কিন্তু সেই ডাক্তার: কোথায় পাব তারে
নন্দন বসু
একটি পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কোভিড পেশেন্ট। স্বামী পোস্ট-সিএবিজি (কার্ডিয়াক বাইপাস সার্জারি) পেশেন্ট। লাঙ ইনফেকশনের হিস্ট্রি আছে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৭৮, অবস্থা বুঝুন। স্ত্রীর কোভিড ছাড়াও টেম্পারেচার ১০৫°-- ১০৬°, টাইফয়েড। প্রথমেই দুই পেশেন্টকে ভর্তি করা হল। চিকিৎসক দেখলেন স্ত্রীর শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন ইনটেকে ঘাটতি, স্বাভাবিক ভাবেই মস্তিষ্কে কম অক্সিজেন সাপ্লাই, এগুলিই প্রধান সমস্যা। আগে থেকেই পালমোনারি ফাংশন টেস্ট রিপোর্ট ভালো ছিল না। পেশেন্ট ওই হাসপাতালে এক নার্স বালিকার জেঠু ও জেঠিমা।
ডাক্তার HRCT স্ক্যান করা ছাড়াও বিস্তর পরীক্ষা ও নানাবিধ ওষুধপত্র ও ICU অ্যাডমিশনের অ্যাডভাইস লিখলেন। নার্স বালিকা HRCT ও ICU ছাড়া অন্য সকল অ্যাডভাইস মেনে চলল। আর একটি লক্ষণীয় ঘটনা, রাত্রি ১০টা থেকে সকাল ৮টা নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সাপোর্ট বলা থাকলেও বালিকা মাঝে মাঝে এসে ৩০ মিনিট অক্সিজেন সাপোর্ট তুলে নিত। এই ভূমিকা পালন করার জন্য অফিস কর্তৃপক্ষকে এমনকি ডাক্তারের অনেক ভর্ৎসনা সহ্য করতে হয়েছে। অসংখ্য কো-মর্বিডিটি ফ্যাক্টর ও ৬৪+ বয়স নিয়ে দুজন পেশেন্টই বাড়ি ফিরল। ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠল।
ডিসচার্জ হবার দু' মাস পরে HRCT করা হল। পালমোনারি ইনফেকশন সিভিয়ারিটি মোট ২৫'এর মধ্যে একজনের ১৯, অপরজনের ১২, ভাবুন ২ মাস চিকিৎসার পরেও বিশেষ কমেনি।
এত কথা বলার মূল কারণটা বলি, নার্স বালিকা যে কথাগুলো পরে বুঝিয়ে বলেছিল:
১) যে অবস্থা নিয়ে পেশেন্ট দুজন হাসপাতালে ভর্তি হল, যে কোনও শিক্ষিত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার HRCT করে চেস্টের অবস্থা আগে দেখে নেবেন এটাই স্বাভাবিক। পরে ভালো মন্দ কিছু হলে এই প্রশ্ন উঠবেই, HRCT করেননি কেন? এটা চিকিৎসকের রক্ষাকবচ।
২) জেঠু জেঠিমা যে অবস্থায় এসেছিলেন ২ মাস পরের HRCT রিপোর্টেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তখনকার রিপোর্ট কী হতে পারত। ক্লিনিক্যালি তখনই সেটা বোঝা গিয়েছিল। অতএব, চরম খারাপ ধরে নিয়েই চিকিৎসা শুরু হল।
৩) কোভিড ব্যাধি থেকে ফুসফুসে সংক্রমণ। জেঠু জেঠিমার সামান্য ঠাণ্ডায় ইনফেকশন হয়। তাই বালিকার মনে হল ICU-র শীতল পরিবেশ সংক্রমণে সাহায্য করবে।
৪) ICU'র নানাবিধ ইনটিউবেশন প্রায়শই সংক্রমণ ডেকে আনে। এটা স্বীকৃত সত্য।
৫) কোভিড তৃতীয় তরঙ্গের ব্যস্ততম দিনগুলোতে ICU'তে অত্যধিক চাপের সময়ে দেখেছি একটি পেশেন্টের বিছানা ফাঁকা হওয়ার পর উপকরণ সামগ্রী যথাযথ সাফ করা ও পরিবর্তন করা হচ্ছে না। ফলত, ক্রস ইনফেকশনের কারণে অনেকে মারা গেছেন। সাধারণ ওয়ার্ডে মৃত্যুর হার অনেক কম।
৬) একজন পেশেন্ট যখনই ইনটিউবেশনে গেল, চেষ্টা থাকা প্রয়োজন কত তাড়াতাড়ি তাকে ওই সাপোর্টের বাইরে আনা সম্ভব। বাস্তবে তার উল্টোটা হয়। 'ছোটে না তো হাঁটে না, কাউকে সে কাটে না'... অতএব চলুক ক্যাথিটার, অক্সিজেন, স্যালাইন, রাইলস টিউব। প্রয়াত ডাঃ নিশীথ চক্রবর্তী ব্যঙ্গ করে বলতেন: 'হুহ্। নল-কল-জল, এর নাম চিকিৎসা।'
৭) বালিকা বলেছিল, কোভিড পেশেন্টকে রাখতে হবে খোলামেলা মুক্ত প্রশস্ত ওয়ার্ডে। সেখানে বাতাসের প্রবেশ ও বাতাস নিষ্কাশনের ভালো বন্দোবস্ত থাকা জরুরি। তাই জেনারেল ওয়ার্ড তার কাছে উপযুক্ত মনে হয়েছে।
৮) যখন ডাক্তার রাত্রি ১০টা থেকে সকাল ৮টা নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, তখনও মাঝে মাঝে আধঘণ্টা অক্সিজেন সাপোর্ট সরিয়ে প্রন পজিশনে (উপুড় হয়ে) শুয়ে থাকতে বলে। যেহেতু ফুসফুস থাকে পিঠের দিকে, তাই এর ফলে ফুসফুস সহজেই কাজ করতে পারে ও সক্রিয় হয়। ফুসফুসের নিজস্ব সক্রিয়তা বাড়ানো প্রধান লক্ষ্য। সাপোর্ট সরিয়ে নিতে পারাই তো সুস্থতা।
৯) যেহেতু জেঠু-জেঠিমা দুজনেই হার্ট-লাঙের পেশেন্ট তাই নিয়মিত স্টেরয়েড ইনজেকশন চলেছে। এর ফলে আবার ব্লাড সুগার বৃদ্ধি, তাই নিয়মিত ইনসুলিন। জ্বরের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক, প্যারাসিটামল, ভিটামিন সি, পেটের জন্য টক দই, আর ভালো পুষ্টিকর খাবার।
১০) ডাক্তাররা বকেছে, অফিস ধমকেছে, কোনও বড় বিপদ ঘটে গেলে কী করবি। নার্স বালিকা কেঁদেছে। জেঠিমা বলেছেন, তুই যা ভালো বুঝবি তাই করবি। আমরা জানি আমাদের ভালোর জন্যই তুই করছিস। এই নিঃশর্ত খোলা বিশ্বাস ছাড়া চিকিৎসা করা সম্ভব হত না।
এত কথা বললাম এই সত্যটা তুলে ধরতে যে, রোগী-চিকিৎসকের মধ্যে যদি এই আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক না থাকে তবে চিকিৎসা এগোয় না। ডাক্তার সদা সতর্ক তার প্রেসক্রিপশনে যেন কোনও আইনি ফাঁক না থাকে। এর নাম চিকিৎসা নয়। এই নার্স বালিকার দ্বিতীয় উদাহরণে মূল বক্তব্য আশা করি স্পষ্ট হবে।
মহিলা পেশেন্ট, বয়স ৮৪/৮৫। দীর্ঘদিন পেটের সমস্যা, পায়খানায় রক্তপাত। রক্তের রিপোর্ট আশঙ্কাজনক। গ্যাস্ট্রোএন্ট্রেরোলজিস্ট দেখেছেন, কোলনোস্কোপি করেছেন। সিস্ট আছে, কিন্তু বায়োপসি রিপোর্ট খারাপ নয়। রক্তের রিপোর্টে স্পষ্ট ক্যানসার। কিন্তু বায়োপসি রিপোর্ট? আসলে গ্যাস্ট্রোএন্ট্রেরোলজিস্ট আগে দেখেছেন রক্তের রিপোর্ট। ক্যানসার নিশ্চিত বুঝে, কোলনের টিউমার নিয়ে অহেতুক নাড়াচাড়া না করে ওপর ওপর স্যাম্পল নিয়ে বায়োপসি করেছেন। কারণ, এই বয়সী এত দুর্বল পেশেন্টকে কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে। অত্যন্ত মানবিক ও বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত। তাই বায়োপসি রিপোর্টে ক্যানসার ধরা পড়েনি। আরও একটু ইন্টিরিয়রে গিয়ে স্যাম্পল নিলে ধরা পড়ত। কিন্তু পেশেন্টের কষ্ট বাড়ত, রক্তপাত হতে পারত। চিকিৎসকের এই মানবিক দৃষ্টিকে অনুসরণ করে সেই বালিকা নার্স পায়খানা ও রক্তপাত বন্ধ করার ওষুধ, নিয়মিত গ্যাসের ওষুধ, পেটের জন্য নিয়মিত ভাইজিল্যাক বা টক দই, ভালো পুষ্টিকর খাবার, তাজা সবজি, মাছ, মাংস ডিম দুধ, রসাল ফল খাবার পরামর্শ দিল।
রোগীর হাত পা ফুলে গেল, ইডিমা স্পষ্ট। ল্যাসিক্স দিয়ে ফ্লুইড বের করা, নিয়মিত ব্লাড প্রেসার দেখা, ফ্লুইড বের হয়ে যাবার ফলে ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স, তার জন্য ওরাল রিহাইড্রেশন, টলভ্যাপটাম ট্যাবলেট, অ্যালবুমিন ইনটেক বাড়ানো, ডিমের সাদা অংশ, অ্যালবুকেয়ার পাউডার, ইনজেকশন।
পেশেন্ট পার্টি একজন বালিকা নার্সের ওপর এই বিপুল দায়িত্ব প্রদানে আস্থা রাখতে পারেনি। একাধিক বিশেষজ্ঞ দেখে গেলেন। পদ্ধতি তাদের কাছে প্রধান। 'অ্যাবডোমিনাল সিটি স্ক্যান রিপোর্ট' ছাড়া চিকিৎসা শুরু হবে না। বায়োপসি রিপোর্ট ছাড়া ক্যানসার নিশ্চিত হব কী করে, তাই আরও একটা বায়োপসি। কেউ একবারও ভাবছেন না, ক্যানসার আছে, ওটা সারানোর কোনও চিকিৎসা হবে না। রোগী যে কদিন বাঁচবে তার আনুষঙ্গিক কষ্টের যদি কিছু উপশম করা যায়। অবশেষে এক মানবিক ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করলেন, বেডশোরের জন্য Oxam spray + Hydroheal Ointment dressing, Tbact Ointment এবং খাবার জন্য Albucare Advance Powder, ছোলা, আখের গুড়, ডিম ইত্যাদি। এবার পেশেন্ট পার্টি সেই বালিকার শরণাপন্ন। বালিকা নিজের চিকিৎসার সমর্থনে একটা জুৎসই প্রেসক্রিপশন হাতে পেয়ে স্বাধীন ভাবে বিশ্বাস ও আস্থার সাথে চিকিৎসা শুরু করল।
পুস্তক কেন্দ্রিক কিছু সমস্যা, সেই মতো সমস্যা সমাধানের নাম চিকিৎসা নয়। নানাবিধ ইনভেস্টিগেশন চলবে। যে কোনও ভাবে ত্রিভূজের দুটি বাহু ও একটি কোণ অথবা দুটি কোণ একটি বাহুকে মেলানোর চেষ্টা। যতক্ষণ না মিলবে পরীক্ষা চালিয়ে যাও। আর মিলে গেলেই ত্রিভুজ দুটি সর্বসম, অতএব দিয়ে দাও ওষুধ। না এটা চিকিৎসা নয়। পেশেন্টের বয়স, আনুসঙ্গিক অন্যান্য রোগ, সাধারণ স্বাস্থ্য, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি প্যারামিটার বিবেচনা করে তবেই চিকিৎসা।
তাহলে শুনুন, আমার বাম চোখে ১৯৯২ থেকে ম্যাকুলার ইডিমা। লিক স্পটটা ম্যাকুলার এতো সংলগ্ন যে ওখানে লেজার থেরাপি সম্ভব নয়। এখন অবধি বছরে একবার দুবার হয়ে হয়ে ওখানে স্থায়ী একটা স্কার তৈরি হয়েছে। বাম চোখে এখন কিছুই দেখি না। বছর খানেক হল ডান চোখে ছানি। নামি চোখের হাসপাতালে দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অপারেশনের দিন স্থির। বালিকা নার্স বলল, জেঠু তুমি আরও একটা ওপিনিয়ন নাও। এখন যেটুকু দৃষ্টি ওই ছানিপড়া ডান চোখে। অপারেশন করতে গিয়ে যদি সেটুকুও যায়। পরামর্শ নিলাম এক সিনিয়র ডাক্তারের। তিনি বললেন, যারাই সিঙ্গল আই ডিপেন্ডেন্ট, তাদের কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্ট আবশ্যিক। যেদিন সম্পূর্ণ দৃষ্টি চলে যাবে সেদিন হারাবার ভয় থাকবে না। তখন অপারেশন করাবেন। তবে এখন ছ' মাস অন্তর ডাক্তার দেখাবেন। যাতে নতুন কোনও সমস্যা দেখা না দেয়। বালিকা সে যাত্রা বাঁচিয়েছে।
আমি যে চিকিৎসার কথা বলছি, তা ডাক্তারি বইয়ে লেখা থাকে না। চিকিৎসার যত বেশি বেসরকারি বাণিজ্যিকীকরণ হবে, এই চিকিৎসা ততই অস্তগামী হবে। মনে আছে, প্যারালাইসিস পেশেন্ট আমার মায়ের ছানি অপারেশনের পর এক মাসের মাথায় চোখে ইনফেকশন হল। অনেক অনুরোধে সিনিয়র ডাক্তার একজন জুনিয়রকে পাঠালেন। তিনি দেখে বললেন, মোস্ট কমন একটা ইনফেকশন হয়েছে। স্যার বলবেন আর একটা ছোট অপারেশন করতে হবে। ওটা ছাড়া সারবে না ঠিকই। আমি সেটাই লিখে দিলাম। কিন্তু কথা হল, উনি শয্যাশায়ী। একা রাস্তায় যাবেন না, রান্নাঘরেও যাবেন না। একটু টিভি, খবরের কাগজ, গল্পগুজব, এর বেশি তো নয়। তাহলে যে দৃষ্টি ফিরে এসেছে সেটাই যথেষ্ট। ওষুধ দিয়ে ইনফেকশনটা গার্ড করলেই যথেষ্ট। ১০০ শতাংশ দৃষ্টি ফেরানোর প্রয়োজন কী! ওষুধ লিখে দেব? আমি সম্মতি দিলাম। এই ডাক্তার বই পড়ে হয় না। এই ডাক্তারের বড়ই অভাব।
সত্যি বলতে গেলে, এই বালিকা আমাদের প্রধান গৃহ চিকিৎসক। তবে একজন ডাক্তারকে তিন মাস অন্তর ফিজ দিয়ে দেখাই। বালিকা তো আর জেঠুকে ডেথ সার্টিফিকেট দিতে পারবে না। তাই এই কৌশল। ডাক্তার দেখাই, কিন্তু প্রেসক্রিপশন ফলো করি না।