নতুন দশকের কথা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
২০২০ শুধু নতুন বছর নয় নতুন এক দশকের শুরু। এক সম্ভাব্য যুগান্তকারী দশক। ঠিক একশো বছর আগে এই দশকেরই শেষ পাদে শুরু হয়েছিল বিশ্বব্যাপী ভয়ঙ্কর মন্দা। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণনাশের মধ্য দিয়ে আবাহন করেছিল তথাকথিত উন্নয়ন অর্থনীতির। আমরা জানি, রেনেসাঁ পরবর্তী ইউরোপের একদিকে ছিল জ্ঞানবীক্ষার উন্মোচন অন্যদিকে অর্থ, সোনা, সম্পদের লোভে তাদের বিশ্ব জুড়ে দখলদারি, লুঠতরাজ ও উপনিবেশ স্থাপনের নির্দয় প্রয়াস। সেই সময়ের কালগর্ভ থেকেই আজকের বাস্তবতা।২০২০ তাহলে কী বার্তা নিয়ে আসছে? বাস্তবতা হল, প্রযুক্তির নির্মোহ আধিপত্যে বিশ্ব আজ এক নৈর্ব্যক্তিক বলয়ে বাঁধা পড়েছে। এর থেকে আপাতত নিস্তার নেই। দেশ কালের সীমানা অবান্তর হয়ে পড়ছে। ভার্চুয়াল বাস্তবতাই আজ অর্থনীতির নির্ধারক। রাজনীতির আঙ্গিনায় গত দশ বছরে বিশ্ব যদি দেখে থাকে প্রকৃতি বিদ্বেষী, বর্ণ বিদ্বেষী, অভিবাসন, শরণার্থী বিরোধী, ধর্মীয় বিভাজনের কাণ্ডারীদের ক্ষমতায় আরোহণ, তাহলে সদ্য পা দেওয়া নতুন দশক দেখবে এদের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ার করুণ পরিহাস। আসলে পুরনো রাজনীতির বাগাড়ম্বতা ফুরিয়ে আসার সময় হয়েছিল। পুরনো বামপন্থী, উদারবাদী, গণতন্ত্রী, মধ্যপন্থীদের ফুরিয়ে যাওয়াকে সাময়িক ভাবে স্থান পূরণ করেছে তথাকথিত দক্ষিণপন্থীরা। এ যেন প্রদীপের অগ্নিশিখার নির্বাপণের আগে ক্ষণিকের জ্বলে ওঠা।
সারা বিশ্ব জুড়ে মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এখন পথে। দিল্লির শাহিনবাগে রাত জাগছে মানুষ, সান্তিয়াগো থেকে হংকং, প্যারিস থেকে লেবানন সর্বত্রই এখন রাস্তার রাজনীতি। যা জানান দিচ্ছে রাজনীতিকদের অপ্রাসঙ্গিকতার কথা। নতুন নতুন দল, নতুন নেতা/নেত্রী চকিতে চলে আসছে জনমানসের সম্মুখ ভাগে। অর্থনীতির জগতেও ফুরচ্ছে স্থায়ী চাকরির জমানা। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ভর করে প্ল্যাটফর্ম ও শেয়ার অর্থনীতি দখল নিয়ে নিচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাঙ্গণ। ২০১৯'এ ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬৮ কোটি। নিজ উদ্যোগ ও সৃজনশীলতাই এখন কর্মের নতুন আঙ্গিক। পুরনো ঘরানার কাজ চলে যাচ্ছে, আসছে এই ধরনের নতুন কাজের পরিসর। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন উঠছে কাজের সময় ও আয় প্রাপ্তির কারণ-সম্পর্ক নিয়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি নির্মাণ করছে অধিক শ্রমব্যয়ে স্বল্প আয়ের অবধারিত অ্যালগরিদম? তাহলে আদতে কার ঘরে যাচ্ছে মুনাফার সিংভাগ? কেন ও কীভাবে বিশ্ব জুড়ে বাড়ছে এক অকল্পনীয় অর্থনৈতিক বৈষম্য? এই প্রশ্নগুলিকেই নতুন দশককে মোকাবিলা করতে হবে।
এরই সঙ্গে মুক্তি পাচ্ছে তারুণ্য। বিশ্বের অর্থনীতি যত নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠছে ততই খসছে পিছুটানের বিড়ম্বনা। ল্যাংটার আবার বাটপাড়ের ভয়! রাজনীতি বা তোষামদের ঘেরাটোপে বন্দী থাকার যন্ত্রণাও অতএব আর নেই। স্থায়ী চাকরি নেই তো কর্ম ও কর্মের অনুষঙ্গেরও বিধিনিষেধ নেই। রাজনীতির প্রাসাদ তাই টলমল।
তবে যাঁরা পড়ে থাকবেন আরও পিছনে তাঁরা কি ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের আওতায় এসে তবে বেঁচেবর্তে থাকবেন? ইউবিআই এখন কতটা বাস্তব? এইসব প্রশ্নও এই দশককে আলোড়িত করবে। ক্ষমতাধারী নিকৃষ্টরা মেক্সিকোর সীমান্তে সুউচ্চ পাঁচিল তোলার চেষ্টা করবে, অ্যামাজন অরণ্যে কর্পোরেট বাণিজ্যের লালসায় আগুন লাগাবে, স্বাধীনতার ৭২ বছর পর দেশের নাগরিকদের আবার লাইন দিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণ দিতে বাধ্য করতে চাইবে। এটা আসলে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার মরীয়া ও উদ্ভ্রান্ত প্রয়াস। কিন্তু গোটা বিশ্বে আর কোনও সীমান্ত নেই যে! তাই পারাপারের কোনও গল্পও নেই। বিশ্ব এখন মুঠোবন্দী। তার কন্দরেই রাজনীতি ও অর্থনীতি, তার লেনদেন, উত্থান-পতন, ভাব-ভালবাসা ও হিংসা-বিদ্বেষ। তবে এই ভুবনের এক বা একাধিক ঈশ্বর আছেন। তাকেই খুঁজে বেড়াবে ২০'এর দশক। এক নতুন দশক।
No comments:
Post a Comment