হ্যালো
কাস্টমার, স্বাধীনতা অ্যাভেলেবল্ হিয়ার
সায়ন্তন
মাইতি
আবার একটা খেলা করার দিন এসে
গেল।
‘স্বাধীনতা’ ‘স্বাধীনতা’ খেলা।
তেরঙ্গা পতাকা উড়িয়ে, জয় হিন্দ্ বন্দেমাতরম্ হুঙ্কার ছেড়ে, এক নিঃশ্বাসে স্বাধীনতা
সংগ্রামীদের নাম আউড়ে, কে ক’জন বিপ্লবীর নাম জানে তার প্রমাণ দিয়ে স্বাধীনতা-খেলা।
পলিটিক্যাল মিছিলে অবশ্য
‘বন্দেমাতরম্’টা রোজই শোনা যায়। ‘জবাব দাও, ক্ষতিপূরণ দাও, ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে
দাও’ (‘গড়ে দাও’ বাদ দিয়ে আর সবই করে দাও) কিংবা ‘এভাবে আমাদের দমিয়ে রাখা যাবে
না’ -প্রত্যেকটা স্লোগানের পরেই ‘বন্দেমাতরম্’। সার্থক মাতৃবন্দনা। ....যাই
হোক, আমাদের ওসব ভেবে লাভ নেই। শঙ্খ ঘোষ, শুভ দাশগুপ্তরা তো আছেন ফাঁপা ঢাক
পেটানোর গালমন্দ করতে। আমরা ছা-পোষা মানুষ। স্লোগানও শুনি, কবিতাও শুনি।
স্লোগানকারীদেরও বাহবা দিই, কবিদেরও।
যে যা-ই বলুক না কেন, আমার
কিন্তু মনে হয় আমরা সারা বছর ধরেই স্বাধীনতা-সচেতন থাকি। অন্তত পতাকা সচেতন। ‘জন গণ মন’ সচেতন (‘কোটেশন’ আছে কিন্তু, এড়িয়ে যাবেন না। ওটা
উঠিয়ে দিলে মানে হয়, জনগনের মন সম্পর্কে সচেতন)। আর.... আর.... আর কী যেন??? ও
হ্যাঁ, কালচার সচেতন। রহমানের উচ্চারনে ‘চিত্ত যেথা ভয়শুন্য’তে পাশ্চাত্য টান দেখে
আমাদের চিত্ত জ্বলে ওঠে। শাহরুখের মুখে ‘টেগোর সাব’ শুনে তখনই তাকে ‘গোর’ দিতে
ইচ্ছে করে। এরকম আরো কত.....
পতাকা নিয়ে আমাদের গাদাগুচ্ছের
আইন আছে, জানেন? ফ্ল্যাগ কোডের আতিশয্যে আমরা ডগোমগো। বেশিরভাগ দেশেই ‘পতাকার
অবমাননা’ বলতে শুধু পোড়ানো, থুতু ফেলা, মাটিতে ঘষটানো, পদদলিত করা, পাথর ছোঁড়া,
কাঁচি চালানো ইত্যাদি কয়েকটা চরম নোংরামিকে বোঝায়। আমরা সেখানে ব্যান করার
ব্যানারে গোটা একটা মহাকাব্য ঢুকিয়ে দিয়েছি। শুধু তাই নয়, খামার-পালানো মুরগীর মত
অপরাধীদের সন্ধানে দিনে ছাব্বিশ ঘণ্টা টাওয়ার খাড়া রেখেছি। এই বুঝি কেউ ফসকে গেল।
.....সে নয় ফসকালো, কিন্তু আমার দেশভক্ত গোয়েন্দাগিরির পরাকাষ্ঠাটাকেও যে ফসকে
দিল। এ যন্ত্রণা বোঝার মত কলজে কারোর আছে? কী বলেন বিনয়-বাদল-দীনেশ?
দেশটা ওয়ার্ল্ড কাপ জিতেই
মুশকিল করল। হরভজন আনন্দের চোটে অঙ্গে জড়িয়ে ফেলল জাতীয় পতাকা।
জা-আ-তী-ও-প-তা-কা-আ..... ভাবা যায়? নেহাৎ রবিঠাকুরের লেখা বলে, নইলে
‘পাঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠা’-র ‘পাঞ্জাব’টাকে শো-কজ করে ছাড়তাম। হরভজনের পরে ঐ
শাহরুখ খান আবার এক কাণ্ড করে বসল। দেশের বিশ্বজয়ের আনন্দেই। পতাকাটাকে মাথার উপর
বনবনাও, কেউ বারণ করে নি। কিন্তু ঘূর্ণির চোটে উলটে নিয়ে পালটে দিলে? গেরুয়া নিচে
আর সবুজ উপরে??? কী দুঃসাহস! লে ঠোক এফ.আই.আর. বাদশার নামে, কে কোথায় আছিস?
এ তো গেল সেলেব্রিটি। আরো কত
ছোটখাটো ঘটনা লেগেই আছে। জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাহান্ন সেকেণ্ডের জায়গায় সাতান্ন
সেকেণ্ড লাগল কেন??? মেঘ করে গিয়ে অসময়ে সূর্য পাটে চলে গেছে, তাও পতাকা নামাও নি
কেন? আর পতাকা আঁকা? ওতে তো খুব কশাস্ থাকতে হবে। কতটা সাদা থাকলে অশোক চক্র কতটা
বড় হবে, একচুল যেন এদিক ওদিক না হয়। ‘জাতীয় পতাকা’ রচনা লেখা??? ওতে পতাকার
হিস্টিরি একদম নিখুঁতভাবে লিখতে হবে। একটু ভুল হল তো গোটাটায় গোল্লা, বাকী হাজারটা
তথ্য যতই ঠিক থাক। সেদিন তো সেই তোতলা ছেলেটা বেজায় বিপদে ফেলল। বক্তৃতা করতে উঠে জিভে হোঁচট খেয়ে কিনা বলে ‘জাতীয় পকাতা’??? ....মাড় গেঁরেছে। বর্ণ বিপর্যয় অন্য
শব্দে যত খুশি হোক। ‘পতাকা’ বলতেই কেলেঙ্কারিটা করলি?
আমাদের অবাক লাগে জাপান,
অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, বেলজিয়ামের কথা ভাবলে। কোনো ‘ফ্ল্যাগ কোড’ই নেই? যে যা খুশি
করতে পারে পতাকা নিয়ে? আর ডেনমার্ক? নিজের দেশের পতাকার উপর ক্ষোভ দেখালে কোনো দোষ
নেই, কিন্তু দেশের মাটিতে অন্য দেশের পতাকা নিয়ে কিছু করেছ তো হাজতবাস!
বিশ্বশান্তি রক্ষার ঢং দেখে বাঁচি নে। মেক্সিকোর ব্যাপার স্যাপারও অদ্ভুত। নাম-কা-ওয়াস্তে
বলা আছে পতাকা অবমাননা করলে অনেকদিনের জেল হবে। কিন্তু হয় আদতে সামান্য জরিমানা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যাণ্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পেরুতে কি আইন আছে জানি না। তবে
লোকজন পতাকা দিয়ে আখছার এটা ওটা করছে, তাই দেখে কেউ কিস্যু বলছে না। কানাডা,
হাঙ্গেরী, ভেনিজুয়েলাতে আবার পতাকার উপর অত্যাচার করে জনগণ জাতীয় প্রতিবাদ জানায়। আশ্চর্য!!
জার্মানি, আয়ারল্যাণ্ড,
রোমানিয়া, পোর্তুগাল, আর্জেণ্টিনা, সুইজারল্যাণ্ড, ফ্রান্সে ‘ফ্ল্যাগ ইস্যু’ একটা
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, শাস্তিও হয় কেউ মানহানি করলে। তবে একদম শুরুতে যেগুলোকে
‘চরম নোংরামি’ বলে এলাম, তেমন অসভ্যতা করলে। আমাদের ওটুকুতে মন ভরবে না। এ
ব্যাপারে ওরা আমাদের চেয়ে পিছিয়েই আছে। আমাদের আদর্শ হল তুরস্ক, পাকিস্তান, চীন। ওরা
যেমন কড়া, আমাদের সেরকমই থাকতে হবে। তবেই না দেশমাতার ‘শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে’।
আজ আবার তেমন একটা দিন এসেছে।
নিজেদের জাহির করার দিন। নাকে-কাঁদা সিরিয়ালগুলোও আজকের দিনে স্পেশাল এপিসোড
দেখাচ্ছে। সেই এপিসোডে কুচুটে শাশুড়ি থেকে সর্বহারা বৌ সবাই পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে
কেমন স্বাধীনতা-স্বাধীনতা খেলছে। আমরাও খেলব।
আমাদের দেখাদেখি আরো কত লোক
খেলবে।
কিন্তু সবাই কি আর স্বাধীনতার
মর্ম বোঝে? ঐ যে রাস্তা দিয়ে সব্জির ঝুড়ি টানতে টানতে যে লোকটা যাচ্ছে, ঐ যে
রিকশাওয়ালাটা ক্লান্ত হয়ে ঝিমোচ্ছে, ওদের দেখলে করুণা হয়। স্বাধীন দেশের হাওয়া
বাতাস খাচ্ছিস আর ‘স্বাধীন’ মানেটাই বুঝলি না। বুঝবেই বা কী করে? সবাই কি আর আমাদের মত? আমরা হলাম জাতীয় পতাকার যোগ্য
ধারক। গেরুয়া মানে সাহস আর ত্যাগ। আমরা এই যে
কত সাহসের সাথে কত দেশদ্রোহীদের কাঠগোড়ায় তুলছি, কূটকচালী করে সময়
সদ্ব্যবহারের সুযোগকে ‘ত্যাগ’ করছি - সে তো সবাই দেখছে। সাদা রঙের মর্যাদা রক্ষায়
আমাদের নেতারা কী নিষ্ঠাবান সত্যবাদী এবং শান্তিকামী। আর আমরাও প্রতিদানে তাঁদের প্রতি বিশ্বাস রেখে জায়গামত ‘শিভ্যালরি’ দেখাই, যেমনটা পতাকার সবুজ রঙ আমাদের হতে
শিখিয়েছে। আর অশোক চক্রের অর্থ মেনে আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। এই তো একটা
সত্যিকারের ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্র।
একটা আবৃত্তি কানে আসছে। কোথায়
মাইকে বাজছে যেন!
“....ভারতবর্ষ মানে শুধু
মীনাক্ষীপুরম কিংবা জামা মসজিদ নয়,
ভারতবর্ষ মানে নেহেরুজীর
বংশানুবৃত্তি কিংবা জিন্না আলি সাহেবের অলিখিত শ্বেতপত্র নয়,
ভারতবর্ষ মানে ঠাকরের কার্টুন
কিংবা জামাতি মুরুব্বিয়ানা নয়।
ভারতবর্ষ মানে এক ভালোবাসা
আমার, তোমার, শব্দের, সঙ্গীতের, জীবনের, আকাশের, মাটির।”
..... ..... .....
হমমমম..... আগেও শুনেছি
কবিতাটা। নাম মনে নেই। দেবেশ ঠাকুরের লেখা। এসব আঁতেল কবিতার মানে আমরা বুঝি না।
সহজ কথা সহজভাবে বলতে পারে না। কীসব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখিত-অলিখিত এসব ভাট বকে
যাচ্ছে। এত জটিল করে বলার মানে কী?
আবার ধর্ম, রাজনীতি –সব ঘেঁটে
একাকার করে দিয়েছে দেখছি। কবি নয় তো, যেন দেশত্রাতা-
“আমার ভারতবর্ষে কোন গেরুয়া
রাজনীতিবিদ কিংবা ইমামের নির্দেশিকা নেই।
এখানে কোনো সংহিতা হাদিস ছাড়াই
কোজাগরী চাঁদের অকৃপণ আলো পড়ে ইদগার উপর
আর রমজানী চাঁদ তুলসীর মঞ্চের
গায়ে পূর্ণ আলো দিয়ে যায়....”
salute
ReplyDelete