নেই কোনও সন্ত্রাস
অনুরাধা রায়
কলেজের টিচার্স
কমনরুমে বসেছিলাম। দুজন ছাত্র এসে দাঁড়াল। দুজনকেই বিরোধী ছাত্র-সংগঠনের নেতা বলে জানি। এই কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সরকার-বিরোধী পক্ষ বেশ শক্তিশালী। এদের একজন, নাম দীপক, আমাদের ইতিহাস বিভাগেরই ছাত্র। সেমেস্টারের গোড়ায় দু-একদিন ক্লাসও করেছিল, তারপর আর দেখি না। সে-ই বলল-‘স্যার, আপনাকে আমাদের প্রতিবাদ সভায় সভাপতি হতে হবে।’
আমি – কিসের প্রতিবাদ?
দীপক – ঐ যে ক্লাস এইটের সরকারি ইতিহাস বইতে ক্ষুদিরামকে সন্ত্রাসবাদী বলেছে। এ আমাদের শহিদদের অপমান, আমাদের সবার অপমান।
আমি - কিন্তু ওরা তো
সত্যি পদ্ধতি হিসাবে সন্ত্রাসই ব্যবহার করেছিল। নিজেরাই সেটা বলত। সেটা স্বীকার
করলে ওদের অপমান করা হবে কেন? প্রতিষ্ঠান-বিরোধী সন্ত্রাসবাদ হিসেবে বিপ্লবী
সন্ত্রাসবাদের কথা নানা দেশের ইতিহাসেই আমরা পড়ে থাকি। খুব প্রচলিত শব্দবন্ধ। এ দেশের কলেজ স্তরের
সব থেকে মান্য ইতিহাসের টেকস্ট বই সুমিত সরকারের ‘ Modern
India’-তে revolutionary terrorism কথাটা ব্যবহৃত। আরো অনেক নামকরা ঐতিহাসিক ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ’ বা এমনকি শুধু ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন ওদের বোঝাতে। এই স্কুলের বইতে কি
শুধু সন্ত্রাসবাদী বলেছে, না কি বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী?
অন্য ছেলেটি বলল – বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীই বলেছে। কিন্তু স্যার, সন্ত্রাসবাদ শব্দটা এক্ষেত্রে আমরা মেনে নিতে পারছি না।
শুধু বিপ্লবী বললে আপত্তি ছিল না।
আমি – শুধু বিপ্লবী
অনেক সময় ওদের বলা হয় বটে; কিন্তু বিপ্লব শব্দটা তো অস্পষ্ট তাই না? কিসের বিপ্লব,
কেন বিপ্লব – এইসব প্রশ্ন থেকে
যায়। দেখ না, আমাদের এই বাংলায় তো
অনেকদিন ধরে বিপ্লব বলতে সাম্যবাদী সমাজ-বিপ্লব বোঝাত। তারপর সেই মানেটা কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল! এমনও
দেখেছি হোস্টেলের ছাত্ররা ডিনারে পচা মাছ
দেবার জন্যে ওয়ার্ডেনের অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে আর ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ স্লোগান দিচ্ছে। আবার এখন খুব শুনি আই-টি বিপ্লব। সে যুগের বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীরা বিদেশি শাসক তাড়িয় দেশে
একটা রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। এমন কতরকমের বিপ্লবই তো হতে পারে।
ছেলেটি – কিন্তু
স্যার, ওদের ‘জঙ্গী জাতীয়তাবাদী’ বা ‘সশস্ত্র বিপ্লবী’ও তো বলা যায়।
আমি – তা যায়, তবে তাতেও তো হিংস্রতার গন্ধ থাকে। আর সেখানেই বোধহয়
তোমাদের আপত্তি?
দীপক ছেলেটি তেড়ে
ফুঁড়ে বলল – যাই বলুন স্যার, সন্ত্রাসবাদী শব্দটা অপমানজনক।
আমাদের প্রতিবাদ করতেই হবে। ফেস-বুক টিভি সর্বত্র প্রতিবাদ হচ্ছে। আপনি এটাকে কী করে মেনে নিচ্ছেন
জানি না। কিন্তু অন্য সব কলেজের অনেক স্যারই প্রতিবাদ করেছেন। আমরা আমাদের
কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান হিসেবে আপনাকে প্রতিবাদ সভায় পাব ভেবেছিলাম। আপনি রাজি না হলে আমাদের বাইরে থেকে কোনও অধ্যাপককে নিয়ে
আসতে হবে।
আমি – তাই এনো। আমি নিজের মাথা দিয়ে নিজে চিন্তা করে থাকি।
কিন্তু কেন শব্দটাতে এত আপত্তি হচ্ছে বল তো? আজ যাদের সন্ত্রাসবাদী বা আতঙ্কবাদী বলে তাদের কথা মনে
করিয়ে দিচ্ছে বলে? আর তাদের তোমরা
পচ্ছন্দ কর না বলে? তাদের আমিও পচ্ছন্দ করি না অবশ্য, কারণ তাদের সন্ত্রাস নিরীহ মানুষদের টার্গেট করে। এটা
আমাদের ক্ষুদিরাম করতেন না, যদিও ভুল করে যে কিছু নিরীহ মানুষদের মেরে ফেলেননি তা
নয়। ওঁরা দেশকে অধীনতা-অত্যাচার থেকে মুক্ত করার জন্য সন্ত্রাসের ব্যবহার
করেছিলেন, অন্তত উদ্দেশ্যের
কথা ভাবলে সদ্ব্যবহারই বলতে হয়। ওঁদের সাহস, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ সমীহ জাগায়।ওঁরা জানতেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক
বোমা-বন্দুক ছুঁড়ে
সাহেবদের হারাতে পারবে না। কিন্তু সাহেবদের মনে সন্ত্রাস তৈরি করলেই কাজটা
অনেকটা এগোবে। তাছাড়া বারীন ঘোষ আর একটা উদ্দ্যেশ্যের কথাও বলেছিলেন – দেশশুদ্ধু লোক যে ঘুমিয়ে আছে বোমার শব্দে তাদের জাগিয়ে
তোলা। আর একটা কথা কি জান, একদিন হয়ত এমন ইতিহাস লেখা হবে যেখানে আজকের আতঙ্কবাদীরা, মানে আজমল কাসভ–টাসভরাও সংগ্রামী বীরের মর্যাদা পাবে। এখনই অনেকের কাছে তারা সংগ্রামী বীর। যাই হোক যেটা আমদের বুঝতে
হবে তা হল সন্ত্রাস অনেক ধরনের হয়। আমাদের বিপ্লবীরাই তো একসময়ে সন্ত্রাস
ব্যবহারের ধরন বদলে ফেলেছিলেন। প্রথম দিকে ব্যক্তি হত্যার পথ নিয়েছিলেন, পরে আরো অনেক বড় করে সাহেবদের আঘাত হানতে চান – চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন তার প্রমাণ। সেদিনই তো
ক্লাসে ১৯২০-র শেষ থেকে বিপ্লব প্রচেষ্টায়
পরিবর্তনের ঝোঁকটা বোঝাচ্ছিলাম। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল সন্ত্রাসের কন্টেকস্ট-টা বোঝা। ইতিহাসে বিশ্লেষণটাই বড়, আর সেটা কন্টেকস্ট অনুযায়ী হতে হয়। শুধু কতগুলো নাম বা
বর্গ দিয়ে ইতিহাস-বর্তমান কিছুই বোঝা
যায় না। নামে কী বা আসে যায়! পৃথিবীটা খুব জটিল তো। কোন নামই তার ব্যাপার-স্যাপার বোঝার পক্ষে সম্পূর্ণ ও যথেষ্ট নয়। নামের অর্থগুলো যে সাধারণের মনে বদলে বদলে যায়, এটাও তো ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। এটাকেও তো আমাদের বুঝতে
হবে। বোঝাটাই দরকার। অন্ধ সংস্কার কিন্তু বোঝার পথ থেকে সরিয়ে আনে। তোমরা যা করছ, তা তো কিছুদিন আগে রামানুজের ‘Three
Hundred Ramayanas’ নিয়ে আপত্তির মতো হয়ে যাচ্ছে।
অন্য ছেলেটি তড়িঘড়ি
বলল – ওরা আলাদা দল,
স্যার। আমাদের আদর্শ আর রাজনীতি অন্য। ওরাও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে প্রতিবাদ করছে বটে, কিন্তু ওদের আলাদা কর্মসূচী।
আমি – সে আমি জানি। কিন্তু তোমরা একই রকম অন্ধ, সেটাই বলতে চাইছি।
ছেলেটি বলল – তা, আপনি না-ই যদি সভাপতি হন, অন্তত একটু চাঁদা তো দেবেন?
আমি – চাঁদা আবার কিসের?
- আমরা শিক্ষা দপ্তরের
সামনে সারাদিন অবস্থান বিক্ষোভ করব আগামীকাল, তার তো খরচা আছে। বাস-ভাড়া, খাওয়াদাওয়া। স্যারেরা আমাদের সাহায্য করছেন। কয়েকজন
সঙ্গেও যাবেন।
- না, আমি চাঁদা দেব না।
দীপক প্রায় দাঁতমুখ
খিঁচিয়ে বলল – আগে আপনাকে অন্যরকম
ভেবেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি আপনি সরকার পক্ষের দালাল।
অন্য ছেলেটি দীপককে
ধমক দিল – এই, স্যারেদের সঙ্গে এরকম অসভ্যের মতো কথা বলবি না তো! কিছু মনে করবেন না স্যার। ওর বড্ড মাথা গরম।
দীপক তারপরেও বলল – এটা আপনি ভাল করছেন না স্যার। আমাদেরও দিন আসবে।
আমার বিভাগের কনিষ্ঠ
সহকর্মী সায়ন্তন পাশেই ছিল – খুব ঝকঝকে ছেলে, স্পষ্টবক্তা। এতক্ষণ ওদের কথা শুনতে
শুনতে তার মুখ খুব থমথমে হয়ে উঠছিল; সেটা লক্ষ করছিলাম। এবার সে ওদের ধমকে বলে উঠল
– “তোমরা পেয়েছ কী? মাস্টারমশাইদের অপমান করছ, আবার চাঁদা চাইছ? এই যে
তুমি এক্ষুনি ওঁকে বললে ‘এটা আপনি ভাল করলেন না’, এটা সন্ত্রাস তৈরি করা নয়?
তোমাদের আমি চিনি। তোমাদের রাজ যখন ছিল, অনেক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সন্ত্রাস হয়েছে,
তোমরা তার মদত করেছ। এখন
বর্তমান সরকারের সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করছ। আবার নিজেরাও দরকার মতো সন্ত্রাস করে
নিচ্ছ। আ্যডমিশনের দিনে তো দুপক্ষই বাঁশ নিয়ে মারামারি করেছ। দুনিয়া দেখেছে। এখন
অশিক্ষিতের মতো একটা নন-ইশু নিয়ে আঁতলামি আর দেশপ্রেম দেখাচ্ছ?
দীপক প্রায় তেড়ে যাচ্ছিল
সায়ন্তনকে। অন্য ছেলেটি তাকে আটকালো। সায়ন্তনকে ভদ্রভাবে বলল – আমাদের সবাইকে কিন্তু বাঁশ হাতে সেদিন দেখা যায়নি, স্যার। দু-চারজনের মাথা গরম থাকে।তাদের সঙ্গে আমাদের সবাইকে এক
করবেন না প্লীজ।
সায়ন্তন বলে যেতে
লাগল – শোনো দীপক, তোমার আচরণেরও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আছে। ইতিহাসের ছাত্র
হয়েও ইতিহাস তো পড়ার প্রয়োজন মনে কর না। পড়লে বুঝতে যে মানুষের গোটা ইতিহাসটাই মোটামুটি
ক্ষমতা ফলানোর ইতিহাস, অনেক লোকের ওপর কিছু
লোকের দাপটের ইতিহাস। তার নানা পন্থার মধ্যে একটা পরিচিত পন্থা সন্ত্রাস। বই-টই তো পড় না, সুমিত সরকারই পড় না, Daniel
Lord Smail-এর ‘On Deep History and the Brain’ পড়ার প্রশ্নই নেই। সেখানে খুব পরিষ্কার দেখানো হয়েছে – সন্ত্রাস মানুষের স্বভাবেই থাকে। বলা যায়, brain-body chemistry-তে থাকে। সন্ত্রাস একটা major psychotropic mechanism, যা আমাদের শরীরের মধ্যে neurochemical release করে। যা হোক, এসব কথা বেশি বললে তো মূর্চ্ছা যাবে! বিজ্ঞানে কম নম্বর পেয়েই তো ইতিহাস পড়তে এসেছ। তবে এটুকু দেখছি, আগে গণতন্ত্রে অন্তত একটু রেখে ঢেকে ক্ষমতা দেখানো হত, ইদানীং সব দলের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে সন্ত্রাস করে চলেছেন – মুখে এবং কাজেও। আর তোমরা তা থেকেই শিখছ।
শোন, সন্ত্রাসকে একদিকে একটা trans-historical process হিসেবে দেখতে হবে, অন্যদিকে সন্ত্রাসের ধারণাটার epistemic construction কেমন এক সময় থেকে অন্য সময়ে, এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে বদলে যায়, সেটা বুঝতে হবে। একটু লেখাপড়া কর, বুঝলে!
দীপক মুখ
বেঁকিয়ে বলল – ‘আমাদের অত লেখাপড়া করার সময় নেই। আমরা জনগণের জন্য কাজ করি।’ দ্বিতীয় ছেলেটি
মন দিয়ে সায়ন্তনের কথা শুনছিল। সে বলল – ‘স্যার, আমি সায়েন্সের স্টুডেন্ট। বটানির।
কিন্তু আপনি কি মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক বলে সন্ত্রাসকে ন্যায্যতা দিতে চাইছেন?’
সায়ন্তন – না,
ন্যায্যতা দিচ্ছি না। সন্ত্রাস আমাদের শরীরে hardwired হয়ে নেই। ঐ যে স্যার বললেন কন্টেকস্ট - কন্টেকস্টই তাকে
বের করে আনে, নানা চেহারায়। এই কন্টেকস্ট হল বেঁচে ওঠার পরিবেশ – সমাজ, সংস্কৃতি,
শিক্ষা ইত্যাদি। যার যেমন। আর deep history পড়লে বুঝবে সন্ত্রাস যেমন আমাদের মধ্যে আছে, পারস্পরিক ভালবাসা সহযোগিতা
এসবও আছে। Evolutionary
anthropologist Christopher Boehm দেখিয়েছেন যে
পুরনো প্রস্তর যুগে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলত
আর কাউকেই বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে দিত না। অর্থাৎ এমন নয় যে ক্ষমতা বিস্তার
অনিবার্য ভাবে রয়েছে মানুষের মজ্জায় মজ্জায়। নতুন প্রস্তরযুগে বিশেষ করে
কৃষিকার্যের প্রবর্তনের ফলে কিন্তু মানুষের মধ্যে নানান বিভাজন, কিছু মানুষদের ওপর
অন্য মানুষদের কর্তৃত্ব ফলানো শুরু হল। তারপর থেকে ইতিহাস মোটামুটি সেই ধারাতেই
চলেছে। কিন্তু আজও মানুষ ইচ্ছে করলে ক্ষমতার বদলে নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিতে পারে।
ঐ যে বললাম সবটাই নির্ভর করে আমাদের শিক্ষা
ও সংস্কৃতির ওপর। শিক্ষায় ফাঁকি দেওয়াটা তাই বরদাস্ত করা যায় না, বুঝলে তো?
ইতিহাস লুকিয়ে রাখা অশিক্ষার লক্ষণ! যাও, এখন বিদায় হও।
ছেলে দুটি আর
বিশেষ সুবিধা হবে না বুঝে চলে গেল। দীপক গজগজ করতে করতে, অন্য ছেলেটি চিন্তিত
মুখে।
-----
আমি সায়ন্তনের
কাছে deep history নিয়ে আর একটু জানতে চাইব ভাবলাম। কিন্তু তার আগে প্রথম
কথাই ওকে বলতে হল – ‘সায়ন্তন এদের চটানো ভাল কথা নয়। খুব সাবধানে থেক!’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সমীরবাবু বললেন – ‘ঠিকই। কিন্তু সায়ন্তন ওদের ভাগিয়ে
দিয়ে এক দিক দিয়ে ভালই করেছ। সামনেই তোমার প্রোমোশন। প্রিন্সিপাল সরকার
পক্ষের লোক। সরকার বিরোধী কোন কাজে মদত করা একেবারে পছন্দ করতেন না।
সায়ন্তন –
হ্যাঁ, সে আমি জানি। প্রায়ই উনি আমাকে মনে করিয়ে দেন যে সামনেই আমার career advancement, কাজেই যেন বুঝে শুনে চলি। মানে আমাকে সন্ত্রস্ত করে তোলা
আর কি। কিন্তু আপনার কি মনে হল যে আমি ছেলেদুটিকে এত জ্ঞান দিলাম নেহাত প্রোমোশনের
কথা ভেবেই?
সমীরবাবু – না,
না। তুমি সত্যি খুব পণ্ডিত ছেলে। অত পাণ্ডিত্য বুঝিও না। তবে পাণ্ডিত্যের সঙ্গে political
correctness-ও থাকতেই হয়,
এটুকু বুঝি। Politically
correct হওয়াটা খুব বড়
কথা কিন্তু। সে যার যেমন পলিটিক্স। এই যে যে সব অধ্যাপক এখন
কাগজের চ্যানেলে ক্ষুদিরামদের সন্ত্রাসবাদী বলার প্রতিবাদ করেছে, তাদের একজনের
বইয়ে অন্তত আমি ওদের সম্পর্কে সন্ত্রাসবাদী শব্দটাই দেখেছি। এখন তিনি বুঝে নিয়েছেন
যে ওটা politically correct নয়।
সায়ন্তন – জানি
জানি, শুধু সন্ত্রাসবাদী বললে তো কথা ছিল না; কি না ওদের
বলেছে ওরা – এলিটিস্ট, কমিউনাল….। যারপরনাই মোটা দাগে দাগিয়েছে। আর এখন দরদ উথলে পড়ছে। যত সব
ঘাস-বিচালি-ঘাস খাওয়ার দল।
আমি বললাম –
এদেশে কমিউনিস্ট, সোশালিস্টদের অনেকে যে ঐ বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে থেকেই
এসেছিলেন। এইটা বুঝেই হয়ত ---।
সায়ন্তন –
কিম্বা আবেগঘন জাতীয়তাবাদে আশ্রয় না নিলে
সমাজবাদের আর দাঁড়াবার জায়গা নেই বলে----
আমাদের কথা শেষ
হবার আগেই, যে ছেলে দুটি একটু আগে এসেছিল তাদের মধ্যে বটানির ছেলেটি অন্য এক
ছাত্রকে নিয়ে আবার আমাদের কমন রুমে ঢুকল। অন্য ছাত্রটি ইতিহাসেরই। মৈনাক। মোটামুটি
ভালই ছাত্র এবং ভদ্র। আমি পছন্দই করি। বটানির ছেলেটি এসে বলল – স্যার, আমি তো
ইতিহাসের ছাত্র নই। একটা কথা আমার মনে জাগছে। এই ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন ইত্যাদি
যাদের বিপ্লবী বলা হয়, তারা সবাই কি সত্যি অস্ত্র নিয়ে খুন-টুন করতে গিয়েছিল? হয়ত
ঘটনাগুলো সেরকম ঠিক ছিল না। তখন তো ভিশুয়াল মিডিয়া ছিল না। পুলিশ-প্রশাসনের তরফে
যা হোক একটা কিছু বলে দিলে কে আর চ্যালেঞ্জ করতে যাবে! হয়ত
অত কিছু হিংসা সত্যি তারা করতে যায়নি। অন্তত কোন কোন ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা একটু
অন্যরকম করেও তো ভেবে নিতে পারি? এই যে মৈনাক আপনাদের ইতিহাসেরই ছাত্র। ও তো বলছে,
এখন কেউ জোর দিয়ে বলে না যে একটাই historical narrative হতে হবে, বরং multiple history-র কথা বলা হয়। ইতিহাস নিজের মত করে বানিয়ে নেওয়াই যায়,
নেওয়া হয়ও। কি রে, মৈনাক?
মৈনাক লাজুক
মুখে বলল – হ্যাঁ, স্যারদের কাছেই তো এসব শুনেছি।
আমি – যাক্
বাবা, তা বলে কি তুমি বলতে পারবে সন্ত্রাসবাদীরা আদৌ সন্ত্রাস করে
নি?
বটানির ছেলেটি
বলল – এমনও তো হতে পারে যে সবটাই সাম্রাজ্যবাদী প্রেসের প্রচার।
আমি – তা বটে!
সোভিয়েটের পতনের পর একটা সভায় আমাদের এক ছাত্রকে বলতে শুনেছিলাম এসবই বুর্জোয়া
প্রেসের প্রচার। সে এখন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে।
বটানির ছাত্রটি
একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলল – স্যার, সামনে ক্ষুদিরাম দিবস। ঐদিন ওঁর সন্ত্রাসবাদী
অপবাদ আমাদের ঘোচাতেই হবে। এটা আমদের নৈতিক দায়িত্ব বলে আমরা স্বীকার করে নিয়েছি।
মৈনাককে বললাম ও যদি একটু সাহায্য করে। একটা অন্যরকমের ন্যারেটিভ
যদি তৈরি করে দেয়! কিন্তু ও ঠিক ভেবে উঠতে পারছে না।
মৈনাক বলল -
ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার দায়ও তো আছে আমার! কি যে করি স্যার!
হেসে বললাম –
ভাবতে থাক, ঠিক একটা কিছু বেরবে। ইতিহাসের দায় আর ইতিহাসের মুক্তির মধ্যে
সামঞ্জস্যবিধান তো তোমাদের মত তরুণ ইতিহাসের ছাত্রদেরই করতে হবে।
-----
দুদিন পরে ক্লাস শেষ
করে ফিরছি। কলেজের সিঁড়ির তলায় দেখি জোর রিহার্সাল চলছে। আর কলেজের পাশের মাঠে
মঞ্চ বাঁধা হচ্ছে। আগামী কাল প্রতিযোগী ছাত্র-সংগঠনের নাটক হবে কলেজের পাশের মাঠে।
প্রিন্সিপাল কলেজের অডিটোরিয়াম দেননি। নাটকের নাম শুনলাম ‘শহিদ ক্ষুদিরাম’।
একটু দাঁড়িয়ে
পড়ে রিহার্সাল দেখলাম। একটি ছেলে প্রফুল্ল সেজেছে, সে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে
যাচ্ছে, কাঁধে একটা ঝোলা। একটু দূরে একটা বাড়ির ফাসাডের মত আঁকা আর ‘ইউরোপিয়ান
ক্লাব’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে একজন
দাঁড়িয়ে। প্রফুল্ল সেদিকেই যাচ্ছে। পরের দৃশ্যে ক্ষুদিরাম, সে হল আমাদের মৈনাক।
সে-ও একটু অন্য পথ ধরে একই দিকে রওনা হল। খানিকটা চলার পর একটি ছেলে এসে গোল মত কি
যেন তার হাতে দিল। মৈনাক বলল – ঠিকঠাক কাজ করবে তো? ছেলেটি বলল – ‘একদম। কোন
চিন্তা নেই। একটু উঁচু করে ছুঁড়বি। দশ ফুট মত উঠলেই ফুলের মালা বেরিয়ে ঝরে ঝরে পড়বে। সন্তোষদা নিজে
বানিয়েছে। প্রতি বছর বাজির কম্পিটিশনে সন্তোষদার ফার্স্ট, সেকেণ্ড, থার্ডের মধ্যে
একটা প্রাইজ বাঁধা।’
এই তাহলে
মৈনাকের অন্যরকম ন্যারেটিভ। এক ফাঁকে ওকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম – ‘তুমি লিখেছো এই
নাটক?’
ও বলল – ‘না
স্যার নাটক লিখেছে বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র শেখর সেন। ওর নাম শুনেছেন তো? ও
বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় গল্প লিখে বেশ নাম করেছে।’ মৈনাক চলে গেল। ইতিমধ্যে আমার
উপস্থিতি অন্য কোন ছাত্রের নজরে পড়েছে। দেখলাম আমার দাঁড়িয়ে থাকাটা তারা ঠিক পছন্দ
করছে না। হয়ত আমাকে ওদের বিপক্ষের লোক মনে করছে বলেই। একজন এসে
স্পষ্টই বলল – ‘আপনি এখন
যান স্যার। এটা আমাদের নিজেদের ব্যাপার।’ তারপর ভদ্রতা করে বলল – ‘আপনি শনিবার
নাটক দেখতে আসতেই পারেন অবশ্য।’
আমি বেরিয়ে
এলাম। না, শনিবার নাটক দেখতে যাবার কোন ইচ্ছে নেই। কিন্তু বেশ কৌতূহলও হচ্ছে –
কিরকম দাঁড়াচ্ছে ক্ষুদিরাম দিবসের নাটক। রসায়ন বিভাগের এক সহকর্মী কলেজের
কোয়াটার্সে থাকে। তার ঘরের একেবারে সামনেই স্টেজ বাঁধা হয়েছে। তাকে বাধ্যত নাটক
দেখতে হবে। শনিবার রাতের দিকে তাকে ফোন করলাম – ‘কি পরিমল আজ নাটক কেমন হল?
ক্ষুদিরামের বোমার ভিতর ফুলের মালা-টালা কিসব আছে শুনলাম।’
পরিমল বলল – আর
বলবেন না! ওটাকে একটা প্রেমের গল্প বানিয়েছে ওরা। ক্ষুদিরাম এক তরুণী মেমসাহেবের
প্রেমে পড়েছে। ইকনমিক্সের একটা ধবধবে ফরসা কটা-চোখ মেয়ে আছে না? ওকে মেম সাজিয়েছে।
টেনিস কোর্টে মেম যখন টেনিস খেলে ক্ষুদিরাম তার বল-বয়। মেম মাঝে মাঝে একটু হেসে
ওকে ধন্যবাদ দেয়। তাতেই সে মেমের প্রেমে পাগল। তার জন্য জানলার ধারে বসে বসে অনেক
চিঠি লেখে, বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র থেকে অনেক কোটেশন। তা সে মেয়ে মায়ের সঙ্গে
ইওরোপীয়ান ক্লাবে যায় সন্ধ্যেবেলা, তাই ক্ষুদিরামও ঠিক করল সেখানে গিয়ে তাদের
গাড়িতে রকেট বোমা ছুঁড়বে। সেই বোমা আকাশে উঠে মালা হয়ে ঝরে পড়বে। তাতে মেম খুব
ইমপ্রেস্ড হবে নিশ্চয়ই। গান গাইতে গাইতে ক্ষুদিরাম চলল – ‘আমি সারা সকালটি বসে বসে
সাধের মালাটি গেথেঁছি।’ আচ্ছা এটা অতুলগীতি, তাই না?
আমি – হ্যাঁ।
‘পরাব বলিয়া তোমারই গলায় মালাটি আমার গেঁথেছি।’ কিন্তু তারপর কী হল?
পরিমল – ওদিকে
প্রফুল্ল চাকীও সেই মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু। সে-ও টেনিস কোর্টে বল-বয় ছিল। এই নিয়ে
দুই বন্ধুর মধ্যে কিছু টেনশনও দেখানো হল। যা হোক সে-ও একই দিনে
ইওরোপীয়ান ক্লাবের উদ্দেশ্যে রওনা হল। গুন গুন করে আবার গান গাইছে – ‘আমার পরান
যাহা চায়, তুমি তাই গো।’ পকেটে তার কবিতার খাতা। সে মেমকে স্বরচিত কবিতা পড়ে
শোনাবে।
কিন্তু ক্লাবে
পৌঁছোনোর ঠিক আগে, একটু দূর থেকেই প্রফুল্ল দেখতে পেল ক্ষুদিরামের কীর্তি।
ক্ষুদিরাম অপেক্ষা করছিল এক পাশে। গাড়ি ক্লাবের গেটে থামতেই সে বোমা ছুঁড়ল। দুম
করে একটা আওয়াজ। মালা যে ভাল তৈরি হল তা নয়, তবে ফুল দুয়েকটা ঝরে পড়ল। এ নিয়ে
ছেলেরা রাগারাগি করেছিল। যে বোমা বানিয়েছে তার কপালে দুঃখ আছে। যাই হোক, মেম সবে
গাড়ি থেকে নেমে গেটের দিকে পা বাড়িয়েছে। বোমা ফাটায় আর্তনাদ করে সে ক্ষুদিরামের
বুকের ওপরেই ঢলে পড়ে গেল। অমনি সবাই এসে হই হই করে ক্ষুদিরামকে ধরে ফেলল। পুলিশও
এসে গেল। ‘একবার বিদায় দে মা’ গাইতে গাইতে ক্ষুদিরাম পুলিশ ভ্যানে উঠল।
আমি – আর, মেম
নিশ্চয়ই বলল, ‘বন্দী আমার প্রাণেশ্বর’?
পরিমল – না,
মেম অজ্ঞান হয়েই পড়ে রইল। তার চোখেমুখে সবাই জল ছেটাতে লাগল। আর ক্ষুদিরাম তার
দিকে করুণ-বিহ্বল চোখে চেয়ে গাইতে গাইতে চলে গেল – ‘ফুলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়েছিলেম রাস্তার ধারে, মেমসাহেবকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই গেলাম ফাঁসি’।
আমি – বাঃ
বিপ্লবী আন্দোলনের চমৎকার বাঙালি ভারসন। বাঙালি মানেই প্রেম, প্রেম মানেই বাঙালি! আর বাঙালি
ছেলের মেমসাহেবের প্রেমে পড়া এক রকমের সামাজিক বিপ্লব তো বটেই! তা ক্ষুদিরামের কি
শেষ অব্দি সত্যি ফাঁসি হল? সেটা দেখানো হল স্টেজে?
পরিমল –
ফাঁসিটা দেখানো হয়নি। তবে জানানো হল যে ফাঁসি-ই হতে যাচ্ছে। শেষ দৃশ্যে সেই খবর
আসতে মেমসাহেবও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আর ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের ওপর মানবতার
বল, প্রেমের বল প্রয়োগ করতে গিয়েই ক্ষুদিরাম শহিদ হল এমন ঘোষণা করে নাটকের
সমাপ্তি। গান্ধীর অহিংস পথও হার মেনে গেল এই বিপ্লবী পন্থার কাছে, এমন ইঙ্গিত
দেওয়া হল।
আমি – আর
প্রফুল্ল চাকীর কি হল?
পরিমল – সে তো
দূর থেকে ব্যাপারটা পুরো বোঝেনি। মেমকে ক্ষুদিরামের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেই
মর্মান্তিক আঘাত পেল। তাহলে তো আর কোন চান্স নেই। সে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ফিরতি
পথ ধরল। তখনও গান গাইছে – ‘যদি আর কারেও ভালবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস/ তবে তুমি
যাহা চাও তা-ই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো’। তারপর, তার কবিতার
খাতার পাতায় পাতায় বিষ মাখানো ছিল, সেই বিষ সে চেটে চেটে খেতে লাগল।
আস্তে আস্তে ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।’
আমি – আহা, এত
চট করেই মরণ বরণ করে নিল! কেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত যখন গাইছে, তখন শরৎচন্দ্রের অনুসরণও
তো করতে পারত! দেবদাসের মত মদে চুর হয়ে বেশ খানিকটা মাতলামি করা যেত। তাতে নাটক
আরো জমত।
পরিমল – না,
কলেজের নাটক তো। অপসংস্কৃতি বলে কথা উঠবে। তাই বোধহয় ওটা আর নাটকে রাখে নি। তবে
নাটকের পরে একটু-আধটু চলেছে মনে হয়। অনেক রাত অবধি মোচ্ছব। ঘুমোনো দায়!
আমি – যাক,
সন্ত্রাসবাদীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ অপবাদ ঘুচল তো! আর তার-ই সঙ্গে ইতিহাসের যবনিকা
পতন - একেই বোধহয় বলে ‘end of history’!
পরিমল হেসে বলল
– আপনার তাহলে চাকরি গেল!
আমি – হ্যাঁ,
এরপর কোন না কোন দাদা-দিদির দলে নাম না লিখিয়ে আর উপায় থাকবে না!
কৃতজ্ঞতা স্বীকার – মালিনী সিদ্ধান্ত
ক্ষমাপ্রার্থনা – ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী।
No comments:
Post a Comment