Wednesday, 20 July 2022

ডাক্তার দেখাই, প্রেসক্রিপশন ফলো করি না!

কিন্তু সেই ডাক্তার: কোথায় পাব তারে

নন্দন বসু


একটি পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কোভিড পেশেন্ট। স্বামী পোস্ট-সিএবিজি (কার্ডিয়াক বাইপাস সার্জারি) পেশেন্ট। লাঙ ইনফেকশনের হিস্ট্রি আছে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৭৮, অবস্থা বুঝুন। স্ত্রীর কোভিড ছাড়াও টেম্পারেচার ১০৫°-- ১০৬°,  টাইফয়েড। প্রথমেই দুই পেশেন্টকে ভর্তি করা হল। চিকিৎসক দেখলেন স্ত্রীর শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন ইনটেকে ঘাটতি, স্বাভাবিক ভাবেই মস্তিষ্কে কম অক্সিজেন সাপ্লাই, এগুলিই প্রধান সমস্যা। আগে থেকেই পালমোনারি ফাংশন টেস্ট রিপোর্ট ভালো ছিল না। পেশেন্ট ওই হাসপাতালে এক নার্স বালিকার জেঠু ও জেঠিমা। 

ডাক্তার HRCT স্ক্যান করা ছাড়াও বিস্তর পরীক্ষা ও নানাবিধ ওষুধপত্র ও ICU অ্যাডমিশনের অ্যাডভাইস লিখলেন। নার্স বালিকা HRCT ও ICU ছাড়া অন্য সকল অ্যাডভাইস মেনে চলল। আর একটি লক্ষণীয় ঘটনা, রাত্রি ১০টা থেকে সকাল ৮টা নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সাপোর্ট বলা থাকলেও বালিকা মাঝে মাঝে এসে ৩০ মিনিট অক্সিজেন সাপোর্ট  তুলে নিত। এই ভূমিকা পালন করার জন্য অফিস কর্তৃপক্ষকে এমনকি ডাক্তারের অনেক ভর্ৎসনা সহ্য করতে হয়েছে। অসংখ্য কো-মর্বিডিটি ফ্যাক্টর ও ৬৪+ বয়স নিয়ে দুজন পেশেন্টই বাড়ি ফিরল। ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠল। 

ডিসচার্জ হবার দু' মাস পরে HRCT করা হল। পালমোনারি ইনফেকশন সিভিয়ারিটি মোট ২৫'এর মধ্যে একজনের ১৯, অপরজনের ১২, ভাবুন ২ মাস চিকিৎসার পরেও বিশেষ কমেনি। 

এত কথা বলার মূল কারণটা বলি, নার্স বালিকা যে কথাগুলো পরে বুঝিয়ে বলেছিল:

১) যে অবস্থা নিয়ে পেশেন্ট দুজন হাসপাতালে ভর্তি হল, যে কোনও শিক্ষিত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার HRCT করে চেস্টের অবস্থা আগে দেখে নেবেন এটাই স্বাভাবিক। পরে ভালো মন্দ কিছু হলে এই প্রশ্ন উঠবেই, HRCT করেননি কেন? এটা চিকিৎসকের রক্ষাকবচ। 

২) জেঠু জেঠিমা যে অবস্থায় এসেছিলেন ২ মাস পরের HRCT রিপোর্টেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তখনকার রিপোর্ট কী হতে পারত। ক্লিনিক্যালি তখনই সেটা বোঝা গিয়েছিল। অতএব, চরম খারাপ ধরে নিয়েই চিকিৎসা শুরু হল। 

৩) কোভিড ব্যাধি থেকে ফুসফুসে সংক্রমণ। জেঠু জেঠিমার সামান্য ঠাণ্ডায় ইনফেকশন হয়। তাই বালিকার মনে হল ICU-র শীতল পরিবেশ সংক্রমণে সাহায্য করবে। 

৪) ICU'র নানাবিধ ইনটিউবেশন প্রায়শই সংক্রমণ ডেকে আনে। এটা স্বীকৃত সত্য। 

৫) কোভিড তৃতীয় তরঙ্গের ব্যস্ততম দিনগুলোতে ICU'তে অত্যধিক চাপের সময়ে দেখেছি একটি পেশেন্টের বিছানা ফাঁকা হওয়ার পর উপকরণ সামগ্রী যথাযথ সাফ করা ও পরিবর্তন করা হচ্ছে না। ফলত, ক্রস ইনফেকশনের কারণে অনেকে মারা গেছেন। সাধারণ ওয়ার্ডে মৃত্যুর হার অনেক কম। 

৬) একজন পেশেন্ট যখনই ইনটিউবেশনে গেল, চেষ্টা থাকা প্রয়োজন কত তাড়াতাড়ি তাকে ওই সাপোর্টের বাইরে আনা সম্ভব। বাস্তবে তার উল্টোটা হয়। 'ছোটে না তো হাঁটে না, কাউকে সে কাটে না'... অতএব চলুক ক্যাথিটার, অক্সিজেন, স্যালাইন, রাইলস টিউব। প্রয়াত ডাঃ নিশীথ চক্রবর্তী ব্যঙ্গ করে বলতেন: 'হুহ্। নল-কল-জল, এর নাম চিকিৎসা।'

৭) বালিকা বলেছিল, কোভিড পেশেন্টকে রাখতে হবে খোলামেলা মুক্ত প্রশস্ত ওয়ার্ডে। সেখানে বাতাসের প্রবেশ ও বাতাস নিষ্কাশনের ভালো বন্দোবস্ত থাকা জরুরি। তাই জেনারেল ওয়ার্ড তার কাছে উপযুক্ত মনে হয়েছে। 

৮) যখন ডাক্তার রাত্রি ১০টা থেকে সকাল ৮টা নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, তখনও মাঝে মাঝে আধঘণ্টা অক্সিজেন সাপোর্ট সরিয়ে প্রন পজিশনে (উপুড় হয়ে) শুয়ে থাকতে বলে। যেহেতু ফুসফুস থাকে পিঠের দিকে, তাই এর ফলে ফুসফুস সহজেই কাজ করতে পারে ও সক্রিয় হয়। ফুসফুসের নিজস্ব সক্রিয়তা বাড়ানো প্রধান লক্ষ্য। সাপোর্ট সরিয়ে নিতে পারাই তো সুস্থতা। 

৯) যেহেতু জেঠু-জেঠিমা দুজনেই হার্ট-লাঙের পেশেন্ট তাই নিয়মিত স্টেরয়েড ইনজেকশন চলেছে। এর ফলে আবার ব্লাড সুগার বৃদ্ধি, তাই নিয়মিত ইনসুলিন। জ্বরের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক, প্যারাসিটামল, ভিটামিন সি, পেটের জন্য টক দই, আর ভালো পুষ্টিকর খাবার। 

১০) ডাক্তাররা বকেছে, অফিস ধমকেছে, কোনও বড় বিপদ ঘটে গেলে কী করবি। নার্স বালিকা কেঁদেছে। জেঠিমা বলেছেন, তুই যা ভালো বুঝবি তাই করবি। আমরা জানি আমাদের ভালোর জন্যই তুই করছিস। এই নিঃশর্ত খোলা বিশ্বাস ছাড়া চিকিৎসা করা সম্ভব হত না। 

এত কথা বললাম এই সত্যটা তুলে ধরতে যে, রোগী-চিকিৎসকের মধ্যে যদি এই আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক না থাকে তবে চিকিৎসা এগোয় না। ডাক্তার সদা সতর্ক তার প্রেসক্রিপশনে যেন কোনও আইনি ফাঁক না থাকে। এর নাম চিকিৎসা নয়। এই নার্স বালিকার দ্বিতীয় উদাহরণে মূল বক্তব্য আশা করি স্পষ্ট হবে। 

মহিলা পেশেন্ট, বয়স ৮৪/৮৫। দীর্ঘদিন পেটের সমস্যা, পায়খানায় রক্তপাত। রক্তের রিপোর্ট আশঙ্কাজনক। গ্যাস্ট্রোএন্ট্রেরোলজিস্ট দেখেছেন, কোলনোস্কোপি করেছেন। সিস্ট আছে, কিন্তু বায়োপসি রিপোর্ট খারাপ নয়। রক্তের রিপোর্টে স্পষ্ট ক্যানসার। কিন্তু বায়োপসি রিপোর্ট? আসলে গ্যাস্ট্রোএন্ট্রেরোলজিস্ট আগে দেখেছেন রক্তের রিপোর্ট। ক্যানসার নিশ্চিত বুঝে, কোলনের টিউমার নিয়ে অহেতুক নাড়াচাড়া না করে ওপর ওপর স্যাম্পল নিয়ে বায়োপসি করেছেন। কারণ, এই বয়সী এত দুর্বল পেশেন্টকে কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে। অত্যন্ত মানবিক ও বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত। তাই বায়োপসি রিপোর্টে ক্যানসার ধরা পড়েনি। আরও একটু ইন্টিরিয়রে গিয়ে স্যাম্পল নিলে ধরা পড়ত। কিন্তু পেশেন্টের কষ্ট বাড়ত, রক্তপাত হতে পারত। চিকিৎসকের এই মানবিক দৃষ্টিকে অনুসরণ করে সেই বালিকা নার্স পায়খানা ও রক্তপাত বন্ধ করার ওষুধ, নিয়মিত গ্যাসের ওষুধ, পেটের জন্য নিয়মিত ভাইজিল্যাক বা টক দই, ভালো পুষ্টিকর খাবার, তাজা সবজি, মাছ, মাংস ডিম দুধ, রসাল ফল খাবার পরামর্শ দিল। 

রোগীর হাত পা ফুলে গেল, ইডিমা স্পষ্ট। ল্যাসিক্স দিয়ে ফ্লুইড বের করা, নিয়মিত ব্লাড প্রেসার দেখা, ফ্লুইড বের হয়ে যাবার ফলে ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স, তার জন্য ওরাল রিহাইড্রেশন, টলভ্যাপটাম ট্যাবলেট, অ্যালবুমিন ইনটেক বাড়ানো, ডিমের সাদা অংশ, অ্যালবুকেয়ার পাউডার, ইনজেকশন। 

পেশেন্ট পার্টি একজন বালিকা নার্সের ওপর এই বিপুল দায়িত্ব প্রদানে আস্থা রাখতে পারেনি। একাধিক বিশেষজ্ঞ দেখে গেলেন। পদ্ধতি তাদের কাছে প্রধান। 'অ্যাবডোমিনাল সিটি স্ক্যান রিপোর্ট' ছাড়া চিকিৎসা শুরু হবে না। বায়োপসি রিপোর্ট ছাড়া ক্যানসার নিশ্চিত হব কী করে, তাই আরও একটা বায়োপসি। কেউ একবারও ভাবছেন না, ক্যানসার আছে, ওটা সারানোর কোনও চিকিৎসা হবে না। রোগী যে কদিন বাঁচবে তার আনুষঙ্গিক কষ্টের যদি কিছু উপশম করা যায়। অবশেষে এক মানবিক ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করলেন, বেডশোরের জন্য Oxam spray + Hydroheal Ointment dressing, Tbact Ointment এবং খাবার জন্য Albucare Advance Powder, ছোলা, আখের গুড়, ডিম ইত্যাদি। এবার পেশেন্ট পার্টি সেই বালিকার শরণাপন্ন। বালিকা নিজের চিকিৎসার সমর্থনে একটা জুৎসই প্রেসক্রিপশন হাতে পেয়ে স্বাধীন ভাবে বিশ্বাস ও আস্থার সাথে চিকিৎসা শুরু করল। 

পুস্তক কেন্দ্রিক কিছু সমস্যা, সেই মতো সমস্যা সমাধানের নাম চিকিৎসা নয়। নানাবিধ ইনভেস্টিগেশন চলবে। যে কোনও ভাবে ত্রিভূজের দুটি বাহু ও একটি কোণ অথবা দুটি কোণ একটি বাহুকে মেলানোর চেষ্টা। যতক্ষণ না মিলবে পরীক্ষা চালিয়ে যাও। আর মিলে গেলেই ত্রিভুজ দুটি সর্বসম, অতএব দিয়ে দাও ওষুধ। না এটা চিকিৎসা নয়। পেশেন্টের বয়স, আনুসঙ্গিক অন্যান্য রোগ, সাধারণ স্বাস্থ্য, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি প্যারামিটার বিবেচনা করে তবেই চিকিৎসা। 

তাহলে শুনুন, আমার বাম চোখে ১৯৯২ থেকে ম্যাকুলার ইডিমা। লিক স্পটটা ম্যাকুলার এতো সংলগ্ন যে ওখানে লেজার থেরাপি সম্ভব নয়। এখন অবধি বছরে একবার দুবার হয়ে হয়ে ওখানে স্থায়ী একটা স্কার তৈরি হয়েছে। বাম চোখে এখন কিছুই দেখি না। বছর খানেক হল ডান চোখে ছানি। নামি চোখের হাসপাতালে দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অপারেশনের দিন স্থির। বালিকা নার্স বলল, জেঠু তুমি আরও একটা ওপিনিয়ন নাও। এখন যেটুকু দৃষ্টি ওই ছানিপড়া ডান চোখে। অপারেশন করতে গিয়ে যদি সেটুকুও যায়। পরামর্শ নিলাম এক সিনিয়র ডাক্তারের। তিনি বললেন, যারাই সিঙ্গল আই ডিপেন্ডেন্ট, তাদের কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্ট আবশ্যিক। যেদিন সম্পূর্ণ দৃষ্টি চলে যাবে সেদিন হারাবার ভয় থাকবে না। তখন অপারেশন করাবেন। তবে এখন ছ' মাস অন্তর ডাক্তার দেখাবেন। যাতে নতুন কোনও সমস্যা দেখা না দেয়। বালিকা সে যাত্রা বাঁচিয়েছে। 

আমি যে চিকিৎসার কথা বলছি, তা ডাক্তারি বইয়ে লেখা থাকে না। চিকিৎসার যত বেশি বেসরকারি বাণিজ্যিকীকরণ হবে, এই চিকিৎসা ততই অস্তগামী হবে। মনে আছে, প্যারালাইসিস পেশেন্ট আমার মায়ের ছানি অপারেশনের পর এক মাসের মাথায় চোখে ইনফেকশন হল। অনেক অনুরোধে সিনিয়র ডাক্তার একজন জুনিয়রকে পাঠালেন। তিনি দেখে বললেন, মোস্ট কমন একটা ইনফেকশন হয়েছে। স্যার বলবেন আর একটা ছোট অপারেশন করতে হবে। ওটা ছাড়া সারবে না ঠিকই। আমি সেটাই লিখে দিলাম। কিন্তু কথা হল, উনি শয্যাশায়ী। একা রাস্তায় যাবেন না, রান্নাঘরেও যাবেন না। একটু টিভি, খবরের কাগজ, গল্পগুজব, এর বেশি তো নয়। তাহলে যে দৃষ্টি ফিরে এসেছে সেটাই যথেষ্ট। ওষুধ দিয়ে ইনফেকশনটা গার্ড করলেই যথেষ্ট। ১০০ শতাংশ দৃষ্টি ফেরানোর প্রয়োজন কী! ওষুধ লিখে দেব? আমি সম্মতি দিলাম। এই ডাক্তার বই পড়ে হয় না। এই ডাক্তারের বড়ই অভাব। 

সত্যি বলতে গেলে, এই বালিকা আমাদের প্রধান গৃহ চিকিৎসক। তবে একজন ডাক্তারকে তিন মাস অন্তর ফিজ দিয়ে দেখাই। বালিকা তো আর জেঠুকে ডেথ সার্টিফিকেট দিতে পারবে না। তাই এই কৌশল। ডাক্তার দেখাই, কিন্তু প্রেসক্রিপশন ফলো করি না।


Saturday, 16 July 2022

সিংহের হিংস্র দন্ত!

আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে চাইছে দিল্লিশ্বর?

প্রবুদ্ধ বাগচী


হীরক রাজার বিপুল ধনভাণ্ডারের দরজা খুলে ঢুকতেই এক প্রকাণ্ড বিস্ময়। গুপী-বাঘা দেখল, সেই কোষাগার পাহারা দিচ্ছে এক রাজকীয় বাঘমামা। তার দু' চোখে গভীর আলস্য। এই চমকে ওঠা ঘটনার মধ্যে দিয়েই গুপীর গলায় উঠে এল গান। 'পায়ে পড়ি বাঘমামা/ কোরো না কো রাগ মামা/ তুমি যে এ ঘরে কে তা জানত?' গানের জাদুতে বাঘের শরীরে যখন দুলুনি লেগেছে তখন এই গানেই উঠে এল আর্ত আশঙ্কা-- 'যদি ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা/ কী জানি কি হবে বাবা/ মারা যাবে তাজা দুটি প্রাণ তো!' একটি চলচ্চিত্র আখ্যানের আশঙ্কা আজ ছায়া ফেলছে গোটা দেশ জুড়ে। সত্যিই কার ঘাড়ে কখন যে বাঘের থাবা এসে পড়বে, এ নিয়ে এই রাহুকালে গোটা দেশের মানুষ আজ ত্রস্ত। যে বাঘ একইসঙ্গে সম্পদের পাহারাদার ও ঘাতক।  

শুরুটা হয়েছিল কয়েক বছর আগে ভীমা-কোরেগাও মামলাকে কেন্দ্র করে। প্রায় পরিকল্পিত এক চক্রান্তে একসঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশিষ্ট কয়েকজন সমাজকর্মী ও মানবাধিকার কর্মীকে। তাঁরা অনেকেই নিজেদের পেশায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ--- অন্তত ‘দেশের বিরুদ্ধে’ যে ভাবে জেহাদিরা যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন, এঁদের সেই গোত্রে ফেলা যায় না। কিন্তু আমি আপনি কী ভাবছি তা নিয়ে কেন্দ্রের প্রশাসনের কোনও মাথাব্যথা নেই। তাঁরা যাকে দেশ বা রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করেছেন, বা তাঁরা সেই দেশ-এর পরিসীমা ঠিক করে দিয়েছেন, সেই গণ্ডি পেরলেই তাঁদের দেগে দেওয়া হবে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলে। এবং সেইভাবেই গুছিয়ে তোলা হবে মামলার পাহাড়- আইনের যত ধারা-উপধারা প্রয়োগ করে তাঁদের যতদিন কারার আড়ালে অন্তরীণ রাখা যায় ততই নাকি দেশের মঙ্গল। বাস্তবে হয়েছেও তাই। এঁদের সকলের সঙ্গেই নাকি ‘মাওবাদী’ যোগ আবিষ্কার করে ফেলেছে প্রশাসন। যারা এই ব্যাভিচারগুলির বিরোধিতা করছেন তাঁরা ‘মাওবাদ’ নামক একটা গোলমেলে বিষয়ে দু' হাত তোলা সমর্থক, এমন নয় মোটেও। আজকে যারা মাওবাদী নামে পরিচিত তাঁদের পথ ও মতের সঙ্গে অনেকের অনেক ধরনের বিরোধ আছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে মতামত প্রকাশের অধিকারকে পায়ের তলায় ফেলে দিলে আদপে গণতন্ত্রের পবিত্র কাঠামোটাই কোথাও দূষিত হয়ে যায়। মনে পড়ে যায়, প্রথমবার সংসদ ভবনে প্রবেশের আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আভূমি প্রণত হয়ে পড়ার সেই ‘হিট ছবি’টা। মুখ ও মুখোশের তফাত যে থাকেই সেটা ভারতের আমজনতা সেদিন বোঝেননি। আজ বুঝছেন।

স্ট্যান স্বামীর মতো মানুষ নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন জনজাতিদের উন্নয়নে, সেবায়। তাঁর বাড়িতে একটা লাঠিও ছিল কিনা সন্দেহ। অথচ তিনিও হয়ে গেলেন দেশদ্রোহী বিপজ্জনক মানুষ, এমনকি অসুস্থতার প্রকোপে যিনি জলের গ্লাস থেকে জল খেতে পারতেন না, তাঁকে জেলের মধ্যে একটা স্ট্র অবধি দেওয়া হয়নি। তাঁর মৃত্যু ঘটে গেছে এক বছর আগেই। জনজাতিদের জন্য বাস্তবিক যিনি নিজের জীবন বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন, সেই অশীতিপর যাজককে শেষ অবধি জামিন দেওয়া যায়নি।

কিন্তু বাঘের রক্তপিপাসা তো অনন্ত, তাই সে নতুন নতুন শিকার খুঁজে বেড়ায়। গুজরাট নরমেধ যজ্ঞ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট একটি অত্যন্ত অসংবেদনশীল রায় ও মন্তব্য করার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে থাবা এসে পড়ল তিস্তা শীতলবাদের ওপর। আপাতত তিনি জামিনহীন জেলবন্দি। তার অল্প আগেই আটক করা হয়েছে মহম্মদ জুবেইরকে। তিনি তাঁর 'অল্ট নিউজ' চ্যানেলে সরকারের নানা কুমতলব আর আইটি সেলের ভুয়ো খবর ‘ভান্ডাফোড়’ করে দিচ্ছিলেন। আর ‘নূপুরের’ কাংস্যনিন্দিত কন্ঠে যিনি বেচাল বাক্য বলে দেশের সরকারকে কূটনৈতিক সমস্যায় ফেলেছিলেন, তাঁর সেই ‘মধুর’ ভাষণ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে সরকারের আরও বিরাগভাজন হলেন জুবেইর। সুতরাং, ‘তুই না করলেও তোর বাবা জল ঘোলা করেছিল’ কায়দায় চল্লিশ বছরের পুরনো হৃষিকেশ মুখার্জি'র একটি ফিল্মের ছবি তুলে এনে জুবেইরকে জব্দ করার এক ফন্দি আঁটা হল। দুয়েকটি মামলায় জামিন পেলেও অন্য নানা মামলায় তিনি এখনও কারা প্রাচীরের ওপারে। অবশ্য সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীদের নানা ধরনের হেনস্থায় বা বৃহত্তর অর্থে সংবাদমাধ্যমের কাজে বাধাদান ও তাদের স্বাধীনতা রুদ্ধ করার প্রশ্নে বর্তমান জমানায় ভারত নামক এই দেশটি আন্তর্জাতিক নিরিখেই এখন এগিয়ে। কোথাও সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিগৃহীত হতে হচ্ছে তাঁদের, তুচ্ছ অজুহাতে গ্রেফতার করে ‘দেশদ্রোহ’এর অভিযোগে তাঁদের বেঁধে ফেলা হচ্ছে। এমন দৃষ্টান্ত আজ ভুরি ভুরি। রাণা আইয়ুব'এর ‘গুজরাট ফাইলস’ আমরা অনেকেই পড়েছি, সেখানে বিধৃত আছে আরএসএস বাহিনীর নৃশংসতা ও প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় রাখার কূটনীতি কতদূর পর্যন্ত বিষাক্ত হতে পারে। সেইসব ঘটনার পরে দেশে সংঘীদের শাসন ইতিমধ্যে আট বছর পেরিয়ে গেছে, আরও আঁটো হয়ে বসেছে তাদের দাপট আর অনাচার।

ঘটনা হল, এই ‘ম্যান ইটার অফ নিউ দিল্লি’ এতকাল যাদের ঘাড়ে থাবা মেরে জিভ চাটছিল, তাঁরা কমবেশি চেতনায়, ভাবনায় কিছুটা বামাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়া, সবাই অবশ্যই ঘোষিত অর্থে ‘কমিউনিস্ট’ নন। কিন্তু সামাজিক চিন্তা বা মানবাধিকারের আন্দোলন অনেকটাই প্রগতিশীল মতবাদের সঙ্গে ঘর করা বিষয়। কিন্তু এবারে ঘাতকের দৃষ্টি যে সব দিকেই পড়েছে তার হদিশ মিলল যখন সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশ সরকার এফআইআর দায়ের করল সমাজকর্মী মেধা পাটেকরের নামেও। মেধা বহুদিনের পরিচিত গান্ধীবাদী সমাজকর্মী, যার মূল পরিচয় পরিবেশ আন্দোলনের সূত্রে। ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলন তাঁকে দেশজোড়া খ্যাতি দিয়েছে, পাশাপাশি তিনি নানা ধরনের সামাজিক আন্দোলনের সহযোদ্ধা। এই রাজ্যের জমি আন্দোলনে আমরা তাঁকে দেখেছি শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের ভূমিকায়। কিন্তু এইরকম একটি ব্যক্তিত্বকে আঘাত করার নতুন ফিকির হল তাঁর তৈরি একটি ট্রাস্ট। জনৈক সংঘী অভিযোগ তুলেছেন, ওই ট্রাস্টের অর্থ নাকি বিদেশ থেকে পাওয়া এবং তা নাকি জনজাতিদের জন্য খরচ করা হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। মেধা স্বয়ং এবং ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ সরকার অভিযোগের তদন্ত করবে বলে খবর। 

কিন্তু এগুলো যে আসলে হিমশৈলের চূড়া তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এইভাবেই একেকটা খুচরো অভিযোগ সামনে রেখে বড় ধরনের আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়, এই অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ পত্রিকার সঙ্গে এমনই কোনও এক ট্রাস্টের পুরনো যোগাযোগ খুঁচিয়ে বার করে সনিয়া গান্ধী ও তাঁর পরিবারের পেছনেও ইডি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে- নিছক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া যাকে আর কিছুই বলা যায় না। মেধা পাটেকরও পরিবেশ অধিকার আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে কোনওদিনই কোনও সরকারের সুনজরে ছিলেন না; বিশেষ করে আজকের কেন্দ্রীয় সরকার ও তাদের বশংবদ রাজ্য সরকারগুলি যখন দেশের নদী নালা পাহাড় সমুদ্র জঙ্গল সবই বহুজাতিকদের হাতে একচেটিয়াভাবে তুলে দিতে মরিয়া, তখন তাদের সামনে ন্যূনতম কোনও প্রতিরোধের মুখ থাকুক এটা তাদের অভিপ্রেত নয়। অনেকেই ইতিমধ্যে জানেন, গুজরাট রাজ্যে নর্মদা নদীর পাড় বুজিয়ে সেখানে বিলাসবহুল হোটেল ও শপিং মল তৈরি করা হয়েছে। কাজেই নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থে ঘা লাগলে, প্রয়োজন বুঝলেই মেধার মতো গান্ধীবাদীকেও খাঁচায় পুরতে তাদের চক্ষু লজ্জায় বাঁধবে না। নরখাদকের আবার লজ্জা!

এরই মধ্যে আরও এক খবর শিরোনামে এল। ছত্তিশগড়ের পরিচিত গান্ধীবাদী সমাজকর্মী হিমাংশু কুমারকে আমরা অনেকেই চিনি। এক সময় ছত্তিশগড়ের ‘সালওয়া জুড়ুম’ ব্যবস্থার প্রতিবাদে যিনি সংগঠিত করেছিলেন এলাকার আদিবাসী মানুষদের, বারবার বিভিন্ন ফোরামে বলে বেড়িয়েছেন এইভাবে পুলিশ ও সেনার তরফে সাধারণ মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া অনৈতিক ও গণতন্ত্রবিরোধী। পরিণামে তাঁর তৈরি করা আশ্রম পুলিশ এসে ভেঙে দেয়। যদিও তিনি তার বিরুদ্ধে সারা দেশ ঘুরে জনমত সংগ্রহ করেছিলেন, এসেছিলেন কলকাতাতেও- তাঁর বক্তৃতা ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশও হয়েছে বাংলা ভাষায়। 

সম্প্রতি তিনি সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছিলেন। কিছুকাল আগে ছত্তিশগড়ে ‘মাওবাদী’ দমন অভিযানের সূত্রে ১৭জন নিরীহ আদিবাসীকে পুলিশ হত্যা করে- নিরীহ নাগরিকদের প্রতি এই রাষ্ট্রীয় অবিচার যেন সুপ্রিম কোর্ট বিবেচনা করে দেখে, এই ছিল তাঁর আর্জি। এতে কোনও অন্যায় আছে বলে মনে হয় না। যে দেশে একজন জনজাতি মহিলাকে রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর তোড়জোড় চলছে এবং বলা হচ্ছে এই ‘মহান প্রয়াস’কে নাকি সকলের সমর্থন করা উচিত, সেখানে নিরীহ সহায়হীন আদিবাসীদের ওপর এমন নির্বিচার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে একজন সমাজকর্মী আইনি সুবিচার চাইতে পারেন না? কিন্তু হলে হবে কি, ইদানিং দেশের সব থেকে উঁচু আদালতের মাথা সব সময় সিধে পথে চলছে না। আদালত জানিয়ে দিয়েছে, হিমাংশু কুমারের জানানো অভিযোগ তাঁরা পত্রপাঠ খারিজ করে দিচ্ছেন। সুতরাং, বাঘের বিচরণভূমি আরও খানিকটা বেড়ে গেল, বেড়ে যাচ্ছে। আপাতত তার লোলজিহ্বা রক্তে মাখামাখি, সে শুধু খুঁজে চলেছে তার পরের শিকার।

একেবারে টাটকা খবর হল, সংসদের আসন্ন বাদল অধিবেশনেও সংসদের ভিতর সমালোচনার জন্য বেশ কিছু শব্দকে স্পিকার নজরবন্দি করেছেন। অর্থাৎ, সংসদের ভিতরে সরকারের সমালোচনাও আর নথিভুক্ত হবে না- বেচাল সমালোচনা হলেই তা কার্যবিবরণী থেকে মুছে দেওয়া হবে। আপাতত শান্তিকল্যাণ। এমনকি সংসদ চত্বরে সাংসদদের কোনওরকম বিক্ষোভ অবস্থান প্রতিবাদী মিছিল ধর্না, তাতেও জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তার মানে শুধু একমুখি প্রচার আর তার অন্তরালে ক্ষিপ্ত বাঘমামার ল্যাজ আছড়ানোর আওয়াজ। 

শুধু বাঘ নয়, এখন অশোকস্তম্ভের নিরীহ সিংহগুলোও নাকি সুউচ্চ নতুন সংসদ ভবনের মাথায় বসে দাঁতে শান দিয়ে  একশো তিরিশ কোটির রক্তপান করবে বলে চনমন করছে! আশেপাশে কোনও রিংমাস্টার আছেন নাকি?


Monday, 11 July 2022

কর্মসংস্থানের নয়া জগৎ?

ঝুঁকিপূর্ণ অনলাইন লটারির রমরমা!

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


টিভি খুললেই লটারির বিজ্ঞাপন। শুধুমাত্র তাই নয়, ফেসবুক কিংবা ইউটিউব- সর্বত্রই এখন এরই রমরমা। এমনকি বড়-বড় তারকারাও এর প্রচারে কসুর করছেন না। 

জুয়া খেলার ইতিহাস বহু প্রাচীন হলেও লটারি খুব বেশি পুরনো নয়। ছেলেবেলায় বাতিল লটারির টিকিট জমিয়ে আমরা মফস্বলের ছেলেরা খেলাও করেছি। পুজোপার্বণে মেলায় গিয়ে বাজি ধরা থেকে জুয়ার নানান ধরন-ধারণও দেখেছি। কিন্তু এখন লটারির যে-অবস্থা দেখা যাচ্ছে তা যেন একটা শিল্পে পরিণত হয়েছে। ভারতের প্রায় ১৩টি রাজ্য লটারি খেলাতে সম্মতি দিয়েছে আর বাকিগুলি নিষিদ্ধ করেছে। তবে মনে হয় না খুব বেশিদিন এই নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখা যাবে। কেননা এটা এখন একটা মুনাফাজনক শিল্প, যা থেকে আমজনতা ও সরকার উভয়েই লাভের ফল কুড়িয়ে নিচ্ছে। যেহেতু ফাটকা কারবার, তাই অনেকেই আবার নিঃস্বও হয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারের রাজকোষে তাতে প্রভাব পড়ছে না। 

২০১৭ সালে সরকারের তরফে লটারির উপরে প্রথম ২৮ শতাংশ জিএসটি লাগু করা হয়। এ-নিয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর বিতর্ক চলেছিল। কেননা লটারিকে না পণ্য হিসাবে দেখা যায়, না পরিষেবা হিসাবে- তাই আদৌ এর উপরে কর চাপানো যায় কিনা তা নিয়ে জল্পনা ছিল। তবে ২৮ শতাংশ জিএসটি যথেষ্ট বেশি হওয়ায় বেআইনি লটারির রমরমাও শুরু হয়ে গেল। ফলে, সরকার যে লাভের গুড় খাবে বলে প্রত্যশা করেছিল, তা ছোট-ছোট কালোবাজারি কারবার গ্রাস করে ফেলল। সে-কারণে দ্বৈত কর নীতির প্রচলন হল– এক) রাজ্যাভ্যন্তরীণ লটারিতে লাগু হল মাত্র ১২ শতাংশ জিএসটি আর দুই) রাজ্যের বাইরে গেলেই বজায় রাখা হল ২৮ শতাংশ। জল গড়াল সুপ্রিম কোর্ট অবধি। শেষমেশ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গিয়ে এর সুরাহা হল। তাতেও খুব বেশি লাভ হয়নি। কেননা করের বোঝা সংস্থার থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে জনসাধারণের উপরে চাপানো হল। আসলে উপায় ছিল না– পুরস্কার মূল্য কম করে দিলে বাজার হয়তো ভেঙেই পড়ত, তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু তাতেও দেখা যায় লটারি বিক্রিতে ঘাটতি। বিখ্যাত ‘প্লেউইন’ বন্ধ অবধি হয়ে যায়। 

তথাকথিত লটারির ব্যবসায় যখন ঘাটতি দেখা দিল তখনই অনলাইন-লটারির চালু। এক ধাক্কায় রাজ্য-দেশের সীমানা ভেঙে গেল। খুলে গেল বিরাট বাজার। জুয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৫.১ শতাংশ বাজার দখল করে আছে লটারি। সুতরাং, ব্যাপারটাকে আর অবহেলা করার মতো অবস্থা থাকল না। এমনিতেই কোভিড, মানুষ ঘরে বসে। হাতে মোবাইল, অফুরন্ত ইন্টারনেট। অতএব, লাফিয়ে-লাফিয়ে অনলাইন-লটারির বাজার বৃদ্ধি পেল। লাভের অঙ্কে জোয়ার এল। 

প্রাক্-জিএসটি অবস্থায় ভারতে লটারির বাজার ছিল বছরে ৫০,০০০ কোটি টাকার। কিন্তু জিএসটি লাগু হওয়ার পরে এই বাজারে ধস দেখা গিয়েছিল, দাঁড়িয়েছিল ১৫,০০০ কোটিতে। কালোবাজারিও শুরু হয় সে-মোতাবেক। আর এইখানেই অনলাইন লটারি সম্রাটের জায়গা করে নেয়। ‘সুগাল ও দামিনী’ জানিয়েছে যে অনলাইন মাধ্যমে ইতিমধ্যে তা ৭৫ শতাংশ বাজার দখল করেছে ও প্রতিদিন ২৫ হাজার পয়েন্ট-অফ-সেল এবং ১.৮ কোটি লেনদেন নথিভুক্ত করেছে। কেরালা– ১৯৬৭ সালে লটারিকে সরকারিকরণ করা প্রথম রাজ্য– ২০১৭ সালের খতিয়ান অনুযায়ী ৭৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব-অর্জন করেছে। অনুমান যে আগামী কয়েক বছরে এটা ১০,০০০ কোটি টাকাকে ছাপিয়ে যাবে। এর অর্থ দাঁড়ায়, কেরালার যা জনসংখ্যা তাতে করে প্রতি সপ্তাহে ৭.৯ কোটি লটারি বিক্রি হয়েছে; অথবা বলা যায়, প্রতিটি বাড়ি ৫০০টি করে লটারি কিনেছে। কেরালার ক্ষেত্রে লটারির ব্যবসা এর অর্থনীতির মূল ভিত্তি। অর্থনৈতিক-বর্ষ ১৯৮১তে যে আয় ছিল ১৩.৪ শতাংশ সেটাই ২০১৭ সালে পৌঁছেছে ৮০.৫ শতাংশে। এমনকি কেরালার সমাজ-কল্যাণ কর্মসূচিগুলিও এই আয় থেকেই রূপায়িত হয় বলে জানা যাচ্ছে। মহারাষ্ট্রে ১৯৬৯ সাল থেকে লটারি চালু হয়েছে। সেখানেই প্রাক্-জিএসটি বাজার ছিল ৬০ কোটি টাকা প্রতিদিন। এছাড়া পাঞ্জাব, গোয়া, সিকিম, মনিপুর ইত্যাদি আছেই। 

পশ্চিমবঙ্গে লটারি চালু হয় ১৯৬৮ সালে। এখানে দীপাবলী, পুজো, রথযাত্রা, নববর্ষ, হোলি ও নিউ-ইয়ার বাম্পার খেলা হয়। সঙ্গে আছে সপ্ত-সাপ্তাহিক লটারি ধনকেশরি। অর্থ দফতর প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, রাজ্য বছরে ১৮ কোটি টাকার লাভ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে অর্থাৎ জিএসটি-উত্তর অবস্থায় এটাকে নতুনভাবে সাজানো হয়। ফলে, ২০০ কোটি টাকার অ-কর রাজস্ব ও রাজ্য জিএসটি ২০০০ কোটি টাকা প্রতি বছর প্রত্যাশা করা হয়েছে। এখানেও ডিজিটাইজেশন প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। সুতরাং, লটারির বাজার ও মুনাফা অন্য রাজ্যগুলিকে যে আকৃষ্ট করবে এবং এটা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে তা বলাই বাহুল্য। 

কিন্তু কারা খেলছে এসব? ২০১৯ সালের একটি গবেষণা জানাচ্ছে যে, অনুর্ধ্ব ৩০ বছরের বিবাহিত লোকজন মূলত এর খেলোয়ার। সংখ্যার ভিত্তিতে দেখলে ২৫-৩৪ বছরের লোকজনের অংশগ্রহণ সব থেকে বেশি, প্রায় ৩১.৪৪ শতাংশ। যদি ব্যাপারটাকে কিউমুলেটিভ করা হয় তবে দেখা যায় যে অনুর্ধ্ব ৩৪ বছরের মানুষই বেশি, প্রায় ৫৬.৪ শতাংশ। পক্ষান্তরে মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেক গুণ বেশি। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৭৯.২৪ শতাংশ পুরুষ, বাকিরা মহিলা। অনলাইন চালু হবার পরে সেখানেই মানুষের ভিড় বেশি। তথ্য বলছে যে, প্রায় ৮৬.৫১ শতাংশ মানুষ মোবাইল-মাধ্যমে খেলে, কম্পিউটারে মাত্র ১৩.০২ শতাংশ আর ট্যাবলেটে ০.৪৭ শতাংশ। তাছাড়া এখন ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু হয়ে যাওয়ায় ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে লটারির রবরবা আরও বৃদ্ধি পাবে বলেই অনুমান। 

এই প্রবণতা এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আগামী অর্থনীতির একটা অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসাবে লটারি নিজের জায়গা করে নেবে। কেবলমাত্র জাতীয় স্তরে নয়, বৈশ্বিক স্তরেও। কেননা এটাই ব্যাঙ্ক ও ফিনটেকের জগতে বিপ্লব আনতে চলেছে। বহু সাবেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। মোবাইল অ্যাপ ও লটারি নির্ভর আয়ের উৎস খুলে যাবে। এটাকে কি তখন অনেকে কাজের বাজার হিসাবে গণ্য করবে না? অবশ্যই করবে। আর তখনই এটা নিজেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। কে জানে তখন হয়তো দেশে-দেশে ‘গ্যাম্বলিং কমিশন’ নামের সংস্থা গড়ে উঠবে, যারা একটা টেঁকসই লটারি ব্যবস্থার পরিকল্পনাকে রূপায়িত করার চেষ্টা করবে ও করের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে চালু রাখবে। আজকের দিনে এইসব নিত্যনতুন ব্যবস্থাগুলিই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অর্থনীতির সাবেক সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। মানুষ নতুন এক রূপান্তর কালে এসে পৌঁছেছে। এটাকে অনুধাবন করাটা জরুরি।


Thursday, 7 July 2022

অসহ্য সময়

ভেসে যায় মানুষ!

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত 
 

 
বন্যার খবর পাওয়ার পর অন্য কিছুতে আর মন বসে না, অথচ রোজই কত কী ঘটে চলেছে। মানুষ খুন হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে, অপমানে ছোট হচ্ছে- হতেই হচ্ছে সর্বত্র- উদয়পুর থেকে বীরভূম বা ইউক্রেন।  উমর খালিদদের বিচার নিয়ে চলেছে বিচারব্যবস্থার হাস্যকর অবস্থান, সংবাদমাধ্যম ব্যস্ত 'মহা' খবর নিয়ে। গণতন্ত্রে হতাশ হয়ে কারা যেন শিরদাঁড়ার খোঁজ করে চলেছেন। আর তারই মধ্যে শুনছি জনসভায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কথা- রাজ্যে রাজ্যে চাই ডবল ইঞ্জিন সরকার; শুনছি তাঁর দেওয়া আশ্বাস। হায়, তবে কী (গোপাল) ভাঁড়ামো সত্য, সত্য আর মিথ্যার দূরত্ব মাত্র চার আঙুলের!
 
তবে বন্যার খবর তো অসত্য নয়। অসত্য নয় যে মানুষ বড় কষ্টে আছে। বন্যা মানেই যেন অশেষ দুর্ভোগ।  যাঁরা গেলেন তাঁরা তো গেলেন, রইলেন যাঁরা তাঁদের দুর্ভোগ কী কম?
 
ভুলিনি ১৯৭৮'এর বন্যা। ট্রেন, বাস বন্ধ। সব্বাই তাকিয়ে কলকাতার দিকে। রাজ্যটাই তখন কলকাতা কেন্দ্রিক (এখনও তাই)। সেই কলকাতাও তখন জলে ভাসছে। কলকাতা এখনও জলে ভাসে অল্প বৃষ্টি হলেই। রাস্তা, পার্ক সবেতে বিপদের গন্ধ। তার মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি। পঞ্চায়েত নির্বাচন আসছে।

এদিকে বন্যার খবর আসছে অসম, মনিপুর, মেঘালয়, উত্তরাখণ্ড থেকে। বাদ নেই আমাদের উত্তরবঙ্গও। বাংলাদেশের একাংশও বন্যায় ভাসছে। দক্ষিণবঙ্গে আমরা আকাশে চোখ তুলে দিন গুনছি তার আগমনের। হাওয়া অফিসকে বোকা বানিয়ে সে বোকা কাকটার মতো ফ্যাচফ্যাচ করে হাসছে। সেই ছবিটা মনে পড়ে? হাওয়া অফিসের কথা অমান্য করে  খটখটে রোদের মধ্যে একজন ছাতা নিয়ে বেরচ্ছে। হাওয়া অফিসের ভবিষ্যদবাণী নাকি এমনই- যা ঘটবে বলে, ঘটে তার উলটোটা। অথচ, দিনকাল নাকি বদলেছে- এখন হাওয়া অফিসে কত লোকজন, যন্ত্রপাতি, আকাশ থেকে কৃত্রিম উপগ্রহও নাকি বার্তা পাঠায়। সব মিথ্যে? কেবল সত্য ঐ ফ্রাক্টাল থিয়োরি (দিল্লীত প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে নাকি লন্ডনে বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে!)!
 
গান্ধীজীর প্রাণ কেড়ে নেওয়া স্বঘোষিত প্রাণপ্রিয় বন্ধুরা এখন বন্যাপীড়িত নানা রাজ্যে ক্ষমতায়। তারা নাকি হৃদয়হীন নয়। দেখছি। দেখতে হচ্ছে। সংবাদমাধ্যম যে দেখাচ্ছে। আইন পাশ হলেও তারা বিধি তৈরি করেনি আজও, এমনকি কেন্দ্রীয় মহাশক্তিধর কমিটির রাজনৈতিক প্রস্তাবেও তারা এনআরসি নিয়ে কথা বলেনি। বলা চলবে না যে ভুলে গেছে, বলা চলবে না এ এক কৌশল। এভাবেই তারা নাকি অসম তথা উত্তর-পূর্ব ভারতকে সাহায্য করছে। আর উত্তরাখণ্ড বা মুম্বই সবে তাদের ফের ক্ষমতায় এনেছে, ওদের কথা পরে ভাবলেও চলবে! সবই তো ডবল ইঞ্জিন সরকার। আর মনিপুর? তারাও। মানুষ চায়নি তবু বদলুরা চেয়েছে একদা। সেই মনিপুরেও জওয়ানরা ধ্বসে প্রাণ দিয়েছে।

ব্রহ্মপুত্র এবারও যেন ক্ষেপেছে। সে একা নয়, ছোট ছোট সব নদী, ঝর্ণা সবাই যেন এক সঙ্গে ক্ষেপে উঠেছে। মানুষকে বাধ্য করেছে প্রতিবারের মতো, ঘরবাড়ি, পরনের জামা-লুঙ্গি নিয়ে, খাবারদাবার ফেলে প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিতে। তবু সবাই বাঁচে না। ধ্বস নামে, নদী গতিমুখ বদলায়। মানুষ দেশ-গ্রাম ফেলে দৌড় দেয়। আশ্রয় চায়, খাদ্য চায়, গলা অবধি ডুবেও পানীয় জল চায়। চায় না শুনতে ওকালের মাতব্বরদের কথা বা একালের সাম্প্রদায়িকতার কথা, ভুলে যায় রঞ্জন গগৈদের কথা, ভুলে থাকে ধর্ষণ, খুনের ইতিকথা। তারা নিশ্চয়ই সরকার চায় (ডবল ইঞ্জিনের গপ্পো বা প্রতিশ্রুতি নয়)। চায় এমন সরকার যারা তাদের প্রাণে বাঁচাবে, ত্রাণ দেবে (খাবার দেবে, খাবার জল দেবে), নিরাপদ আশ্রয় দেবে।  এমন সরকার যা মাতব্বরি করবে না, দলবাজি করবে না, ত্রাণে ভোটের হিসেব কষবে না। তেমন সরকার ডবল না সিঙ্গল ইঞ্জিনের তা কে দেখে? মানুষ আজ বড় অসহায়, মানুষ কাঁদছে, মানুষ বুলডোজার বা ইঞ্জিন চায় না, মানুষ বাঁচতে চায়। 
 
ওহে ভোটগৃধ্নু ইঞ্জিনিয়ারদের দল, গলিত শব বিচারব্যবস্থার প্রতিনিধি বর্গ, কৃমিখোঁটা সাংবাদিক কুল, ভোট নিয়ে না ভেবে, খুন-ধর্ষণ নিয়ে না ভেবে, ডবল না সিঙ্গল ইঞ্জিন তা নিয়ে না ভেবে তোমরা ঝাঁপ দাও, নিজ নিজ শিরদাঁড়া খুঁজে তোমরা মানুষ বাঁচাও।
 

Tuesday, 5 July 2022

ধনীদের সম্পদ হ্রাস!

বিশ্ব রাজনৈতিক-অর্থনীতি কোন পথে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

আশ্চর্য হলেও সত্যি! ২০২২ সালের প্রথম ছ’ মাসে বিশ্বের তাবৎ ধনীদের সম্পদে কল্পনাতীত পতন ঘটেছে। ব্লুমবার্গ’এর একটি তথ্য-প্রতিবেদন জানাচ্ছে, উল্লিখিত সময়ে বিশ্বখ্যাত ধনী মার্ক জুকেরবার্গ, জেফ বেজোস এবং এলন মাস্ক’এর সম্পদ হ্রাসের পরিমাণ যথাক্রমে ৬৬, ৬৩ ও ৬২ বিলিয়ন ডলার। গত বছরও যেখানে বিশ্বে অন্তত দশ জন ধনী ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী ছিলেন, তাঁদের সংখ্যা এখন নেমে এসে দাঁড়িয়েছে চারে। শুধুমাত্র তাই নয়, ক্রিপ্টো সম্পদে বলীয়ান চ্যাংপেং ঝাও (‘বিনান্স’ কোম্পানির কর্ণধার) যিনি এই বছরের জানুয়ারি মাসেও ৯৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদের অধিকারী ছিলেন, তাঁর সম্পদও জুন মাসের শেষে এসে নেমে দাঁড়িয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলারে। হচ্ছে টা কী?

সাবেক বিশ্লেষণকারীরা বলছেন, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিতে তেলের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে গোটা বিশ্বে যে মন্দাবস্থা তৈরি হয়েছে, তারই ফলশ্রুতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের হাল খারাপ হয়ে আসায় ধনীদের সম্পদেও টান পড়ছে। উপরন্তু, মুদ্রাস্ফীতি ও বর্ধিত সুদের হার এই দুরবস্থাকে আরও প্রকট করেছে; তার ওপর কোভিডের আতঙ্কে চীনে নতুন করে সার্বিক লকডাউন বিষয়টিকে আরও ঘোরতর করে তুলেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, গত দু’ বছরে কোভিড জনিত মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যে সঙ্গীন অবস্থায় পৌঁছেছিল, কর্মহীন মানুষের দারিদ্র্য বৃদ্ধি যে দুঃসহ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তখন কিন্তু এইসব সর্বোচ্চ ধনীদের সম্পদের পরিমাণ মোটেও হ্রাস পায়নি। বরং বলা হয়েছিল, কোভিডের কারণে আমজনতা অর্থনৈতিক ভাবে যতটা ঘায়েল হয়েছিলেন, সেই তুলনায় গুটি কয়েক কোম্পানি ও তাদের অধিপতিরা কয়েক গুন বেশি মুনাফা অর্জন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে অক্সফ্যাম’এর একটি প্রতিবেদন (১৭ জানুয়ারি ২০২২) বলছে, মহামারির দু’ বছরে বিশ্বের সর্বোচ্চ দশ ধনাঢ্যের সম্পদ ৭০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে- দিনে ১.৩ বিলিয়ন ডলার করে বৃদ্ধি। এই দশ ধনীরা হলেন: এলন মাস্ক, জেফ বেজোস, বার্নার্ড আরনল্ট ও তাঁর পরিবার, বিল গেটস, ল্যারি এলিসন, ল্যারি পেজ, সার্গেই ব্রিন, মার্ক জুকেরবার্গ, স্টিভ বলমার ও ওয়ারেন বাফেট। ফলে, অনেকেই বলতে শুরু করেন যে এই মহামারি আসলে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র-প্রকল্প যেখানে কার্যত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত প্রযুক্তির সর্বব্যাপী অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে প্রায় গোটা বিশ্বের দখল নেওয়াটাই ছিল এই ধনীদের চক্রান্তমূলক অভিসন্ধি।

তাহলে আজ হঠাৎ কী এমন পরিস্থিতির উদয় হল যে সেইসব কতিপয় কোম্পানি ও ধনীরা তাদের সম্পদকে বিপুল ভাবে খোয়াতে শুরু করলেন? Meta (F)B), Amazon, Apple, Netflix, Alphabet (G)oogle)- বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্পদধারী এই কোম্পানিগুলিকে একসঙ্গে জুড়ে কোনও কোনও মিডিয়ায় FAANG বলা হয়। এই বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে FAANG’এর সম্পদ হ্রাস পেয়েছে ৩৭ শতাংশ। ‘ষড়যন্ত্র’ হয়ে থাকলে পাশা হঠাৎ উল্টে গেল কেন? নাকি সাময়িক মন্দা? তাহলে, এই মন্দার প্রকোপ তাঁদের ওপর কোভিড কালে দেখা গেল না কেন? কেউ কেউ আবার বলছেন- আমরা নাকি ২০০৮’এর মতো আবারও একটি সাব-প্রাইম সংকটের মুখোমুখি প্রায়, যা ২০২৩’এর গোড়ায় আত্মপ্রকাশ করবে। আসলে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত যে রাজনৈতিক-অর্থনীতির জমানা গত দশকের গোড়া থেকে বিশ্ব জুড়ে ধীরে ধীরে প্রায় গেঁড়ে বসতে থেকেছে, আমরা তারই পর্বান্তর পেরচ্ছি মাত্র। এই পর্বান্তরে বহুবিধ রূপান্তরের সাক্ষী থাকব আমরা, যাকে না বুঝলে বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে থ’ মেরে বসে থাকা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায়ন্তর থাকবে না।

কথাটা হল, ওয়েব ১.০-ওয়েব ২.০ পেরিয়ে আমরা এখন ওয়েব ৩.০ জমানায় প্রবেশ করেছি। এই ওয়েব ৩.০ জমানা হল এমন এক নৈর্ব্যক্তিক পর্বান্তর যেখানে লেনদেনের মধ্যবর্তী স্তরগুলি অপসারিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, রাষ্ট্রের নিয়মবিধি, ক্লাউড সার্ভার ইত্যাদি কোনও কিছুর আর দরকার থাকবে না; ব্যবহারকারীরা পরস্পরের মধ্যে সরাসরি আদান-প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবেন। ব্লকচেইন প্রযুক্তি হবে এই ব্যবস্থাপনার আধার এবং বিকেন্দ্রীকরণ (DeFI) হবে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ। অতএব, তথ্যকে কব্জা করে কতিপয় কর্পোরেট কোম্পানির ছড়ি ঘোরানোর যুগেরও অবসান হতে থাকবে। প্রত্যেক ব্যবহারকারীর নিজস্ব অনলাইন পরিচয় সুনিশ্চিত ও নিরাপদ হবে, যার সুবাদে তিনি তাঁর নিজস্ব তথ্য কীভাবে ব্যবহৃত হবে তার নিয়ন্ত্রণ তাঁর নিজের হাতে রাখতে পারবেন। এক কথায়, ওয়েব ২.০ জমানায় সোশ্যাল মিডিয়ার সুবৃহৎ কারবারীরা গত দু’ দশক ধরে যে একচ্ছত্র শাসন ও আধিপত্য কায়েম করে এসেছে, সম্ভবত তার অবসানের পথে আমরা এগোব এবার।

অর্থাৎ, ওয়েব ৩.০ জমানায় পুঁজি তার ক্ষেত্র বদল করে বিনিয়োজিত হতে চাইছে ব্লকচেইন স্টার্ট-আপ ও আনুষঙ্গিক পরিসরগুলিতে। খেয়াল করে দেখুন, ২০২১ সালে ব্লকচেইন স্টার্ট-আপগুলিতে পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ ৭১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত ‘গ্যালাক্সি ডিজিটাল রিসার্চ’এর একটি অনুসন্ধান বলছে, এই বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে বড় বড় সোশ্যাল মিডিয়া ও টেক কোম্পানিগুলিতে যখন সম্পদের পরিমাণ ক্ষয় পাচ্ছে, এমনকি ক্রিপ্টো বাজারও তার চূড়ান্ত শিখর থেকে অন্তত ৫০ শতাংশ পড়ে গেছে, তখন ক্রিপ্টো স্টার্ট-আপ’এ ভেঞ্চার পুঁজি ১০ বিলিয়ন ডলারের ওপর বিনিয়োগ সেরে ফেলেছে। মনে রাখতে হবে, ভেঞ্চার পুঁজিই কিন্তু আগামী দিনে পুঁজির উর্বর ক্ষেত্র কোথায় হতে চলেছে তার গন্ধ পায়। সেই হেতু, কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে তা আরও ভালো ভাবে মালুম করতে হলে সদ্য ঘটে যাওয়া বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট তথ্য হ্যাকিং’এর দিকে চোখ ফেরাতে হবে। খবরে প্রকাশ, সাংহাই পুলিশের হেফাজত থেকে জনৈক হ্যাকার ১০০ কোটি চীনা নাগরিকের যাবতীয় তথ্যাদি হ্যাক করেছে। ইতিমধ্যে ‘চীনা ড্যান’ নামক সেই হ্যাকার ‘ব্রিচ ফোরামস’এ (হ্যাকার ফোরাম) অপহৃত ওই ২৩ টেরাবাইট তথ্যের দর হেঁকেছে ১০ বিটকয়েন, যা এই মুহূর্তে ২ লক্ষ ডলারের সমতুল্য। এই তথ্যটি কেন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক? এটা বোঝার জন্য যে, সাবেক রাষ্ট্রব্যবস্থার সমস্ত নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এক সমান্তরাল অর্থনীতির ভুবন ইতিমধ্যেই প্রবাহিত। আফসোসের বিষয়, ডার্ক ইন্টারেনেটের এই জগতে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে কুখ্যাত অপরাধীরা।

মনে পড়ছে মার্কস কথিত সেই অমোঘ উক্তিটি: ‘What the bourgeoisie, therefore, produces, above all, is its own grave-diggers.’। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’এ মার্কস প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণিকে পুঁজিপতিদের কবর-খননকারী হিসেবে বুঝেছিলেন। তারপর প্রায় ১৭৫ বছর অতিক্রান্ত। খুব স্বাভাবিক, উনিশ শতকের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প ভিত্তিক উৎপাদন ও আনুষঙ্গিক শ্রমিক শ্রেণির অবয়ব অতিক্রম করে আমরা আজ এক নতুন পুঁজিবাদের দুনিয়ায় প্রবেশ করেছি যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত মূলত ডিজিটাল-নির্ভর এক সর্বব্যাপী ব্যবস্থা আমাদের এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির ঘরানা দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে, উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি ও মুনাফা আহরণের সূত্রটি তো হারিয়ে যায়নি। আর সেই সূত্র ধরেই তো আজ বিশ্বে নয়া ধনীদের উদয়, FAANG’এর সর্বজনীন আধিপত্য। এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইও তাই স্বতঃসিদ্ধ। সেই লড়াই একদিকে যেমন জোটবদ্ধ নতুন শ্রমবাহিনীর লড়াই, অন্যদিকে ভেতর থেকে প্রযুক্তি-বিদ্যাকে অপহরণ করে পদ্ধতিগত ভাবে অনুকূল পরিসরে নিয়ে আসারও লড়াই। 

জাপানের সাতোশি নাকামতো, ক্রিপ্টোমুদ্রা বিটকয়েন প্রচলনের জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তির যে কাঠামোর কথা ভেবেছিলেন, তা আজ আর শুধুমাত্র ক্রিপ্টোমুদ্রায় আবদ্ধ না থেকে এক বড় পরিসরে বিকল্প অর্থনীতির ধারা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। পুঁজিরও বিনিয়োগ-অভিমুখ এখন সেই পানে। কারণ, পুঁজিবাদ যে আত্মঘাতীও বটে- সে নিজেই নিজের কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করে। তদুপরি, মার্কস সাহেবের সেই চিরায়ত উচ্চারণটিও যে অম্লান আজও- উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদিকা শক্তির মধ্যে আর যখন কোনও বোঝাপড়া সম্ভব নয়, তখন তা বিস্ফোরণের রূপ নেয় নতুন উৎপাদন সম্পর্ককে জন্ম দেওয়ার জন্য। সূত্রটি বলে দেওয়া আছে, যা বাস্তবে দেখাও গেছে বারে বারে, কিন্তু তা কোন পথে কেমনতর রূপে আসবে তা স্বভাবতই অধরা। আজকের বামপন্থীদের সমস্যা হল, তাঁরা কপিবুক স্টাইলেই খেলতে চান। তাই চোখ থাকতেও দৃষ্টিহীন। এখন বুঝি, ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার সময় কেন মার্কস’এর ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের বিক্রি হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল এবং বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মূল্যতত্ত্বের পরিচ্ছেদটি বার বার করে বুঝতে চাইছিলেন। তখন মার্কস’এর অধিকাংশ অনুগামীরা অবশ্য আতসকাঁচ নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন ১৮৭১ সালের প্যারী কমিউনের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা, যা আদপে আর ঘটার নয়।

প্রশ্ন হল, ব্লকচেইন প্রযুক্তি ভিত্তিক ওয়েব ৩.০ জমানা আমাদের কি নতুন কোনও উৎপাদন সম্পর্কের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে?