মালিকের তুঘলকি আচরণের খোঁজ কে নেবে?
প্রবুদ্ধ বাগচী
শালিমারের রং কারখানায় কোনও শ্রমিক অশান্তির সংবাদ ছিল না । পুরনো এই কারখানায় কর্মীরা পুরুষানুক্রমে চাকরি করে আসছিলেন । সেই প্রথাটা তৈরি করেছিলেন মালিকরাই । কিন্তু শ্রমিক মালিকের এই আপাত-সৌহার্দ্য যে একটা কারখানার নিরাপত্তার পক্ষে যথেষ্ট নয় এই সহজ কথাটা অনেকে বুঝতেই চান না । যেমন ধরা যাক, শ্রীরামপুরের স্ট্যান্ডার্ড ফারমাসিউটিক্যালস এর কথা । সারাভাই গ্রুপের এই কারখানাটিতে কোনও শ্রমিক অসন্তোষ ছিল না । যেহেতু এঁরা পেনিসিলিন তৈরি করতেন তাদের পণ্যের বাজারের কোনও অনিশ্চিত অবস্থা ছিল না । তবু কী এক অজ্ঞাত কারণে নব্বই দশকের গোড়ায় এই প্রাচীন কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায় । বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েন । সুত্র খুঁজতে গিয়েছিলেন আমাদের এক সিনিয়র দাদা । একটি তথ্যচিত্র করবেন বলে । করেওছিলেন । সেই তথ্যচিত্রের শুরুতে একটি গান ছিল । যিনি বিনা পারিশ্রমিকে গানটি গেয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে তখন বিশেষ কেউ চিনতেন না । তার নাম সুমন চট্টোপাধ্যায় । কিন্তু এই রুগ্নতার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল স্রেফ নিজেদের মর্জিমাফিক শ্রীরামপুরের কারখানায় আর কোনও বিনিয়োগ করবেন না বলেই তারা কারখানার পাততাড়ি গুটোলেন । এবং গুজরাটে নতুন কারখানা খুলে ফেললেন । এই হিসেবগুলো বোঝা খুব কঠিন ।
শালিমারের রং কোম্পানির কারখানা বন্ধ করার পেছনে এইরকম একটা মর্জি কাজ করছে বোঝা যায় । পূর্বাঞ্চলে রং'এর বাজার নেই, এ বড় আশ্চর্য অজুহাত । বিশ্বায়নের এই যুগে পণ্যের আঞ্চলিক বাজারের গুরুত্ব কতটুকু ? আরও মজার কথা, জামুরিয়াতে কারা শ্যাম স্টীলের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টাকা চেয়েছে না চেয়েছে তাই নিয়ে সংবাদমাধ্যম সরগরম , চেম্বার অফ কমার্স আশঙ্কা প্রকাশ করে বসেছেন রাজ্যের শিল্পের হাল নিয়ে । কিন্তু শালিমারের রং কোম্পানির মালিক তাদের সদস্য নন ? তিনি খেয়ালখুশির বশে কারখানা বন্ধ করে দিলে চেম্বার অফ কমার্সের গায়ে একটুও ফোস্কা পড়ে না কেন ? তাঁরা উদ্বিগ্ন হন না কেন ? শালিমার কোম্পানি অর্থাভাবে হাওড়ার কারখানা সারাতে পারছেন না কিন্তু চেন্নাইতে নতুন কারখানা খোলার জন্য অর্থের অভাব হচ্ছে না ।
হিন্দুস্থান মোটরস ও এই একই অজুহাতে হিন্দমোটরের কারখানা বন্ধ করে অন্যত্র কারখানা খুলে বসেছেন । শিল্পের বিকাশের জন্য কী কী চাই এইসব নিয়ে মাঝে মাঝেই গম্ভীর আলোচনা শুনি । জমি চাই, স্বল্প মূল্যে বিদ্যুৎ চাই, সরকারি সদিচ্ছা চাই, অসন্তোষহীন শ্রমিক চাই, যখন তখন ছাঁটাই এর অধিকার চাই... এখন এমনকি শ্রম আইনের সংস্কারও চাই! না হলে ওই কড়া আইন মেনে চলা মালিকের পক্ষে সত্যি বড় কষ্টের । আহা, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বিনিয়োগ করে, যার বেশিটা আসলে ধার দেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, তাঁরা কাজের সুযোগ দিচ্ছেন তাঁদের ওপর এমন কঠিন আইনি ফাঁস চাপালে তাঁদের শ্বাসকষ্ট হবে না ! সবই চাই, কিন্তু সব থেকে আগে চাই মালিক ও বিনিয়োগকারীর তুঘলকি আচরণের জন্য নিটোল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি --- নইলে শিল্প বাঁচে না ! শালিমার কারখানার সামনে যারা নাছোড়বান্দা অনশন করছেন তাঁদের না বাঁচলেও চলে , তাই না ? প্রায় বছর পঁচিশ আগে ইন্ডিয়ান অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানির সর্বোচ্চ কর্তাকে একটা সেমিনারে মুখোমুখি পেয়েছিলাম । এই প্রশ্নটা তাঁকে করেছিলাম । তিনি চড়া গলায় বলেছিলেন , এইসব অবান্তর প্রশ্ন কেন করছেন ? ঠিক, অবান্তরই তো । পরে ওই ব্যক্তিটি হলদিয়া পেট্রোকেমের উঁচু পদে বসেছিলেন । নামটা না হয় নাই করলাম । প্রশ্নের উত্তরটা তো আর ওই নামের আড়ালে নেই ...
No comments:
Post a Comment