Friday, 21 January 2022

ব্লকচেইন প্রযুক্তির অ আ ক খ

এক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত বিশ্বের দিকে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

বালিতে মুখ গুঁজে ঝড়ের হাত থেকে কি আর রেহাই পাওয়া যায়! অনুরূপ, চারপাশের বিস্ময়কর ও ‘অসহনীয়’ পরিবর্তনগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে বা তাদের নাকচ করে কি সমাজ বিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলিকে আদৌ অনুধাবন করা যাবে? যদি মনে করি, গত দু’ বছরে ডিজিটাল দুনিয়ার অতি-প্রসারমানতা কোভিড ঘটিয়েই করানো হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে, তার আগের দশ বছরের যুগান্তকারী পরিবর্তনগুলিকে আমরা একেবারেই বুঝে উঠতে পারিনি।

প্রথমেই স্পষ্ট হয়ে নেওয়া দরকার, পুঁজিবাদ এমনই একটি প্রযুক্তি-নির্ভর নৈর্ব্যক্তিক ব্যবস্থা, যেখানে নির্দিষ্ট কর্পোরেটপতির একচেটিয়া আধিপত্য কখনই নিরঙ্কুশ নয়। তদুপরি, কোনও রাষ্ট্রনায়কের একনায়কতন্ত্রও সে বেশি দিন বরদাস্ত করে না। সময় বিশেষে অথবা নিদারুণ সংকটকালে পুঁজিবাদের চলার পথে জটিলতা তৈরি হলে কখনও কখনও স্বৈরাচার তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, কিন্তু তা দীর্ঘকালীন নয়। বলা ভালো, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও দর কষাকষির আবহে পুঁজিবাদ নৈর্ব্যক্তিক উপায়ে চলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। কারণ, সে কতকগুলি নিয়ম দ্বারা চালিত, সে নিয়মের ব্যত্যয় হলে তারই বিপদ বেশি। ইতিহাসও সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। হিটলার বা মুসোলিনির পতনের জন্য পুঁজিবাদের অপর দুনিয়াকে এমনকি বিশ্ব যুদ্ধে পর্যন্ত লিপ্ত হতে হয়েছে। 

পুঁজিবাদ তার চলার পথে ক্রমেই আপেক্ষিক অর্থে আরও খোলামেলা ‘গণতান্ত্রিক’ পরিসরের দিকেই এগোতে চেয়েছে। যদিও এই ‘খোলামেলা গণতান্ত্রিক পরিসর’ কখনই দারিদ্র, বৈষম্য ও শোষণের অবসান ঘটাতে চায়নি, কিন্তু এর বিরুদ্ধে বহু কিছু বলার সুযোগ দিয়েছে ও সেগুলিকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে যতটা সম্ভব নিরাময় করা যায়, তার বন্দোবস্ত রেখেছে। অর্থাৎ, একদিকে দারিদ্র ও বৈষম্য বিনা পুঁজিবাদের রথ চলে না, কিন্তু অন্যদিকে সে দারিদ্রকে কতটা সহনীয় করা যায়, সে ব্যবস্থাপনা রাখার চেষ্টা হয়েছে। আর ব্যবস্থাটা যখন নৈর্ব্যক্তিক, তখন ব্যক্তিগত পরিসরে দারিদ্র কারও চিরায়ত নয়- আজ যে গরিব কাল সে ধনী হতে পারে, আজ যে ধনী কাল সে পথে বসতে পারে। এই নৈর্ব্যক্তিক প্রতিপালনই পুঁজিবাদকে চোখের আড়ালে ঠেলে মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতা, অবিশ্বাস, অনৈক্য ও সংঘাতকে বেঁচে থাকার আবশ্যিক শর্ত হিসেবে মেনে নিতে প্ররোচিত করেছে। ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের তিনটি খণ্ডে মার্কস সাহেব আড়ালে থাকা চালক-পুঁজিবাদের এই নিষ্ঠুর ব্যবস্থাপনাকেই তাঁর মুনাফার হার ও উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বে উন্মোচিত করেছেন। তারপর প্রায় দেড়শো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আজ নবতর পুঁজিবাদ সদ্য সদ্য এসে উপস্থিত হয়েছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ও ক্রিপ্টো ব্যবস্থাপনার দুয়ারে।

মুনাফার হারের ক্রমবৃদ্ধিই পুঁজিবাদের চলার মন্ত্র। সেই বৃদ্ধির তৃষ্ণাতেই উৎপাদনের এক ক্ষেত্র থেকে অপর ক্ষেত্রে পুঁজির গতায়াত। নতুন নতুন প্রযুক্তির উন্মেষই অর্থনীতির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে পুঁজি তথা পুঁজিবাদকে নিয়ে চলে উচ্চতর মুনাফার তৃষ্ণা মেটাতে। যে কারণে, কৃষি থেকে পর্যটন, খেলাধুলো থেকে বিনোদন, মায় ব্যক্তিগত সম্পর্কও হয়ে ওঠে পণ্য এবং মুনাফার উৎস। এ এক অসীম যাত্রা। এই একুশ শতকের বিশের দশকে এসে দেখা যাচ্ছে, বহু মানুষ নিজের যা কিছু তাকে পণ্য করে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে কখন তা বাজার পাবে। আর সে সুযোগ করে দিয়েছে অনলাইন প্রযুক্তি। আর সেই অবকাশেই এসে পড়েছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি, ক্রিপ্টো ও non-fungible token (এনএফটি)’এর এক অভাবনীয় দুনিয়া যা হয়তো আগামী দিনে এক সুদূরপ্রসারী বাঁক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কেউ কেউ বলছেন, ইত্যবসরে আমরা পা রেখেছি 'মেটাভার্স'এর অজানা ভুবনে।

বিটকয়েন নিয়ে এখন প্রায়-সর্বত্র আলোচনা প্রসারিত হওয়ায় অনেকেই ব্লকচেইন প্রযুক্তি ও ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে কিছুটা অবহিত হয়েছেন। কিন্তু প্রথমেই এই কথাটা বলে নেব যে, বিটকয়েন একমাত্র ক্রিপ্টোকারেন্সি নয় এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি ক্রিপ্টো দুনিয়ার অন্যতম একটি অংশ মাত্র। অর্থাৎ, ব্লকচেইন প্রযুক্তি থেকে উদ্গত ক্রিপ্টো দুনিয়া ও এনএফটি এমন একটি ব্যবস্থাপনার সূত্রপাত করতে চাইছে যা হয়তো আগামী দিনে পুঁজিবাদের নতুন এক মোড়ক ও সংজ্ঞা হাজির করতে পারে। এই প্রবণতাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই অথবা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে বদ্ধ কল্পনার জগতে বসে থাকারও কোনও অবকাশ নেই।

আমরা সকলেই জানি, ব্লকচেইন প্রযুক্তি হল এমন এক ব্যবস্থাপনা যা ক্লাউড সার্ভার ভিত্তিক একমুখি প্রক্রিয়া নয় যেখানে সার্ভারে তথ্যমালা জমা পড়বে; এখানে কোনও পরিচালক কেন্দ্রীয় সংস্থাও নেই। অল্প কথায় বলা যায়, এ হল এমন এক distributed ledger বা বিতরিত হালখাতা যা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত সকলের কম্পিউটারে অবস্থিত এবং যেখানে প্রতিটি লেনদেন বা তথ্য সংকলিত হয়ে জমা পড়ছে। এই জমা পড়া তথ্যগুলি ব্লক হিসেবে সুগঠিত হয়ে একটা চেইন বা শৃঙ্খল গড়ে তোলে যেখানে অভ্যন্তরস্থ তথ্যরাশিগুলিকে আর বদলানো যায় না। কারণ, একবার একটা এন্ট্রি হয়ে গেলে তা যেহেতু ব্লকচেইনে শৃঙ্খলিত অন্য সকলের কম্পিউটারেও নথিবদ্ধ হয়ে যায়, তাই একে বদলানোর আর কোনও উপায় থাকে না। তবে তত্ত্বগত ভাবে উপায় একটি আছে- ব্লকচেইন ব্যবস্থাপনায় যদি ৫০ শতাংশের বেশি অংশীদার কোনও বদলের পক্ষে সম্মতি দেয় তবে তা হতে পারে। কিন্তু তা একপ্রকার অবাস্তব। কারণ, লক্ষ লক্ষ কম্পিউটার Node’এ যুক্ত অংশীদারদের ৫০ শতাংশের সম্মতি আদায় করা এক দুরূহ ব্যাপার।

সার কথায়, অংশীদারদের পরস্পরের সম্মতিতে যা লেনদেন হচ্ছে, তা নথিবদ্ধ হয়ে সকলের দৃষ্টিগোচরে থাকছে ও এইভাবে লেনদেনের একটি অপরিবর্তনীয় ধারা বয়ে চলেছে। এখানে অংশীদারেরা যেহেতু পরস্পরের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে (হয়তো প্রযুক্তিগত ভাবে কিছুটা বাধ্যত) সম্পূর্ণত স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান লেনদেন করছে, তাই এখানে তৃতীয় কোনও আস্থাভাজক কর্তৃত্বের প্রয়োজন নেই। যেভাবে দেশে দেশে মুদ্রা ব্যবস্থার নিরাপত্তা ও তার ওপর আস্থা বজায় রাখার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ধরনের তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন পড়ে, অথবা পণ্য লেনদেনে কারচুপি, মজুতদারি, কালোবাজারি রুখতে সরকারি সংস্থা নজরদারির কাজ করে, ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে তার কোনও দরকার পড়ে না; কারণ, এখানে প্রযুক্তিটাই এমন যে অংশীদারদের পরস্পরের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেই এই ব্যবস্থাপনাটিকে চালাতে হয়। এই যে তৃতীয় পক্ষের অনুপস্থিতি, এটা এমন এক দিকনির্দেশ যা এ তাবৎকাল চলে আসা লেনদেন এবং অর্থনীতির যাবতীয় আঙ্গিক ও মর্মবস্তুকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এর সঙ্গে এনএফটি’র প্রচলন এমন এক অনন্য অধিকার যুক্ত লেনদেন ও মালিকানার ধারণা নিয়ে আসছে যে, ভবিষ্যতে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিহীন এ হেন অর্থনৈতিক ক্রিয়াই প্রধান পথ হয়ে উঠবে।

উদ্ভুত এই পরিস্থিতি সমাজ-অর্থনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা বলার সময় এখনও হয়নি। কিন্তু প্রবণতাগুলি বেশ স্পষ্ট। গত অক্টোবর ২০২১’এ প্রকাশ যে আমাদের দেশে ১০ কোটিরও বেশি মানুষ ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করছেন। দেশের সরকারও বিভ্রান্ত যে- ক্রিপ্টোকারেন্সিকে সম্পূর্ণত বেআইনি ঘোষণা করবে নাকি তাকে শুধুমাত্র সম্পদ হিসেবে (মুদ্রা নয়) ব্যবহার হতে আংশিক অনুমতি দেবে। ক্রিপ্টোকারেন্সি’র মতো অন্যান্য সব লেনদেন ও কর্মপ্রক্রিয়াই যদি ব্লকচেইন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যায়, তবে নিঃসন্দেহে তা হবে এক অকল্পনীয় পরিবর্তন। কারণ, তা হবে এক মুক্ত দুনিয়ায় চরে বেড়ানোর মতো। সেখানে কর্পোরেট মহারথীদের আলাদা কোনও কর্তৃত্বের সুযোগ মিলবে কিনা তা যদিও বা এখনও স্পষ্ট নয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন অথচ সম্মতিসূচক এই গণ লেনদেন ব্যবস্থা যে এক নতুন বিশ্বকে আবাহন করছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সাবেক ভূ-রাজনৈতিক-সামরিক রাষ্ট্রের শৃঙ্খল মুক্ত হয়েই কি আগামী বিশ্বের পদচারণা?

4 comments:

  1. The last paragraph is the gist of the story, but it's too short to visualise; needs sort of augmentation to get understood.

    ReplyDelete
  2. Very informative. Though the connection of cryptocurrency and NFT with metaverse could be mentioned in one or 2 line. Looks abrupt for the first time reader unaware of these technical jargons.

    ReplyDelete
  3. চিন এই সম্ভাবনাকে কীভাবে দেখছে, বা নিয়ন্ত্রণ করছে।
    বাজেটে ক্রিপ্টোর পক্ষে যে সরকার তা স্পষ্ট।
    সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটি বুঝতে হবে।
    মোদি ৩০% কর চাপিয়ে মুনাফার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে।
    সহজ লেখা জটিল বিষয়ে।

    ReplyDelete
  4. It will enhance the dynamics of capitalism to the inevitableness of its withering away. So,I think it will usher into a new era..

    ReplyDelete