Monday 14 July 2014

২০০ কোটির মূর্তি !


বল্লভভাই বনাম গান্ধী 

প্রবুদ্ধ বাগচী



সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ঠিক কাদের সর্দার ছিলেন ইতিহাসে হয়তো তার বিশদ বিবরণ আছে । কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একেবারে শেষ পর্যায়ে যখন মুম্বাইয়ে ভারতীয় নৌ সেনারাও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে, সেটা ১৯৪৬এর সম্ভবত ফেব্রুয়ারি মাস, তখন ব্রিটিশ সরকারও বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁদের চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে । নৌবিদ্রোহ শুধু নৌসেনাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, অন্যান্য শাখাতেও তার বিস্তার ঘটে । পাশাপাশি, মহারাষ্ট্রের সাধারণ মানুষও এই বিদ্রোহের সমর্থনে তাঁদের সংহতি জানিয়েছিলেন, বাংলাও পিছিয়ে ছিল না। মুম্বাইয়ের রাস্তায় মিছিল ও সমাবেশ করে, হরতাল পালন করে তাঁরা জানান দেন যে এই লড়াই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার চূড়ান্ত লড়াই । নৌসেনারা সেই লড়াইয়ের দিনগুলিতে বারবার কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে আহ্বান জানিয়ে ছিলেন তাঁদের এই সংগ্রামে সমর্থন জানাতে ও জনমত গড়ে তুলতে। সেই সময়ের কংগ্রেসের নেতারা এতে কর্ণপাত করেননি। শোনা যায়, নেহেরু নাকি কিছুটা দোলাচলে ছিলেন কিন্তু বল্লভভাই সরাসরি ওই বিদ্রোহী সেনাদের বিপক্ষে দাঁড়ান। যেহেতু ক্যাবিনেট মিশনের ঘোষণা হয়ে গেছে তাই তাঁর মনে হয়েছিল এই সেনাবিদ্রোহ সময়-উপযোগী নয়। কার্যত তাঁর প্রত্যক্ষ অসহযোগিতায় নৌসেনারা অত্যন্ত অপমানজনক অবস্থায় আত্মসমর্পণ করেন এবং ভারতের স্বাধীনতার একটা গৌরবময় লড়াইয়ের অপমৃত্যু ঘটে। এর অল্প পরেই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হানাহানি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। এহেন সর্দার'এর একটি অতিকায় মূর্তি নির্মাণকল্পে এইবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা নাকি স্ট্যাচু অফ লিবার্টির দ্বিগুণ উচ্চতার ।
রাজনৈতিকভাবে সারা পৃথিবীর মানুষ ভারতবর্ষকে মহাত্মা গান্ধীর দেশ হিসেবেই জানে । তাঁর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও স্বাধীনতার আন্দোলনে তাঁর অবদান কেউই আজও একদম অস্বীকার করে উঠতে পারেননি। অবশ্য আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর এই পরিচিতির জন্য আমাদের কোনো অতিকায় প্রস্তরমূর্তি বানাতে হয়নি। নিজের পরিচয়ে আর জীবনেই তিনি বিশ্বব্যাপী মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হয়ে আছেন আজও। আজও কোনও বিদেশী রাষ্ট্রনায়ক নয়াদিল্লিতে এলে রাজঘাটে একবার শ্রদ্ধা জানাতে যান।
জানি না আগামী ভারতের আইডল হিসেবে তিনি অস্পৃশ্য হয়ে যাবেন কিনা। কিন্তু ইতিহাস তো অর্থের বরাদ্দ দিয়ে মুছে ফেলা যায় না। রোমা রঁলা গান্ধী সম্বন্ধে যা লিখেছিলেন তা সকলেই জানেন। কিন্তু বলার কথা এইটাই যে তিনি সকলকে বাদ রেখে গান্ধী সম্বন্ধেই ওই কথা বলেছিলেন । সেই সময়কালের মধ্যে দেশের সব রাজনৈতিক নেতারাই ছিলেন যারা হয়তো রাজনীতির পরিচয়ের বাইরে কোনও আলাদা ভুবনের নাগরিক হয়ে উঠতে পারেননি, গান্ধী পেরেছিলেন। তাই যে স্বাধীনতার জন্য ছিল তাঁর জীবনপণ তার প্রথম সম্ভাবনাতেই যখন দেশ হিংসায় উদ্বেল তিনি শুরু করলেন তার নতুন যাত্রা। তিনি একলা হলেন, মুক্ত হলেন। নোয়াখালিতে যখন কোনও রাজনৈতিক নেতা নেই তিনি ছুটে গেলেন সেখানে। আর দেশভাগের স্বাধীনতার তুমুল উৎসবের দিন তিনি মূক হয়ে রইলেন এই বাংলায়। অথচ বল্লভভাই তখন সরাসরি হিন্দুত্বের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, নেহেরু ক্ষমতা পাওয়ার নেশায় তালকানা। বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘সেই স্বর্গ, যা মানুষ সৃষ্টি করে একলা তার আপন মনে, সব মানুষ নয়, অনেক মানুষও নয়, কেউ কেউ যার একটুমাত্র আভাস হয়তো মাঝে মাঝে পায়, কিন্তু যাকে জীবনের মধ্যে উপলব্ধি করতে যিনি পারেন, তেমন মানুষ কমই আসেন পৃথিবীতে; আর তেমনই একজনকে আজ আমরা চোখের ওপর দেখছি বিদীর্ণ বিহ্বল নোয়াখালির জলে, জঙ্গলে, ধুলোয় ।’
জনগণের ২০০ কোটি টাকায় তৈরি ঘোষিত হিন্দুত্ববাদী সর্দারের মূর্তি কি ঢেকে দিতে পারবে এই মানুষটির ভুবনজোড়া মূর্তিকে ?   

No comments:

Post a Comment