শক্ত জমি কঠিন লড়াই
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
অভূতপূর্ব বিহার নির্বাচন নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর ‘একক মাত্রা’ ব্লগে লিখেছিলাম। সে
লেখায় প্রকারান্তরে স্পষ্ট করেই বলেছিলাম, বিহারে মহাগঠবন্ধনের পক্ষে যে লহর উঠেছে
তা তাদের জয়ের দিকে ইঙ্গিত করছে। ৭ নভেম্বর বুথ ফেরত সমীক্ষায় দেখা
গেল আমার ভাবনা অমূলক ছিল না। কিন্তু নির্বাচনের ফল প্রকাশ পেতে বোঝা গেল, লড়াইটা ছিল এক শক্ত জমির ওপর; যেখানে গত বছর লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ ৪০টার মধ্যে ৩৯টা আসন (বিধানসভা আসনের বিচারে ২২৩) জিতে এমন এক অসম লড়াইয়ের ভিত্তি তৈরি করে রেখেছিল যে কার্যত মহাগঠবন্ধনকে প্রায় শূন্যের কোটা থেকেই শুরু করতে হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই মহাগঠবন্ধন দিতে পেরেছে তা অতুলনীয় এবং শেষমেশ প্রায় ফটো-ফিনিশে এনডিএ কোনওরকমে কান কেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এখন পরিস্থিতি মহারাষ্ট্রের মতো হবে কিনা, অথবা নবগঠিত সরকার কতটা স্থায়ী হবে, এইসব চর্চা আগামীদিনের জন্য তোলা রইল।
আগের লেখাতেই এই নির্বাচনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে বলেছি। তাই নতুন করে সে
বিষয়ে আর বলার কিছু নেই। আপাতত উপলব্ধি এটুকুই যে, ভারতবর্ষের রাজনীতি এক নতুন মোড়
নিচ্ছে। তা নানা অর্থে, নানা আঙ্গিকে।
গত এক দশকে এ দেশ ও বিশ্ব জুড়ে রক্ষণশীল ও উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তির যে উত্থান,
অবশেষে, ধীর-গতিতে হলেও তার পতন-অভিসার পর্বে আমরা প্রবেশ করেছি। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের পতন স্পষ্টতই ইঙ্গিতবাহী। অবশ্য, তার আগে তথাকথিত উদারবাদী
রাজনীতি-অর্থনীতির যে বিশ্বত্রাস আমরা দেখেছি, তা কম আশঙ্কার ছিল না। গত শতকের
৯০-এর দশকের শেষে এশিয়ান টাইগারদের দ্রুত উত্থান ও পতন, ২০০৮-এর সাবপ্রাইম সংকটে
বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মুখ থুবড়ে পড়া ও সর্বোপরি, এক বিপুল আর্থিক বৈষম্য, গোটা
দুনিয়াকে এক তীব্র সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত করেছিল। আমাদের দেশে তার ব্যতিক্রম
ঘটেনি। তারই প্রতিক্রিয়ায় প্রায় সর্বত্র এমন এক উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতা নির্মিত
হতে থাকে যেখানে অভিবাসন, বিশ্ব বাণিজ্য, বর্ণ-ধর্ম-জাতি নিরপেক্ষ অবস্থান,
গণতান্ত্রিক আচার-বিধি, সমালোচনার অধিকার ইত্যাদি মূল্যবোধগুলি ধিক্কৃত হতে শুরু
করে। ফলে, দেশে দেশে স্বৈরাচার, ব্যক্তিকেন্দ্রিক উন্মাদনা, এক দলীয় শাসনের বিধিব্যবস্থা
ও প্রাচীনপন্থা ন্যায্যতা পেতে আরম্ভ করে ও তেমন তেমন জনমত ও শাসকও শক্তিশালী হয়ে
ওঠে। যেমন, আমেরিকায় ট্রাম্প, ব্রাজিলে বোলসোনারো বা তুরস্কে এর্ডোগান। গোটা মানবসভ্যতার
কাছে তা হয়ে ওঠে এক মহাবিপদ। আমাদের দেশেও ক্রমেই এমনতর দমবন্ধ করা পরিস্থিতির উদয়
হয়। এমতাবস্থায়, বিহার নির্বাচনের ফলাফল নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী ও নতুনতর এক
রাজনৈতিক দিশার ইঙ্গিতবাহী।
এমন কথা কেন বলছি?
প্রথমত, এই নির্বাচন ছিল এক মহাজাগরণ। প্রধান বিরোধী দল যার মূল নেতা জেলবন্দী
ও পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে বিবাদ চরমে- এমনতর এক ছন্নছাড়া অবস্থাতেও দেখা গেল পট খুব
দ্রুত বদলে গেল। সে দল চকিতে অন্তর্বিরোধ নিয়েই এক তরুণকে নেতা হিসেবে সামনে রেখে
প্রস্তুত হতে শুরু করে দিল। আসলে, তা ছিল জনতার প্রস্তুতি। জনতা যখন খুড়কুটো ধরেই
দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, তখন স্বাভাবিক, আশা-ভরসার দুর্বলতম জায়গাটিও আপন নিয়মে তৈরি
হতে থাকে। বিহারের মানুষের সমস্যা যে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যা
করোনাকালে আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, সেই বার্তা ক্রমে গেল রটি; শুধু তাই নয়, সমস্ত
গরিব মানুষ যেন জাতপাত ও ধর্মের উর্ধ্বে উঠে শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইল। এই
মাত্রাটিই ছিল এবারের নির্বাচনে যাদুকাঠি। তবে কম্মটি কম দুঃসাধ্য ছিল না। কারণ, বহুকালের জারিত জাতপাত ও ধর্মীয় রাজনীতি থেকে চাইলেই অত সহজে ছুটকারা পাওয়া যায় না! কিন্তু জনতা যদি সদর্থক প্রস্তুতি নিতে থাকে, কোনও জননেতা
বা আপাত দলও তখন জুটে যায়। কথিত আছে, নবম শতকে গৌড় বাংলায় যখন মাৎস্যন্যায় চলছিল,
তখন এক হাতি রাস্তা থেকে গোপাল নামে এক কৃষক বালককে শুঁড়ে তুলে সিংহাসনে বসিয়ে
দিয়েছিল। এইভাবেই বাংলায় সূচিত হয়েছিল পাল বংশের শাসন যা মাৎস্যন্যায় থেকে রাজ্যকে
বাঁচিয়েছিল। সেই হাতি আর কেউই নয়, জনসমাজের প্রতীক। যে কারণে, সময়ের আবাহনে আরজেডি
যেমন নিজেদের নতুন করে গুছিয়ে নিতে পেরেছে, তেমনই ত্বরিত গতিতে তারা এক
মহাগঠবন্ধনও গড়ে তুলতে সফল হয়েছে। ফলে, রক্ষণশীল,
ধর্ম-ভিত্তিক, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও বিভাজনপন্থী রাজনীতি খুব জোর ধাক্কা খেয়েছে, যার
কোনও আন্দাজই তাদের তাবড় নেতারাও করে উঠতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত, সোশ্যালিস্ট ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহ্য বহনকারী বিহার বহু দিন পর
এমন এক মহাগঠবন্ধন দেখল যেখানে তিনটি কমিউনিস্ট দল ও সোশ্যালিস্ট ভাবধারায় গড়ে ওঠা
আরজেডি’র মধ্যে এক নিপুণ ও সাবলীল ঐক্য নির্মাণ সম্ভবপর হল। আরজেডি-বাম ঐক্যই
এবারের নির্বাচনের মূল অক্ষ ছিল যা গরিব ও মেহনতী মানুষের এক বড় অংশকে এক ছাতার
তলায় এনে নির্বাচনী রণাঙ্গনে এক নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে। কংগ্রেস
এই জোটে সামিল হয়ে কিছুটা বাতাস জুগিয়েছে নিঃসন্দেহে, অন্যথায় তাদের কোনও উপায়ও
ছিল না। কিন্তু মোটের ওপর তাদের আপেক্ষিক ব্যর্থতার জন্যই (৭০টা আসন নিয়ে মাত্র ১৯টায় জয়) মহাগঠবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি এসেও থমকে গিয়েছে।
তৃতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে বিহারের বুকে দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের এক বড় অংশের
মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে সিপিআই(এমএল)-লিবারশেন দল যে আন্দোলন চালিয়ে গেছে, আজ
১২টি আসন পেয়ে (১৯টি আসনে লড়ে) তারা নিজেদের এক শক্তিশালী অবস্থার জানান দিয়েছে।
সেই সঙ্গে সিপিআই ও সিপিআই(এম) দলের ২টি করে আসন লাভ সামগ্রিক ভাবে বাম
শক্তিকে আরও সবল করেছে। সারা দেশ জুড়ে ম্রিয়মান হয়ে আসা বামশক্তির পক্ষে এ এক
অত্যন্ত উজ্জ্বল আভাস। এই সুযোগে বামপন্থাকে নতুন ভাবে প্রাসঙ্গিক করে তোলার
চ্যালেঞ্জ আজ বামপন্থীদের সামনে হাজির হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে ও গিগ
অর্থনীতির প্রসারে রাজনৈতিক অর্থনীতির জগতে যে অভিনব পরিবর্তনগুলি দেখা দিয়েছে,
সেগুলিকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করে শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার নতুন চ্যালেঞ্জকে
গ্রহণ করার সময় এখন তাদের সামনে উপস্থিত। শ্রেণির প্রশ্নকে গুলিয়ে ফেললেই কিন্তু
সমস্যা।
চতুর্থত, বিহারের নির্বাচন থেকে এও বোঝা গেছে, রাজনীতির অভিজ্ঞান ও পথ নির্মিত
হয় বাস্তব রাজনীতির ময়দান থেকে। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত বা স্বঘোষিত
বুদ্ধিজীবী অথবা বড় মিডিয়ায় জ্ঞান বিতরণকারী কোনও বোদ্ধার পক্ষে তা অনুধাবন করা দুষ্কর।
যেমন দেখলাম, ৭ নভেম্বরের বুথ ফেরত সমীক্ষার আগে প্রায় কোনও পণ্ডিতই বিশ্বাস করতে
চাননি যে বিহারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণত আলাদা ও সেখানে জনতা নীরবে এক গুণগত পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। কারণ, তাঁদের পণ্ডিতির সঙ্গে মেহনতি মানুষের
কোনও অরগ্যানিক সম্পর্ক নেই (অল্প সংখ্যক ব্যতিক্রমী নিশ্চয়ই আছেন)।
পঞ্চমত, এবারের নির্বাচনে ‘জনতার মিডিয়া’র প্রবল উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা গেল।
যখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এক বড় সময় জুড়ে প্রচার করে চলেছে যে বিহারে এনডিএ’র দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়
অবধারিত (গ্রাউন্ড লেভেলে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে তবুও), তখন স্থানীয় স্তরে বিভিন্ন
ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উদ্যোগে বহু সংবাদ-ভিডিও নির্মিত হয়ে ইউটিউব’এ পাওয়া গেছে, যা
ঘুরে ঘুরে জনতার সাক্ষাৎকার নিয়ে এক অন্য বাস্তবতার জানান দিচ্ছে। এই ভিডিওগুলির
সাবস্ক্রিপশন ও দর্শক কয়েক হাজার তো বটেই, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে লাখেরও বেশি। এদের
নেওয়া প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎকার থেকে জনতার মেজাজ ও মানসিকতা খুব স্পষ্ট করে বোঝা গিয়েছে,
যেখানে মালুম করা যাচ্ছিল যে এনডিএ'র সঙ্গে মহাগঠবন্ধনের ঠক্কর এবার সমানে সমানে হবে।
ষষ্ঠত, এনডিএ’র তরফে অবিরত তোলা ধর্মীয় বিভাজনের মুদ্দাগুলি এবারের নির্বাচনে
তেমন কোনও দাগ কাটতে পারেনি (অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, শেষ পর্যায়ে সীমাঞ্চলের এলাকাগুলিতে এর কিছু প্রভাব পড়েছে)। কারণ, বিরোধীরা সেই উত্থাপিত মুদ্দাগুলি নিয়ে কোনও কথাই
বলেনি। ফলে, সামগ্রিক ভাবে তা একপ্রকার মাঠে মারা গেছে। এ ক্ষেত্রে মহাগঠবন্ধনের নেতা তেজস্বী
যাদব শাসকের ফাঁদে পা না দিয়ে নিঃসন্দেহে পরিণতমনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। বরং,
বেরোজগারি ও আর্থিক মুদ্দার ওপর জোর দিয়ে নির্বাচনের স্টিয়ারিংটাই তাঁরা শাসকের
হাত থেকে কেড়ে নিয়েছেন।
শেষত, যদিও একই সময়ে এটা নিঃসন্দেহে ভাল খবর যে আমেরিকায় এক উগ্র রক্ষণশীল
প্রেসিডেন্ট’কে নির্বাচনে পরাজিত করা গেছে (অবশ্য তা কিছুটা অবধারিত ছিল), কিন্তু
সাহেব প্রীতিতে গদগদ বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক অংশ যেভাবে লাফাচ্ছে, যেন জো
বাইডেনকে তারাই ভোট দিয়ে জিতিয়েছে। অতএব, বিহারের
ভোট? সে তো অশিক্ষিত, দেহাতীদের ব্যাপার, তা নিয়ে অত মাথা ঘামানোর দরকারই বা কী!
এই মধ্যবিত্তের সেই অংশই আবার বিস্ময় প্রকাশ করছে যে এত মানুষ তবুও ট্রাম্প’কে ভোট
দিয়েছে। আহা, যেন কত ‘শিক্ষিত’ এই আমেরিকানরা, তারা কী করে এত বেশি সংখ্যায়
ট্রাম্পকে ভোট দেয়! তা নিয়ে এক ‘এগিয়ে থাকা’ বাংলা দৈনিকে বিগলিত হয়ে নাকি
উত্তর-সম্পাদকীয়ও লিখে ফেলা গেছে। ওদের ভোট আর বিহারের ভোট কি এক! এই
হল আরেক ধরনের জাতিবাদী ও শ্রেণিবাদী মৌলবাদ যা তথাকথিত উদারবাদীদের উত্তরাধিকার।
এরা গরিব মানুষকে মূর্খ ভাবে ও ইংরেজি-জানা মানুষদের শিক্ষিত!
সংক্ষেপে, মেহনতি শ্রমজীবী মানুষ যদি ধর্ম-বর্ণ-জাতি-জাতপাতের উর্ধ্বে উঠে
আর্থিক মুদ্দার ওপর নিজেদের দাবি-দাওয়াকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে এক সদর্থক
যাত্রাপথ তৈরি হয়। বিহারের নির্বাচন এই এজেন্ডাকেই সদর্পে তুলে ধরেছে। তাই, আওয়াজ
উঠেছে: 3D – Dignity, Development, Democracy (মর্যাদা, উন্নয়ন,
গণতন্ত্র)। বিহারের লড়াইয়ের পথই আপাতত ভারতের পথ।