অজিতদা
অর্ঘ্য দাস
“The
mediocre teacher tells. The good teacher explains. The superior teacher
demonstrates. The great teacher inspires.” – William Arthur Ward
আমার
মতো অনেক নরেন্দ্রপুর-প্রাক্তনীরই স্কুল-স্মৃতির অনেকটা জায়গা জুড়ে আছেন অজিতদা| ছাত্রজীবনে
অনেক মহাপ্রাণ শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছি, কিন্তু
অজিত কুমার সেনগুপ্তের মতো আর কাউকে পাইনি| তিনি
ছিলেন অদ্বিতীয়| তাঁর মতো ব্যক্তিত্বকে লেখার অক্ষরে ছোঁয়া যায়না, তবু
বলছি, অজিতদাকে নিয়ে আগের লেখাটা লিখে নিজে বড় তৃপ্তি পেয়েছি| পাঠকরাও
ভালো লেগেছে বলে জানিয়েছেন| সেজন্যই অজিতদার আরো কিছু স্মৃতি পাঠকদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার
ইচ্ছা জাগল|
লোকে
বলে “First impression is the last impression”, কিন্তু
মজার কথাটা হলো অজিতদাকে প্রথম দর্শনে কিন্তু আমাদের মোটেই ভালো লাগেনি | ক্লাস
এইটে প্রথমদিন পড়াতে এসেই যেরকম মস্তানি-মার্কা কথাবার্তা বলেছিলেন তাতে ভয়ে
আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছিল | আমার
আগের লেখাটায় (https://www.facebook.com/arghyadas1985/posts/395976047242346) সেই
ক্লাসের কথা লিখেছি | কিন্তু যত দিন গেছে, ততই
বেড়েছে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা |
কোনদিন
তাঁর ক্লাসকে আমাদের জীবনবিজ্ঞান ক্লাস বলে মনে হয়নি, চিরকালই
আমাদের কাছে ওটা ছিল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গল্প শোনার ক্লাস, অথচ
সবার আগে তিনি সিলেবাস শেষ করতেন | তাঁর
পড়ানো বহু জিনিসই আজও হুবহু মনে আছে আমার | ক্লাস
টেনে কোষ বিভাজন এমনভাবে পড়াতেন যে ছবির মতো পুরো ব্যাপারটা চোখের সামনে ভেসে উঠত | বারবার
জিজ্ঞেস করতেন, “দেখতে পারছিস ? পুরো
ব্যাপারটা চোখের সামনে দেখতে পারছিস তো ?” | আজকের
দিনের ল্যাপটপ-প্রজেক্টর-স্মার্টবোর্ড সম্বৃদ্ধ আধুনিক ক্লাসরুমেও কোনো শিক্ষক
ওরকম ভাবে কোষ বিভাজন পড়াতে পারবেন কিনা সন্দেহ!
অজিতদার
গল্পে জীবন্ত হয়ে উঠত চরিত্রগুলো | আমরা
স্পষ্ট দেখতে পেতাম অস্ট্রিয়ার এক অখ্যাত পাদ্রী গ্রেগর জোহান মেন্ডেল চার্চের
বাগানে মটরশুঁটি গাছ লাগিয়ে সেখানে বংশগতির পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন আর তাঁর
ডায়েরিতে ফলাফল নোট করছেন | তাঁর সেই ডায়েরি প্রথম লোকচক্ষুর সামনে আসবে তাঁর মৃত্যুর পনেরো
বছর পরে, যা জীববিজ্ঞানে রীতিমতো বিপ্লব নিয়ে আসবে আর তাঁকে এনে দেবে ‘বংশগতির
জনক’ আখ্যা | চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত ১৯৫২ সালের শিকাগো ইউনিভার্সিটির
ল্যাবে বৈজ্ঞানিক হ্যারল্ড ঊরে আর তাঁর ছাত্র স্ট্যানলি মিলারের সেই বিখ্যাত
এক্সপেরিমেন্ট যা প্রমাণ করেছিল যে, ঈশ্বর কিংবা
ভিনগ্রহী alien নয়, পৃথিবীতে
প্রাণসঞ্চারের নেপথ্য-নায়ক কিছু ‘বৈপ্লবিক’ রাসায়নিক
বিক্রিয়া (বৈজ্ঞানিক ওপারিনের ভাষায় ‘revolutionary reaction’) |
দেখতে পেতাম বিখ্যাত জাহাজ HMS Beagle-এ
চেপে দলবল নিয়ে ডারউইন সাহেব বেরিয়েছেন সমুদ্রযাত্রায় | পরে
এই যাত্রার গবেষণালব্ধ ফলই তিনি লিপিবদ্ধ করবেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The
Origin of Species by means of Natural Selection’-এ, যা
জীববিজ্ঞানে বাইবেলের মর্যাদা পাবে |
অজিতদা
একাধিকবার আমাদের বলতেন যে জগদীশ চন্দ্র বোস কস্মিনকালেও প্রমাণ করেননি যে “গাছের
প্রাণ আছে”, কারণ ব্যাপারটা জগদীশ বাবু জন্মাবার বহু
পূর্বেই প্রমাণিত | জগদীশ বোস প্রমাণ করেছিলেন যে অন্যান্য প্রাণীর মতো “গাছও
বাহ্যিক উত্তেজনায় সাড়া দেয়” | তাঁর
আবিস্কৃত ক্রেসোগ্রাফ (Crescograph) যন্ত্র
বিভিন্ন বাহ্যিক উত্তেজকের উপস্থিতিতে গাছের বৃদ্ধি কীভাবে প্রভাবিত হয় তা পরিমাপ
করে | ক্লাস এইটের প্রথম ক্লাসেই বললেন, “তোদের
পাঠ্যবইয়ের প্রথম লাইনেই ভুল আছে | এখানে
বলা হয়েছে ইঁট দিয়ে যেমন বাড়ি তৈরি হয়, সেরকমই
কোষ দিয়ে জীবদেহ গঠিত হয় | কিন্তু এই তুলনাটা ভূল কারণ একটা ইঁট দিয়ে কখনই কোনও বাড়ি তৈরি হতে
পারে না, অন্যদিকে অসংখ্য এককোষী জীব পৃথিবীতে বর্তমান |”
‘জনন’ চ্যাপ্টার পড়াতে গিয়ে তাঁর প্রথম কথা ছিল, “আমি
জন্মেছি কারণ আমার বাবার দেহের একটি শুক্রানু আমার মায়ের দেহের একটি ডিম্বানুর
সাথে মিলিত হয়েছিল |” ওই একটি সোজা-সাপটা উক্তিতেই ছেলেপুলের
বয়ঃসন্ধি-সুলভ ফচকে হাসি গায়েব হয়ে যেত |
বাহ্যিক
ভাবে অত্যন্ত গম্ভীর বলে মনে হওয়া মানুষটির হাস্যরসবোধ ছিল অসামান্য | অজিতদার
ছাত্রমাত্রেই এ কথা জানে | নিজের চেহারা নিয়েও তিনি রসিকতা করতেন| অজিতদাকে
জন্মলগ্নেই তাঁর মাকে হারান | এ
প্রসঙ্গে অজিতদা বলতেন যে ওনার মা অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন| সেই
মায়ের এরকম কুৎসিত সন্তান! এই দুঃখেই নাকি তাঁর মা তাঁকে জন্ম দিয়েই দেহত্যাগ
করেন!! পরমব্রহ্ম যে নিরাকার তা রামকৃষ্ণ মিশনে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হওয়ার পর থেকে
বহুবার শুনেছিলাম কিন্তু ব্যাপারটা বোধগম্য হয়নি | অজিতদাই
প্রথম ব্যাপারটার সন্তোষজনক ব্যাখা দেন | উনি
বলেছিলেন, “বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালে তোরা সৃষ্টিকর্তা
ব্রহ═মা কে দেখেছিস - তিন মাথা ওয়ালা, মুখে
সাদা দাড়ি - রীতিমতো আকার, আয়তন যুক্ত| এবার ‘ব্রহ্মা’ বানান থেকে আ-কার টা বাদ দিয়ে দে, কি
পড়ে থাকল ? ‘ব্রহ্ম’ তো? ফলে
ব্রহ্ম ‘নিরাকার’! বুঝতে পেরেছিস তো ? ব্রহ্মা
হলেন সাকার আর ব্রহ্ম হলেন নিরাকার |” কেউ
খুব উঁচু গলায় কথা বললে অজিতদা তাকে ‘অমায়িক’ (অ-মাইক)
আখ্যা দিতেন, কারণ সেই ব্যক্তির কোনো মাইকের দরকার নেই!
কিন্তু
নানা বিষয়ে রসিকতা করলেও তাঁর ক্লাসের নিয়মকানুনে বিন্দুমাত্র শিথিলতার সুযোগ ছিল
না | একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি | ক্লাস
এইটের মাঝামাঝি সময়, একদিন অজিতদা টেবিলের উপর এক পা মুড়ে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে চোখ
বন্ধ করে খুব মন দিয়ে পড়াচ্ছেন আর আমি পড়া শুনতে শুনতে আঙ্গুল ফাটাচ্ছি | সবে
তিনটে আঙ্গুল ফাটিয়েছি, হঠাৎ অজিতদা পড়ানো থামিয়ে আমার দিকে কটমট করে তাকালেন | তারপর
বললেন, “সবে তো তিনটে হলো, আরো
তো সাতটা আঙ্গুল বাকি আছে | ফাটা, ফাটা, ওগুলোও ফাটা |” তারপর
টেবিল থেকে পা নামিয়ে দাঁড়িয়ে একরাশ বিরক্তি ভরে বললেন, “এরকম
করলে আমার কন্সেন্ট্রেশন নষ্ট হয়ে যায় | আজ আর
পড়াতে পারব না | আমি চললাম |” বলেই হনহন করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন | আমরা
তো থ, সবে দশ মিনিট হয়েছে, বাকি
সময়টা কি করব ! খানিক বাদে ‘সরি’ বলতে
বেরিয়ে আমি অজিতদাকে খুঁজে পেলাম আমবাগানের বেদির উপর, দেখি
আরেকজন স্যারের সাথে খোশমেজাজে গল্প করছেন | আমি
কাঁচুমাচু মুখে ‘সরি’ বলতে অজিতদা বললেন, “ঠিক
আছে | কিন্তু এরকম আর কোনদিন করিসনা যেন |” আমাকে
‘ঠিক আছে’ বললেন বটে, কিন্তু সেদিন ক্লাস নিতে আর আসেননি তিনি !
একবার
সিনিয়রের অ্যাসেম্বলি হলে ‘স্টোরি টেলিং কম্পিটিশন’ হচ্ছে, সেটা
২০০০ সাল - আমরা তখন ক্লাস এইটে পড়ি, অজিতদা
এবং আরো দু’জন শিক্ষক তাতে Judge হয়েছেন| কম্পিটিশন শেষ হয়ে গেছে, এরপর
মিনিট দশেক সময় লাগবে স্কোর হিসাবের জন্য। এমন
সময় সাধারনতঃ judge দের বলা হয় কিছু বলবার জন্য| অজিতদা
এলেন| সারা হল ভর্তি ছাত্র, স্যার
আর সন্ন্যাসীরা বসে আছেন| এমন সময় অজিতদা গম্ভীর মুখে বলা শুরু করলেন, “আজ
আমাকে কিছু বলবার জন্য পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছে| এই
সময়ের মধ্যে ছোটগল্পের রাজা রবীন্দ্রনাথের কোনো গল্প বলা সম্ভব না| এই
কদিন আগে বনফুলের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হল| কিন্তু
এই কম সময়ের মধ্যে বনফুলও ফুটবে না| ফলে আজ
আমি একটা অন্যধরনের গল্প বলব| গল্পের
নাম শুনে হয়ত অনেকের মুখেই হাসি ফুটে উঠবে, কিন্তু
গল্পটা শোনার পর সেই হাসি মিলিয়েও যেতে পারে| আমার
গল্পের নাম ‘শুয়োরের বাচ্চা’| হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুয়োরের
বাচ্চা|” আমাদের চক্ষু চড়কগাছ, ভাবছি
লোকটা কি সব বলছে! পিছনে তাকিয়ে দেখি মহারাজদের মুখও থমথমে! ছেলেপুলে ততক্ষণে
মুখ টিপে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে| আসলে
তখন আমাদের কাছে ওটাই ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের গালাগালি| কিন্তু
অজিতদা তো অজিতদাই! তিনি যখন কিছু বলা শুরু করতেন তখন যেন কি একটা ভোজবাজি হয়ে
যেত, সমস্ত শ্রোতা যেন হিপনোটাইজড হয়ে পড়ত| এদিনও
তাই হলো, অজিতদার গল্প চলতে থাকল, আর
সমস্ত শ্রোতার মুখ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হতে থাকল| শেষে
অজিতদা যখন গল্প শেষ করলেন তখন সমস্ত অ্যাসেম্বলি হলে যেন পেপার-ড্রপ সাইলেন্স !!
হাততালির ঝড়টা শুরু হতে অন্ততঃ পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগল!
গল্পটা
খুব সংক্ষেপে বলছি – এক ব্যক্তি তাঁর শুয়োরের খোয়াঁড় দেখভালের জন্য একটি কমবয়েসী গরিব
ছেলেকে নিযুক্ত করেছিলেন| লোকটি ওই ছেলেটিকে খুব কম মাইনে দিতেন, দু’বেলা
ভালো করে খেতে তো দিতেনই না, উপরন্ত
কথায় কথায় তাকে গালি দিতেন ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে| একদিন এই ছেলেটির শরীর খুব খারাপ থাকায় কাজে তার খানিক গাফিলতি হয়ে
যায়| শাস্তিস্বরূপ নির্দয় মালিক তাকে রাতের বেলায় অভুক্ত অবস্থায়
খোয়াঁড়ের মধ্যেই বন্ধ করে রাখেন| অসুস্থ
অভুক্ত ছেলেটি ক্ষিদের জ্বালায় ছটফট করতে করতে অবশেষে এক মা-শুয়োরের দুধের বাঁটে
মুখ লাগিয়ে দুধ পান করতে থাকে| সকালবেলায়
মালিক খোয়াঁড় খুলে দেখেন ছেলেটি শুয়োরের বাঁটে মুখ লাগিয়েই ঘুমিয়ে রয়েছে, ঠিক
যেমন মানবশিশু মায়ের দুধে মুখ লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ! মালিক দৃশ্যটা দেখে বিরক্তিতে
মুখটা বেঁকিয়ে বলে ওঠেন, “শালা শুয়োরের বাচ্চা!”
... গল্পটি হয়ত খুবই সাধারণ, কিন্তু
অজিতদার অসাধারণ বাচনকৌশলে প্রতিটা চরিত্র, প্রতিটা
দৃশ্য হয়ে উঠেছিল জীবন্ত|
অজিতদা
বলতেন উনি নাকি টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখতে খুব ভালবাসতেন| উনি
টিভিতে যখন কোনো সিরিয়াল বা সিনেমা দেখতেন তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতেন কখন
বিজ্ঞাপনের ব্রেক দেওয়া হবে সেজন্য! ‘Advertisement Science’ নিয়ে
নাকি বেশ কিছুদিন পড়াশুনাও করেছিলেন| ‘Tea Taster’ এর
চাকরি তাঁকে খুব আকর্ষণ করত| শাস্ত্রীয়
সঙ্গীত ছিল তাঁর পছন্দের বিষয়, আমাদের
গল্প করেছিলেন বহুবছর আগে উত্তরপ্রদেশের কোনো এক মন্দিরের চাতালে বসে ভোর চারটের
সময় উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁয়ের সানাই ‘লাইভ’ শোনার
অভিজ্ঞতার কথা | ধর্ম সম্বন্ধে তিনি ছিলেন উদারপন্থী | কোনো
পুজোপার্বণ উপলক্ষ্যে উপোস করার রীতিতে তিনি একেবারেই বিশ্বাসী ছিলেন না | উনি
বলতেন, “এমন কি কখনোও হতে পারে যে তুই সারাদিন উপোস
করার পর এক থালা খাবার সাজিয়ে তোর মায়ের সামনে রাখছিস, আর
তোর মা অভুক্ত ছেলের সামনে বসে ওই খাবার খাচ্ছেন ?” যুক্তিটা
কিন্তু ভেবে দেখার মতো !
ফুটবলে
অজিতদা ছিলেন কট্টর ব্রাজিল সমর্থক | আমাদের
গল্প বলেছিলেন BTQ-য়ে (Bachelor Teachers’ Quarter,
বর্তমানে ‘বুদ্ধ ভবন’) থাকাকালীন ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে তরুণ
শিক্ষকদের উন্মাদনার কথা | সেসময় নরেন্দ্রপুরের ব্যাচেলর শিক্ষকদের আবাস ছিল ওই BTQ
| অজিতদা বলতেন নকশাল আমলের উত্তপ্ত সময়ের নরেন্দ্রপুর মিশনের কথা | এই
প্রসঙ্গেই আমরা জানতে পারি রঞ্জন মহারাজের মতো ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্বের কথা | আরেকটা
মজার কথা বলেছিলেন অজিতদা | ১৯৫০-৬০ এর দশকে নরেন্দ্রপুরে বেশ কিছু বিদেশী শিক্ষক শিক্ষকতা
করেছিলেন, পুরনো স্কুল ম্যাগাজিনগুলো দেখলে এঁদের নাম পাওয়া যায় | এরকমই
একজন শিক্ষক নতুন এসেছেন, অজিতদার সাথেই তাঁর টেম্পরারি থাকবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে | সেটা
গরমের দিন, বেচারা বিদেশী বড় কাহিল হয়ে পড়েছেন গরমে | সন্ধ্যাবেলায়
তিনি স্নান করার জন্য জামাকাপড় খুলে একেবারে ‘জন্মদিনের
পোশাকে’ (এটা ছিল অজিতদার পেটেন্ট কথা !) সজ্জিত হয়ে
কেবলমাত্র একটি তোয়ালে কাঁধে চাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাত্রা শুরু করেছেন বাথরুমের
উদ্দেশ্যে| ভাগ্যিস সে সময় ছাত্ররা কেউ রুমে ছিল না, তারা
সবাই গিয়েছিল স্টাডিহলে পড়াশুনা করতে, অজিতদা
দৌড়ে গিয়ে তাঁকে আটকান আর ঘরে টেনে নিয়ে আসেন| সে
বেচারা তো বুঝতেই পারে না উলঙ্গ হয়ে সর্বসমক্ষে চলাফেরা করাতে অসুবিধা কি, তার
উপর এখানে যখন সবাই ছেলে! শেষে অনেক কষ্টে অজিতদা তাকে বোঝান ভারতীয় ও পাশ্চাত্য
সভ্যতার পার্থক্য| আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা অজিতদার অভিনীত নাটক দেখতে পাইনি, আসলে
আমরা যখন মিশনে ভর্তি হয়েছি ততদিনে অজিতদা নাটক করা ছেড়ে দিয়েছেন| শুনেছি
ঐতিহাসিক নাটকে তিনি অসাধারণ অভিনয় করতেন|
অজিতদার
মনপ্রাণ জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ| সারদানন্দ
ভবনের পিছনদিকে যে এক-চিলতে ঘরটায় মাঝেমাঝে থাকতেন, কয়েকবার
সেখানে গিয়েছি| সেই অগোছালো ঘর জুড়ে ছিল শুধু বই আর বই| নিজে
যেমন ছিলেন মুক্তমনা, সেরকম ছাত্রদেরকেও শিখিয়েছিলেন মনের জানালা খুলে দিতে | শিখিয়েছিলেন
প্রশ্ন করতে| শিখিয়েছিলেন সত্যবাদী হতে| বলেছিলেন
দোষ করলেও মাথা উঁচু করে তা স্বীকার করার সৎসাহস রাখতে| ধর্ম-সমাজ-রাজনীতি
সমস্ত বিষয়েই তিনি খোলাখুলি আলোচনা করতেন| স্বামীজি
যে ‘Man making & character building’ এর কথা
বলে গেছেন অজিতদার জীবনের লক্ষ্যই ছিল তাই| দেশ-বিদেশের
অসংখ্য ছাত্র তাঁর দেখানো আদর্শকেই জীবনের পাথেয় করেছে| শাশ্বত
শিক্ষক বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন ঠিক তাই| এই
আদর্শ খানিকটা তিনি উত্তরাধিকার সুত্রে লাভ করেছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে| অজিতদার
বাবাও ছিলেন একজন আদর্শবাদী শিক্ষক | ছেলেকে
তিনি বলেছিলেন, “বড় হয়ে হয় শিক্ষক হবি, নাহলে
হবি ওয়াগন ব্রেকার| এর মাঝামাঝি কিছু নয়|”
আজ
থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগের কথা| ১৮ ই
জুন, ২০১০| শুক্রবারের অবসন্ন বিকেলবেলা| আকাশের
মুখ ভার| মিশনের মেইন গেটটা দিয়ে ঢুকেই যে বিশাল মাঠটা, তার
পাশে রাখা একটা শববাহী ভ্যান| সেখানে
চিরনিদ্রায় শায়িত অজিতদা| সবাই শোকে স্তব্ধ, সময়ও
যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে| একটু পরেই অজিতদার শেষ ইচ্ছা অনুসারে গোটা স্কুল ক্যাম্পাসে ঘোরানো
হবে তাঁর নশ্বর দেহ| এক বুক শূন্যতা নিয়ে ঘরে ফিরে আসতে আসতে নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, সত্যিই
কি অজিতদা আর নেই ? এরপর যত দিন গিয়েছে তত অনুভব করেছি যে অজিতদা আছেন, ভীষণভাবে
আছেন আমাদের মধ্যে| তিনি তো নিছক রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন না, আপামর
ছাত্রকূলের কাছে তিনি ছিলেন ‘larger than life’, সামান্য
মৃত্যুর সাধ্য কি তাঁকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবে!!
অজিত
কুমার সেনগুপ্ত মরিয়া প্রমাণ করিয়াছেন তিনি মরেন নাই!
Courtesy: Sri Arghya Das, in Narendrapur ex-Student’s Forum, a
closed group in FB.
এক অনন্য কাহিনী!
ReplyDelete