Tuesday, 30 July 2019

সুলুক সন্ধান


 আধুনিক অর্থনীতির ভুবনে
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

(এই নিবন্ধটি লেখকের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ 'আশায় বাঁচে চাষা'র সামান্য অংশবিশেষ। গ্রন্থটি আধুনিক অর্থনীতির নিউরাল নেটওয়ার্ক'কে ধরার একটি চেষ্টা।)

উনিশ শতকের ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্র ছাড়িয়ে বিশ ও একবিংশ শতকে আমরা এমন সব পণ্য-ভুবনে প্রবেশ করেছি, যা সেইসব যুগে প্রায় অকল্পনীয় ছিল। এর মধ্যে প্রধান দুটি ক্ষেত্র হল: বিনোদনের দুনিয়া ও বিজ্ঞাপনের জগৎ বিনোদনের জগতে চলচ্চিত্র শিল্প ও খেলাধুলোর দুনিয়া অর্থনীতিতে এক বিশাল জায়গা জুড়ে দখল পেল। চলচ্চিত্র ও খেলাধুলোর আয়োজনগুলি পণ্য-বাণিজ্যে এক মহাসাম্রাজ্য সৃষ্টি করল। সকলেই জানি, বিনোদনের আকর্ষণ সবসময়েই তীব্র। সেই গুণাবলীর জন্য এই জগৎ ছুঁয়ে ফেলল মুনাফার উচ্চ শিখর। কিন্তু এ তো আর কারখানার মতো নির্দিষ্ট কাঠামোভিত্তিক উৎপাদন-প্রসূত পণ্য নয়! তাহলে কীভাবে এখানে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হচ্ছে? তার পণ্যের ধরনটাই বা কেমন? 

ধরুন, একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা। কোনও প্রযোজক বা সংস্থা পুঁজি বিনিয়োগ করল একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেঅভিনেতা, টেকনিশিয়ান, ক্যামেরাম্যান, সঙ্গীত পরিচালক, সম্পাদক প্রভৃতি – সব মিলিয়ে বেশ কিছু মানুষ নিয়োজিত হলেন এ কাজে। কিন্তু তাঁদের নির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক দৈনন্দিন বাঁধাধরা কাজের বয়ান নেই। চুক্তির ভিত্তিতে তাঁরা শ্রমঘন্টা ব্যয় করেন, মূল অভিমুখটা থাকে তাঁদের নির্দিষ্ট কর্মফল প্রযোজকের হাতে তুলে দেওয়ার। এই টুকরো টুকরো কর্মফল বা পণ্যগুলিকে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক বস্তু-অবয়বে প্রত্যক্ষ করা যায় না। এগুলো সবটাই কাঁটাছেড়ার মধ্য দিয়ে জায়গা করে নেয় মূল ছবিটির কন্দরে। আমরা যখন নির্মিত ছবিটি কোনও হলে বা অন্যত্র দেখি, তার মধ্যেই বিন্যস্ত হয়ে থাকে সমস্ত শ্রমের ফসলগুলি। সকলে মিলে যে শ্রম দিলেন, তার বিনিময়ে তাঁরা মজুরি পেলেন, আর সৃষ্টি করলেন উদ্বৃত্ত মূল্যও, যা বাজারে এসে প্রযোজকের মুনাফায় রূপান্তরিত হয়। এই মুনাফায় রূপান্তর নির্ভর করে ছবিটি কতবার কতজন প্রত্যক্ষ করলেন তার ওপর। কারণ, ক্রেতারা (এখানে দর্শক) বিনিময় মূল্য দিয়েই ছবিটি দেখেন আর সেই মূল্যের পরিমাণের ওপরই নির্ভর করে প্রযোজকের মুনাফার বহর। কিন্তু এখানে খানিক ব্যতিক্রম আছে। ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, একটি শ্রম প্রক্রিয়ায় একই সময়ে এক ধরনেরই অযূত পণ্য নির্মিত হয়। যেমন ধরুন, একই দিনে একই ধরনের এক হাজার পিস জুতো বা মোবাইল সেট তৈরি হল। সেই প্রত্যেকটি পণ্যের মধ্যেই উদ্বৃত্ত মূল্য অন্তরস্থ হয়ে থাকে, যা বাজারে এসে বিনিময় মূল্যের নিরিখে মুনাফায় পরিণতি পায়। কিন্তু একটি ছবি তো একটি মাত্রই পণ্য; এই অর্থে যে এখানে একই সময়ে প্রযোজকের বিনিয়োজিত পুঁজিতে শ্রমব্যয় করে অযূত ছবি নির্মিত হয় না। একটা সময়ে একটিই মাত্র ছবি তৈরি হয়, যার অবশ্য অনেকগুলি কপি হতে পারেবুঝে দেখুন, নির্দিষ্ট চলচ্চিত্রটিতে যারা শ্রম দিচ্ছেন তাঁরা কিন্তু সেই সময়ে একটি মাত্রই পণ্য তৈরি করছেন (মূল ছবিটি), পরে কোনও টেকনিশিয়ান তার অনেকগুলি কপি বানাচ্ছেন (আগে ছিল রিল, এখন ডিজিটাল ফরম্যাট)। আর এই ছবিটিই যুগ যুগ ধরে চলছে বা চলতে পারে। 

একটি জুতো বা মোবাইল সেট অথবা একটি জামা ক্রেতার নিজস্ব সম্পত্তি যা তাঁর ব্যবহার ও ইচ্ছা বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পর বাতিল হয়ে যায়, ফলে, আবারও দরকার পড়ে আরেকটি জুতো বা জামার। কিন্তু একটি ছবি কোনও ক্রেতার নিজস্ব সম্পত্তি নয় বা তার চূড়ান্ত ক্ষয়ও নেই। তা আবারও বাজারে আসতে পারে, যতবার বাজারে আসে চলতে পারে, চললে প্রযোজকের ঘরে মুনাফা যায়। এই ছবি নির্মাণে যারা যারা কাজ করেন, তাঁদের মজুরি বা মূল্যমানও ভিন্ন। অভিনেতা একরকমের অর্থ পান তো সম্পাদক বা টেকনিশিয়ান আরেকরকম। আর এও জানা সকলের, অভিনেতাদেরও পারিশ্রমিক ভিন্ন ভিন্ন, যা তাঁদের বাজারে কদরের ওপর নির্ভর করে। মোদ্দা বিষয়টা হল, চিরাচরিত ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে যে ভাবে পণ্যে মূল্যযোগ হয় ও বাজারে গিয়ে মুনাফায় রূপান্তর পায় তা বিনোদন জগতে ভিন্ন আঙ্গিকে সাধিত হয়; কিন্তু মূল্যযোগ ও উদ্বৃত্ত মূল্যের আহরণ প্রক্রিয়াকে বাদ দিয়ে নয়। এই বিষয়টিকে মাথায় রাখলে আধুনিক অর্থনীতির ভুবনকে চিনতে কোনও অসুবিধা হওয়ারই কথা নয়। 


একই কথা খেলাধুলোর জগতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আগে খেলাধুলো ছিল নিছক বিনোদন ও ইচ্ছানির্ভর বা ভাল লাগা এক মানবিক গুণ হিসেবে। খেলাধুলোয় সম্পূর্ণ বাণিজ্য এসেছে অনেক পরে। ভাল খেললে বা কোনও টুর্নামেন্টে পুরস্কার পেলে স্থানীয় প্রশাসন বা পাড়া অথবা সরকার থেকেও স্বীকৃতি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল অনেকদিনের, যা পরে বহু ক্ষেত্রে চাকরি দেওয়া অবধি গড়িয়েছে। কিন্তু কোনও খেলা বা খেলোয়াড় চুক্তির ভিত্তিতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনও ক্লাব বা টুর্নামেন্টে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে, এই প্রবণতা বেশি দিনের নয়। আর এটা হওয়াটাই ভবিতব্য ছিল। কারণ, পুঁজির স্বভাবই হল, যা যা এখনও অর্থ-বিনিময় ও মুনাফার নিগড়ে ধরা পড়েনি তাদের ধরতে হবে। কারণ, নতুন নতুন পরিসরগুলিতেই পাওয়া যায় মুনাফার উচ্চ হার। এখানেও সেই প্রযুক্তি তৈরি করে দেয় উপযুক্ত ভূমি। মূলত টেলিভিশন আসার সঙ্গেই খেলাধুলোর জগতে ব্র্যান্ডিং ও বাণিজ্য ভিত্তিক অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। কারণ, টেলিভিশন হল সেই প্রযুক্তি যা যে কোনও দ্রষ্টব্যকে একইসঙ্গে বহুজনের সামনে হাজির করতে পারে। কোথাও কোথাও রেডিও’ও কিছু জনপ্রিয় খেলাধুলোর ক্ষেত্রে শ্রবণের মাধ্যমে বহুজনের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছে। তথ্য বলছে, প্রথমে এই বাণিজ্য আসে স্পনসরশিপ ও খেলাধুলোকে বাজারের একটি প্রকরণ হিসেবে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। গত শতকের সত্তরের দশকেই এর প্রাবল্যের শুরু। ১৯৮৪ সালে লস এঞ্জেলেস অলিম্পিক্সের সংগঠকেরা এই বাবদ ২০ কোটি মার্কিন ডলারের মতো মুনাফা করে। ইতিমধ্যে এইসব সংগঠকেরা বুঝে গেছেন, আধুনিক অলিম্পিকগুলিকে যদি বাণিজ্যের আওতায় আনা যায় তাহলে কর্পোরেট স্পন্সররা প্রায় ১৫৬টি দেশের ২৫০ কোটি লোকের নাগাল পেয়ে যেতে পারেন। এই যখন টাকা ও বাণিজ্য ব্যাপ্তির বহর তখন স্বাভাবিক গোটা খেলাধুলোর জগতের এই ডোরে বাঁধা পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাই, শুধু খেলার সরঞ্জাম বিক্রি করা নয়, বা খেলার মাধ্যমে কর্পোরেট দুনিয়ার পণ্যগুলিকে জনপ্রিয় করাই নয়, খেলা ও খেলোয়ারদেরও এমন মূল্য নির্মাণ করতে হবে যাতে তাঁরা আরও বেশি বিনোদন-দায়ক ও চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠতে পারেন। তা করতে গেলে, যেমন খেলায় আরও পেশাদারিত্ব ও আঙ্গিকে বিবিধ পরিবর্তন আনতে হবে, পাশাপাশি খেলোয়ারদের হতে হবে সর্বক্ষণের কর্মী-খেলোয়ার। এই খেলোয়াররাই এখানে কুশীলব, যাঁদের দক্ষতা, শ্রম, দম ও লড়াকু মেজাজের ওপরই খেলাধুলোর বাণিজ্য নির্ভর করে থাকবে। এইভাবে খেলাধুলো হয়ে গেল এক পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য বিশেষ, যেখানে খেলোয়ারদের থেকে উদ্বৃত্ত মুল্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া চালু হল ও বাজারে গিয়ে তা মুনাফায় রূপ পেল। 

কিন্তু চলচ্চিত্রের মতো এখানেও খেলোয়ারেরা নির্দিষ্ট কাঠামোভিত্তিক শ্রম দেন না, বরং, সারা বছর ধরে ২৪x৭ তাঁদের গোটা কর্মজীবনটাই নিরন্তর শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকেকারণ, খেলায় শুধু খেললে হয় না, অনুশীলনের দরকার আছে, টিমের সঙ্গে মানসিক সংযোগ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া আছে, খাওয়াদাওয়ার নিয়ম ও আচারবিধি আছে, অন্যান্য স্বাস্থ্যমুলক ব্যবস্থাদি গ্রহণেরও ব্যাপার আছে – সব মিলিয়ে এ এক লাগাতার কর্মপ্রক্রিয়া ও অবশ্যই পুঁজি-নির্ভর এর জন্য তাঁরা যে অর্থ পান (বা মজুরি) চুক্তির ভিত্তিতে, তার মূল্য অত্যন্ত বেশি (অনেক ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য), কিন্তু তার বিনিময়ে তাঁরা যে বাজারে ‘খেলতে-থাকা’ পণ্য হিসেবে নিবেদিত হন তা আরও বেশি মূল্য দিতে প্রস্তুত। এই বাড়তি মূল্যটা সম্ভব হয়েছিল টিভির আগমনে এক বিশাল দর্শক-বাজারের উদ্ভবের ফলে, এখন তো স্মার্ট ফোনের দৌলতে তা আরও প্রসারিত। অতএব, তাঁরা নিজেদের প্রস্তুতি ও আসল খেলার দিনে নিজেদের খেলার বৈভব ও রূপ দেখিয়ে যে সামগ্রিক ‘খেলাটি’র মূল্য তৈরি করেন তা তাঁদের প্রাপ্য মূল্যের থেকে অনেক বেশি। এই বাড়তি মূল্যটা চলে যায় কর্পোরেট মালিক বা আয়োজকদের পকেটে। এখানে বিক্রিত পণ্যটি হল, যদি ধরা যায় একটি ফুটবল ম্যাচের কথা, ৯০-মিনিটের একটি সময় যা ক্রেতার চেতনে, মননে নানান ভাব ও আবেগ নির্মাণ করে; সেই তার ব্যবহারিক মূল্য। এর আরও নানান দিক আছে, সে আলোচনা করতে গেলে আমাদের বিষয়ান্তরে যেতে হবে। এখানে শুধু আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছি, পুঁজি কীভাবে মুনাফার খোঁজে প্রযুক্তির সহায়তায় খেলাধুলোর জগৎকেও নিজের অঙ্গীভূত করে নেয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে মনে আসছে, ১৯৭৭ সালে শুরু হওয়া কেরি প্যাকারের একদিনের ক্রিকেট ম্যাচের কথা। (চলবে)।

Monday, 22 July 2019

যাত্রাপথে

আগামী দিনে কাজ নেই?
সুভাষ দাস


মুরলিধর গার্লস কলেজের ছিমছাম-সুন্দর সভাঘরে দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে চলতে থাকা 'একক মাত্রা'র বিংশতি বর্ষ প্রথম সংখ্যা  জুলাই ২০১৯'র আনুষ্ঠানিক প্রকাশ সভায় উপস্থিত থাকতে পেরে খুব খুশি হয়েছি। চিন্তা উদ্রেককারী অনেক কিছু জানতে পারলাম। দুবার চা, বিস্কুট ও কেক পরিবেশনও ভালো লেগেছে।
 একক মাত্রা'র অন্যতম কার্যনির্বাহী সম্পাদক অরুণাভ বিশ্বাস ঘরোয়া অভিব্যক্তিতে যে ভাবে সভা পরিচালনা করলেন তার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই কলকাতার কার্জন পার্কে নাট্যকর্মী প্রবীর দত্তকে হত্যা করা হয়েছিল। এই দিনটিকে স্মরণ করলেন বিমল দেব। একক মাত্রা'র সুহৃদ বিজ্ঞানী তুষার চক্রবর্তী পত্রিকার দীর্ঘ পরিক্রমণ সম্পর্কে বললেন, 'একক মাত্রা' এক মাত্রিক নয়। একের মধ্যে বহু মাত্রা, নানা চিন্তাকে খোলামেলা, নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই  চলার কঠিন সংকল্পে 'একক মাত্রা'র সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা বজায় থেকেছে। তারপর আমরা প্রবেশ করলাম মূল আলোচনায়।
 এই সময়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় বিষয়: আগামী দিনে চাকরি নেই। আমরা উন্মুখ হয়েছিলাম। আলোচনার সঞ্চালক অমিত চৌধুরী মুখবন্ধে তাঁর বক্তব্য পেশ করে এই বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য বক্তাদের একে একে ডাকলেন।
 আলোচনা শুরু করে কর্পোরেট জগতের পেশায় যুক্ত সুপর্ণ মৈত্র বললেন, পুঁজিপতিদের উদ্দেশ্য নয় চাকরি সৃষ্টি করা। তাঁদের লক্ষ্য মুনাফা। প্রধানত সেটাই তাদের চালিত করে। শিল্প পরিচালকদের অভিযোগ চাকরি আছে কিন্তু যোগ্য প্রার্থী পাচ্ছেন না। তাঁর আক্ষেপ, পড়াশোনার সিলেবাস যারা তৈরি করছেন তাঁরা নিশ্চিত বেতনের অধ্যাপক। তাঁরা বাইরের উথাল-পাতাল শিল্প-বাণিজ্যের জগতের খবর সম্বন্ধে তেমন ওয়াকিবহাল নন। তিনি এ কথাও মনে করালেন, মানুষের হাতে টাকা না থাকলে তাঁরা কীভাবে কিনবেন।

সংকটের এই জায়গায় পরের বক্তা সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্য বললেন, এখন সরকারি চাকরি ছাড়া বিরাট সংখ্যক মানুষের স্থায়ী চাকরি নেই। যেন ঠিকাদারি কাজ। কারও সপ্তাহে সাতদিনই কাজ। কারও রাত ১২টায় ডিউটি শেষ করে আবার ভোর ৩টে থেকে ডিউটি শুরু। চাকরি অস্থায়ী হলেও সংগঠিত সংস্থায় যে প্রফিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা আছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে বিরাট সংখ্যক মানুষ কাজ করছেন তাদের কোনও সুরক্ষা নেই। কৃষির বিশাল কর্মক্ষেত্র এখন ভয়ানক অনিশ্চিত। সামাজিক ন্যায়ের দিক তাঁকে খুব ভাবায়। স্বনিযুক্ত এই সব মানুষদের খাটনিতে যথাযথ আয়ের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ঝুঁকি থাকলে ভালো করে কাজ করার চাপ থাকাটা ভালো হলেও শেষ পর্যন্ত তাদেরও ভালো যাতে হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের লোকদের কাজের ব্যবস্থা খুব দরকার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এলে চাকরির বাজার ভয়ানক সংকুচিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

এই আশঙ্কা নিয়ে পরবর্তী আলোচক অর্থনীতি ও ক্ষেত্র-গবেষণা জগতের অচিন চক্রবর্তী বললেন: আইটি-র জন্য ভারতের বেশির ভাগ লোকের কাজ যাবে না। ভারতে বেকারত্ব মাত্র ৬.২ শতাংশ। কারণ, বেশিরভাগ লোকের কাজ না করে উপায় নেই। তাই কিছু না কিছু করছে। সরকারি হিসাবে বছরে কেউ ১৮৩ দিন কাজ করলে তিনি বেকার নন। ভারতে মাত্র দেড় কোটির মতো ব্যক্তি সরকারি কাজে যুক্ত। চাকরির নিশ্চয়তা থেকে আয়ের নিশ্চয়তা সরকারকে করতে হবে। সামাজিক দিককে গুরুত্ব দিতে হবে টেকনোলজি দ্বারা তাড়িত না হয়ে।

এই টেকনোলজিকে গুরুত্ব দিয়ে  একক মাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অনিন্দ্য ভট্টাচার্য বললেন: কী হারে কাজ যাচ্ছে আর কী হারে কাজ হচ্ছে তা বিচার করতে হবে। তিনি বললেন, দশম ক্লাসের থেকে কম পড়াশোনা করেছেন এমন লোকজনদের মধ্যে বেকারত্ব ১.২ শতাংশ, আবার গ্রাজুয়েট ও তার উর্ধ্বযোগ্যতা সম্পন্নদের মধ্যে বেকারত্ব ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ, যত বেশি যোগ্যতা তত চাকরি পাওয়ার সম্ভবনা কম। টেকনোলজির কারণে কাজ যেমন যাচ্ছে আবার নতুন কাজও তৈরি হচ্ছে। অ্যামাজনের বাজার বিশ্বব্যাপী। সেনাবাহিনী ও যুদ্ধের অস্ত্র তৈরিতে বেশি মানুষ কাজ করেন। অ্যাপেল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, ফেসবুক'এর মতো সংস্থায় লাভের হার বেশি অথচ কর্মী কম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসার ফলে মানুষ ছাড়াই এখন মেশিন কাজ করবে। এখনও জাপান, আমেরিকা, রাশিয়া থেকে ভারতে সরকারি চাকুরে বেশি। বৃহত্তর সামাজিক দিকের কথা ভাবলে ১০০ দিনের কাজের মতো আংশিক  নয়, অন্তত সুস্থভাবে বাঁচার জন্য সকলকে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম সুনিশ্চিত করতে হবে। যথার্থ গণতন্ত্রের মধ্যে তা করা যেতে পারে।

শ্রোতাদের নানা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সঞ্চালক অমিত চৌধুরী আলোচনার ইতি টানেন।

Tuesday, 16 July 2019

বিশ্ব যখন এক দেশ!

স্টার্ট-আপ'ই কি ভবিষ্যৎ?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
গত এক দশক ধরে আমরা শুনে আসছি সোশ্যাল মিডিয়ার কথা। আমরা ক্রিপটোকারেন্সির কথাও শুনেছি, যেমন বিটকয়েন, ইদানীং লিবরা। এবার ভেসে উঠছে 'সোশ্যাল মানি' বা সামাজিক মুদ্রা'র প্রসঙ্গ। অর্থাৎ, স্থানীয় ও মুক্ত ডিজিটাল কারেন্সিতে ভরে উঠবে দুনিয়াদারি। ফেসবুকের 'লিবরা'র প্রভাব কী ও কতটা পড়বে (যদিও পেপাল, অ্যামাজন, মাস্টারকার্ড এরা 'লিবরা' ব্যবহারে সম্মতি জানিয়েছে) তা এখনও পুরোপুরি চর্চার বিষয় হয়ে ওঠেনি কিন্তু স্থানীয় কিছু কারেন্সি ইতিমধ্যেই অর্থনীতির আঞ্চলিক অলিগলিতে চলমান হয়ে উঠেছে ও তার সামগ্রিক প্রভাব কী পড়তে চলেছে তা সকলকেই রীতিমতো ভাবাচ্ছে। যেমন, জার্মানিতে 'chiemgauer' বা জাপানে 'fureai kippu'এর মতো স্থানীয় মুদ্রা ইতিমধ্যেই নানান সামাজিক লেনদেনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভার্চুয়াল মিডিয়ায় এমন মুক্ত মুদ্রা জনপ্রিয় হয়ে উঠলে তা আলাদা ধরনের বিকেন্দ্রিকৃত অর্থনীতির জন্ম দেবে কিনা সেই আলোচনাই এখন সকলকে ব্যস্ত রেখেছে। কেউ কেউ এর মধ্যে গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্রের উপাদানও দেখতে পাচ্ছেন।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, চলমান অর্থনীতির এক নতুন গুণগত নির্মাণ অবশ্যম্ভাবী। অর্থনীতির কর্মপ্রক্রিয়া যত বেশি ডিজিটাল ও সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে ততই সে সহজে ধারণ করছে এক বিস্তৃত জনরাশিকেও। তার সঙ্গে প্রযুক্তির  অবিশ্বাস্য গতি ও উল্লম্ফন ভেঙ্গে ফেলছে এক দেশ-আমলা-নেতার ক্ষমতার সীমানা। অতি সম্প্রতি, আমেরিকার ফেডারেল ট্রেড কমিশন ফেসবুককে ৫ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছে তাদের ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহারের কারণে। যা আমেরিকার মাটিতে এ তাবৎ সব থেকে বড় জরিমানা। নেটগুরুদের কাছে রাজনৈতিক শাসকদের একচেটিয়া ক্ষমতার অবসানের আশঙ্কায় এই শাস্তি প্রদান কিনা সে কথাও উঠছে। কারণ, নজরদারি ও ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণের অভিযোগ তো সব থেকে বেশি ওঠে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই। তবে এ কথাও স্বীকার্য, নেট দুনিয়ায় দৈত্যকায় কর্পোরেটকুল মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে কম নয়ছয় করেনি। একদিকে রাষ্ট্র অপরদিকে নেট দৈত্য- এই দুইয়ের টানাপোড়েনে এমন কৌশল কি অর্জন করা সম্ভব যেখানে এই বিশাল ভার্চুয়াল দুনিয়ায় কার্যকরী সামাজিক কোনও উদ্যোগ বাস্তবায়িত হতে পারে? সেখানেই সোশ্যাল মানি'র প্রাসঙ্গিকতা। কারণ, মুদ্রা যদি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে অবাধে ঘোরাঘুরি করে তবে তা অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিকে উল্টে দিতে সক্ষম। তেমন তেমন হবে কিনা সেও এখন চর্চার বিষয়। অতএব এই বাড়তি প্রশ্নও উঠছে, সোশ্যাল মিডিয়া, সোশ্যাল মানির জগৎ ছুঁয়ে আমরা কি অচিরেই প্রবেশ করতে চলেছি সোশ্যাল ইনিশিয়েটিভের এক পরিসরে? কী এই 'সোশ্যাল ইনিশিয়েটিভ' বা সামাজিক উদ্যোগ? তা হল এমন এক সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিসর যেখানে অর্থনীতির বহুবিধ সম্ভাবনাগুলি সকলের কাছে উন্মুক্ত হচ্ছে ও যে যেভাবে সক্ষম নিজ নিজ গুণে ও চয়নে একেকটা কাজের বিন্দুকে ধরে উপার্জনক্ষম হয়ে উঠছেন। ফলত, একেকটা নতুন কর্মভূমি যেন প্রত্যহ আপন খেয়ালেই সৃষ্ট হয়ে চলেছে। যেন, এক 'augmented reality' আপনার সামনে মূর্ত হয়ে উঠছে কার্যকারণের সম্ভাবনা নিয়ে। এই মুহূর্তে কেউ কি জানেন, ব্লকচেন প্রযুক্তিতে পারদর্শী কতজন মানব সম্পদের অসম্ভব প্রয়োজন? অথচ, প্রথাগত স্বীকৃত শিক্ষায়তনগুলি বিস্তৃত ভাবে ব্লকচেন পড়াচ্ছে এমন একটিও সম্ভবত এ দেশে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ব্লকচেন জানা কিছু লোকজন তো পাওয়াও যাচ্ছে! তারা আসছে কোথা থেকে? কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান এইসব নিয়ে ক্লাস চালু করেছে বটে কিন্তু তা কতটা কার্যকরী হয়ে উঠতে পেরেছে তা নিয়ে সন্দিহান থাকারও যথেষ্ট কারণ আছে বলে অনুমান। তাই খতিয়ে দেখা এই যে, আজকের প্রয়োজনীয় কুশলী মানবসম্পদ শিক্ষায়তনের বাইরেই স্বশিক্ষায় তৈরি হচ্ছে নানাবিধ উপায়ে। আর নতুন কর্মোদ্যোগগুলি এইসব রসদ নিয়ে কাজ করতে করতেই আরও শিক্ষিত ও দক্ষ হয়ে উঠছে। তার সঙ্গে ক্রমপ্রসারিত সামাজিক উদ্যোগের পরিসর এই সমস্ত বাস্তবতাকে আক্ষরিক অর্থে রূপ দিয়ে চলেছে। অর্থাৎ, স্বপাঠ ও স্বশিক্ষাও আজকের বাস্তব কর্মজগতে অবশ্যম্ভাবী উপাদান হয়ে উঠেছে।

এই প্রেক্ষিতে দুনিয়া জুড়েই 'স্টার্ট আপ' এখন এমন একটি উদ্যোগ ও কর্মবাসনা যা নিকট ভবিষ্যতে অর্থনীতির ভুবনকে ছেয়ে ফেলবে তার প্রগাঢ় অস্তিত্ব ও বাস্তবতায়। যত যা কিছু প্ল্যাটফর্ম বা অ্যাপ, সবই আজ শেষ বিচারে এক 'সামাজিক বাজার'এর অবয়ব পেয়েছে যেখানে বহু বহু সংখ্যক মানুষ পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু তৈরি করে নিতে পারছে। দেশ, কাল, ভাষার সীমানা ছাড়িয়ে সমস্ত যোগাযোগ ও লেনদেন এখন আয়াসসাধ্য। তার সঙ্গে 'সোশ্যাল মানি' ও 'সোশ্যাল ইনিশিয়েটিভ'এর যুগলবন্দীতে অর্থনীতির অবয়ব কোথায় গিয়ে কীভাবে দাঁড়াবে তাই এখন চিন্তকদের ধন্দে রেখেছে। তবে, অ্যামাজন, ফেবুক, গুগল'এর মতো অতিকায় ভার্চুয়াল কর্পোরেট দৈত্যরা এই সামাজিক উদ্যোগের পরিসরকে শেষাবধি নিয়ন্ত্রণ করে চলবে কিনা, সেও এক অমূল্য প্রশ্ন।


Monday, 15 July 2019

পড়ার খিদে

'একক মাত্রা' ও আমি
সঞ্জয় মজুমদার
 
'একক মাত্রা'র সাথে চাক্ষুষ পরিচয় বেশ কয়েক বছরের। অলস মধ্যাহ্নে কলকাতা বইমেলায়, বৌদ্ধিক জগতের মণি-মাণিক্যের খোঁজে আমি আর সুনেত্রা (আমার কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক) ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কখন যে লিটল ম্যাগাজিন হাটে আমাদের পা চলে এসেছে খেয়াল করিনি। প্রতিটা টেবিল উৎসাহ নিয়ে দেখতে দেখতে 'একক মাত্রা' নামটায় চোখ আটকে গেল। সুনেত্রা বলল, তুই এই পত্রিকা আমাদের কলেজে দেখেছিস, বেশ দু-তিন জন গ্রাহক আছে আমাদের। যাই হোক, একটা সংখ্যা তুলে নিয়ে বেশ খানিকটা পড়েই ফেললাম। এবার চোখের সাথে মনটাও আটকে গেল। বেশ কিছু সংখ্যার বিষয় নির্বাচনের অভিনবত্বে মনটা ছ্যাঁকাও খেল। আর বেশি কিছু ভাবলাম না। টেবিলের ওপারে লক্ষ করলাম এক ভদ্রলোক ভীষণ ঘেমেনেয়ে, 'দেখাশোনা ফ্রি, কেনাকাটা নিজস্ব ব্যাপার' গোছের হাবভাব নিয়ে বসে আছেন। ঠিক বসে নেই, খবরের কাগজের ঠোঙায় একগাদা শুকনো মুড়ি আর তার থেকেও বেশি তেলেভাজা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। চোখাচোখি হতেই ঘাম, মুড়ি, তেলেভাজা সব ভুলে, পরম উৎসাহে, কোন সংখ্যাটি নেওয়া উচিত, কেন নেওয়া উচিত, এই নিয়ে বিস্তারিত বলতে লাগলেন। কথা বলার ধরনে একটা অনায়াস অনাড়ম্বর ঝকঝকে মনোভাব পরিষ্কার ধরা পড়ল।  অনেকদিন পরে জানতে পেরেছিলাম এনার নাম অনিন্দ্য ভট্টাচার্য। তারপর গ্রাহক থেকে আজীবন গ্রাহকে উত্তরণের মাঝে অনেকটা সময় কেটে গেল। পাঠক হিসেবে পত্রিকার সাথে যোগাযোগের মাত্রা বাড়তে লাগল। এরপর একে একে, 'একক মাত্রা' হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সদস্য, শনিবারের হাট এবং মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠানে নিয়মিত হাজিরা। এই ছিল আমার 'একক মাত্রা'র সাথে শুরুর কথা।

প্রথম পরিচ্ছেদে শুরুর কথা হলে, মাঝের কথাটাও বলা দরকার। গ্রাহক তো হলাম, কিন্তু 'একক মাত্রা'র সাথে বইমেলায় প্রথম দর্শনে প্রেমের পর, উৎসাহ কি বজায় থাকল? অর্থাৎ, আমি কি 'একক মাত্রা'র প্রতিটি সংখ্যায় পত্রিকা কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রকাশিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক রচনার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারলাম? আরও স্পষ্ট করে বললে, সঞ্জয় মজুমদার কি 'একক মাত্রা'য় প্রকাশিত সংখ্যাগুলি সময় করে, মন দিয়ে পড়ার ধৈর্য দেখাতে পারল? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো নিজের কাছে যথাযথ না পেলে একটা পত্রিকার প্রতি সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না।

আমার নিজের ক্ষেত্রে এই মূল্যায়ন সঠিকভাবে করতে গেলে, অন্তত ছেলেবেলায় আমাকে ফিরতেই হবে। সেই সময়ে খবরের কাগজ, বই, বইয়ের মধ্যে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা এসব নিয়মিত পড়ার অভ্যাস যে আমার ছিল, তেমনটা নয়। কিন্তু অভ্যাসটা তৈরি হয়েছিল, আর সেটা হয়েছিল আমার মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। আমাদের দুই ভাই-বোনকে দুই পাশে রেখে মা পড়ছেন, আবেগ দিয়ে পড়ে চলেছেন  বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটদের রামায়ণ, মহাভারত, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি, সুকুমার রায়ের হ য ব র ল, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের আবার যখের ধন, দেড়শো খোকার কাণ্ড, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের হুকাকাশি, এমন কত কি।  ইচ্ছে করেই ভবিষ্যতে কখনও মায়ের পড়া বইগুলো, মানে আমাদের শুনিয়ে পড়া বইগুলো কিনে পড়িনি। অনুভবে টাটকা হয়ে মরমে বিঁধে আছে সে সব।  বোঝানো যায় না। এখনও চোখ বুঝলে মায়ের গলা শুনতে পাই। প্রত্যেকটা উচ্চারিত শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদে মায়ের আবেগঘন কণ্ঠস্বরের স্পষ্টতা আজও কানে বাজে।

গতানুগতিক পরীক্ষা পাশের পড়াশোনার চাপ ছিল। মারধর, কানমলা, বকুনি এইসবের ভয়ে সে সব চাপ সহ্য করেছি, আনন্দ পাইনি। ফলাফল যে খুব একটা মন্দ হত এমনটা বলা যায় না। কিন্তু কী পড়ছি, কেনই বা পড়ছি, পরীক্ষা পাস ছাড়া এইসব পড়াশোনার কোনও মূল্য আছে কিনা, তা আমার কাছে খুব রহস্যময় ছিল। অথচ বাড়ির দরজায় কাগজওয়ালা যখন সদ্য প্রকাশিত 'দেশ' পত্রিকা কিংবা 'আনন্দমেলা' ছুঁড়ে দিয়ে চলে যেতেন, তখন আমায় দেখে মনে হত ক্ষুধার্ত পশুর সামনে এক টুকরো মাংস কেউ যেন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেল। সাংঘাতিক অধিকারবোধে পত্রিকা দুটি নিয়ে আমি অদৃশ্য হয়ে যেতাম। নির্জন ঘরে, সদ্য প্রকাশিত পত্রিকার গন্ধে, পড়ার খিদে যেত বেড়ে। এখনও আমার তাই হয়। এটুকু অবুঝ শৈশব আর কৈশোর এখনও সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছি। যাই হোক, তারপর শুরু হত জানার আনন্দে পড়া, বোঝার আনন্দে পড়া, অনাস্বাদিত কিছু পাওয়ার উত্তেজনায় পড়া। পড়তে পড়তে হারিয়ে যাওয়া, হারিয়ে যেতে যেতে পড়তে থাকা। শেষ পাতাটা মনে হত জীবনের শেষ অধ্যায়। পরের সংখ্যা আবার পরের মাসে। সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার শুরু। প্রকৃত তাগিদ থেকে কিছু পড়ার, পড়ে বোঝার এই খিদের জন্ম দিয়েছিলেন আমার মা (এখন বয়স প্রায় ৮০)।

এত কিছু গৌরচন্দ্রিকা করার উদ্দেশ্য কিন্তু নিজের মা-বাবাকে একমাত্র মহানুভব এবং সংবেদনশীল প্রমাণ করা নয়। বলার কথা এবং ভাবার কথা এই যে, গতানুগতিক পড়াশোনার বাইরেও, জানার খিদে তৈরি করার বা তৈরি করিয়ে দেওয়ার একটা দায়িত্ব বাড়ির বড়দের থেকেই যায়। পড়া, শোনা এবং সেই সঙ্গে বোঝার ক্ষমতাও যদি জন্ম নেয়, তবেই একটা ভালো লেখার সঠিক মূল্যায়ন করার আশা জাগতে পারে। আমি নিশ্চয়ই ভাগ্যবান, হয়তো এই কারণেই। পৃথিবীর সব শিশুর কিন্তু আমার মতো মা-বাবা জোটে না। অবহেলায় বড় হওয়া শিশুরা আছে, অনাথ শিশুরা আছে, আবার সবাই এবং সবকিছু থেকেও একা একা বড় হওয়া শিশুরাও আছে। এদের অনেকেই ভবিষ্যতে অনেক বড় মানুষও হয়েছেন। কিন্তু দেখা যাবে কোনও বিশেষ ঘটনা বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাব এদের প্রত্যেকের জীবনেই আছে। রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' আর শরৎচন্দ্রের 'শেষ প্রশ্ন' একটু বড় হয়ে পড়েছি। মা পড়ে শোনাননি। আসলে নিজে থেকে ভালো জিনিস পড়ার খিদে ততদিনে তৈরি হয়ে গেছে। এরপর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর সময়ের সাথে সাথে বয়স যত বাড়তে থেকেছে, ভালো লেখা, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, দৈনন্দিন জীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশ, বিনোদন ইত্যাদি বহুধা বিস্তৃত বিষয়ে বিশ্লেষণাত্মক লেখা, খাপ-খোলা ধারালো তলোয়ারের মতো লেখা, মগজে শান দেওয়ার মতো লেখা পড়ার খিদে বাড়তেই থেকেছে। ক্রমবর্ধমান এই ক্ষুধা নিরসনের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। পরিবেশ আমাকে একটা সময় ভালো লেখা পড়ার উৎসাহ জুগিয়ে ছিল। উৎসাহের আগুন জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব, জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে আমাকেই নিতে হয়েছে। বিভিন্ন ফরম্যাটে ভালো লেখা পড়েছি। লেখা তো শুধু বইয়ের পাতাতেই থাকে না। রেডিওর অনুষ্ঠানে থাকে, টেলিভিশনের পর্দায় থাকে, ফিল্মের রুপোলি পর্দায় থাকে, ব্লগ টুইটার ইনস্টাগ্রাম ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতেও থাকে। অর্থাৎ, লেখার সব রকম মাধ্যমকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছি। রবি ঠাকুরের যে লেখা নষ্টনীড়ে পড়লাম সেই লেখাই সত্যজিতের চারুলতায় অন্যভাবে পড়লাম। 'রক্তকরবী' ছাপার অক্ষরে পড়লাম আবার শম্ভু মিত্রের নাটকেও প্রত্যক্ষ করলাম। অর্থাৎ, একই লেখা দুই রকম মাধ্যমে, দুই ভাবে পাঠকের মনে ডানা মেলল। স্কুলে পড়তে চার্লি চ্যাপলিনের 'মডার্ন টাইমস' দেখে হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই আমি, পঞ্চাশোর্ধ আজ, একই চলচ্চিত্র দেখে মন ভার করে বসে থাকি, চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। শরৎচন্দ্রের 'চরিত্রহীন', 'শেষ প্রশ্ন', রবীন্দ্রনাথের 'গোরা', জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পড়তে গিয়ে একেক রকম অনুভূতি হয়েছে। ছেলেবেলা থেকে, জ্ঞানে বা অজ্ঞানে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আমাদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ তৈরি করে না দিতে পারলে, ভবিষ্যতে ভালো কিছুর মূল্যায়ন করার ক্ষমতা তৈরি হওয়া মুশকিল।

যাই হোক, একক মাত্রার সাথে গত দুই তিন বছর ধরে আমার নিরবচ্ছিন্ন প্রেমের উৎস কিন্তু ভালো লেখা পড়ার খিদে। একক মাত্রা আমার কাছে সাজানো বাগানের ফুলকারি করা গাছ নয়,  জলভর্তি বাক্সে আবদ্ধ মাছ নয়, যেখানে মেপে অক্সিজেন যোগাতে হয়, মাটি আর পাথর দিয়ে তৈরি বাঘ ভাল্লুক নয়। এই পত্রিকা আমার কাছে অবাধ্য ঝরনার মতো, পথের ধারে আপন খেয়ালে গজিয়ে ওঠা গাছের মতো, লোহার প্রাচীর ভেদ করে আসা জলের ধারার মতো, আপন খুশিতে উড়ে চলা পরিযায়ী পাখিদের মতো, বনের মধ্যে সুন্দর বন্যদের মতো, খাপ খোলা ঝলসে ওঠা তলোয়ারের মতো, আপসহীন বিপ্লবীদের মতো।  একক মাত্রার ভেতরের লেখার মূল্য আমার কাছে অসীম, অথচ বাইরের ছাপানো মূল্য দশ-বিশ-ত্রিশ। প্রায় আর্থিক সহায় সম্বলহীন এই পত্রিকা ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু করে দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে বিভিন্ন সমসাময়িক ও প্রাসঙ্গিক বিষয় নির্বাচন আর লেখার মাধ্যমে এক আপসহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সমাজই তার গবেষণাগার। একাডেমিক রোমান্টিসিজমকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া এক ঝাঁক স্ফুলিঙ্গের সংগ্রহ এই পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা: বিশ্বায়নের অর্থনীতি, ভূমি, নদীর খোঁজে, নলেজ ওয়ার্কার: অতি কথা ও বাস্তবতা, পরিবার: অতীত ও ভবিষ্যৎ, বার্তা যোগাযোগ ও সাইবার ভুবন, দুই বাংলার আড্ডা, উপমহাদেশের ধর্ম ও রাজনীতি, নগরায়ন, পঞ্চায়েত ও বিকেন্দ্রীকরণ, মিডিয়ার নতুন মুখ, দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র, বিনোদনের রকমফের, সরকার পোষার দায়, সমাজমানসে সঙ্গীত, ভারতে ধর্ম-দর্শন, তর্কে বিতর্কে এনজিও, তথ্যপ্রযুক্তির ফানুস, প্রকৃতি ও মানুষ, পাগল, আজকের ফ্যাশন, এখন গণতন্ত্র, কবিতার নির্মাণ, শিক্ষার হ য ব র ল, নাগরিক শক্তি, প্রযুক্তির সংস্কৃতি, গ্রামবাংলা, শিল্পায়নের গোলকধাঁধা, উত্তরবঙ্গের কথা, নাটক এখন, বিশ্ব সঙ্কটে উন্নয়ন, রাজনীতির ভাষা, কর্পোরেট কাহিনি, আঞ্চলিকতার বহুরূপ, হলি বলি টলি, বিজ্ঞানের নানা মুখ, বাণিজ্যে বসতে মিডিয়া, মহানগর, আলো-আঁধারে পশ্চিমবঙ্গ, গবেষণার রাজনীতি, কৃষি ও কৃষক, চিত্রকলার চালচিত্র, রাজনীতি ও সন্ত্রাস, ভোটতন্ত্র, দুর্নীতির সাতকাহন, অস্তাচলে জনস্বাস্থ্য,
পরমাণু শক্তি, অন্য রবীন্দ্রনাথ, এখনও গান্ধী, সোশ্যাল মিডিয়া, কারিগরি শিক্ষা কোন পথে, সুশাসন কুশাসন, নগর জীবন, তথ্য নিছক তথ্য নয়, তথ্যের অধিকার, বিজ্ঞাপনের ভাষা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও জনস্বার্থ, শিক্ষার নানা কথা,
নাগরিক শক্তি ও রাজনীতি, ভারত পথিক, ওয়েব দুনিয়া, খেলাধুলার অন্দরমহল, একাকিত্ব, সীমান্ত দেশ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বাজার অর্থনীতির তাল বেতাল, পরিসংখ্যানের সত্যি মিথ্যে, খাদ্য সার্বভৌমত্ব, বাজারি সাহিত্য, জল: তৃষ্ণার্ত ভুবন, শহরতলি, লোকাল ট্রেন, ধর্মের রাজনীতি, পশ্চিমবঙ্গের হাল হকিকত, জলবায়ুর পরিবর্তন, আমজনতার মিডিয়া, জীবন যাপন, সিন্ডিকেট দুনিয়া, কী পড়ি কেন পড়ি, সেলেব তরজা ইত্যাদি।

যত পড়া যাবে, ততই 'একক মাত্রা'র মূল্যায়নের গভীরতা বাড়বে। এইসব কথা বলার জন্য 'একক মাত্রা' আমাকে এক পয়সাও দেয়নি। শুধু ছোটবেলায়, আমার মায়ের মতো, ভালো লেখা পড়ার (তা সে অন্য পত্রিকাও হতে পারে), বোঝার অফুরান উৎসাহ যুগিয়েই চলেছে। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন মেলায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করে, পাঠকবর্গকে লেখকে রূপান্তরিত করার সাহস দেখিয়ে, সবাইকে নিয়ে একটা সাসটেইনেবল গ্রোথকে ফলো করছে। অর্থাৎ, নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করছে, অন্যদের অস্তিত্ব বিপন্ন না করে। এটাই আমার, এখন পর্যন্ত, 'একক মাত্রা' সম্পর্কে স্পষ্ট মূল্যায়ন।

Monday, 8 July 2019

একক মাত্রা ২০

ফিরে দেখা
১৯৯৮'এ পথ চলা শুরু। নিরন্তর। প্রতি দু' মাস অন্তর। কুড়ি কুড়ি বছরের পারে এসে তাই 'ফিরে দেখা'। এ দেখায় কোনও খাদ নেই। যারা ছিলেন, জানেন এই কুড়ি বছরের পরিক্রমা, তাঁরা অনায়াসে লিখে ফেললেন তাঁদের অনুভূতির কথা। সবচেয়ে বড় কথা, এই যাত্রায় অশেষ দুর্ভোগও ছিল। ছিল কালিমা লেপনের সচেতন 'বাহাদুরি'। যেমন থাকে আর পাঁচটা সাড়া-জাগানো কাজে। সব নিয়েই তাই পথ চলা। আরও বহুজন এ পথের সাক্ষী। তাঁরা মিশে রইলেন আমাদের সগভীর বাতায়নে। আবারও বছর কুড়ি পরে যদি দেখা হয় এইভাবেই, তখনও চলার পথে যেন থাকে সেই ছন্দোবদ্ধ দ্যুতি আর পরিশ্রমলব্ধ সৃজন আখ্যান। সেই আমাদের সকলের পরম প্রাপ্তি।