লিটল ম্যাগাজিন নেই মানে গণতন্ত্র নেই
শ্রেয়ণ
নন্দন চত্বর থেকে লিটল ম্যাগাজিন মেলাকে সরানোর প্রতিবাদে লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের বৈঠক
আমরা যারা লিটল ম্যাগাজিন করি তারা সোজা কথায়
ব্যবসায়িক বুদ্ধি সম্পন্ন(?) আম-বাঙালির ভাষায় ‘ঘরের
খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে’ জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট করে থাকি। সত্যিই তো, এখন চারদিকের অর্থনীতি টালমাটাল, বাজারে রোজগার
নেই, যেখানে তাকাই সেখানেই ছাঁটাই, জিনিসপত্রের দামে আগুন, আর আমরা কিনা এমন সব
কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখি যেখান থেকে সংসারের তেল নুনের খরচটুকুও ওঠে না, উপরন্তু
পকেট থেকে উপার্জিত এবং সঞ্চিত অর্থের বেহিসেবি নিষ্কাশনই ভবিতব্য হয়ে ওঠে। লিটল
ম্যাগাজিন আন্দোলন কি তাহলে বিলাসিতার গালভরা নামান্তর মাত্র? যেখানে দেশের
বেশিরভাগ মানুষ দু’বেলা পেট পুরে খেতে পায় না, গায়ে দেবার জামা পায় না, সেখানে
আমরা কখনও নন্দনে কখনও কলেজ স্কোয়ারে মোচ্ছব করে বেড়াই। এখন তো সেই পুরুলিয়া থেকে
কোচবিহার সব জায়গাতেই সারা বছর লিটল ম্যাগাজিন মোচ্ছব লেগেই আছে। এ কী অনাসৃষ্টি
রে বাবা।
তা মোচ্ছব না হয় মানলাম, কিন্তু রাজরোষে পড়বে কেন
বাপু? সরকার কি জনগণকে কৃচ্ছ্রসাধন করতে শেখাচ্ছে? ভোগবাদী অসংযমী লালসাকে
নিবৃত্তির কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে? তাহলে তো সবার আগে তেলমশলাযুক্ত মুখরোচক সুস্বাদু
খাবারদাবারগুলো নিষিদ্ধ করা দরকার, কিংবা অন্তত যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া ভিডিওগুলোকে সব
আনাচকানাচ থেকে খুঁজে ধ্বংস অভিযান শুরু করাই যেত কমপক্ষে। তাহলে কি লিটল
ম্যাগাজিন বিলাস এবং মোচ্ছবের থেকেও বেশি কিছু? এমন কিছু যাকে রাষ্ট্র ভয় পায়,
প্রতিষ্ঠান ভয় পায়। ভয় পায় বলেই তো নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। আর এই ভয় পাওয়ার
ব্যাপারটা যে আনকোরা তাও নয় মোটেই।
এই পশ্চিমবঙ্গে বাম শাসনে সরকারি উদ্যোগে লিটল
ম্যাগাজিন মেলা শুরু করা হয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্ক মেনেই। লিটল ম্যাগাজিন চিরকালই
মননশীলতার সূতিকাগার, সেই স্বর্ণভাণ্ডকে নিজের পক্ষে আনার একটা বড় সুযোগ ছিল এই
মেলা। সরকারপন্থী একদল
লিটল ম্যাগাজিন কর্মীকে নিয়ে ‘মেলা প্রস্তুতি কমিটি’ গঠন করা হল। কিন্তু লিটল
ম্যাগাজিনের ধর্মই তো আনুগত্যের বিরুদ্ধে হাঁটা, যে কারণে মেলা কমিটির সাথে
বেশিরভাগ লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরই কোনও সম্পর্ক ছিল না এবং কমিটিও লিটল ম্যাগাজিনের
স্বার্থের চেয়ে সরকারি স্বার্থকেই প্রাধান্য দিত। স্বাভাবিকভাবেই সরকার লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে পকেটে পুরতে সক্ষম
হয়নি, তাই লিটল ম্যাগাজিন মেলায় বাম সরকার লাঠি চালাতেও দ্বিধা করেনি এতটুকুও।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে নন্দন চত্বরে কয়েকজন
লিটল ম্যাগাজিন কর্মী সরকার-বিরোধী পোস্টার লাগানোয় তাদের লক-আপে পুরে দেওয়া হয়।
তখন অগ্নিগর্ভ সময়, তার ওপর এই ঘটনা লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের একাংশকে বড় রকম
ধাক্কা দিয়েছিল। সেই ধাক্কা দানা বেঁধেছিল ‘লিটল ম্যাগাজিন সমন্বয় মঞ্চ’ গঠনের
মধ্যে দিয়ে। ‘সমন্বয় মঞ্চ’ বিকল্প লিটল ম্যাগাজিন মেলার ডাক দিয়েছিল তখন, বহু লিটল
ম্যাগাজিন সরকারি মেলা বয়কট করে বেরিয়েও এসেছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঠে
প্রেসিডেন্সির ছাত্র সংসদের সহায়তায় বিকল্প মেলা বসল। এতে আবার বাম বুদ্ধিজীবীরা
খেপে লাল। তাঁদের বক্তব্য, ‘প্রেসিডেন্সির মাঠ তো সরকারি জমি, সরকারি মেলা বয়কট
করে সরকারি জমিতেই বিকল্প মেলা করা কেন আবার?’ আজব যুক্তি! তাহলে তো সরকারি
রাস্তাতেও সরকার বিরোধী মিছিল-জমায়েত করা বন্ধ করতে হয়!
প্রেসিডেন্সি কলেজে বিকল্প মেলা বেশি
বছর স্থায়ী হয়নি। তার মূল কারণ ছিল দু’টো। এক, কলেজ ক্যাম্পাসে পাঁচিল ঘেরা বদ্ধ
জায়গায় বহু পাঠকই প্রবেশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতেন, তাই একটি উন্মুক্ত স্থানের
প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। দুই, তৎকালীন প্রেসিডেন্সির অধ্যক্ষের চূড়ান্ত অসহযোগিতাও
সমন্বয় মঞ্চের কাছে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এইরকম সময়ে কলকাতা পৌরসংস্থা রাজনৈতিক
হিসেব কষে সমন্বয় মঞ্চকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তখন যাঁরা বিধানসভায় বিরোধী
আসনে বসতেন, অর্থাৎ এখন যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল, কলকাতা পৌরসংস্থার বোর্ড তখন
তাঁদের হাতে ছিল। পৌরসংস্থা তখন সমন্বয়
মঞ্চকে নিষ্করভাবে কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর উদ্যানে বিকল্প লিটল ম্যাগাজিন মেলা
করার অনুমতি দেয়। সেই থেকে কলেজ স্কোয়ারে প্রতি বছর লিটল ম্যাগাজিন মেলা অনুষ্ঠিত
হয়ে আসছে।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয়
রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটল। চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিধানসভা
ও মহাকরণে জাঁকিয়ে বসল নতুন সরকার। সরকারি লিটল ম্যাগাজিন মেলার জন্য নতুন করে ‘মেলা প্রস্তুতি কমিটি’
তৈরি হল। সেখানে পুরনো কিছু সদস্যদের সাথে নতুন করে বহু লিটল ম্যাগাজিন কর্মীকেও
ডাকা হল। অনেকেই মনে করেছিলেন যে সরকার বোধহয় এবার সত্যিই লিটল ম্যাগাজিনের
গুরুত্বকে সম্মান জানানোর উদ্যোগ নিল। কিন্তু তাঁদের মোহভঙ্গ হতে সময় লাগেনি।
মোটামুটি তিন বছরের মধ্যেই ঐ কমিটি আবার বাম আমলের মতোই আলঙ্কারিক প্রতিষ্ঠানে
পরিণত হয়। অনেক সদস্যই জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপাল হতে না চেয়ে পদত্যাগ করেন। লিটল
ম্যাগাজিন আন্দোলন তার স্বধর্মচ্যূত হয় না একদিকে, অন্যদিকে সরকারি রোষও নেমে আসতে
থেকে লিটল ম্যাগাজিনের দিকে। ২০১২ সাল থেকে অবাণিজ্যিক পত্রিকাগুলিকে সরকারি
বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। যদিও এর আগে সরকারি বিজ্ঞাপনের অনুমোদিত অর্থও প্রশাসনের
কোষাগার থেকে বের করতে লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের কালঘাম বেরিয়ে যেত।
এমনিতেই লিটল ম্যাগাজিন সরকারের কোনও
কাজেই আসে না। সারা বাংলার লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে
আণুবীক্ষণিকভবে নগণ্য। তার ওপর আবার লিটল ম্যাগাজিন সব রকম প্রশ্নহীন আনুগত্যকেই প্রশ্ন
করে, সব রকম আধিপত্যেরই প্রতিবাদ করে, এরা কখনই সরকারের আজ্ঞাবহ ভৃত্য হয়ে উঠতে
পারবে না। তাহলে দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষে লাভ কোথায়? তাই এইবার প্রশাসন রীতিমতো
পরিকল্পনা করে সরকারি লিটল ম্যাগাজিন মেলাটিকে বন্ধ করার উদ্যোগ বাস্তবায়িত করা
শুরু করল। গত বছর প্রথম পদক্ষেপে নন্দন চত্বর ও মোহরকুঞ্জ চত্বর – ক্যাথিড্রাল রোডের দুই দিকে মেলাটাকে বিভাজিত
করে দেওয়া হল। লিটল ম্যাগাজিনের পাঠকদের একাংশ ব্যস্ত ক্যাথিড্রাল রোড পারাপার
করতে গিয়ে পথ দুর্ঘটনার শিকারও হলেন, দুর্ঘটনার ভীতি মেলায় পাঠক সংখ্যা কমিয়ে দিল
খানিকটা। স্টল সাজানোর মধ্যেও নৈপুণ্যের অভাব থাকায় ভেতরের স্টলগুলি বেশিরভাগ
পাঠকের দৃষ্টির বাইরেই থেকে গেল।
এই বছর সেই পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ
সযত্নে রূপায়িত হতে চলেছে। এবার লিটল ম্যাগাজিন কর্মী ও পাঠকদের সাথে পরামর্শ না
করেই একতরফাভাবে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সিদ্ধান্ত নিল যে সরকারি লিটল ম্যাগাজিন
মেলার আয়োজন করা হবে সুদূর সল্টলেকের রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে। এতদিন লিটল ম্যাগাজিন
মেলা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল নন্দন-রবীন্দ্রসদন
চত্বরেই হয়ে এসেছে, যার একদিকে মেট্রো স্টেশন আর অন্যদিকে হাওড়া স্টেশনগামী বাসের
বন্দোবস্ত থাকায় কলকাতা সহ বিভিন্ন জেলার লিটল ম্যাগাজিন কর্মী ও পাঠকদের
যাতাযাতের কোনও অসুবিধে ছিল না। রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে মেলা অনুষ্ঠিত হলে দু’পক্ষই
সমস্যায় পড়বেন। অনেক স্টল নিয়মিত খোলা সম্ভব হবে না, পাঠকের অভাবে মেলা ধুঁকবে।
প্রশাসন ঠিক এটাই চায়। এভাবে মেলা ব্যর্থ হবার অজুহাতেই প্রশাসন আগামী বছর থেকে
সরকারি লিটল ম্যাগাজিন মেলা বন্ধ করে দেবে।
সরকারের এই অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপকে
প্রতিরোধ করার জন্য তৈরি হয়েছে ‘বাংলা লিটল ম্যাগাজিন ফোরাম’। ঠিক হয়েছে যে এই
সংগঠন ‘লিটল ম্যাগাজিন সমন্বয় মঞ্চ’র সাথে হাত ধরাধরি করে বিভিন্ন লিটল
ম্যাগাজিনগুলির স্বার্থরক্ষা করবে। এই উদ্যোগ অতীব প্রয়োজনীয় এবং রাষ্ট্রশক্তি
যেভাবে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে, সেখানে এই ধরনের সচেতনতা যথেষ্ট প্রশংসনীয়ও বটে।
‘বাংলা লিটল ম্যাগাজিন ফোরাম’এর বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে
সরকারি মেলার স্থান পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লিটল ম্যাগাজিন কর্মী ও পাঠকদের পক্ষ থেকে
প্রশাসনকে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হবে। স্মারকলিপিতে যদি প্রশাসনের মত না পালটায়,
মেলার স্থান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে সেই মেলা বয়কটের
সাথে সাথে বিক্ষোভ-আন্দোলনের পথও খোলা রাখা হয়েছে। বিকল্প লিটল ম্যাগাজিন মেলার
প্রতি জোর দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
স্বাধীন মতামত প্রকাশের স্বার্থেই লিটল
ম্যাগাজিনগুলির স্বনির্ভর হয়ে ওঠা জরুরি। লিটল ম্যাগাজিন রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল
হয়ে পড়বে সেটা কখনই কাম্য নয়। বরং রাষ্ট্র যাতে লিটল ম্যাগাজিনের ওপর নির্ভরশীল
হয়ে ওঠে সেদিকেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কারণ লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া গণতন্ত্র বাঁচে
না। যে দেশে লিটল ম্যাগাজিন নেই, সেই দেশে গণতন্ত্রও নেই। লিটল ম্যাগাজিন
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী। লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের এই গুরুদায়িত্ব
ভুলে গেলে চলবে না। তাই বিকল্প লিটল ম্যাগাজিন মেলাকে আরও শক্তিশালী আরও প্রসারিত
করার সময় এইটাই। এখন বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন জেলায় সফল ভাবে লিটল ম্যাগাজিনের
সমাগম হচ্ছে, তাহলে কলকাতায় কেন সেটা হতে পারবে না? পঞ্চাশ-ষাট’টি লিটল ম্যাগাজিন
এখন কলকাতায় বিকল্প মেলায় আসছে, আরও কয়েকশো পত্রিকা আসুক। সরকারের মেলা বয়কট করে
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে স্বাবলম্বী করে তুলুক। সারা বাংলার পত্রিকা কর্মীরাই
মেলা আয়োজনে সক্রিয় হোন, প্রয়োজনে দূর মফস্বল ও গ্রাম থেকে আসা পত্রিকাকর্মীদের
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক কয়েকদিনের জন্য। এসবের জন্য মেলার অর্থনৈতিক
ভিত্তিকে মজবুত করতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, তার ভাবনা-চিন্তা শুরু হোক এখন
থেকেই। তার সাথে সাথে প্রতি মাসের ‘লিটল ম্যাগাজিন হাট’এও আরও বেশি পত্রিকা যোগ
দিক। যাঁরা প্রতি মাসে সময় পান না তাঁরা যদি অন্তত বছরে একবার কি দু’বার সময় করে
হাটে বসতে পারেন, তাহলেই হাট আরও জমে উঠবে। লিটল ম্যাগাজিনের কাজ তো শুধু শীতকালীন
নয়, এটি সারা বছরের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন।
যোগাযোগঃ ৯১৬৩৪৪৯৬২৫
বাহ।ভালো লাগলো লেখাটা
ReplyDeleteশ্রেয়ণ, তোমার প্রতিবাদটি যথেষ্ট সোচ্চার, নিখাদ এবং ভন্ডামিহীন। অনেকেই তো হাতের কাছে পড়ে পাওয়ার মতন নিরাপদে থাকে এক প্রতিবাদে। কিন্তু নিজের ভিতরে গণতন্র রাখেনা পাছে নিজের আধিপত্য হারিয়ে যায়।
ReplyDeleteঅভিনন্দন তোমাকে।
উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়
ধন্যবাদ
ReplyDelete