নতুন বছরে চিন্তাশুদ্ধি প্রয়োজন
সঞ্জয় মজুমদার
আমরা-ওরা নির্ভর রাজনৈতিক শক্তি কায়েম করে, নির্ভরতা দেওয়ার তুলনায় আতঙ্কিত করে রাখতে পারলে মুনাফা বেশি জোটে। ক্ষমতাও কুক্ষিগত হয়, আর হয় পৃথিবী জোড়া পরিবারতন্ত্রের বিষবৃক্ষের সমাহার। অথচ ইতিহাসের পাতা উল্টে মগজাস্ত্র খাটালে বোঝা যাবে, নেতা-মন্ত্রী ইত্যাদি লোকগুলো একটা সময়ে দেশের সাধারণ নাগরিকই ছিলেন। সাদাকালো, ভালোমন্দ মিশিয়ে দীর্ঘ লড়াই এবং আত্মত্যাগের পর নেতৃত্বের জায়গায় নিজেদের নিয়ে এসেছেন। একইভাবে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে থেকেও কেউ কখনও নেতৃত্বে আসতে পারেন এবং পরিস্থিতি যা তাতে রাজনীতিতে অভিজ্ঞতার সাথে তারুণ্যের মিশ্রণ খুব দরকার। ইচ্ছে থাকলে উপায়ও হয়ে যায়। শরীরের ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড মিলে, বাইরের বিশুদ্ধ বাতাস টেনে এনে, দূষিত রক্ত বিশুদ্ধ করে, সুস্থ্ সবল শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে চালু রাখে। শোধিত বীজ না হলে গাছও বাঁচে না। ঠিক তেমনই সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া নাগরিক লড়াই করে উপরের দিকে উঠে আসে। পরে আরও অর্থ বা ক্ষমতার সীমাহীন লোভে রাজনৈতিক মঞ্চকে আঁকড়ে ধরে। ফল? দূষিত রক্ত। কাজেই সমাজের শারীরবৃত্তীয় চক্র ঠিক রাখতে গেলে বিশুদ্ধ বাতাসের মতো, নতুন প্রজন্মের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। নাগরিক সমাজের ভেতর থেকেই নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে উঠে আসার প্রয়োজন আছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে অর্থনৈতিক শক্তি আর প্রযুক্তিই শেষ কথা বলবে। এটাই আগামীর বাস্তব। প্লাস্টিকের মতো অসুস্থ রাজনীতিকে চিহ্নিত করে ছুঁড়ে ফেলার সময় এসেছে। এ কাজ সরকার করে দেবে না। নাগরিকদেরই দায়িত্ব নিতে হবে, যার প্রাথমিক এবং আবশ্যিক শর্ত সততা, একাগ্রতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, উপস্থিত বুদ্ধি, একতা আর সংগঠন শক্তি। সাহস আর ইচ্ছে থাকলেই 'নেতা-নাগরিক-নেতা'র দুষ্ট চক্রটা 'নাগরিক-নেতা-নাগরিক'এর পুষ্ট চক্রে পরিবর্তন করা যায়।
নেতৃত্ব কি শুধু রাজনৈতিক হয়? সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, এটা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই বুঝেও বলছি, বাকি ক্ষেত্রগুলো, যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য-উদ্যোগ, শিল্প-সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ক্রীড়া ইত্যাদি বিভিন্ন 'স্কুল-অফ্ থটস্'এর মঞ্চ থেকেও নেতৃত্ব আসুক। নেতৃত্বের জন্ম হোক। ঘড়ির কাঁটা বলছে, পৃথিবীর তাবড় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শেষ পর্যন্ত কালজয়ী চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী। ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সংবিধান, পুলিশ-প্রশাসন, সেনাবাহিনী আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আস্ফালন করা, দাপট দেখানো, এটাই কি ক্ষমতা? হয়তো অনেকটাই। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। ভাবার সময় এসেছে। একটা বছর চলে গিয়ে আরেকটা বছর আসছে। ২০২০'তে আমরা হাতে চাঁদ পাব কিনা সেটা নির্ভর করবে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের উপর নয়, সবরকম সামাজিক ক্রিয়াকলাপে নাগরিকদের আরও বেশি অংশগ্রহণের উপর।
আর নাগরিকত্ব? এই বছর এবং বিগত বছরগুলিতে শরণার্থী, অনুপ্রবেশকারী কিংবা নাগরিক ইত্যাদি নিয়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে চলা বাক-বিতন্ডা, তর্ক-বিতর্ক, প্রতিবাদ-মিটিং-মিছিল থেকে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট, শুধু একটা আইন প্রণয়ন করার চেষ্টা করে নাগরিকত্বের সীমারেখা টানা মুশকিল। এই বিষয়ে গভীরভাবে ভাবনাচিন্তার অভাব থেকে গেছে। বাড়ির ছাদ-পাঁচিল-কার্নিশ দখল নিয়ে কাক-শালিক-চড়ুইদের আকাশসীমা দখল করার লড়াই, এপাড়া-ওপাড়া মিলিয়ে এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে, রাস্তার কুকুর-বেড়ালদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামেও নাগরিকত্ব হারানোর ভয় লুকিয়ে থাকে। এক বছর হয়ে গেলে ভাড়াটেও বাড়িওয়ালার কাছে চিরস্থায়ী নাগরিকত্বের আর্জি পেশ করেন। এগুলো সবই খুব স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক প্রত্যাশা। নাগরিকত্বের বিচারটা শুধু মানুষের ভেতরই সীমাবদ্ধ নয় এটা গোটা জীবজগতেই ছড়িয়ে আছে। সময়ের হাত ধরে একটু দীর্ঘকালীন সময় কোনও স্থানে বসবাস নাগরিকত্বের আশা জাগায়। আবার, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, এবং নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে একটা-না-একটা আইন মেরেকেটে করতেই হয়। এ বছরের অনেকটাই খাঁটি ভারতীয়ত্বের অগ্নিপরীক্ষার চাপে-তাপে কেটে গেল।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৯'এর রাত বারোটা পেরতে বেশি দেরি নেই। স্কুল-কলেজ-হোস্টেল, অফিস এমনকি পুলিশ আর সেনাবাহিনীতেও প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া কৃষকের আত্মহত্যা এখন সাধারণ ঘটনা। 'নিউ-ইয়ার-রেজোলিউশন' খায় না গায়ে মাখে বুঝিনা, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন হবে কিনা ভবিষ্যৎ বলবে কিন্তু নাগরিক হিসেবে নিজেদের চিন্তাভাবনার আশু সংশোধন প্রয়োজন এটা স্পষ্ট।
No comments:
Post a Comment