যদিকে
শাসকের তরফ থেকেও অযথা হেনস্থা অথবা তিলকে তাল করে দেখিয়ে টার্গেট করাটাও সমানতালে
চলেছে। উপরন্তু, বিজেপির দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের আড়াল করে তাদের বাঁচিয়ে নেওয়া বা
তাদের সম্পর্কে গুরুতর অভিযোগগুলোকে বিন্দুমাত্র আমল না দেওয়া- এই প্রক্রিয়াটিও
চালু আছে সমানতালে। যেমন, কী সুন্দর গায়ে বাতাস লাগিয়ে শুভেন্দু অধিকারী, নিশীথ প্রামাণিক,
হিমন্ত বিশ্ব শর্মারা দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অর্থাৎ, বিজেপি’র গেমপ্ল্যানটা
হল: ১) ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে যতটা
সম্ভব সমস্ত বিরোধী দলগুলির সুনাম ও অর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে বিপ্রতীপে নিজেদের
শুদ্ধ, ওয়াশিং মেশিনে ধবধবে সাদা হয়ে আসা ‘ইমেজ’কে নিশ্চিত করা; ২) সর্বত্র এক সন্ত্রাস
ও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বিজেপির পায়ে পরে বাঁচতে
চাইবে; ৩) বামপন্থী মতাদর্শকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করা, যা ব্যতিরেকে নিজেদের ধর্মান্ধ
মতাদর্শকে তারা মানুষের মনে ভাসাতে পারবে না। খেয়াল রাখি, বামপন্থী মতাদর্শ
শুধুমাত্র তথাকথিত বাম দলগুলির মধ্যে আজ আর সীমায়িত নেই। বামপন্থী মতাদর্শের বহু
কিছুকে আজ অ-বামপন্থীরাও হাতিয়ার করেছে। সে অর্থে, বামপন্থা্র নতুন ভাবে
প্রাণসঞ্চার হচ্ছে। এই জায়গাটাকেই বিজেপি দুরমুশ করতে চায়, তাই বামপন্থী দলগুলির
থেকেও বেশি করে বাম-ধারণার প্রচ্ছায়ায় অবস্থিত 'অবাম দলগুলি'কেই তারা এখন টার্গেট করেছে
যারা এই মুহূর্তে তাদের সামনে রাজনৈতিক বিপদ। যেমন, আপ, ডিএমকে, তৃণমূল, টিআরএস,
আরজেডি, সমাজবাদী দল ইত্যাদি। ‘রেউড়ি’ বা জনকল্যাণ রাজনীতির বিরুদ্ধে মোদীর আচম্বিত
বিষোদগার কতকটা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই।
আমরা দেখলাম, নিউ ইয়র্ক টাইমস’এ
দিল্লির আপ সরকারের স্কুল পরিচালনার সাফল্য নিয়ে বড় করে খবর প্রকাশের পরপরই সিবিআই
কীভাবে হামলে পড়ল উপমুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়ার বাড়িতে। তার মাসখানেক
আগেই ইডি দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈনকে তুলে নিয়ে গেছে। কারণ, সত্যেন্দ্র
জৈন’র নেতৃত্বে দিল্লি সরকার স্বাস্থ্যক্ষত্রেও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছে এবং
মহল্লা ক্লিনিক সারা দেশ জুড়েই এক অভূতপূর্ব নিদর্শন হয়ে উঠেছে। সবিশেষ উল্লেখ্য,
আপ নেত্রী অতিশী সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, বিজেপি’র পক্ষ থেকে যিনি মণীশ
সিসোদিয়াকে বিজেপিতে যোগ দিলে সমস্ত কেস প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে বলে যে বার্তাটি
দিয়েছেন, সেই তিনিই শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়, হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকেও একই
প্রস্তাব দিয়ে দলে ভিড়িয়েছিলেন। আশাকরি, দুর্নীতির বহর ও খেলাটি এবার খোলসা হচ্ছে।
সম্প্রতি, পশ্চিমবঙ্গেও আয়কর বিভাগ থেকে কলকাতা টিভি’র দফতর ও তাদের অধিকর্তাদের
বাড়িতে ৮০ ঘন্টা ব্যাপী ব্যাপক অভিযান চালানো হয় এবং তাদের জনপ্রিয় ‘চতুর্থ
স্তম্ভ’ শীর্ষক সম্প্রসারণটি শুধুমাত্র বন্ধ করে দেওয়া নয়, তার পরিচালক
সুচন্দ্রিমা পালকে ব্যক্তিগত ভাবেও তুমুল হেনস্থা করা হয়। কারণ, ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ নামক
ওই সম্প্রসারণটিতে বহু খোলামেলা কথা বলা হত যা বিজেপি’র কাছে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। উল্লেখ্য, এই অভিযানে সিবিআই'কে কিন্তু খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে; হেনস্থা করাটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।
কিন্তু মৌলিক প্রশ্নটি হল, দুর্নীতির
এই দুর্বিনীত খেলা কি চলতেই থাকবে? এত আলোড়ন, হৈ-হট্টগোলের পরেও তার থেকে কি কোনও
নিস্তার নেই? মুশকিল হচ্ছে, এই কিছুদিন আগেও বড় গলায় কেউ কেউ বলতেন, সমস্ত কাজকর্ম
যদি ডিজিটাল হয়ে যায়, ঘরে বসে অনলাইনে যদি লেনদেন করা যায় তাহলে দুর্নীতির প্রকোপ
কমে আসবে। কথাটা আংশিক সত্য। ছোট ছোট খুচরো সরকারি দুর্নীতির ক্ষেত্রে তা সত্য। কিন্তু
ডিজিটাল ভুবন জোড়া যে গভীর ফাঁদ বিস্তৃত, তাতে অহরহ আর্থিক তথ্য সমেত ধরা পড়ে যাওয়া
ও সর্বস্বান্ত হওয়া এখন নিত্যকার ঘটনা মাত্র। খুব সজাগ ও সতর্ক ব্যক্তি ছাড়া এই
ফাঁদে অধিকাংশ মানুষই নানা উপায়ে পড়ছেন ও প্রতারিত হচ্ছেন। অর্থাৎ, ডিজিটাল দুনিয়া
এক নতুন ধরনের বাটপাড়ি ও দুর্নীতির পথ খুলে দিয়েছে। তার সঙ্গে ‘ডার্ক ওয়েব’এর
অভূতপূর্ব অন্ধকার জগতের কারবার তো আছেই। আর কর্পোরেট দুর্নীতি? যেখানে লক্ষ কোটি
টাকা হাপিশ করে গায়েব হয়ে যায় তথাকথিত কর্পোরেটরা! কর্পোরেট বন্ধুকে খাতিরদারি
করতে দেশের শীর্ষতম শাসকেরা মকুব করে দেয় রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের ঋণ! পিএম কেয়ার
ফান্ড? ইলেক্টোরাল বন্ড? যে বিপুল অর্থের কোনও সরকারি অডিট নেই, উৎস জানানোর
বাধ্যবাধকতা নেই! তাহলে কি দুর্নীতিকে আইনত মান্যতা দেওয়ার তোড়জোড় চলেছে বর্তমান
শাসকের আমলে?
বলাই বাহুল্য, আপনি যদি দুর্নীতির
জগতে প্রবেশ করতে না চান, প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয় ভূমিকাতেই নিজেকে দুর্নীতি মুক্ত রাখতে
চান, এবং শুধু আপনি নন, অধিকাংশ মানুষই তেমনটা চান, তাহলে দুর্নীতির শিকড় আলগা হবে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, কর্পোরেট দুর্নীতি আমার-আপনার ভাবনা নির্ভর নয়। তা শাসকের নীতি-প্রকৌশলের
সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সে দুর্নীতিকে রোধ করতে হলে জনসমাজকে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে
নামতে হবে। সেই ভাবনার জগতে আমরা অধিকাংশেরা পৌঁছতে পারব কিনা, তা বলা দুষ্কর,
কিন্তু পৃথিবীর বহু দেশ আছে যেখানে দুর্নীতির ঘটনা প্রায় শূন্য (যেমন, ডেনমার্ক,
ফিনল্যান্ড)। তার জন্য অবশ্যই জনতার স্বার্থবাহী এমন এক ব্যবস্থা থাকা উচিত যা
পুরোদস্তুর কাজ করতে সক্ষম। সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
দিল্লি ও পঞ্জাবের রাজ্য সরকার এ বিষয়ে নিশ্চয়ই তাদের যথাসাধ্য অবদান রেখেছে ও
ইতিবাচক ফলাফলও পেয়েছে। এখন দেখার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ডিজিটাল ভুবন যে
আংশিক ভাবে হলেও দুর্নীতিকে রোধ করতে সক্ষম বলে দাবি করা হয়, তা কতটা কার্যকরী হয়ে
উঠতে পারে। কারণ, জনমানসে দুর্নীতি যদি এক সামাজিক-মান্য বর্গ হিসেবে দাঁড়িয়ে
থাকে, তাহলে তা হানাহানিতেই লিপ্ত থাকবে যে কোনও পরিস্থিতিতেও। এই ‘মেনে নেওয়া’র মানসিকতা
দানা বাঁধতে যেমন সময় নিয়েছে, তেমনই খুব অল্প সময়ে তা নিরসনও হবে না, কিন্তু প্রচেষ্টা
ও জনমত দুইই সচল থাক। কতটা এগোনো গেল বোঝা যাবে। এবার অন্তত সে যাত্রা শুরু হোক।