আগামী দিনে কাজ নেই?
সুভাষ দাস
মুরলিধর গার্লস কলেজের ছিমছাম-সুন্দর সভাঘরে দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে চলতে থাকা 'একক মাত্রা'র বিংশতি বর্ষ প্রথম সংখ্যা জুলাই ২০১৯'র আনুষ্ঠানিক প্রকাশ সভায় উপস্থিত থাকতে পেরে খুব খুশি হয়েছি। চিন্তা উদ্রেককারী অনেক কিছু জানতে পারলাম। দুবার চা, বিস্কুট ও কেক পরিবেশনও ভালো লেগেছে।
একক মাত্রা'র অন্যতম কার্যনির্বাহী সম্পাদক অরুণাভ বিশ্বাস ঘরোয়া অভিব্যক্তিতে যে ভাবে সভা পরিচালনা করলেন তার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই কলকাতার কার্জন পার্কে নাট্যকর্মী প্রবীর দত্তকে হত্যা করা হয়েছিল। এই দিনটিকে স্মরণ করলেন বিমল দেব। একক মাত্রা'র সুহৃদ বিজ্ঞানী তুষার চক্রবর্তী পত্রিকার দীর্ঘ পরিক্রমণ সম্পর্কে বললেন, 'একক মাত্রা' এক মাত্রিক নয়। একের মধ্যে বহু মাত্রা, নানা চিন্তাকে খোলামেলা, নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই চলার কঠিন সংকল্পে 'একক মাত্রা'র সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা বজায় থেকেছে। তারপর আমরা প্রবেশ করলাম মূল আলোচনায়।
এই সময়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় বিষয়: আগামী দিনে চাকরি নেই। আমরা উন্মুখ হয়েছিলাম। আলোচনার সঞ্চালক অমিত চৌধুরী মুখবন্ধে তাঁর বক্তব্য পেশ করে এই বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য বক্তাদের একে একে ডাকলেন।
আলোচনা শুরু করে কর্পোরেট জগতের পেশায় যুক্ত সুপর্ণ মৈত্র বললেন, পুঁজিপতিদের উদ্দেশ্য নয় চাকরি সৃষ্টি করা। তাঁদের লক্ষ্য মুনাফা। প্রধানত সেটাই তাদের চালিত করে। শিল্প পরিচালকদের অভিযোগ চাকরি আছে কিন্তু যোগ্য প্রার্থী পাচ্ছেন না। তাঁর আক্ষেপ, পড়াশোনার সিলেবাস যারা তৈরি করছেন তাঁরা নিশ্চিত বেতনের অধ্যাপক। তাঁরা বাইরের উথাল-পাতাল শিল্প-বাণিজ্যের জগতের খবর সম্বন্ধে তেমন ওয়াকিবহাল নন। তিনি এ কথাও মনে করালেন, মানুষের হাতে টাকা না থাকলে তাঁরা কীভাবে কিনবেন।
সংকটের এই জায়গায় পরের বক্তা সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্য বললেন, এখন সরকারি চাকরি ছাড়া বিরাট সংখ্যক মানুষের স্থায়ী চাকরি নেই। যেন ঠিকাদারি কাজ। কারও সপ্তাহে সাতদিনই কাজ। কারও রাত ১২টায় ডিউটি শেষ করে আবার ভোর ৩টে থেকে ডিউটি শুরু। চাকরি অস্থায়ী হলেও সংগঠিত সংস্থায় যে প্রফিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা আছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে বিরাট সংখ্যক মানুষ কাজ করছেন তাদের কোনও সুরক্ষা নেই। কৃষির বিশাল কর্মক্ষেত্র এখন ভয়ানক অনিশ্চিত। সামাজিক ন্যায়ের দিক তাঁকে খুব ভাবায়। স্বনিযুক্ত এই সব মানুষদের খাটনিতে যথাযথ আয়ের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ঝুঁকি থাকলে ভালো করে কাজ করার চাপ থাকাটা ভালো হলেও শেষ পর্যন্ত তাদেরও ভালো যাতে হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের লোকদের কাজের ব্যবস্থা খুব দরকার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এলে চাকরির বাজার ভয়ানক সংকুচিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
এই আশঙ্কা নিয়ে পরবর্তী আলোচক অর্থনীতি ও ক্ষেত্র-গবেষণা জগতের অচিন চক্রবর্তী বললেন: আইটি-র জন্য ভারতের বেশির ভাগ লোকের কাজ যাবে না। ভারতে বেকারত্ব মাত্র ৬.২ শতাংশ। কারণ, বেশিরভাগ লোকের কাজ না করে উপায় নেই। তাই কিছু না কিছু করছে। সরকারি হিসাবে বছরে কেউ ১৮৩ দিন কাজ করলে তিনি বেকার নন। ভারতে মাত্র দেড় কোটির মতো ব্যক্তি সরকারি কাজে যুক্ত। চাকরির নিশ্চয়তা থেকে আয়ের নিশ্চয়তা সরকারকে করতে হবে। সামাজিক দিককে গুরুত্ব দিতে হবে টেকনোলজি দ্বারা তাড়িত না হয়ে।
এই টেকনোলজিকে গুরুত্ব দিয়ে একক মাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অনিন্দ্য ভট্টাচার্য বললেন: কী হারে কাজ যাচ্ছে আর কী হারে কাজ হচ্ছে তা বিচার করতে হবে। তিনি বললেন, দশম ক্লাসের থেকে কম পড়াশোনা করেছেন এমন লোকজনদের মধ্যে বেকারত্ব ১.২ শতাংশ, আবার গ্রাজুয়েট ও তার উর্ধ্বযোগ্যতা সম্পন্নদের মধ্যে বেকারত্ব ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ, যত বেশি যোগ্যতা তত চাকরি পাওয়ার সম্ভবনা কম। টেকনোলজির কারণে কাজ যেমন যাচ্ছে আবার নতুন কাজও তৈরি হচ্ছে। অ্যামাজনের বাজার বিশ্বব্যাপী। সেনাবাহিনী ও যুদ্ধের অস্ত্র তৈরিতে বেশি মানুষ কাজ করেন। অ্যাপেল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, ফেসবুক'এর মতো সংস্থায় লাভের হার বেশি অথচ কর্মী কম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসার ফলে মানুষ ছাড়াই এখন মেশিন কাজ করবে। এখনও জাপান, আমেরিকা, রাশিয়া থেকে ভারতে সরকারি চাকুরে বেশি। বৃহত্তর সামাজিক দিকের কথা ভাবলে ১০০ দিনের কাজের মতো আংশিক নয়, অন্তত সুস্থভাবে বাঁচার জন্য সকলকে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম সুনিশ্চিত করতে হবে। যথার্থ গণতন্ত্রের মধ্যে তা করা যেতে পারে।
শ্রোতাদের নানা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সঞ্চালক অমিত চৌধুরী আলোচনার ইতি টানেন।
No comments:
Post a Comment