Saturday, 28 November 2020

বলিহারি!

এত চাষা এল কোত্থেকে?

সত্য বল


ভারতের ইসলাম আগ্রাসন যতটা সত্য, উচ্ছে চাল সোনামুগের ডাল ঢেঁড়স গাজরের দামও ততটাই সত্য। বিগত সত্তর বছরে ভারতবর্ষের গর্দভ জনতা এই আগ্রাসন অনুভব না করে হাই ইন্টারেস্ট রেট, লো জিডিপি, কাজ চলার মতো চাকরি নিয়ে হইহই করে চলছিল। তারা দেশদ্রোহী ছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। আজ দেশে জাতীয়তাবাদী সরকার আসার পর থেকে হিন্দু খতরে মে পড়ে গেছে এবং মূল্যবৃদ্ধি, জিডিপি, চাকরি, নারী সুরক্ষা সব ক্ষেত্রেই আমরা আন্তর্জাতিক স্তরে খোরাকের পাত্র। অভিনন্দন জাতীয়তাবাদী সরকার।

এই মুহূর্তে দেশের রাজধানীতে কৃষকদের ওপর দিল্লীর শীতে জলকামান চালানো হচ্ছে। তারা নকশাল‌ও নন, কৃষক। মাননীয় কেন্দ্রীয় সরকার যাঁদের জন্য চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারছে না, দিনে আঠাশ ঘন্টা কাজ করছে, তাদের ভালোর জন্য কৃষক বিল এনেছে। অথচ এই গোমুখ্যু (দুঃখিত গরু আমাদের মা এবং মোষ পিতা) চাষাগুলো সেগুলো বুঝতেই চাইছে না! হাজার হাজার মাইল হেঁটে আসছে। আর আস্পর্ধা কত, বলে, সঙ্গে দু' মাসের রেশন এনেছে! যতদিন না তাদের সোনায় মুড়ে রাখতে মহৎ উদ্দেশ্যে যে বিলগুলি পাশ করানো হয়েছিল ফাঁকা পার্লামেন্টে চোরের মতো, সেগুলো না প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তারা উঠবে না! ভাবুন একবার দেশদ্রোহী কাকে বলে! এদের পেছনে প্রতিবেশী দেশের মদত জলের মতো স্পষ্ট। আর না বুঝলে জেল ফেরত গোস্বামীবাবু টেবিল থাবড়ে ঠিক প্রমাণ করে দেবেন। তবে এখন‌ও অবধি এই কৃষক অসন্তোষ নিয়ে ওনার মৌনতা হিমালয়ের মতোই মহৎ এবং গম্ভীর। কটা লাশ পড়লে হয়তো পায়েল রোহ্‌আটগি কি কঙ্গনা রানআউটের সঙ্গে ঘন্টাখানেক বসা যাবে।

আসলে সকালে হোয়াট্‌স‌অ্যাপে দেশভক্তির মেসেজে আমরা কৃষক বিলের উপযোগিতা ময়ূরের চোখের জলের মতো বুঝে ফেলি। কিন্তু এইসব চাষাভুষোদের হোয়াট্‌স‌অ্যাপওয়ালা ফোন এখন‌ও নেই। তাই এই 'যুগান্তকারী' বিল কর্পোরেটদের অশুভ আঁতাত কীভাবে তছনছ করে কৃষকদের কোটিপতি বানিয়ে ফেলবে সেটা তারা বুঝতেই চাইছে না। আমরা কিন্তু ঠিক বুঝে গিয়েছি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মূর্তি কীভাবে টুরিজম করে লাভ করবে, কী করে নোটবন্দী ঘচাঘচ দেশের কালো টাকা বের করে আনবে, পনের লাখের গল্প, বছরে দু' কোটি চাকরি, জলের দরে পেট্রল সব, সঅব বুঝে গেছি আমরা।

দেশদ্রোহী কৃষকরা বুঝতে চাইছে না। খুব সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার দেশের স্বঘোষিত দেশভক্ত, ধর্মের রক্ষাকর্তা, জনদরদী এবং পুঁজিপতি বিরোধী সরকার যাদের ভালোর জন্য বিল পাশ করল, তারাই এর বিরোধিতা করে রাস্তায় নামে। তওবা তওবা! নরাধম এরা, অকৃতজ্ঞ, মানে এই কৃষকদের কথা বলছি আরকি!

সেই জন্যই বলি আজ জলকামান চলেছে, টিয়ার গ্যাস চলেছে, আগামীকাল গুলি চলুক গদ্দারদের ওপর। দেশপ্রেমী নেতাই তো বলেছিলেন এ কথা। কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লি সরকারকে বলেছে নয়টি, হ্যাঁ মাত্র নয়টি স্টেডিয়ামকে জেলে পরিণত করতে। দেশদ্রোহী গদ্দার চাষীদের জন্য। দেশদ্রোহী কেজরিওয়াল না করে দিয়েছে। ওটাও গদ্দার।

দালাল মিডিয়া এসব খবর দেখাবে কেন! কী সুনিপুণ শিল্পের মাধ্যমে দেশদ্রোহীরা উদ্ধত পদক্ষেপে রাজধানী নোংরা করছে! দাবি করছে পেটে লাথি মারা বিল মানবে না! মানবে না বললেই হল? হাতরাসের মেয়েটা মানেনি বলেই তো ধর্ষিত হল, যার এখনও বিচার হল না রামরাজ্যে। সবাই চুপ। এরাও চুপ হবে। একেবারে চুপ হবে। জাস্টিস লোয়া থেকে গৌরী লংকেশ, সব সেট হয়ে গিয়েছে। এরা তো গোমুখ‍্যু চাষাভুসো!

তবে আবার বলি, দালাল মিডিয়া দেখাবে না এসব। তাই দেশপ্রেমী হিসেবে আমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। সব কটা বিদ্রোহী চাষাদের কুকুরের মতো গুলি করে মারতে হবে। কারণ পেঁয়াজ আজ আশি কিনছি, কাল দেড়শ কিনব। দেশের জন্য এটুকু করব না? বলুন? আমরা না গরু, থুড়ি ভারত মায়ের, থুড়ি ভারত মাতা কি সন্তান! সে তো ফ্রি'তে জিও-ও করেছি, এখন যেন কত করে দিতে হয়? লকডাউনে কাদের যেন সম্পত্তি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ল?

সুতরাং, দেশকে ভালোবাসলে এই লেখা শেয়ার করুন। এভাবে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিন কীভাবে গদ্দার চাষীরা ক্ষেপে গেছে। অ্যাতো শেয়ার করুন যাতে দিল্লী পর্যন্ত খবর পৌঁছে যায় আর দেশপ্রেমিক সরকার বাধ্য হয় এদের কুকুরের মতো গুলি করে মেরে ফেলতে। তবেই তো প্রতিষ্ঠা হবে ভারত আদাম্বানি কোম্পানি লিমিটেড। শায়েস্তা হবে আচাভুয়া চাষাগুলো। আর ফসলের দাম হবে লজেন্সের মতো। যেমন জলের দরে পেট্রল।

বলুন ভারত মাতা কি....

Thursday, 26 November 2020

শৈল্পিক জাদুকর

ফুটবল-ঈশ্বর-মারাদোনা

সুমন কল‍্যাণ মৌলিক


পিটার শিলটন ইংল্যান্ডে তাঁর বাড়িতে বসে আজ কী ভাবছেন জানি না, কিন্তু এটা জানি যে যতদিন এই গ্রহে ফুটবল বেঁচে থাকবে ততদিন ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড ম্যাচের সেই দুটো গোলের কথা থেকে যাবে মানুষের মনে, আলাপে, আলোচনায় বা নিছক স্মৃতি রোমন্থনে। নিজেদের সেন্টার লাইন থেকে বল পেয়ে প্রতিপক্ষের সাত জনকে কাটিয়ে মারাদোনার সেই অত্যাশ্চর্য গোল নিয়ে লাখ লাখ কথা হয়েছে, ক্রীড়া অনুরাগীদের ভোটে তা ইতিমধ্যেই শতাব্দীর সেরা গোল হিসাবে নির্বাচিত। কিন্তু আমার মতো মারাদোনা ফ্যানের কাছে আরও আনন্দের প্রথম গোলটা। নীতিবাগীশ পণ্ডিতেরা যতই নিদান দিন না কেন যে হাত দিয়ে গোল করা ফুটবল শাস্ত্র বিরোধী, কিন্তু আমি আজও বিশ্বাস করি সে গোল তো ঈশ্বরের হাত! আর কোনও শাস্ত্রে এটা তো লেখা নেই যে ঈশ্বর চিরকাল শুধু ধনীদের, ক্ষমতাসীনদের ধামাধরা হয়ে থাকবেন, ঈশ্বরেরও তো একবার শাপমোচন হওয়া দরকার। ফকল্যান্ড যুদ্ধ জয়ের পর ইংল্যান্ডের সেই গর্বিত বিজয় উল্লাস, গ্যালারিতে বৃদ্ধ সিংহের সেই উদ্ধত বারোফট্টাইকে একেবারে চুপ করিয়ে দিয়েছিল আমাদের 'বাঁটকুল' নায়ক। পরের দিন কাগজে ব্রিটিশ প্রেসের মারাদোনার প্রতি তীব্র বিষোদ্গার দেখে পাড়ার ভজাদা বলেছিলেন, 'লালমুখোগুলো হাতটাই দ্যাখলো, পিটার শিলটনের মতো অত লম্বা গোলকিপারকে বাঁটকুলটা যে স্পষ্ট জাম্পে হারাইয়া দিল, তা নিয়ে ব্যাটাচ্ছেলেরা এক্কেবারে চুপ।'

যুক্তিবাদীরা আমার বক্তব্য শুনে রে রে করে উঠতে পারেন। কিন্তু সে সময়ে তো আমরা এরকম করেই ভাবতাম। আমরা মানে সেই কিশোরেরা যারা সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। আসলে সময়টাই তো অন্যরকম ছিল। মফস্বল শহরগুলোতে বছর তিন-চারেক হল সাদাকালো টিভি এসেছে। তখন হামলোগ বা চিত্রহার দেখতে সন্ধ্যাবেলায় লোকের বাড়িতে গ্যাঁট হয়ে বসা যেত, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ থাকলে পাড়ার মোড়ে ফ্ল্যাগ টাঙানো যেত, বাঙাল-ঘটিদের টিমে দূরবীন দিয়ে বাঙালি ফুটবলার খুৃৃঁজতে হত না। গরমকালের শুরু থেকে প্রায় দুর্গাপূজা পর্যন্ত রবিবার বা অন্যান্য ছুটির দিনগুলোতে সারা দিন ধরে জমজমাট ওয়ান ডে টুর্নামেন্ট চলত। পাড়ার যে ছেলেটা ভালো ফুটবল খেলে তাকে সবাই এক ডাকে চিনত। খবরের কাগজ বিক্রেতা কাকুর কাছে 'খেলার কথা' বা 'খেলার আসর' (সে সময় বাংলা ভাষায় প্রকাশিত খেলার পত্রিকা) এনে দেওয়ার আব্দার থাকত। তখন স্যাটেলাইট বিপ্লবের কল্যাণে উয়েফা লিগ, ইপিএল বা লা-লিগা ডালভাত হয়ে যায় নি। ফলে বিশ্বকাপ, ইউরো কাপের মতো টুর্নামেন্ট আমাদের কাছে ছিল এক তাজা হাওয়ার মতো।

৬০ বছর বয়সে মারাদোনার হৃৎপিণ্ড চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার নিদারুণ খবর শোনার পর থেকে ভাববার চেষ্টা করছি কেন আমরা সবাই পাগলের মতো মারাদোনাকে ভালোবেসে ফেললাম। আসলে ফুটবল যতই দলগত খেলা হোক না কেন ব্যক্তিগত নৈপুণ্য বা সৃজনশীলতার একটা আলাদা আকর্ষণ আছেই। ইংরেজি 'স্কিল' শব্দটির অর্থ দক্ষতা, কিন্তু তা দিয়ে বিষয়টা ঠিক বোঝা যায় না। ইউরোপীয় ওয়ান টাচ পাসিং ফুটবলের দক্ষতা প্রশ্নাতীত, তাদের যান্ত্রিক-শৃঙ্খলা নির্ভর ফুটবলের সাফল্যের হারও অনেক বেশি। কিন্তু বাঙালির সেটা ঠিক পছন্দ নয়। আমাদের অনেক বেশি মনে ধরে ফুটবলে নান্দনিকতা, প্রতিভার আশ্চর্য স্ফুরণ যা অনেক বেশি সহজলভ্য ছিল তখনকার লাতিন আমেরিকার ফুটবলে। তাই বাঙালি জন্ম থেকেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ভক্ত। আমাদের সময়ে দু-একজন ছাড়া জার্মানি বা হল্যান্ডের ফুটবল ভক্ত চোখে পড়ত না। আর ইতালির কথা বললেই মনে পড়ত সারাক্ষণ নিজেদের সীমানায় লোক বাড়িয়ে ডিফেন্স, লম্বা-লম্বা থ্রো আর কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ক্কচিৎ কদাচিৎ দু একখানা গোল। ঠিক এখানেই মারাদোনার মাহাত্ম্য — জাদুকরী দক্ষতায় তিন কাঠি চিনে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা। মনে রাখতে হবে, সে সময় বল প্লেয়ারদের রক্ষার জন্য ফিফা এত নিয়ম করেনি। মাঠে ডিফেন্ডারদের কড়া ট্যাকল ও চোরাগোপ্তা আক্রমণে বার বার রক্তাক্ত হতে হয়েছে তাঁকে কিন্তু সারা মাঠ জুড়ে ফুল ফুটিয়েছেন এই খর্বকায় মানুষটা।

তবে মারাদোনার শৈল্পিক জাদুকরীই তার প্রতি আমাদের অনিঃশেষ মুগ্ধতার একমাত্র কারণ নয়। মারাদোনার আমাদের হৃদয় জুড়ে থাকার আরেকটা বড় কারণ তার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। মারাদোনা যখন ফর্মের চূড়ায়, বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফা তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ। ফুটবলের বিশ্বজনীন জনপ্রিয়তাকে বাণিজ্য করে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ক্রীড়া সংস্থা। জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ, শেপ ব্ল্যাটাররা আচার-আচরণে এক একজন খুদে স্বৈরশাসক। ঠিক সে সময় মারাদোনা ফিফার তুঘলকি আচরণের সমালোচনা করেছেন, দু-একবার শাস্তির মুখে পড়েছেন। মারাদোনার সব অভিযোগের হয়তো সারবত্তা ছিল না, কিন্তু আজ এ কথা প্রমাণিত যে সে সময় ফিফা সত্যিই ছিল ঘুঘুর বাসা। জুরিখে ফিফার অফিসের বহু শীর্ষ কর্তা (মায় কিংবদন্তি ফুটবলার ও প্রশাসক প্লাতিনি পর্যন্ত) আজ দুর্নীতির দায়ে জেলের ঘানি টানছে। ক্ষমতার কেন্দ্রকে প্রশ্ন করার অভ্যাস মারাদোনার ফুটবল ছাড়ার পরে‌ও চালু থেকেছে। কখনও পোপের সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, কখনও এককেন্দ্রিক বিশ্বের স্বঘোষিত অভিভাবক মার্কিন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে তোপ বা ক্ষুধার প্রশ্নে উন্নত দেশগুলোর নিরুত্তাপ থাকাকে আক্রমণ — মারাদোনা সবসময় পক্ষ নিয়েছেন। এই অনুষঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারার প্রতি তাঁর ভালোবাসা, কিউবার জনমুখি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, সর্বোপরি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন ছোট বড় দেশে ফেটে পড়া মার্কিন সাম্রাজবাদ বিরোধী লড়াইয়ের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন। ধীরে ধীরে মারাদোনা হয়ে উঠেছেন এমন এক অপ্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থী আইকন যিনি আদতে প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুগত তথা চিরকালীন পলিটিকালি কারেক্ট ব্রাজিলের পেলের এক জীবন্ত প্রতিস্পর্ধা। আশির দশকে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ে দিশেহারা বামমনস্ক বাঙালি পরম মমতায় তাঁকে আঁকড়ে ধরেছে।

আজ এই অন্তহীন শোকের আবহে কেউ কেউ বলছেন, মাদক না নিলে, একটু শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করলে মারাদোনা নাকি আরও বহু দিন খেলতে পারতেন। হয়তো তাঁরা সঠিক। কিন্তু প্রতিভা বা সৃজনশীলতাকে সবসময় কি শৃঙ্খলায় বাঁধা যায়? আসলে ঋত্বিক ঘটক, মাইকেল মধুসূদন, রামকিঙ্কর বেইজ, জর্জ বেস্ট বা মারাদোনার মতো মানুষেরা তাঁদের যাবতীয় অপূর্ণতা বা দুর্বলতা নিয়েই আমাদের মধ্যে থেকে যাবেন, আমরা তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে বারবার খুঁজে নেব জীবনের রসদ। 

অনেক দিন আগে এক আড্ডায় আমার এক বন্ধু প্রশ্ন করেছিল, 'বল তো, জুভেন্টাস, এসি মিলান, ইন্টার মিলানের মতো ওজনদার দল থাকা সত্ত্বেও মারাদোনা ইতালির লিগের খেলায় নাপোলির মতো এক অকুলীন দলে সই করেছিল কেন?' চুপ করে রয়েছি দেখে বন্ধুর গর্বিত উত্তর, 'আসলে মারাদোনা তো গডফাদার হতে চেয়েছিল। আর নাপোলির মাফিয়াদের নিয়েই তো গডফাদার উপন্যাসটা লেখা।' তর্ক করিনি, উত্তরটা আজ‌ও অজানা। কিন্তু এটা জানি যে সেই নাপোলিকে মারাদোনা প্রায় একক দক্ষতায় ইতালি চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। হ্যাঁ এটাই মারাদোনা। বিদায় কমরেড। বিদায় ফুটবলের ঈশ্বর।

 

Thursday, 19 November 2020

নাগালহীন

ব্রাত্যপ্রাণের উৎসব

সঞ্জয় মজুমদার


ফেস্টিভ সিজন আশ্বিনের শারদপ্রাতে শুরু। তারপর একে একে দেবদেবীদের ধরাধামে অবতরণ। চলে ছট এবং জগদ্ধাত্রীর আলোকমালায় আলোকিত হয়ে যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত। 

এইরে, ভুল বললাম? বিলক্ষণ। আর একটু বাকি থেকে গেল যে। হ্যাপি নিউ ইয়ার আর বাঙালির ভ্যালেন্টাইন-ডে সরস্বতী পুজো বাদ গেলে চলবে? একদম না। শক্তি আরাধনা আর সামাজিকতার আড়ালে তো আসলে ব্যবসা-বাণিজ্যের উৎসব, কনজিউমারিজমের উৎসব। ভবিষ্যতে আরও কত জুড়বে। দেবতা মানুষ তৈরি করেছেন, নাকি মানুষ দেবতাকে। পুজোর উৎসব নাকি উৎসবের পুজো, বোঝা দায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই যে কোনও পুজোয়, থুড়ি, ধর্মীয় উৎসবে, মানে উৎসবে, ভোর থেকেই আমজনতা এবং মিডিয়া আতসকাঁচের তলায় তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য খুঁজে বেড়ায়। মেইনস্ট্রিমের দৃশ্যমাধ্যম, মানে টেলিভিশনের সামনে বসলে বারো আনা ঠাসা থাকে পোশাক-আশাক, খাবার-দাবার, ঘোরাঘুরি, নানান কেনাকাটির জিনিসপত্র এবং আরও কত কিছুর বিজ্ঞাপনে। বাকি পঁচিশের কুড়িও চলে যায় প্রভাবশালীদের বক্তব্য আর প্রতিভার বিজ্ঞাপনে। শেষ পাঁচে অ্যাংকর ও রিপোর্টার বেচারি মিলে একটু একটু তথ্য আর সংবাদ পরিবেশন করেন। আর সম্পাদনাহীন সোশ্যাল মিডিয়ায় তো 'আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে'। অবস্থা এমন, আর কিছুদিন পর বোধহয় ফেসবুকে মুহূর্তে সেলিব্রিটি হতে চাওয়া আমজনতার স্ট্যাটাস আপডেটেও বিজ্ঞাপনদাতার বদান্যতা লাগবে। মানে, আমার সদ্য পোস্ট করা কভার ফটো দেখতে গেলেও প্রথমে ধূপের বিজ্ঞাপন দেখতে হবে।   

প্রথম দিকে একটু ভয়-ভীতি সমীহ থাকলেও, এখন দেখছি করোনার বাজারে নিউ নরমাল, সামাজিক দূরত্ববিধি, স্যানিটাইজেশন, মাস্ক (যদিও থুতনিতেই সেঁটে থাকে বেশি) একটু একটু করে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে উঠছে। কোভিড-১৯'কে শিখণ্ডী খাড়া করে ডটকম কোম্পানিগুলো জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অনলাইন করার চেষ্টায় প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। উৎসবও বাদ যায়নি। যেতেই পারে না। জনগণ যাতে শারীরিক এবং মানসিক, সব দিক থেকেই সামাজিক দূরত্ববিধি  অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে তার দিকে কড়া নজর রেখেছে তারা। কারণ, নজর যত কড়া হবে ব্যবসার লাইন তত অন হবে, মানে অনলাইনে ফুলে ফেঁপে উঠবে। ক্যামেরাম্যান আর রিপোর্টার বুম হাতে, আধা-বাংলা আধা-ইংরেজি মেশানো ভাষায়, প্যান্ডেলে আর মন্দিরে ছুটোছুটি করে যত খুশি রিপোর্ট করুক, আপনি কিন্তু বেরবেন না। প্যান্ডেল হোক বা মন্দির, হপিং জিনিসটা অনলাইনেই বাঁধা থাকবে। উৎসবের দিনে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, বিশ্লেষণ আর ঈশ্বরের ফটোগ্রাফিক এভিডেন্স, স্ট্যাটাস আপডেট আর বায়োডাটার সম্প্রচার এবং মন্দিরের পুরোহিত, সেবাইতদের নাগাড়ে প্রেস ব্রিফিং ও বাইট, সবটাই অনলাইনে বিজ্ঞাপন বিরতি সমেত। 'কথিত আছে' শিরোনামে মন্দিরের বা পুজোর পৌরাণিক গাথা এবং জনপ্রিয়তা যত, স্পন্সরশিপও তত। মজার কথা হল, এসবের অত্যাচারে পুজো শব্দটা অপমানে, অভিমানে, সন্তর্পণে নিজেই যেন নিজেকে বিস্মৃতির অন্তরালে নিয়ে গেছে উৎসবকে জায়গা ছেড়ে দেবে বলে। বিশ্ব-পণ্যায়ন তো তাই চাইছে। পুজো নয়, আরাধনা নয়, সাধনা নয়, হোক শুধু উৎসব। মানুষের উৎসব, প্রাণের উৎসব ইত্যাদি মায়াবন্ধে আমাদের বেঁধে ফেলে, সব কিছুকেই এমনকি পুজোকেও বাজারজাত করে ফেলেছে। ভেবে দেখলে উৎসবের সাথে পুজোর সম্পর্কটা অনেকটা 'ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে'র মতো। শুধু পুজো শব্দটা দিয়ে যথেষ্ট ব্যবসা করা যাচ্ছে না বলেই হয়তো উৎসবের আমদানি। জনতার স্নায়ুতে রিল্যাক্সেশনের সুড়সুড়ি দিয়ে ফেস্টিভ সিজনের মুখোশ পরিয়েছে। উৎসব ঘিরে বাজারে তৈরি হয়েছে চাহিদা, কৃত্রিম চাহিদা। অফলাইনে কম, অনলাইনে বেশি। অমোঘ তার আকর্ষণ। উৎসব এখন বিলাসিতা নয়, বরং অধিকার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাঁধে ভর করে দুদিন পরে এ হেন উৎসবেরও কোনও বাজারজাত অনলাইন সংস্করণ বেরবে।  তখন সে পুজোর মতো ঘুঁটে হয়েই পুড়বে।

কিন্তু উৎসবটা কিসের? মানুষের? প্রাণের? কোন প্রাণ? কোন প্রাণী? দু'রকম উত্তর আছে এ ক্ষেত্রে। প্রথমত, ভোট-বাজারের কথা ভাবলে, উত্তর হল মানুষ। কারণ, গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় অংশগ্রহণের উপযুক্ত দু-পেয়ে ছাড়া আর যে কেউ নেই। অতএব, শুধুই মানুষ। হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া, গরু, উট, হাতি, মাছ, এমনকি গাছপালার প্রাণ, শুধু বলির উপাদান। ভোটের বাজারে প্রাণের মূল্য শুধু মানুষেরই মেরেকেটে একটু আছে। এই যে করোনা বাজির বিস্ফোরণে, নিউ নর্মালের গুঁতোয় আদালত শব্দ দূষণে লাগাম পরিয়েছে, সেও তো শুধু মানুষের কথাই ভেবে। জীবজন্তুদের আদালত আছে নাকি? অস্তিত্বহীন কিছু একটা হয়তো আছে। খবর রাখিনি। আসলে জীববৈচিত্র বা বায়ো-ডাইভার্সিটি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনাচক্র আয়োজন করে কুম্ভীরাশ্রু ফেলা যেতেই পারে, কিন্তু উৎসবে, আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে, তাদের প্রাণের কোনও মূল্য নেই। পশুপ্রেম, পশুচিকিৎসা শতাংশের হিসেবে অদৃশ্য প্রায়। ধর্মমত জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে, গোটা পৃথিবী জুড়ে শয়ে শয়ে বছর ধরে মানুষের প্রাণের উৎসবের আড়ালে অসহায় জীবজন্তুর রক্তের উৎসব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মহামান্য আদালতের শুভ উদ্যোগে শব্দের তাণ্ডব যদি আলোর উৎসবে রাতারাতি রূপান্তরিত হতে পারে, তবে বলির উৎসব রক্তপাতহীন প্রকৃত পুজোয় ফিরতে পারবে না কেন? শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে আর কতটা নির্মম, কতটা অন্ধ হতে পারি আমরা?    

এবার আসি দ্বিতীয় উত্তরটায়। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিত চিন্তা করলে উত্তরটা জটিল নয়, কিন্তু সহজও নয়। হ্যাঁ, আমি ভারতীয় সমাজে হাজার খানেক বছর ধরে প্রবহমান 'জাতের নামে বজ্জাতি'র প্রসঙ্গই তুলছি। আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে জাতপাতের রাজনীতি মারণব্যাধির চেয়েও মারাত্মক। আড়াই কোটির কাছাকাছি জনসংখ্যা দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেন এবং তাঁরা অধিকাংশই দলিত শ্রেণিভুক্ত। রাজস্থান বিহার ঝাড়খন্ড উত্তরপ্রদেশ উড়িষ্যা তামিলনাড়ু সহ বেশ কিছু রাজ্যে এঁরা একঘরে এমনকি আলাদা গ্রামের বাসিন্দা হয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে জীবনধারণ করেন। সত্যনিষ্ঠ সমীক্ষার তথ্য বলছে, সামাজিক প্রক্রিয়ায় রাস্তা আর জঙ্গলের পশুদের থেকে এঁদের খুব একটা পার্থক্য করা হয় না। কাজেই উৎসবের আঙিনায় এঁরা যে সমাদৃত হবেন না, বলাই বাহুল্য। অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ, দলিত এই মানুষগুলোর গ্রাম, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নেশায় বুঁদ ১৩৮ কোটির দেশে আছে এবং অনেক আছে।‌ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সবেতেই নিষ্ঠুর শীতল সামাজিক অবজ্ঞার শিকার এঁরা। উৎসব নাকি সামাজিক বন্ধনের গ্রন্থি। এই মানুষগুলো কিন্তু এখনও সেই গ্রন্থিতে ব্রাত্য। সরকার যে চেষ্টা করছে না এমনটা নয়। নাগরিক দায়দায়িত্ব, বোধবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে সবরকম সামাজিক প্রক্রিয়া যদি আদালতের চাবুক আর সরকারি বাধ্যবাধকতায় হতে থাকে, তাহলে তা আর মানুষের উৎসব থাকে কী? বিশেষত এইসব প্রান্তিক মানুষ? অনলাইন উৎসবের বিনিয়োগকারীরা কী বলছেন?

 

Tuesday, 17 November 2020

বহমান জীবন যেমন

বাঙালির 'দ্বিপ্রহরের নায়ক' ছিলেন না

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

আবেগ দিয়ে কোনও মৃত্যুকে রুখে দেওয়া সম্ভব নয়। ছিয়াশি ছুঁতে চলা কিংবদন্তী অভিনেতা যে ধরনের অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করছিলেন তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়াও তাই সম্ভব ছিল না। সুতরাং মৃত্যুকে আটকে রাখা যায়নি। শেষদিন অবধি তিনি সজীব ও কর্মক্ষম ছিলেন এটাই আমাদের অনেক পাওয়া। আরেক কিংবদন্তী ম্যাটিনি আইডল চল্লিশ বছর আগে প্রায় শুটিং ফ্লোরে কাজ করতে করতেই ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর দিকে। রবি ঘোষের মতো প্রতিভাশালী অভিনেতাও তাই। কিন্তু বেশ কিছু রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয় করলেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই অর্থে বাঙালির ‘দ্বিপ্রহরের নায়ক’ কোনওদিনই ছিলেন না, সম্ভবত তিনি নিজেও সেটা চাননি। কারণ, তাঁর ছিল ভিন্ন রকমের একটা মনন ও মেধাবী সাংস্কৃতিক পরিচয়। যে ভাবনা থেকে উত্তমকুমার তাঁর সহ-অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে বারণ করেছিলেন গাড়িতে তেল ভরার সময় রাস্তায় নেমে না দাঁড়াতে। তাঁর প্রশ্ন ছিল, রুপোলি পর্দার নায়ককে দর্শকরা এত সহজে তাঁদের নাগালের মধ্যে পাবেন কেন? নায়ক থাকবেন তাঁর ফ্যানদের দূরত্বের বাইরে অধরা, সেটাই গ্ল্যামার। এমন জীবনদর্শনে সৌমিত্র বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। অন্তত তাকে ঘিরে যে সব লেখাপত্র কাহিনি এতদিন পড়ে এসেছি এবং এখনও পড়ার সুযোগ হচ্ছে তাতে এমন কথা ভাবার সুযোগ নেই। 

এর কারণটা ঠিক ঠিক লিখেছেন জয় গোস্বামী। বাংলা কেন, ভারতের চলচ্চিত্র জগতেও এমন একজন অভিনেতা পাওয়া সম্ভব নয়, বিপুল অভিনয়ের পাশাপাশি যার রয়েছে কবিতা, গদ্য ও নাটকের সংগ্রহ। রয়েছে পাঠ ও আবৃত্তির ঈর্ষনীয় সংকলন। দেশ-বিদেশের নাটকের অনুবাদ তাঁর কলমে, নতুন নতুন কবিতার আয়োজনে ঋদ্ধ তাঁর লেখনী, আমাদের শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রচর্চায় নিবেদিত তাঁর মনন। মনে না পড়ে উপায় নেই, গত বছর (২০১৯) সব থেকে খ্যাত ও পরিচিত সাহিত্যপত্রের শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর একটি দীর্ঘ কবিতা– তিনি এতটাই সমকালীন। এইসব কারণেই তাঁকে আমরা একটু কাছের মানুষ ভাবতাম, সচরাচর ফিল্মের নায়কদের সম্বন্ধে যা আমাদের ভাবার অবকাশ থাকে না। তাই তাঁর নতুন ছবির পাশাপাশি উন্মুখ হয়ে থাকতাম নতুন নাটকের জন্য, নতুন কবিতার জন্য। এটা নিছক একজন চরিত্র-অভিনেতার কাছে গড়পড়তা চাওয়ার থেকে বেশি। 

এখান থেকেই প্রসঙ্গ ঘুরে যেতে পারে ভিন্ন একদিকে। তাঁর অভিনীত তিনশো ছবির কথা আমরা এখন শুনতে পাচ্ছি, হয়তো সংখ্যাটা আরও কিছু বেশি হলেও হতে পারে। ষাট বছরের অভিনয় জীবনে সংখ্যাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষে বেশ অনেকটা বেশি। এত ফিল্মের সব চরিত্রের সঙ্গে কি তিনি সুবিচার করতে পেরেছেন না তেমন করা আদৌ সম্ভব? সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে এবং নিজে একজন পড়ুয়া অভিনেতা হিসেবে অভিনয়ের আনাচকানাচ তাঁর অজানা ছিল না- কীভাবে চরিত্রের মধ্যে নিজে ঢুকে যেতে হয়, কীভাবে চরিত্রের দাবি মিটিয়ে পালটিয়ে নিতে হয় নিজেকে, এইসব তাঁকে শিখিয়ে দেওয়ার কোনও দরকার ছিল না। কিন্তু যে চরিত্র তিনি পর্দায় জীবন্ত করে তুলবেন তার পেছনে পরিচালকের কিছু ভাবনা ও মননশীলতা থাকা প্রয়োজন, কারণ ফিল্ম মূলত পরিচালকের মাধ্যম। হলফ করে কি বলা যায় খুব বেশি হলে গোটা পঞ্চাশ ছবি বাদ দিলে বাকি যে সব ফিল্মে তিনি অভিনয় করেছেন সেগুলোতে পরিচালকরা এতদূর যোগ্য ছিলেন যে সেইসব ফিল্মের কোনও সেরিব্রাল আবেদন ছিল? আদৌ সেখানে অভিনেতার খুব নিবিড় ভাবে বুঝে নেওয়ার জায়গা ছিল চরিত্রকে? কমার্শিয়াল ফিল্ম বলে কোনও ফিল্মকে অপকৃষ্ট বলা বিধেয় নয় কিন্তু বাণিজ্যিক ফিল্ম সমস্ত যুক্তি ও ফিল্মের শর্তকে মাড়িয়ে গেলে তা কি শেষ অবধি আর ফিল্ম থাকে? সমস্যা এখানে। 

কথা উঠতেই পারে, একজন পেশাদার অভিনেতার পক্ষে কি এমন বাছাই করার সুযোগ থাকে? না, অবশ্যই থাকে না। ফিল্ম একটি বিনিয়োগের জায়গা, তার নগদবিদায় ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিচালকের ওপর প্রযোজকের চাপ থাকে। স্বয়ং সত্যজিৎ'কে ‘পথের পাঁচালী’র এক সম্ভাব্য প্রযোজক পরামর্শ দিয়েছিলেন সর্বজয়াকে দুয়েকটা পুকুরে চানের দৃশ্যে শুট করে নিতে। সব পরিচালক না বলতে পারেন না, আর অভিনেতার তো এই বিষয়ে কোনও ভূমিকাই নেই। ফলে, তাঁকে পরিচালক যে ভূমিকা ঠিক করে দেন সেটাই তার অবলম্বন। এই পর্যন্ত ঠিক। কিন্তু সৌমিত্রের মতো একজন ভিন্ন মানসিকতার অভিনেতার কেমন লাগত ওইসব মামুলি চরিত্রে অভিনয় করতে যাদের পেছনে সে ভাবে কোনও ভাবনার ছাপ আর তেমন নেই। কোথাও একটা যেন রুচির তফাত। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র অসীম চরিত্রের অভিনেতাকে যখন লিপ দিতে হত কোনও লঘু গানের সঙ্গে- কেমন লাগত তাঁর? কেমন লাগত ‘শাখা প্রশাখা’র প্রশান্তর, যখন একটা মেলোড্রামাটিক দৃশ্য শুট করে তাঁকে রোজগার করতে হত ?

আসলে সমস্যাটা এইখানে। আমাদের যদি এখন কেউ বাধ্য করে চড়া সুরের একটা পৌরাণিক যাত্রাপালা দেখতে অথবা খুব লঘু সুরের একটা জগঝম্প গানের শ্রোতা হতে কিংবা মুখের সামনে খুলে ধরে একটা শিশুপাঠ্য কবিতার বইয়ের পাতা- কেমন লাগবে আমাদের? নিশ্চয়ই আমাদের প্রথমে শুরু হবে অসোয়াস্তি; তারপরেও যদি এই জুলুম চলে তবে আমাদের দমবন্ধ লাগবে, কষ্ট হবে। কিন্তু এরপরেও যদি আমাদের উপায় না থাকে এগুলোর থেকে বেরিয়ে না আসার, তবে? সে এক গভীর বেদনার সময় যখন মনন যা দাবি করে ঠিক তার বিপরীতটাই আমাদের সামনে ঘনিয়ে ওঠে। বললে কি ভুল হবে, সৌমিত্র এমনই কিছু অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে চলেছেন তার কেরিয়ারের অনেকটা সময়! অন্তত সাতের দশক থেকে নয়ের দশক অবধি! হয়তো তাঁর সামনে কোনও বিকল্প ছিল না।

কেন বিকল্প ছিল না এটা প্রশ্ন নয়, কথাটা হল কেন বিকল্প থাকে না? আমাদের সমাজে ও সংস্কৃতিতে যারা এগিয়ে ভাবেন, এগিয়ে থাকেন তাঁদের জন্য কোনও যথার্থ পরিসর আমরা আজও তৈরি রাখতে পারিনি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে মাপের বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, শিল্পিত অভিনয়ের একজন পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর নাম আলাদা করে উল্লেখ করার মতো এবং পাশাপাশি তাঁর অন্যান্য শিল্পধারার প্রতি নিবেদন, সেও কম বলার কথা নয়- কিন্তু এমন একজন মানুষকেও সম্পূর্ণ তাঁর রুচির বিপরীতে গিয়ে জড়িয়ে পড়তে হয় এমন সব অভিনয়ে যা কেবলমাত্র তাঁর রুটিরুজির জন্যই কেবল প্রয়োজনীয়। একজন প্রকৃত শিল্পীর পক্ষে এ বড় বেদনার আবহ।

বাংলা বাজারে কেবলমাত্র লেখালিখি করে জীবন নির্বাহ করা শুধু কঠিন নয়, অন্য যে কোনও শিল্পের ঘরানাতেও তা সমান সত্যি। সত্যজিৎ রায়েরও ফিল্ম বানিয়ে সংসার চলত না বলেই শোনা যায়। পরের দিকে, এমনকি এখনও, বইয়ের রয়্যালটিই ছিল তাঁর রোজগারের বড় অংশ। সৌমিত্রের কাছ থেকেও আমরা আরও অনেক কিছু পেতে পারতাম হয়তো, যদি তাঁকে আমরা একটা দাঁড়াবার জায়গা দিতে পারতাম। কিন্তু পুরো সময়ের জন্য নাটক করতে চেয়ে শিশির ভাদুড়ী ‘জাতীয় নাট্যশালা’ পাননি, একই আকাঙ্ক্ষা বুকে পাথরের মতো জমিয়ে রেখে চলে গেছেন শম্ভু মিত্র। আমাদের রাজ্যে তার ব্যবস্থা করা যায়নি। একইভাবে করা যায়নি তেমন ব্যবস্থা যাতে সৌমিত্রের মতো অভিনেতাকে জাত খুইয়ে ভুলভাল অভিনয়ে না ঝরিয়ে ফেলতে হয় তাঁর জীবনীশক্তি। 

আমাদের চলচ্চিত্র উৎসব, আমাদের নাট্য আন্দোলন, আমাদের ফিল্ম সোসাইটি, আমাদের সরকারি সংস্কৃতির নানা উদ্যোগ, ‘দমাদম দমাদম কৃষ্টি ভীষণ’- সব কিছুর ভিতর এই এক অপার শূন্যতা- কেউ মরে গেলে আমাদের আবেগ উথলে ওঠে, যা তাঁর জীবদ্দশায় ঠিক ততটা নয়। মনে পড়ছে, আরেক বিদগ্ধ অভিনেতা উৎপল দত্তের কথা- ঠিক ঠিক করে সংসার চালানোর জন্য দিনের পর দিন তিনি তৃতীয় শ্রেণির মুম্বাই ফিল্মে নায়িকাদের শ্লীলতাহানির দৃশ্যে অভিনয় করে যেতে বাধ্য হয়েছেন! কী বলা হবে? ট্রাজেডি?

 

Wednesday, 11 November 2020

'হম নয়া সোচ কা হ্যায়'

শক্ত জমি কঠিন লড়াই

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


অভূতপূর্ব বিহার নির্বাচন নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর ‘একক মাত্রা’ ব্লগে লিখেছিলাম। সে লেখায় প্রকারান্তরে স্পষ্ট করেই বলেছিলাম, বিহারে মহাগঠবন্ধনের পক্ষে যে লহর উঠেছে তা তাদের জয়ের দিকে ইঙ্গিত করছে। ৭ নভেম্বর বুথ ফেরত সমীক্ষায় দেখা গেল আমার ভাবনা অমূলক ছিল না। কিন্তু নির্বাচনের ফল প্রকাশ পেতে বোঝা গেল, লড়াইটা ছিল এক শক্ত জমির ওপর; যেখানে গত বছর লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ ৪০টার মধ্যে ৩৯টা আসন (বিধানসভা আসনের বিচারে ২২৩) জিতে এমন এক অসম লড়াইয়ের ভিত্তি তৈরি করে রেখেছিল যে কার্যত মহাগঠবন্ধনকে প্রায় শূন্যের কোটা থেকেই শুরু করতে হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই মহাগঠবন্ধন দিতে পেরেছে তা অতুলনীয় এবং শেষমেশ প্রায় ফটো-ফিনিশে এনডিএ কোনওরকমে কান কেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এখন পরিস্থিতি মহারাষ্ট্রের মতো হবে কিনা, অথবা নবগঠিত সরকার কতটা স্থায়ী হবে, এইসব চর্চা আগামীদিনের জন্য তোলা রইল।

আগের লেখাতেই এই নির্বাচনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে বলেছি। তাই নতুন করে সে বিষয়ে আর বলার কিছু নেই। আপাতত উপলব্ধি এটুকুই যে, ভারতবর্ষের রাজনীতি এক নতুন মোড় নিচ্ছে। তা নানা অর্থে, নানা আঙ্গিকে।

গত এক দশকে এ দেশ ও বিশ্ব জুড়ে রক্ষণশীল ও উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তির যে উত্থান, অবশেষে, ধীর-গতিতে হলেও তার পতন-অভিসার পর্বে আমরা প্রবেশ করেছি। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের পতন স্পষ্টতই ইঙ্গিতবাহী। অবশ্য, তার আগে তথাকথিত উদারবাদী রাজনীতি-অর্থনীতির যে বিশ্বত্রাস আমরা দেখেছি, তা কম আশঙ্কার ছিল না। গত শতকের ৯০-এর দশকের শেষে এশিয়ান টাইগারদের দ্রুত উত্থান ও পতন, ২০০৮-এর সাবপ্রাইম সংকটে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মুখ থুবড়ে পড়া ও সর্বোপরি, এক বিপুল আর্থিক বৈষম্য, গোটা দুনিয়াকে এক তীব্র সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত করেছিল। আমাদের দেশে তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তারই প্রতিক্রিয়ায় প্রায় সর্বত্র এমন এক উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতা নির্মিত হতে থাকে যেখানে অভিবাসন, বিশ্ব বাণিজ্য, বর্ণ-ধর্ম-জাতি নিরপেক্ষ অবস্থান, গণতান্ত্রিক আচার-বিধি, সমালোচনার অধিকার ইত্যাদি মূল্যবোধগুলি ধিক্কৃত হতে শুরু করে। ফলে, দেশে দেশে স্বৈরাচার, ব্যক্তিকেন্দ্রিক উন্মাদনা, এক দলীয় শাসনের বিধিব্যবস্থা ও প্রাচীনপন্থা ন্যায্যতা পেতে আরম্ভ করে ও তেমন তেমন জনমত ও শাসকও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যেমন, আমেরিকায় ট্রাম্প, ব্রাজিলে বোলসোনারো বা তুরস্কে এর্ডোগান। গোটা মানবসভ্যতার কাছে তা হয়ে ওঠে এক মহাবিপদ। আমাদের দেশেও ক্রমেই এমনতর দমবন্ধ করা পরিস্থিতির উদয় হয়। এমতাবস্থায়, বিহার নির্বাচনের ফলাফল নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী ও নতুনতর এক রাজনৈতিক দিশার ইঙ্গিতবাহী।

এমন কথা কেন বলছি?

প্রথমত, এই নির্বাচন ছিল এক মহাজাগরণ। প্রধান বিরোধী দল যার মূল নেতা জেলবন্দী ও পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে বিবাদ চরমে- এমনতর এক ছন্নছাড়া অবস্থাতেও দেখা গেল পট খুব দ্রুত বদলে গেল। সে দল চকিতে অন্তর্বিরোধ নিয়েই এক তরুণকে নেতা হিসেবে সামনে রেখে প্রস্তুত হতে শুরু করে দিল। আসলে, তা ছিল জনতার প্রস্তুতি। জনতা যখন খুড়কুটো ধরেই দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, তখন স্বাভাবিক, আশা-ভরসার দুর্বলতম জায়গাটিও আপন নিয়মে তৈরি হতে থাকে। বিহারের মানুষের সমস্যা যে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যা করোনাকালে আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, সেই বার্তা ক্রমে গেল রটি; শুধু তাই নয়, সমস্ত গরিব মানুষ যেন জাতপাত ও ধর্মের উর্ধ্বে উঠে শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইল। এই মাত্রাটিই ছিল এবারের নির্বাচনে যাদুকাঠি। তবে কম্মটি কম দুঃসাধ্য ছিল না। কারণ, বহুকালের জারিত জাতপাত ও ধর্মীয় রাজনীতি থেকে চাইলেই অত সহজে ছুটকারা পাওয়া যায় না! কিন্তু জনতা যদি সদর্থক প্রস্তুতি নিতে থাকে, কোনও জননেতা বা আপাত দলও তখন জুটে যায়। কথিত আছে, নবম শতকে গৌড় বাংলায় যখন মাৎস্যন্যায় চলছিল, তখন এক হাতি রাস্তা থেকে গোপাল নামে এক কৃষক বালককে শুঁড়ে তুলে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছিল। এইভাবেই বাংলায় সূচিত হয়েছিল পাল বংশের শাসন যা মাৎস্যন্যায় থেকে রাজ্যকে বাঁচিয়েছিল। সেই হাতি আর কেউই নয়, জনসমাজের প্রতীক। যে কারণে, সময়ের আবাহনে আরজেডি যেমন নিজেদের নতুন করে গুছিয়ে নিতে পেরেছে, তেমনই ত্বরিত গতিতে তারা এক মহাগঠবন্ধনও গড়ে তুলতে সফল হয়েছে। ফলে, রক্ষণশীল, ধর্ম-ভিত্তিক, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও বিভাজনপন্থী রাজনীতি খুব জোর ধাক্কা খেয়েছে, যার কোনও আন্দাজই তাদের তাবড় নেতারাও করে উঠতে পারেননি।

দ্বিতীয়ত, সোশ্যালিস্ট ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহ্য বহনকারী বিহার বহু দিন পর এমন এক মহাগঠবন্ধন দেখল যেখানে তিনটি কমিউনিস্ট দল ও সোশ্যালিস্ট ভাবধারায় গড়ে ওঠা আরজেডি’র মধ্যে এক নিপুণ ও সাবলীল ঐক্য নির্মাণ সম্ভবপর হল। আরজেডি-বাম ঐক্যই এবারের নির্বাচনের মূল অক্ষ ছিল যা গরিব ও মেহনতী মানুষের এক বড় অংশকে এক ছাতার তলায় এনে নির্বাচনী রণাঙ্গনে এক নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে। কংগ্রেস এই জোটে সামিল হয়ে কিছুটা বাতাস জুগিয়েছে নিঃসন্দেহে, অন্যথায় তাদের কোনও উপায়ও ছিল না। কিন্তু মোটের ওপর তাদের আপেক্ষিক ব্যর্থতার জন্যই (৭০টা আসন নিয়ে মাত্র ১৯টায় জয়) মহাগঠবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি এসেও থমকে গিয়েছে।

তৃতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে বিহারের বুকে দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের এক বড় অংশের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে সিপিআই(এমএল)-লিবারশেন দল যে আন্দোলন চালিয়ে গেছে, আজ ১২টি আসন পেয়ে (১৯টি আসনে লড়ে) তারা নিজেদের এক শক্তিশালী অবস্থার জানান দিয়েছে। সেই সঙ্গে সিপিআই ও সিপিআই(এম) দলের ২টি করে আসন লাভ সামগ্রিক ভাবে বাম শক্তিকে আরও সবল করেছে। সারা দেশ জুড়ে ম্রিয়মান হয়ে আসা বামশক্তির পক্ষে এ এক অত্যন্ত উজ্জ্বল আভাস। এই সুযোগে বামপন্থাকে নতুন ভাবে প্রাসঙ্গিক করে তোলার চ্যালেঞ্জ আজ বামপন্থীদের সামনে হাজির হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে ও গিগ অর্থনীতির প্রসারে রাজনৈতিক অর্থনীতির জগতে যে অভিনব পরিবর্তনগুলি দেখা দিয়েছে, সেগুলিকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করে শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার নতুন চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করার সময় এখন তাদের সামনে উপস্থিত। শ্রেণির প্রশ্নকে গুলিয়ে ফেললেই কিন্তু সমস্যা।

চতুর্থত, বিহারের নির্বাচন থেকে এও বোঝা গেছে, রাজনীতির অভিজ্ঞান ও পথ নির্মিত হয় বাস্তব রাজনীতির ময়দান থেকে। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত বা স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী অথবা বড় মিডিয়ায় জ্ঞান বিতরণকারী কোনও বোদ্ধার পক্ষে তা অনুধাবন করা দুষ্কর। যেমন দেখলাম, ৭ নভেম্বরের বুথ ফেরত সমীক্ষার আগে প্রায় কোনও পণ্ডিতই বিশ্বাস করতে চাননি যে বিহারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণত আলাদা ও সেখানে জনতা নীরবে এক গুণগত পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। কারণ, তাঁদের পণ্ডিতির সঙ্গে মেহনতি মানুষের কোনও অরগ্যানিক সম্পর্ক নেই (অল্প সংখ্যক ব্যতিক্রমী নিশ্চয়ই আছেন)।

পঞ্চমত, এবারের নির্বাচনে ‘জনতার মিডিয়া’র প্রবল উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা গেল। যখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এক বড় সময় জুড়ে প্রচার করে চলেছে যে বিহারে এনডিএ’র দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয় অবধারিত (গ্রাউন্ড লেভেলে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে তবুও), তখন স্থানীয় স্তরে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উদ্যোগে বহু সংবাদ-ভিডিও নির্মিত হয়ে ইউটিউব’এ পাওয়া গেছে, যা ঘুরে ঘুরে জনতার সাক্ষাৎকার নিয়ে এক অন্য বাস্তবতার জানান দিচ্ছে। এই ভিডিওগুলির সাবস্ক্রিপশন ও দর্শক কয়েক হাজার তো বটেই, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে লাখেরও বেশি। এদের নেওয়া প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎকার থেকে জনতার মেজাজ ও মানসিকতা খুব স্পষ্ট করে বোঝা গিয়েছে, যেখানে মালুম করা যাচ্ছিল যে এনডিএ'র সঙ্গে মহাগঠবন্ধনের ঠক্কর এবার সমানে সমানে হবে।

ষষ্ঠত, এনডিএ’র তরফে অবিরত তোলা ধর্মীয় বিভাজনের মুদ্দাগুলি এবারের নির্বাচনে তেমন কোনও দাগ কাটতে পারেনি (অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, শেষ পর্যায়ে সীমাঞ্চলের এলাকাগুলিতে এর কিছু প্রভাব পড়েছে)। কারণ, বিরোধীরা সেই উত্থাপিত মুদ্দাগুলি নিয়ে কোনও কথাই বলেনি। ফলে, সামগ্রিক ভাবে তা একপ্রকার মাঠে মারা গেছে। এ ক্ষেত্রে মহাগঠবন্ধনের নেতা তেজস্বী যাদব শাসকের ফাঁদে পা না দিয়ে নিঃসন্দেহে পরিণতমনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। বরং, বেরোজগারি ও আর্থিক মুদ্দার ওপর জোর দিয়ে নির্বাচনের স্টিয়ারিংটাই তাঁরা শাসকের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছেন।

শেষত, যদিও একই সময়ে এটা নিঃসন্দেহে ভাল খবর যে আমেরিকায় এক উগ্র রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট’কে নির্বাচনে পরাজিত করা গেছে (অবশ্য তা কিছুটা অবধারিত ছিল), কিন্তু সাহেব প্রীতিতে গদগদ বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক অংশ যেভাবে লাফাচ্ছে, যেন জো বাইডেনকে তারাই ভোট দিয়ে জিতিয়েছে। অতএব, বিহারের ভোট? সে তো অশিক্ষিত, দেহাতীদের ব্যাপার, তা নিয়ে অত মাথা ঘামানোর দরকারই বা কী! এই মধ্যবিত্তের সেই অংশই আবার বিস্ময় প্রকাশ করছে যে এত মানুষ তবুও ট্রাম্প’কে ভোট দিয়েছে। আহা, যেন কত ‘শিক্ষিত’ এই আমেরিকানরা, তারা কী করে এত বেশি সংখ্যায় ট্রাম্পকে ভোট দেয়! তা নিয়ে এক ‘এগিয়ে থাকা’ বাংলা দৈনিকে বিগলিত হয়ে নাকি উত্তর-সম্পাদকীয়ও লিখে ফেলা গেছে। ওদের ভোট আর বিহারের ভোট কি এক! এই হল আরেক ধরনের জাতিবাদী ও শ্রেণিবাদী মৌলবাদ যা তথাকথিত উদারবাদীদের উত্তরাধিকার। এরা গরিব মানুষকে মূর্খ ভাবে ও ইংরেজি-জানা মানুষদের শিক্ষিত!

সংক্ষেপে, মেহনতি শ্রমজীবী মানুষ যদি ধর্ম-বর্ণ-জাতি-জাতপাতের উর্ধ্বে উঠে আর্থিক মুদ্দার ওপর নিজেদের দাবি-দাওয়াকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে এক সদর্থক যাত্রাপথ তৈরি হয়। বিহারের নির্বাচন এই এজেন্ডাকেই সদর্পে তুলে ধরেছে। তাই, আওয়াজ উঠেছে: 3D – Dignity, Development, Democracy (মর্যাদা, উন্নয়ন, গণতন্ত্র)। বিহারের লড়াইয়ের পথই আপাতত ভারতের পথ।


Sunday, 8 November 2020

গুরুত্ব কমছে নেতাদের

লাভ জিহাদের মৌলবাদ

শ্রেয়ণ 


উপমহাদেশে ‘লাভ জিহাদ’ কথাটি গত কয়েক বছরে বেশ প্রচলিত হয়ে উঠেছে। যদিও ভারতের সংবিধান এবং আইনব্যবস্থায় কথাটির কোনও বৈধতা নেই। সংসদে এক বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডিও তা স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে তাকে আইনের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চেষ্টা কম করছে না হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। অসমের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ঘোষণা করেছেন, ২০২১ সালে বিজেপি আবার বিধানসভায় জিতলে লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই শুরু হবে। লাভ জিহাদির শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। হরিয়ানাতেও আইন আনার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সেই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজ। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা কড়া পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছেন। যোগী আদিত্যনাথও পিছিয়ে নেই। হুংকার দিয়েছেন, লাভ জিহাদে অভিযুক্তদের রাম নাম সত্য করে দেওয়া হবে। এমনকি জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রধান রেখা শর্মা সম্প্রতি অভিযোগ করেন, মহারাষ্ট্রে লাভ জিহাদের সংখ্যা বাড়ছে। 

মজার কথা হল, কোরান তো দূরের কথা, মুসলমান ধর্মগুরুদের বক্তব্যেও ‘লাভ জিহাদ’এর কোনও সংজ্ঞা মেলে না। মিলবেই বা কী করে? ইসলাম ধর্মে ‘জিহাদ’ কথাটির তাৎপর্য অনেক গভীর। আল্লাহ্-র পথে সংগ্রামকে বলা হয় জিহাদ। এই সংগ্রাম নিজের ভেতরে এবং বাইরে চলে। অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোও জিহাদের একটি অংশ। যুদ্ধ এবং জিহাদ সমার্থক নয়। নির্বিচারে কিংবা অন্যায়ভাবে মানুষ খুনের ওপর কোরানে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অমুসলমানকে জোর করে মুসলমানে পরিণত করাও ইসলাম সমর্থন করে না। তবে মৌলবাদী সব জায়গাতেই রয়েছে। মুসলমানদের মধ্যেও ধর্মের নামে প্রচুর লোক অধর্মের ব্যবসা চালায়। রক্তে স্নান করেই তাদের তৃপ্তি। হিন্দুধর্মের মধ্যেও তেমন লোক বিরল নয়। তা বলে গোটা সম্প্রদায়কে মৌলবাদী বলে দাগানো যায় কি?

পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ অবশ্য এটাই করে এসেছে। সেই ক্রুসেডের সময়ে ইউরোপে শুরু হয়েছিল ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানো। আধুনিক যুগে প্রগতিশীলতার মুখোশ পড়ে সারা বিশ্বে সেই কাজ চলছে। সাম্রাজ্যবাদের গর্ভেই সংঘ পরিবারের জন্ম, তা সবাই জানি। ‘লাভ জিহাদ’, ‘অনুপ্রবেশ জিহাদ’-এর মতো শব্দবন্ধ সংঘীদেরই বানানো। আরএসএস নেতা এমজি বৈদ্য লাভ জিহাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, মুসলমান যুবকেরা যখন হিন্দু মেয়েকে ভালোবাসার টোপ দেখিয়ে বিয়ে করে তাঁকে ধর্মান্তরিত করে, তখন মৌলবিরা খুশি হন৷ কিন্তু বিপরীতটা হলেই তাঁরা ক্ষেপে যান৷

প্রশ্ন হল, উল্টোটা কি হয় না? না হলে, হিন্দু মেয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করলে সংঘীরা তুলকালাম করে কেন? ‘লাভ জিহাদ’-এর অভিযোগ আনে কেন? এমনকি ‘তানিষ্ক’-এর বিজ্ঞাপনকে ঘিরে যে হৈ-হল্লা করলেন খেমচাঁদ শর্মা থেকে কঙ্গনা রানাওয়াত এবং তাঁদের অনুগামীরা, টাটার মতো এত বড় পুঁজিপতি সংস্থা নিজেদের বিজ্ঞাপন সরাতে বাধ্য হল, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার অবকাশ থেকেই যায়। 

তবে ‘লাভ জিহাদ’-এর ভীতি অনেক চেষ্টা করেও সংঘীরা উপমহাদেশের বাইরে ছড়াতে পারেনি। পশ্চিমি দুনিয়া ইসলাম বিদ্বেষের আঁতুড়ঘর হলেও ইস্যুটাকে খায়নি সেখানকার মানুষ। উপমহাদেশের শিখ এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কেউ কেউ অবশ্য ফাঁদে পা দিয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতেই কেরলের এক গির্জা থেকে বলা হয়, লাভ জিহাদ একটি বাস্তব সমস্যা। খ্রিস্টান মহিলাদের লোভ দেখিয়ে বিয়ে করে সন্ত্রাসের কাজে লাগাচ্ছে মুসলমান যুবকেরা – এমন অভিযোগ তোলা হয়।

মৌলবাদকে জল-হাওয়া দিয়ে পুষ্ট করছে বিশ্বায়ন। ইতিহাস লক্ষ করলেই দেখা যায়, নয়া-উদারবাদের যুগে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ক্রমশ বাড়ছে। এর সূচনা যদিও হয়েছিল আধুনিক উপনিবেশ বিস্তারের আদিকাল থেকে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং সমকালীন প্রযুক্তি এখন হিংসা নির্মাণ করে। মুসলমানদের কিছু অংশে যেমন মৌলবাদ দ্রুত ছড়াচ্ছে, তেমনি হিন্দু-শিখ-খ্রিস্টানদের মধ্যেও। একটি সম্প্রদায়ের মৌলবাদকে প্রতিরোধ করতে অন্য সম্প্রদায়ে মৌলবাদ বাড়ে – এই বোগাস তত্ত্ব যদি আউড়ে যাই, তাহলে আসল সমস্যাই নজর এড়িয়ে যাবে। 

মধ্যযুগে ইসলামের কোনও কেন্দ্র ছিল না। ভারতের কোনও কোনও সুলতান আরবের খলিফার অনুমোদন নিতেন কেবলই নামে, বাস্তবে নিজেদের মতোই চলতেন। মুঘলরা কোনও খলিফাকেই মানতেন না। পৃথিবীর নানা জায়গায় মুসলমানদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ছিল, তাই নিয়ে আনন্দে ছিলেন তাঁরা। আধুনিক যুগে কিছু পশ্চিমি পণ্ডিত প্রচার করতে লাগলেন, আরবের সংস্কৃতিই বিশুদ্ধ ইসলামের সংস্কৃতি। সেখান থেকেই শুরু হল গণ্ডগোল। হিন্দুধর্মেরও বিশুদ্ধ রূপ খুঁজতে শুরু করেছিলেন প্রাচ্যবাদী ইউরোপীয়রা। বিশুদ্ধতায় ফেরার আহ্বান থেকেই আসে মৌলবাদ এবং বিদ্বেষ। 

ভিন ধর্মে বিয়ে আমাদের উপমহাদেশে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। জোর করে ভালোবাসা আটকানো যায় না। সাধারণ জনগণও তা বোঝেন। সমস্যা হয় মোড়লদের নিয়ে। তবে নতুন যুগ আসছে। গুরুত্ব কমছে নেতাদের। বাড়ছে আম-আদমির সক্রিয়তা। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে তার পূর্বাভাস আমরা দেখলাম। সেরকম চলতে থাকলে মৌলবাদকেও আমরা ক্রমশ পরাজিত করতে পারব।

 

Friday, 6 November 2020

অভূতপূর্ব!

বাইডেন জিতছে কিন্তু টালমাটাল আমেরিকা

সোমনাথ গুহ

 

আমেরিকায় ইলেক্টোরাল ভোটের ওপরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হারজিত নির্ভর করে। ২০১৬'র নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্রাট দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনের থেকে ৩০ লক্ষ পপুলার ভোট কম পেয়েছিলেন কিন্তু ৫৪০টা ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে ৩০৪টা পেয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে হোয়াইট হাউস দখল করে নিয়েছিলেন। এই মুহুর্তে জো বাইডেন ২৫৩টা ভোট পেয়ে ম্যাজিক নাম্বারের থেকে মাত্র ১৭ ভোট দূরে। পপুলার ভোটেও তিনি এগিয়ে। এখন অবধি তাঁর ঝুলিতে ৭.৩৬ কোটি ভোট যা ২০০৮ সালে বারাক ওবামার রেকর্ড ভোট প্রাপ্তিকেও (৬.৯৪ কোটি) ছাড়িয়ে গেছে। বাইডেনের জয় আসন্ন। চারটি রাজ্যে এখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে- পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, অ্যারিজোনা এবং নেভাদা। 

পেনসিলভানিয়ার কথা ধরা যাক। এই রাজ্যটির ২০টা ইলেক্টোরাল ভোট আছে। এখানে ট্রাম্প গণনার শুরুতে ৭ লক্ষ ভোটে এগিয়ে ছিলেন যেটা কমতে কমতে শুক্রবার সকালে ৪৮৮৫৪ ভোটে নেমে এসেছে। এখনও প্রায় আড়াই লক্ষ ভোট গোনা বাকি। বিশেষজ্ঞদের হিসাবে বাইডেন বাকি ভোটের ৬২ শতাংশ পেলেই জিতে যাবেন। এই টেলিকাস্টের সময় চার গুচ্ছ ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে বাইডেন যথাক্রমে ৬৬, ৭২, ৭৯, ৮৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, অর্থাৎ, বাকি ভোটে তার প্রাপ্তির হার উত্তরোত্তর বাড়ছে। সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে চমকপ্রদ কিছু না হলে বাইডেন পেনসিলভানিয়া জিতছেন এবং একই সাথে নির্বাচনও জিতছেন এবং চার বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হচ্ছেন। প্রায় একই চিত্র জর্জিয়ায় যেখানে ট্রাম্পের ২ লক্ষের লিড কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২৪৯৭। আরও প্রায় ১৫০০০ ভোট গোনা বাকি। এখানেও বাকি ভোট যে হারে জেতা প্রয়োজন বাইডেন তার থেকে বেশি শতাংশ পাচ্ছেন, সুতরাং, এখানে তাঁর জেতা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। জর্জিয়ার ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা ১৬ যা তাকে জয়ের একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে।

মেইল-ভোটিং হচ্ছে এবারে আমেরিকার নির্বাচনে গেমচেঞ্জার। মেইল বা অ্যাবসেন্টি ভোটিং আমাদের পোস্টাল ভোটিংয়ের মতো। যাদের সশরীরে বুথে যাওয়ার অসুবিধা আছে তারা কারণ জানিয়ে এই ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারেন। অনেক রাজ্যে কোনও কারণ জানানোরও প্রয়োজন নেই, কোনও ব্যক্তি আবেদন করলেই মেইল-ভোটিং করতে পারেন। এছাড়াও পেনসিলভানিয়ার মতো রাজ্যে নির্বাচনের নির্ধারিত দিনের পরে তিন দিন অবধি যা ভোট ডাকে আসবে, তাতে যদি ডাকঘরের স্ট্যাম্পে ইলেকশন ডে’র তারিখ দেওয়া থাকে, তা বৈধ বলে গণ্য হবে। অতিমারির কারণে এবার এই ধরনের ভোটদান অভুতপূর্ব ভাবে বেড়ে গেছে। সংখ্যাটা বলা হচ্ছে অন্তত এক কোটি। এর ফলে ভোটদানের হার এবার আমেরিকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ: ৬৭ শতাংশ। 

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোভিড১৯ পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন। মারির কারণে যে সব নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল নিজের সমর্থকদের সরাসরি প্ররোচনা করেছেন সেগুলো অমান্য করার জন্য। রিপাবলিকানরা তাঁদের নেতাকেই অনুসরণ করেছেন, কোভিডকে গুরুত্ব দেননি এবং বৃহৎ অংশ ৩রা নভেম্বর বুথে গিয়ে সশরীরে ভোট দিয়েছেন। এর বিপরীতে ডেমোক্রেটরা মারিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, যাবতীয় সুরক্ষা বিধি মেনে চলেছেন এবং বাড়ি থেকে ভোট দেওয়াই শ্রেয় মনে করেছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ, ডেমোক্রেট নেতৃবৃন্দ কৌশলগত ভাবে তাঁদের সমর্থকদের কোনও ঝুঁকি না নিয়ে বাড়ি থেকে ভোট দিতে উৎসাহিত করেছেন। তাঁরা জানেন, এর ফলে বেশি সংখ্যক ভোট পড়বে এবং তার অধিকাংশ তাঁদের পক্ষেই যাবে। গণনার সময় বুথের ভোট আগে গোনা হয়েছে এবং ট্রাম্প তরতর করে এগিয়ে গেছেন। কিন্তু যখন ডাকে আসা ভোটের গণনা শুরু হয়েছে একই গতিতে তাঁর লিড কমে গেছে। ট্রাম্প এটা জানতেন এবং তাই প্রথম থেকেই এই ডাক ভোটের বিরোধিতা করেছেন এতটাই যে উনি ডাক বিভাগের তহবিলের পাওনা টাকা আটকে দিয়েছেন। ওনার যুক্তি হচ্ছে, এতে অনেক ভোট এসে পৌঁছয় না, কারচুপির অনেক সুযোগ থাকে। তাই দেয়াল লিখন পরিষ্কার হয়ে যাবার পরেও তিনি বলছেন ডেমোক্রেটরা নির্বাচন চুরি করে নিয়েছে। আমেরিকার মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। বুক ঠুকে বলছেন বৈধ ভোটে আমিই জিতেছি, এখন যা গোনা হচ্ছে সব অবৈধ ও দেরিতে আসা ভোট, অতএব স্টপ কাউন্টিং। একই আওয়াজ তুলে তাঁর দলবল রাস্তায় নেমে পড়েছে, কিছু জায়গায় ভাঙচুর শুরু হয়ে গেছে। তিনি আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। পেনসিলভানিয়ার উপরে উল্লেখিত নিয়ম বাতিল করার জন্য তিনি কোর্টে আবেদন করেছিলেন, রাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আর্জি খারিজ করে দিয়েছে। এবার উইসকনসিন, মিশিগান, নেভাদা সহ অন্তত পাঁচটি রাজ্যে পুনর্গণনার জন্য তিনি আদালতে যাচ্ছেন।

মজাটা হচ্ছে পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়াতে ডেমোক্রেটরা মেইল-ভোট বৃদ্ধির কারণে যে সুবিধা পেয়েছেন, রিপাবলিকানরা অ্যারিজোনাতে একই সুবিধা পেয়েছে। এই রাজ্যে বাইডেন গণনার শুরুতে ২ লক্ষ ভোটে এগিয়ে ছিলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেটা কমে দাঁড়ায় ৭০০০০, রাতে ৫৮০০০, শুক্রবার সকালে ৪৬২৫৭। এখনও প্রায় আড়াই লক্ষ ভোট গোনা বাকি। এখানে গণনায় কিন্তু ট্রাম্প উচ্ছ্বসিত, কাউন্টিং বন্ধ করতে বলছেন না। এটাই ট্রাম্প- স্ববিরোধিতায় ভরপুর, বেপরোয়া, খামখেয়ালি, হঠকারি, কথাবার্তায় বেলাগাম, অশালীন, বন্ধু রাষ্ট্রকেও তুচ্ছ কারণে কটু কথা বলতে যার একটুও বাধে না। চিন্তা করুন হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন না দিলে প্রত্যাঘাত করা হবে বলে ভারতকে কী ভাবে হুমকি দিয়েছেন; কিংবা হেলায় ভারতের বাতাস নোংরা বলে দেন, জলবায়ু সংকটের জন্য অন্যান্য দেশের সাথে ভারতকেও একই ভাবে দায়ী করেন। এসবই ‘হাউদি মোদি’, ‘নমস্কার ট্রাম্প’ হওয়া সত্ত্বেও।

আর এখানেই হচ্ছে এবারের আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আসল গল্প। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো এতো অননুমেয় এক চরিত্র কোন যাদুবলে এত ভোট পান! তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৬.৯৬ কোটি যা দেশের ইতিহাসে কোনও ‘পরাজিত’ প্রার্থীর রেকর্ড ভোট। ২০১৬'র নির্বাচনে ৬ কোটির আশেপাশে ভোট পেয়ে তিনি বাজিমাত করে দিয়েছিলেন। এবার তার চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছেন। মিডিয়া, প্রায় সব নির্বাচনী সমীক্ষা, এক্সিট পোল তাঁর সম্ভাবনা তো প্রায় উড়িয়ে দিয়েছিল। নির্বাচনের আড়াই দিন পরেও এখনও যে বাইডেন অফিসিয়ালি ম্যাজিক সংখ্যায় পৌঁছতে পারেননি তার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রচুর ব্যালট ডাকে আসার কারণে গণনায় দেরি হওয়া। একই সাথে আরও একটি কারণ, অন্তত সাত-আটটি রাজ্যে ট্রাম্পের নাছোড় লড়াই। অতিমারি তো বাইডেনের পক্ষে শাপে বর হয়েছে, না হলে তিনি হেরেও যেতে পারতেন। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করেছেন। অবৈধ অভিবাসন রোধ করেছেন, এমনকি বৈধ অভিবাসনও সীমিত করে দিয়েছেন। বিপুল সংখ্যক ভোটারদের তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে তাঁদের চাকরি, ব্যবসা, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই অভিবাসন-বিরোধী পলিসি জরুরি। বাইরে থেকে এসে লোকে এখানে টাকা কামাবে আর আমার দেশের মানুষ চাকরি পাবে না, এটা চলতে পারে না। একই কারণে প্যারিসের জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে এসেছেন, টাকা দেওয়া বন্ধ করেছেন; হু'কেও পয়সা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ ওই একটাই- এসবে আমেরিকার কোনও লাভ নেই। 'আমি আমেরিকার রক্ষাকর্তা' এটা বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যা বহু মানুষকে স্পষ্টতই প্রভাবিত করেছে।

নানা রকম আইনি জটিলতার কারণে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ হতে হয়তো দেরি হবে কিন্তু হতেই পারে নতুন জমানা শুরু হওয়ার পরেও ট্রাম্প ঘরে ফিরে যাবেন না। উনি রাজনীতিতে একইরকম ভাবে সক্রিয় থেকে যাবেন। এমনকি তিনি ২০২৪ সালে আবারও প্রার্থী হতে পারেন। উনি নতুন প্রেসিডেন্টের প্রতিটি পদক্ষেপ অন্তর্ঘাত করার চেষ্টা করবেন। এছাড়া সেনেটে যদি রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় (এই মুহুর্তে ৪৭:৪৭, মোট সদস্য ১০০) তাহলে বাইডেনকে তাঁর নিজস্ব কর্মসূচি চালু করতে প্রভূত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। আগামী চার বছর আমেরিকায় একটা টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়।