আধুনিক অর্থনীতির ভুবনে
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
(এই নিবন্ধটি লেখকের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ 'আশায় বাঁচে চাষা'র সামান্য অংশবিশেষ। গ্রন্থটি আধুনিক অর্থনীতির নিউরাল নেটওয়ার্ক'কে ধরার একটি চেষ্টা।)
উনিশ শতকের ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্র ছাড়িয়ে বিশ ও
একবিংশ শতকে আমরা এমন সব পণ্য-ভুবনে প্রবেশ করেছি, যা সেইসব যুগে প্রায় অকল্পনীয়
ছিল। এর মধ্যে প্রধান দুটি ক্ষেত্র হল: বিনোদনের দুনিয়া ও বিজ্ঞাপনের জগৎ। বিনোদনের জগতে চলচ্চিত্র শিল্প ও
খেলাধুলোর দুনিয়া অর্থনীতিতে এক বিশাল জায়গা জুড়ে দখল পেল। চলচ্চিত্র ও খেলাধুলোর
আয়োজনগুলি পণ্য-বাণিজ্যে এক মহাসাম্রাজ্য সৃষ্টি করল। সকলেই জানি, বিনোদনের আকর্ষণ
সবসময়েই তীব্র। সেই গুণাবলীর জন্য এই জগৎ ছুঁয়ে ফেলল মুনাফার উচ্চ শিখর। কিন্তু এ
তো আর কারখানার মতো নির্দিষ্ট কাঠামোভিত্তিক উৎপাদন-প্রসূত পণ্য নয়! তাহলে কীভাবে
এখানে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হচ্ছে? তার পণ্যের ধরনটাই বা কেমন?
ধরুন, একটি
চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা। কোনও প্রযোজক বা সংস্থা পুঁজি বিনিয়োগ করল একটি
চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। অভিনেতা,
টেকনিশিয়ান, ক্যামেরাম্যান, সঙ্গীত পরিচালক, সম্পাদক প্রভৃতি – সব মিলিয়ে বেশ কিছু
মানুষ নিয়োজিত হলেন এ কাজে। কিন্তু তাঁদের নির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক দৈনন্দিন
বাঁধাধরা কাজের বয়ান নেই। চুক্তির ভিত্তিতে তাঁরা শ্রমঘন্টা ব্যয় করেন, মূল
অভিমুখটা থাকে তাঁদের নির্দিষ্ট কর্মফল প্রযোজকের হাতে তুলে দেওয়ার। এই টুকরো
টুকরো কর্মফল বা পণ্যগুলিকে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক বস্তু-অবয়বে প্রত্যক্ষ করা
যায় না। এগুলো সবটাই কাঁটাছেড়ার মধ্য দিয়ে জায়গা করে নেয় মূল ছবিটির কন্দরে। আমরা
যখন নির্মিত ছবিটি কোনও হলে বা অন্যত্র দেখি, তার মধ্যেই বিন্যস্ত হয়ে থাকে সমস্ত
শ্রমের ফসলগুলি। সকলে মিলে যে শ্রম দিলেন, তার বিনিময়ে তাঁরা মজুরি পেলেন, আর
সৃষ্টি করলেন উদ্বৃত্ত মূল্যও, যা বাজারে এসে প্রযোজকের মুনাফায় রূপান্তরিত হয়। এই
মুনাফায় রূপান্তর নির্ভর করে ছবিটি কতবার কতজন প্রত্যক্ষ করলেন তার ওপর। কারণ,
ক্রেতারা (এখানে দর্শক) বিনিময় মূল্য দিয়েই ছবিটি দেখেন আর সেই মূল্যের পরিমাণের
ওপরই নির্ভর করে প্রযোজকের মুনাফার বহর। কিন্তু এখানে খানিক ব্যতিক্রম আছে।
ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, একটি শ্রম প্রক্রিয়ায় একই সময়ে এক ধরনেরই অযূত
পণ্য নির্মিত হয়। যেমন ধরুন, একই দিনে একই ধরনের এক হাজার পিস জুতো বা মোবাইল সেট
তৈরি হল। সেই প্রত্যেকটি পণ্যের মধ্যেই উদ্বৃত্ত মূল্য অন্তরস্থ হয়ে থাকে, যা
বাজারে এসে বিনিময় মূল্যের নিরিখে মুনাফায় পরিণতি পায়। কিন্তু একটি ছবি তো একটি
মাত্রই পণ্য; এই অর্থে যে এখানে একই সময়ে প্রযোজকের বিনিয়োজিত পুঁজিতে শ্রমব্যয়
করে অযূত ছবি নির্মিত হয় না। একটা সময়ে একটিই মাত্র ছবি তৈরি হয়, যার অবশ্য অনেকগুলি
কপি হতে পারে। বুঝে
দেখুন, নির্দিষ্ট চলচ্চিত্রটিতে যারা শ্রম দিচ্ছেন তাঁরা কিন্তু সেই সময়ে একটি
মাত্রই পণ্য তৈরি করছেন (মূল ছবিটি), পরে কোনও টেকনিশিয়ান তার অনেকগুলি কপি বানাচ্ছেন
(আগে ছিল রিল, এখন ডিজিটাল ফরম্যাট)। আর এই ছবিটিই যুগ যুগ ধরে চলছে বা চলতে পারে।
একটি জুতো বা মোবাইল সেট অথবা একটি জামা ক্রেতার নিজস্ব সম্পত্তি যা তাঁর ব্যবহার
ও ইচ্ছা বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পর বাতিল হয়ে যায়, ফলে, আবারও দরকার পড়ে আরেকটি
জুতো বা জামার। কিন্তু একটি ছবি কোনও ক্রেতার নিজস্ব সম্পত্তি নয় বা তার চূড়ান্ত ক্ষয়ও
নেই। তা আবারও বাজারে আসতে পারে, যতবার বাজারে আসে চলতে পারে, চললে প্রযোজকের ঘরে
মুনাফা যায়। এই ছবি নির্মাণে যারা যারা কাজ করেন, তাঁদের মজুরি বা মূল্যমানও
ভিন্ন। অভিনেতা একরকমের অর্থ পান তো সম্পাদক বা টেকনিশিয়ান আরেকরকম। আর এও জানা
সকলের, অভিনেতাদেরও পারিশ্রমিক ভিন্ন ভিন্ন, যা তাঁদের বাজারে কদরের ওপর নির্ভর
করে। মোদ্দা বিষয়টা হল, চিরাচরিত ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে যে ভাবে পণ্যে
মূল্যযোগ হয় ও বাজারে গিয়ে মুনাফায় রূপান্তর পায় তা বিনোদন জগতে ভিন্ন আঙ্গিকে
সাধিত হয়; কিন্তু মূল্যযোগ ও উদ্বৃত্ত মূল্যের আহরণ প্রক্রিয়াকে বাদ দিয়ে নয়। এই
বিষয়টিকে মাথায় রাখলে আধুনিক অর্থনীতির ভুবনকে চিনতে কোনও অসুবিধা হওয়ারই কথা নয়।
একই কথা খেলাধুলোর জগতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আগে
খেলাধুলো ছিল নিছক বিনোদন ও ইচ্ছানির্ভর বা ভাল লাগা এক মানবিক গুণ হিসেবে।
খেলাধুলোয় সম্পূর্ণ বাণিজ্য এসেছে অনেক পরে। ভাল খেললে বা কোনও টুর্নামেন্টে
পুরস্কার পেলে স্থানীয় প্রশাসন বা পাড়া অথবা সরকার থেকেও স্বীকৃতি দেওয়ার রেওয়াজ
ছিল অনেকদিনের, যা পরে বহু ক্ষেত্রে চাকরি দেওয়া অবধি গড়িয়েছে। কিন্তু কোনও খেলা
বা খেলোয়াড় চুক্তির ভিত্তিতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনও ক্লাব বা
টুর্নামেন্টে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে, এই প্রবণতা বেশি দিনের নয়। আর এটা হওয়াটাই ভবিতব্য
ছিল। কারণ, পুঁজির স্বভাবই হল, যা যা এখনও অর্থ-বিনিময় ও মুনাফার নিগড়ে ধরা পড়েনি
তাদের ধরতে হবে। কারণ, নতুন নতুন পরিসরগুলিতেই পাওয়া যায় মুনাফার উচ্চ হার। এখানেও
সেই প্রযুক্তি তৈরি করে দেয় উপযুক্ত ভূমি। মূলত টেলিভিশন আসার সঙ্গেই খেলাধুলোর
জগতে ব্র্যান্ডিং ও বাণিজ্য ভিত্তিক অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। কারণ, টেলিভিশন
হল সেই প্রযুক্তি যা যে কোনও দ্রষ্টব্যকে একইসঙ্গে বহুজনের সামনে হাজির করতে পারে।
কোথাও কোথাও রেডিও’ও কিছু জনপ্রিয় খেলাধুলোর ক্ষেত্রে শ্রবণের মাধ্যমে বহুজনের
কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছে। তথ্য বলছে, প্রথমে এই বাণিজ্য আসে স্পনসরশিপ ও
খেলাধুলোকে বাজারের একটি প্রকরণ হিসেবে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। গত শতকের সত্তরের
দশকেই এর প্রাবল্যের শুরু। ১৯৮৪ সালে লস এঞ্জেলেস অলিম্পিক্সের সংগঠকেরা এই বাবদ ২০
কোটি মার্কিন ডলারের মতো মুনাফা করে। ইতিমধ্যে এইসব সংগঠকেরা বুঝে গেছেন, আধুনিক
অলিম্পিকগুলিকে যদি বাণিজ্যের আওতায় আনা যায় তাহলে কর্পোরেট স্পন্সররা প্রায় ১৫৬টি
দেশের ২৫০ কোটি লোকের নাগাল পেয়ে যেতে পারেন। এই যখন টাকা ও বাণিজ্য ব্যাপ্তির বহর
তখন স্বাভাবিক গোটা খেলাধুলোর জগতের এই ডোরে বাঁধা পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাই,
শুধু খেলার সরঞ্জাম বিক্রি করা নয়, বা খেলার মাধ্যমে কর্পোরেট দুনিয়ার পণ্যগুলিকে
জনপ্রিয় করাই নয়, খেলা ও খেলোয়ারদেরও এমন মূল্য নির্মাণ করতে হবে যাতে তাঁরা আরও
বেশি বিনোদন-দায়ক ও চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠতে পারেন। তা করতে গেলে, যেমন খেলায় আরও
পেশাদারিত্ব ও আঙ্গিকে বিবিধ পরিবর্তন আনতে হবে, পাশাপাশি খেলোয়ারদের হতে হবে
সর্বক্ষণের কর্মী-খেলোয়ার। এই খেলোয়াররাই এখানে কুশীলব, যাঁদের দক্ষতা, শ্রম, দম ও
লড়াকু মেজাজের ওপরই খেলাধুলোর বাণিজ্য নির্ভর করে থাকবে। এইভাবে খেলাধুলো হয়ে গেল
এক পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য বিশেষ, যেখানে খেলোয়ারদের থেকে উদ্বৃত্ত মুল্য সংগ্রহের
প্রক্রিয়া চালু হল ও বাজারে গিয়ে তা মুনাফায় রূপ পেল।
কিন্তু চলচ্চিত্রের মতো
এখানেও খেলোয়ারেরা নির্দিষ্ট কাঠামোভিত্তিক শ্রম দেন না, বরং, সারা বছর ধরে ২৪x৭ তাঁদের গোটা
কর্মজীবনটাই নিরন্তর শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ, খেলায় শুধু খেললে
হয় না, অনুশীলনের দরকার আছে, টিমের সঙ্গে মানসিক সংযোগ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া আছে,
খাওয়াদাওয়ার নিয়ম ও আচারবিধি আছে, অন্যান্য স্বাস্থ্যমুলক ব্যবস্থাদি গ্রহণেরও
ব্যাপার আছে – সব মিলিয়ে এ এক লাগাতার কর্মপ্রক্রিয়া ও অবশ্যই পুঁজি-নির্ভর। এর জন্য তাঁরা যে অর্থ
পান (বা মজুরি) চুক্তির ভিত্তিতে, তার মূল্য অত্যন্ত বেশি (অনেক ক্ষেত্রে
অবিশ্বাস্য), কিন্তু তার বিনিময়ে তাঁরা যে বাজারে ‘খেলতে-থাকা’ পণ্য হিসেবে নিবেদিত
হন তা আরও বেশি মূল্য দিতে প্রস্তুত। এই বাড়তি মূল্যটা সম্ভব হয়েছিল টিভির আগমনে
এক বিশাল দর্শক-বাজারের উদ্ভবের ফলে, এখন তো স্মার্ট ফোনের দৌলতে তা আরও প্রসারিত।
অতএব, তাঁরা নিজেদের প্রস্তুতি ও আসল খেলার দিনে নিজেদের খেলার বৈভব ও রূপ দেখিয়ে
যে সামগ্রিক ‘খেলাটি’র মূল্য তৈরি করেন তা তাঁদের প্রাপ্য মূল্যের থেকে অনেক বেশি।
এই বাড়তি মূল্যটা চলে যায় কর্পোরেট মালিক বা আয়োজকদের পকেটে। এখানে বিক্রিত পণ্যটি
হল, যদি ধরা যায় একটি ফুটবল ম্যাচের কথা, ৯০-মিনিটের একটি সময় যা ক্রেতার চেতনে,
মননে নানান ভাব ও আবেগ নির্মাণ করে; সেই তার ব্যবহারিক মূল্য। এর আরও নানান দিক
আছে, সে আলোচনা করতে গেলে আমাদের বিষয়ান্তরে যেতে হবে। এখানে শুধু আমরা দেখানোর
চেষ্টা করেছি, পুঁজি কীভাবে মুনাফার খোঁজে প্রযুক্তির সহায়তায় খেলাধুলোর জগৎকেও
নিজের অঙ্গীভূত করে নেয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে মনে আসছে, ১৯৭৭ সালে শুরু হওয়া
কেরি প্যাকারের একদিনের ক্রিকেট ম্যাচের কথা। (চলবে)।