দিনের পরে যে দিন এল
অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
আরেকটা ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যে ৭টা বেজে ৩২ মিনিট– একদম তিরিশটা বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে এই দিনেই– অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল-পতাকা ক্রেমলিনের শীর্ষদেশ থেকে ধীরে-ধীরে নেমে গিয়েছিল। ঠিক তার পরের দিন ২৬ ডিসেম্বরে ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’-এর মৃত্যু হয়েছিল আর জন্ম নিয়েছিল এক অন্য ভবিষ্যৎ। বিশ শতকের ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এটা। তাই এই নিয়ে বিস্তর চর্চা, আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। হাজার-হাজার পাতা লেখা হয়েছে তথ্য-যুক্তি-প্রতিযুক্তির বিশ্লেষণে। কেন সোভিয়েত দেশের পতন হয়েছিল, মার্কসবাদ কি চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়নি, সমাজতন্ত্র কি সেখানে সংঘবদ্ধ অপরাধের প্রতিভূ হয়ে ওঠেনি, সাংস্কৃতিক বিপ্লব কি সেখানে গড়েই ওঠেনি, কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত ‘কমান্ড ইকোনমি’ কতটা দায়ী, শ্রমিক শ্রেণির গণতন্ত্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতান্ত্রিকতার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দ্বন্দ্ব কীভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, স্ট্যালিন-ক্রুশ্চেভ-গর্বাচেভ কার ঘাড়ে বন্দুক রাখা যুক্তিযুক্ত, সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-সংশোধনবাদ-প্রোপাগান্ডা কী ভূমিকা পালন করেছিল, গর্বাচেভ-ইয়েলৎসিন-শুশকেভিচ-ক্র্যাভচুককে ইতিহাস কোন্ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে ইত্যাদি বহু প্রশ্নে এই তিরিশটা বছর জর্জরিত হয়েছে। তার চেয়েও বেশি স্তূপীকৃত হয়েছে নানা মুনির নানা মতামতের দলিল-দস্তাবেজ। পিছন ফিরে সে সব পাতা ওলটানো যেতেই পারে কিন্তু আজ বরং কিছুটা সামনের দিকেই তাকানো যাক, অর্থাৎ, কী লেখা হয়েছে সেই পতনের ভবিষ্যতে।
এ কথা মনে রাখতে হবে যে, পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ আফ্রিকা-এশিয়ার সম্পদ ও বাজারের প্রতি চিরকাল লোলুপ। তারা এককালে ‘ধর্মযুদ্ধের’ আড়ালে ইসলামের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে নষ্ট করেছে, তারপর থেকে ভারত সহ নানা দেশ দখল করে ধর্মান্তকরণ করেছে ও সম্পদ চুরি করে নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়েছে, হিরোশিমা-নাগাসাকি ঘটিয়েছে, আফগানিস্তান-প্যালেস্তাইন সর্বত্র অশান্তি ছড়িয়েছে, তৈলখনি দখল করেছে, ভিয়েতনামে অত্যাচার চালিয়েছে, আফ্রিকাকে নিজেদের আস্তাকুঁড়ে পরিণত করেছে এবং এইসব করে নিজেদের বানিয়েছে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি। হু-ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ইত্যাদি সর্বত্র আজও নিজেদের প্রভাব বজায় রেখেছে। এসব করার ক্ষেত্রে তাদের কাছে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তাই তার পতনের জন্য তারা বহু প্রচেষ্টা চালিয়ে উন্মুখ হয়ে বসেছিল। সাফল্য আসতেই সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার শবদেহের পাশে তাদের পৈশাচিক নৃত্য শুরু হয়েছিল যা আজও চলছে। ফলে, তাদের স্বাভাবিক ধর্মই তারা পালন করেছে – অন্যান্য দেশগুলি শুধু নিজেদের সময়ে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে ও এখন অনুতাপ করছে। তবে এইখানে আছে একটি প্রবল ব্যতিক্রম, যারা ওই মৃতদেহটিকে পোস্ট-মর্টেম করে জেনেছিল মৃত্যুর প্রকৃত কারণটিকে। তার নাম হল চীন।এখন চীনের নামেও যথেষ্ট বদনাম আছে। আমরা প্রকৃতার্থে জানি না সেই দেশের মানুষের অভিমত কিংবা সেই দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থার কথা। কেন না সেখান থেকে সরাসরি প্রায় কিছুই প্রকাশিত হয় না। এমনকি এই করোনা অতিমারির সময়েও প্রায় কোনও তথ্য সর্বজনে তারা প্রকাশ করেনি। কিন্তু বাহ্যিক ইঙ্গিতে-প্রতিফলনে কিছু বিষয় স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। এ কথা কি জলের মতো স্বচ্ছ নয় যে, কেন ২০২৮ সালের মধ্যে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি হতে চলেছে বলে অনুমান, অতিমারির মধ্যেও চীনের অর্থনীতিতে কেন প্রায় কোনও প্রভাব পড়েনি, কী করে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে অন্যান্য নানান প্রান্তে চীন ক্রমশ নিজের ক্ষমতা বিস্তার করছে ইত্যাদি। কোন্ মন্ত্রবলে কোন্ জাদুবলে চীন এটা করতে পারছে যা আজ থেকে পনেরো বছর আগেও মানুষ ভাবতে পারেনি– তা একবার অনুধাবন করে দেখতেই হয়।
সহজ কথাটি হল, চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছে। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চীনের নেতা মাও-সে-তুং সম্বন্ধে বলা কিছু কথা। তিনি ও বরোদিন তখন চীন দেশে গিয়েছেন সেখানকার বিপ্লবকে পথ দেখাতে। তখন সেখানে কৃষক অভ্যুত্থানের টালমাটাল সময়। মাও তখন বড় কোনও নেতাস্থানীয় না হলেও চীনের কৃষক সমাজকে চেনেন খুব ভালো করে। মানবেন্দ্রনাথ লিখছেন, 'আমরা দেখলাম একজন লম্বা কাষ্ঠল মানুষ ঝড়ের গতিতে ঐতিহাসিক সমাবেশটিতে প্রবেশ করল। এই সেই মানুষ যে আগে আমাদের সঙ্গে দেখাটুকু করতে রাজি হয়নি। এখন এসেও একবারের জন্য বসল অবধি না, এমনকি আমাদেরকে প্রায় কোনো পাত্তাই দিল না। বরোদিন তখন চাপা কণ্ঠে আমাকে বলল, বুঝলে তো এই সেইই, অপেক্ষা করো দেখবে এইবারে একটি চীনা বোমা ফাটবে। আমি বুঝলাম এর নামই হল মাও-সে-তুং। মাও চেনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল এবং তারপর অত্যন্ত উষ্ণ কন্ঠে বক্তৃতা করতে উঠল, বলল, ‘বিদেশিরা এসে চীনের বাস্তবকে বুঝে ফেলবে এ কথা আমি মানি না। আমি হুনান থেকে সরাসরি আসছি; আর এসে দেখছি এরা আমাদের কৃষকদের ভুলভাল যা-তা বোঝাচ্ছে। আমার স্পষ্ট কথা এই যে, গ্রামে-গ্রামে ঘটানো অপরিপক্ক সমাজ বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর হয়ে যেন আমরা এই মুহূর্তে জাগ্রত আমাদের দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করে না দিই। পার্টি কংগ্রেস ইতিমধ্যেই অনেক ভুল করেছে। আর যেন তা না করে। এইসব রেজোলিউশন-টেজোলিউশন আপাতত মুলতুবি থাকাই জরুরি।’ আমি শুধু বুঝলাম, এ কোনো সাধারণ মানুষ হতে পারে না।'
এখন একুশ শতকে দাঁড়িয়ে মনে হয় মাও-এর সেই উত্তরাধিকারকেই চীন হয়তো বহন করছে।
আজ সোভিয়েতের থেকে তিন বছর বেশি সময় ধরে চৈনিক কমিউনিস্ট পার্টি সেখানে রাজত্ব করছে। এর মূল কারণ বোধহয় সোভিয়েতের পতনের পরে চীনের চুপচাপ বসে না থাকা। তারা প্রায় উন্মাদের মতো এই পতনের কারণ অনুসন্ধান করেছিল। চীন বিশেষজ্ঞ ডেভিড শ্যাম্ভো একবার লিখেছিলেন যে, 'তারা (চীনারা) শয়নে-স্বপনে-জাগরণে যেন শুধু এই নিয়েই চিন্তা করছে। আর এই চিন্তা তাদের প্রত্যেকটি বড় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিতও করছে।' এই ২০১২ সালেও জিনপিং পার্টি কর্মীদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'বলো কেন সোভিয়েত পড়ে গেল?' এবং বলেছিলেন, 'আসলে আদর্শ ও তার বাস্তবায়নের মধ্যে সেখানে দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল, এমন একজন সত্যিকারের মানুষ পাওয়া যায়নি যে এটাকে আটকাতে পারত।' এটাকে চীন উপলব্ধি করেছিল বলেই হয়তো তারা মূলত তিনটি দিকে নিজেদের ভিত শক্ত করেছিল। এক, তারা পুঁজিবাদকে গ্রহণ করেছিল ঠিকই কিন্তু চৈনিক নৈতিকতার ভিত্তিতে অর্থাৎ, রাশিয়ার আর্থনীতিক অবনতি থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা নিজেরা অন্য কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা গলায়নি, যুদ্ধে অংশ নেয়নি। বরং নিজেদের পরিকাঠামো-পরিষেবাকে উন্নততর করেছিল। তারা রাশিয়ার ‘সোশ্যালিস্ট কমান্ড ইকোনমি’-কে প্রত্যাখ্যান করে চৈনিক মাটির দ্বারা নির্মিত পুঁজিবাদকে গ্রহণ করেছিল। তারা বিদেশি পুঁজির জন্য দরজা বন্ধ করেনি। এমনকি তারা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে যোগদান অবধি করেছিল ও ‘বিশ্বের কারখানায়’ নিজেদের পরিণত করেছিল। তারা সরকারি সহযোগিতায় বিরাট বিরাট কারখানা তৈরি করে নিজেদের ধীরে-ধীরে উৎপাদন ক্ষমতার দৈত্যে পরিণত করেছিল। তারা জনগণকে চৈনিক সংস্কৃতির অন্তর্গত রেখে উদার-অর্থনীতির বিলাসিতার দরজা খুলেছিল। তারা পশ্চিমের সংস্কৃতিকে নিজেদের গায়ের চাদর করেছিল ঠিকই কিন্তু মূল পোশাক হয়ে উঠতে দেয়নি।
দুই, গ্লাসনস্তের মতো ভুল তারা করেনি। তারা চীনের প্রাচীরের মতোই আরেকটি ডিজিটাল প্রাচীর তৈরি করেছে। সেখানে তারা পশ্চিমি চোরেদের ঠেকানোর সমস্ত বন্দোবস্ত করে রেখেছে। তারা আইন ও প্রযুক্তি দিয়ে পশ্চিমি দুনিয়ার নানান ওয়েবসাইট, যেমন, ফেসবুক, গুগল, ট্যুইটার ইত্যাদিকে অনুপ্রবেশ করতে দেয়নি। তারা নিজেদের সিস্টেম নিজেরা বানিয়েছে। তাই চীন দেশের কোনও তথ্যই পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে নেই। পক্ষান্তরে চীন কিন্তু পশ্চিমি দুনিয়ার সর্বত্র নিজেদের লোক ঢুকিয়েছে, পশ্চিমের বাজার দখল করে তাদের সব তথ্য সংগ্রহ করেছে অবাধে। এই কারণে এখন মার্কিন দুনিয়া চীনের ওপর বেশ রেগে আছে। ফলে, তারা নানান প্রোপাগান্ডাও চালাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছে না। আর এর কারণ হল তিন নম্বর কথাটি। চীন তার চতুর্পার্শ্বের অঞ্চলে কড়া নজরদারি চালিয়েছে। রাশিয়া যেমন চারপাশে কিছুই দেখেনি, তাই একের পর এক অঞ্চল আলাদা হয়ে গিয়েছিল। চীন সেখানে চারপাশের অঞ্চলগুলিতে অর্থাৎ তাইওয়ান, হংকং, জিনঝিয়াং, তিব্বত ইত্যাদিতে কড়া পাহারা লাগিয়েছে যাতে পশ্চিমি দুনিয়া সেখানে গিয়ে ‘বর্ণ রাজনীতি’র পাশাখেলা, অগাধ সম্পত্তির লোভ দেখানো আর ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি লাগু করতে না পারে। এই তো ২০১৯ সালে হংকং'এ খুব আন্দোলন হল কিন্তু চীন একে চিনতে পেরেই ২০২০ সালের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছিল। এখন চীনের ক্ষমতা এতই বেড়েছে যে তারা অন্যান্য দেশকেও ধমক-চমক দিচ্ছে কিন্তু কেউই বিশেষ জোরের সঙ্গে গলা তুলতে পারছে না, মাঝেমধ্যে ফোঁস করছে ঠিকই। এই যদি চলতে থাকে তবে এ কথা অবশ্যম্ভাবী যে চীনই আগামীর সম্রাট হতে চলেছে।
২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের তাহলে এটাই হল ভবিতব্য। মিখাইল চেলনোকভ কিছুদিন আগেই এ ব্যাপারে একমত হয়ে বলেছেন, 'চীন, আমার মতে, অপ্রতিরোধ্য উন্নতির পথেই এগোচ্ছে, চীন কী রাজনৈতিক কী আর্থনীতিক কী সামরিক সর্বদিকেই আরও আরও আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করে যেন একটা ঝড়ের মতো ধেয়ে আসছে।' সুতরাং, এ কথা স্পষ্ট যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে দুনিয়া যেরকম ইউনিপোলার হয়ে গিয়েছিল, একুশ শতকে সেই রাশিয়ার কারণেই আবার তা বাইপোলার হয়েছে। তখন মার্কিন দৈত্য দুনিয়াতে জাঁকিয়ে বসেছিল, এখন বসছে চীন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পঞ্চাশতম বর্ষ পালনের দিনে দুনিয়ার ব্যাটন কার হাতে থাকবে সেটাই এখন দেখার– গিগ অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শাসিত নিকৃষ্ট পুঁজিবাদের হাতে নাকি অচেনা-অজানা এক অন্য সমাজব্যবস্থায় পৌঁছে যাব আমরা। দেখাই যাক ...
No comments:
Post a Comment