Sunday, 23 November 2025

SIR'এর হ য ব র ল

চোখে দেখা হাল হকিকত

মালবিকা মিত্র



'তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি ২০০২ সালে তোমার ভোটের বয়েস হয়নি। এবার বলো, তোমার বাবা-মা কার নাম ছিল? সেই কাগজ এনেছো?' 

আমার সামনে দাঁড়ানো নির্বাচক পটল বাগদি এসআইআর ফর্ম পূরণ করতে এসেছে। তার সোজা উত্তর, অত সব তো আমি জানি না, আর মা-বাবাও তো কেউ বেঁচে নেই। তারপর জানালো তার এক দাদা আছে, বর্ধমানে থাকে। অম্বলগ্রামে ওরা থাকত। মা-বাবাও ওখানেই ছিল। পটল ভদ্রেশ্বর আসত জমির কাজ করতে। তারপর এখানেই দুলির সাথে আলাপ, প্রেম, বিয়ে ও স্থায়ী বসবাস। অম্বলগ্রাম কোথায় সে বলতে পারে না, কোন বিধানসভা জানে না, কোন ভোটকেন্দ্র তাও জানে না। বলতে পারলে হয়তো নেট ঘেঁটে বিধানসভা ঘেঁটে খুঁজে বের করে দেওয়া যেত। সে ওসব কিছুই জানে না। শুধু জানে অম্বলগ্রাম আর বর্ধমান। মা-বাবা মরে যাওয়ার পর সে আর কখনও অম্বলগ্রামে যায়নি।

নেট সার্চ করে জানা গেল, 'অম্বলগ্রাম একটি গ্রাম এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম-২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের অন্তর্গত ও কেতুগ্রাম থানার অধীনে থাকা গ্রামগুলির মধ্যে একটি। অম্বলগ্রামে একটি রেলওয়ে স্টেশনও রয়েছে।' এরপর ২০০২ সালের কেতুগ্রাম বিধানসভার ভোটার তালিকা। সেখান থেকে অম্বলগ্রাম থানা ঠিকানায় বুথে বুথে অনুসন্ধান। কারণ, পটল বাগদি জানে না কোন স্কুলে তার বাপ-ঠাকুরদা ভোট দিত। এই কাজ পটল বাগদির পক্ষে করা অসম্ভব। আর সম্ভব না হলে তাকে উটকো অবৈধ ভোটার বলা হবে। কারণ, তার নাম উঠেছে ২০১৯ সালে। সে তো পুরনো ট্র্যাক রেকর্ড দেখাতে পারছে না। 

তৃণমূল দলের এসআইএর হেল্প ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে এইসব দেখছিলাম। জনৈক টুসি মাঝি এসেছেন ফর্ম ফিল আপ করতে। তার শ্বশুরবাড়ি এখানেই। তাদের ট্র্যাক রেকর্ডে ২০০২ সালে নাম পাওয়া গেল। কিন্তু টুসি বিয়ে হয়ে এসেছে বড়ঞা থেকে। সে ভোটার লিস্টের ওই নির্দিষ্ট পাতাটি সংগ্রহ করেছে। সেখানে তার মা-বাবার নাম আছে। এবার টুসি'কে যখন প্রশ্ন করা হল, তার মায়ের নাম কী, তার বাবার নাম কী? সে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে আছে। কারণ, সে তো আম্মু-আব্বুকে কোনও নামে চেনে না। সে আম্মু-আব্বু বলেই জানে। কোথাও তো তাকে আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। হেল্প ডেস্কের স্বেচ্ছাসেবকের প্রশ্ন, মা বাবার নাম কী? টুসি বলে, ওই তো, ওই কাগজে লিখ্যা আছে, দেইখে নিন। স্বেচ্ছাসেবক বলে, দেখব তো বটেই, নামটা তো বলতে হবে। বলে ওই তো ওই কাগজে লিখা আছে। ওই কাগজে আসলে যে ৪০ জন বাবা-মার নাম লেখা আছে, সেটাও সে বোঝে না। 

এরাই তো হবে এসআইআর'এর বলির পাঁঠা। একজন নির্বাচক সুফল বলল, ২০০২ সালে আমার তো নাম ছিল না। আমার মায়ের নাম ছিল। বাবা তো সেই কবেই আমার দুই বছর বয়সে মারা গেছে। মায়ের নাম ফেলু বিবি, গ্রামের কেউ কেউ ফুলি বিবি বলেও ডাকে। এই যে ২০০২'এর ভোটার লিস্ট এনেছি। এখানে নাম আছে। অনেক খুঁজে ভুলি বিবি, ফেলনা বিবি এসব নাম পেলাম কিন্তু ফেলু বিবি আর পাই না। অবশেষে সুফলের মেয়ে যে এখন সবে ক্লাস ফাইভ, সে দেখিয়ে বলল, ওই তো লিস্টিতে ফেলু বিবি লেখা আছে। দেখলাম একজন নির্বাচক ডালিম, তার আত্মীয়ের নামের জায়গায় লেখা আছে ফেলু বিবি, নির্বাচকের জায়গায় নেই। সুফলের ছোট মেয়ে বলে ওটাই তো, ডালিম আমার চাচা কিন্তু চাচার নাম তো প্রমাণ হিসেবে দেখানোর অধিকার আমাকে দেওয়া হয়নি। 

বাড়ির মহিলাদের পক্ষে নিজের মা-বাবা, দাদু-ঠাকুমার ২০০২'এর ভোটার তালিকা, নাম তথ্যপ্রমাণ হিসেবে হাজির করা খুব সমস্যার। যেহেতু তারা বিয়ে হয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে, একটা পরিচয় ছেড়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ সম্পর্কে বা বলা যায় নিম্নবর্গের সম্পর্কের মধ্যে কোনও একটি পোশাকি নাম নয়, মুখে মুখে ক্যাবলা মামা, হাবাদা, গজাদা, ভজাকা, জটাধারী দাদু, ছোলামটর মামা, ঘটি গরম দাদা ইত্যাদি নাম এত বেশি পরিচিত যে পোশাকি নামটা উধাও হয়ে গেছে। অনেকেই জানে না দাদু-ঠাকুমার নাম। তৃতীয়ত, মালদা-মুর্শিদাবাদ বা ঝাড়গ্রাম মেদিনীপুর বাঁকুড়া পুরুলিয়া থেকে অনলাইনে ভোটার তালিকা বের করে খুঁজে আনা শিবের অসাধ্যি। চতুর্থত, ২০০২ সালে নাম থাকা আত্মীয়তার সম্পর্কের মধ্যে শুধুমাত্র মা-বাবা ও পিতৃকুলের দাদু-ঠাকুমার নাম থাকা চাই। পরে তদবির করে জানা গেল, মামাবাড়ির দাদু-দিদিমা হলেও চলবে। 

নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চ স্তরে কমবেশি সকলেরই আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস, এসব সহজলভ্য। ফলে এদের পক্ষে ২০০২'এর ট্র্যাক রেকর্ড উপস্থাপন করা খুব জটিল বিষয় নয়। সমস্যায় পড়বে নিম্নবিত্তরা, প্রান্তিকরা। যাদের ঘরে নেট আছে, ইন্টারনেট নেই। তাদের ঘরে খ্যাবলা জাল আছে, একটু বর্ষার জল জমলেই সেই জাল নিয়ে বাচ্চারা কোমর জল, গলা জলে নেমে পড়ে। এই অংশটি হল এসআইআর'এর মূল লক্ষ্যবস্তু বা শিকার। একবার ভাবুন, অক্ষর চেনে না, বানান বলতে পারবে না, এমন মানুষ কীভাবে লিস্টে নিজের মায়ের নাম খুঁজবে? আপনি বলবেন, অন্য কেউ খুঁজে দেবে। তাহলে শুনুন, আমাদের কাছেই আছে একটি আবাসন। সেখানে এমনই এক প্রান্তিক মহিলা দৈনিক ঠিকা কাজ করে। তাকে বলছি, তুমি কোথায় কাজ করো? সে বলছে, ওই নজরাল বিবি বাড়ি আছে, সেখানে। আমি বললাম সেটা কোথায়? সেই মহিলা বলল, কেন ইস্টিশনের পাশেই উঁচু লম্বা যে বাড়ি। তখন বুঝলাম বাড়িটার নাম নেচারাল ভিউ। সেটা ওর উচ্চারণে নজরাল বিবি। ও বলবে মা বাবার নাম, আর সেটা শুনে আপনি খুঁজে বের করবেন ভোটার তালিকা থেকে। সেও এক অসাধ্য সাধন। 

এরপরেও কথা আছে। এসআইআর ফর্মে উপরের অংশে জানতে চাওয়া হয়েছে নির্বাচকের জন্ম তারিখ, বাবার নাম, মায়ের নাম এবং স্বামী বা স্ত্রীর নাম। আর বাকি যা আছে সেগুলো ঐচ্ছিক, দিতে পারেন নাও দিতে পারেন। এবার ফর্মের দ্বিতীয় অংশে ওই নির্বাচকের প্রাচীনত্ব ও তার ট্র্যাক রেকর্ড খোঁজা হচ্ছে। সেখানে তার ২০০২'এর ভোটার তালিকায় নাম ছিল কিনা জানতে চাওয়া হচ্ছে। থাকলে তো মিটে গেল। যারা লেখাপড়া করা বাবু, মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, তারা সহজেই এ কাজ সেরে ফেলছেন। আর যারা প্রান্তিক তারাই ২০০২'এর হদিস করতে পারছে না। যে কথা আগেই বলেছি। কিন্তু যে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত উচ্চ বর্গীয় সম্প্রদায়, তারাও এক জায়গায় গিয়ে  ফাঁপড়ে পড়বে এবং পড়ছে। ২০০২ সালে নিজের নাম না থাকলেও বাবা-মার নাম থাকলেই চলবে। যাদের সেটা নেই তারা দাদু ঠাকুমা, দাদু দিদিমা'র নাম ও তথ্য উল্লেখ করবেন। কিন্তু ওপরের অংশে তো কেবল মা-বাবা ও স্বামী বা স্ত্রীর নাম উল্লেখ আছে। দাদু দিদিমার নামটার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের সূত্র প্রমাণ হবে কীভাবে? এমনকি উল্লেখ করার জায়গা নেই যে, এরা কীভাবে সম্পর্কিত। বাধ্য হয়ে নামের পাশে লিখে দেওয়া হচ্ছে, দাদু দিদিমা ঠাকুমা এবং ব্র্যাকেটে মাতৃকুল বা পিতৃকুল। কোনও নির্দেশ ছাড়াই নিজস্ব উদ্ভাবনে এটা করা হচ্ছে।

এরপরেও একটা সমস্যা চোখে পড়ছে। কোনও কোনও নির্বাচকের দাদু দিদিমা তো নেইই, এমনকি কোনও আত্মীয়-পরিজনও নেই। বলতে পারেন নিউক্লিয়াস ফ্যামিলির প্রথম জেনারেশন। বিশেষ করে বিবাহিত মহিলা, মা-বাবা বহুকাল গত হয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এভাবেই কন্যার বিয়ে দিয়েছেন। তাই কোনও নির্দিষ্ট ঠিকানা মা-বাবার ছিল না। ফলে, মেয়ে জানে না কোথায় কোন রাজ্যে কোন ভোটকেন্দ্রে মা বাবার নাম খোঁজ করবে। কোনও আত্মীয় পরিজনের নামও বলতে পারছে না। আমার পাড়ার বিয়ে হয়ে আসা বউমা। তারা এই সমস্যার সম্মুখীন। আবার ২০০২ সালে যে নাম ও পদবী ছিল পরবর্তীকালে নাম ও পদবী দুইই পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে, বর্তমান স্ট্যাটাসের সঙ্গে ২০০২'এর প্রদত্ত তথ্য ম্যাচ করছে না। অথচ ফর্মে এটি উল্লেখ করার কোনও ক্ষেত্র নেই।

সবচেয়ে বড় কথা, এসআইআর ফর্মটি অসম্পূর্ণ। প্রথমত, আরও দু-একটি তথ্য জানার বা মন্তব্য করার সুযোগ থাকা উচিত ছিল। দ্বিতীয়ত, অহেতুক এমন সব তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে যা নির্বাচকের ভোটার তালিকায় আগেই তথ্য হিসেবে দেওয়া আছে। নতুন করে সেগুলো জানতে চাওয়া অর্থহীন। সর্বোপরি, নির্বাচকের স্বামী বা স্ত্রীর নাম জেনে ২০০২'এর প্রাচীনত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ, স্ত্রীর নাম ২০০২'এ থাকলে তাতে স্বামীর কিছু যাবে আসবে না। একইভাবে স্বামীর নাম ২০০২'এ থাকলেও তাতে স্ত্রীর কোনও সুবিধা হবে না। এভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য জানানোর সুযোগ একদিকে নেই, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চেয়ে জটিলতা সৃষ্টি সকলকে বিভ্রান্ত করেছে।

বিএলও'দের অবস্থা আরও করুণ। জনৈক বিএলও'কে জানানো হল তার জমা নেওয়া ফর্ম সফল ভাবে সিস্টেমে আপলোড হয়েছে ৬৩ শতাংশ। পরদিন তাকে জানানো হল, সফল ভাবে আপলোড হয়েছে ৫৭ শতাংশ। বিএলও'র মাথায় হাত। এলাকার মানুষ বিএলও'কে দোষারোপ করবে। নিত্যদিন হাট বাজারে তার সঙ্গে দেখা হয়। একদিন সংবাদপত্রে লেখা হল, বিএলও'রা তিনবার এসআইআর ফর্ম দিতে গিয়েও ভোটারকে না পেয়ে ফিরে এসেছেন। রাজ্যে ৫৫ লক্ষ ভোটারের কোনও হদিস নেই। অর্থাৎ, বলতে চাওয়া হয়েছে যে ৫৫ লক্ষ ভুয়ো ভোটার। তারপরেই আবার কদিন পর সংবাদপত্রে লেখা হল, বাংলায় ৯৯.১৬ শতাংশ এসআইআর ফর্ম বিলি সম্পূর্ণ। তথ্য দুটি কিন্তু পরস্পর বিরোধী। দ্বিতীয় তথ্যটিও সঠিক নয়, কারণ, একটি ভোটার তালিকায় ৭৩৬ জন ভোটারের মধ্যে ৪২ জন আছেন যারা হয় মৃত না হয় অন্যত্র চলে গেছেন, কিন্তু নাম কাটাননি। অর্থাৎ, ৫ শতাংশের কিছু বেশি। তাহলে ৯৯.১৬ শতাংশ ভোটারকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। 

এই অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য আমাকে অবাক করে না। কারণ, ভোট শেষ হবার পর প্রদত্ত ভোটের শতাংশের হিসেব তিন ঘন্টা পরে বদলে যায়, মোট ভোটারের সংখ্যা নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর বেড়ে যায়। হিসেব করে ভোট লুঠ হচ্ছে না। লুঠ করার পর হিসাব মেলানো হচ্ছে। বুঝতে পারি, যা কিছু ঘটতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে এটা বলতে পারি, উদ্দেশ্য যদি হয় নাম বাদ দেওয়া এবং সেটা যদি শুভেন্দু অধিকারী কথিত এক কোটি হয়, তাহলে সেই উদ্দেশ্য পূরণে এমন একটি এসআইআর ফলদায়ক। নিশ্চিতভাবে উপযুক্ত। একজন নাগরিক হিসেবে আমিও দৃঢ়ভাবে সচেষ্ট যাতে শুভেন্দু অধিকারীর পাকা গুটি কেটে ঘরে ঢোকানো যায়। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, একজন বৈধ ভোটারেরও নাম বাদ পড়তে দেব না। সেই আহ্বানে আমার ক্ষুদ্র সীমানায় ও সামর্থ্যে আমিও সামিল। আপনি আমাকে চটিচাটা বলতেই পারেন।


Wednesday, 19 November 2025

ঘরে না ফেরার গল্প

বন্ধুত্বের মর্মস্পর্শী কাহিনি 

সোমা চ্যাটার্জি



মধ্যপ্রদেশের জনহীন মহাসড়কে দুই পরিযায়ী শ্রমিক কোভিডের লকডাউনে ঘরে ফিরছে পায়ে হেঁটে। তাদেরই একজন জ্বরাক্রান্ত, হাঁটার শক্তি নেই, টলে পড়েছে, আকুল হয়ে তাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে অপরজন। পথশ্রমে হতক্লান্ত, অসুস্থ বন্ধুর জন্য গাঁয়ের নির্জলা টিউবওয়েল প্রাণপণে পাম্প করছে সামান্য জলের আশায়। কখনও আদর করে, কখনও ধমক দিয়ে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, কখনও তার অবসন্ন হাতের তালুতে ক্যাম্বিসের ক্রিকেট বল গুঁজে দিয়ে বা মায়ের হাতে বানানো বিরিয়ানির সুগন্ধের অসত্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বোতল থেকে বিন্দু বিন্দু জল ছুঁইয়ে তাকে জীবনে ফিরিয়ে আনার অসাধ্যসাধনের চেষ্টা করছে বন্ধু। 

এই সত্য গল্পটিই এক চালচিত্র হয়ে উঠেছে এই সময়ের  সবচেয়ে আলোচিত ও প্রশংসিত কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ভারতীয় ছবি ‘হোমবাউন্ড’এ।

এই ছবি উত্তর ভারতের একটি ছোট গ্রামের দুই বন্ধুর-- ইশান খট্টর (শোয়েব- মুসলিম) এবং বিশাল জেঠওয়া (চন্দন- দলিত)। দুজনেই দরিদ্র ও সমাজের প্রান্তিক মানুষ এবং পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ছবির শুরুতেই দেখা যায়, পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি প্রার্থী হাজার হাজার যুবক-যুবতীর ট্রেন আসার শব্দে রেললাইন পেরিয়ে প্ল্যাটফর্ম বদলানোর প্রাণান্তকর দৌড়। ভিড় কামরায় অগুনতি উৎকণ্ঠিত মুখ, সবাই একই স্বপ্নের সুতোয় বাঁধা। শোয়েব-চন্দনের বন্ধুত্বের উত্থান-পতন সবই কনস্টেবল হওয়ার স্বপ্নে ও বিশ্বাসে আবর্তিত। কারণ, তারা ভাবে যে তাদের পুলিশের ইউনিফর্ম, ধর্ম ও বর্ণের তাদের প্রতিদিনের অপমানের বিরুদ্ধে এক বর্ম হবে। কিন্তু পুলিশের চাকরির পরীক্ষায় পাশ করলেও নিয়োগের উপর কোনও অজ্ঞাত স্থগিতাদেশের জন্য তাদের চাকরি হয় না। অবশেষে পুলিশে চাকরির চিঠি যখন তাদের বাড়িতে এসে পৌঁছয়, চন্দন আর  নেই। 

এই ছবি আমাদের সামনে প্রতিষ্ঠানের চিরকালীন দৈন্য তুলে ধরে, উন্মোচিত করে সরকারি কাজের দীর্ঘসূত্রিতা ও ঘুণধরা ব্যবস্থার বঞ্চনার ইতিহাস। দলিত চন্দনের মা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী হলেও গ্রামের  স্কুলে তার রান্না করা খাবার উচ্চবর্ণের লোকেরা টান মেরে ফেলে দেয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সামনেই। (সহজেই অনুমেয় কেন সেন্সর বোর্ড ছবিটিতে মোট ছ’টি ‘কাট’ প্রস্তাব করেছিল।) উঠে আসে সমাজে জাতপাত, লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি, নতুন বন্ধু সুধা ভারতী (জাহ্নবী কাপুর)'কে নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় দ্বিধাগ্রস্ত চন্দনের হাবেভাবে প্রকাশ পায় অস্বস্তি। প্রতিভাত হয় এই একুশ শতকেও আমাদের দেশের গ্রামে গ্রামে অপমান আর অপ্রাপ্তির চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে বড় হওয়া হরিজন পরিবারের সন্তানের সরকারি চাকরির ফর্মে নিজের ‘দলিত' পরিচয় লিখতে দ্বিধার কথা।  

কিন্তু চাকরির ফর্মে নিজেকে 'সাধারণ বিভাগ' উল্লেখ করা চন্দনকে তার পরিবার-- মা (শালিনী ভাটসা) ও বাবা (দধি আর পান্ডে)-- সবসময় স্বপ্ন দেখায় যে তার চাকরির মাধ্যমে তাদের পরিবারের একটি পাকা বাড়ির স্বপ্ন পূরণ হবে; বোন (হর্ষিকা পারমার) বলে, 'সির্ফ তুমকো চুন-নে কা অধিকার মিলা হ্যায়'। তাদের চারজনের দলিত পরিবারে কেবল তারই পছন্দ করার অধিকার রয়েছে। বোঝা যায় যে আজও  আমাদের সমাজে পুরুষ হয়ে জন্ম নেওয়া সুবিধা-বঞ্চিতদের মধ্যেও একটি সুবিধা।

শোয়েব এবং চন্দন ছোটবেলার বন্ধু হলেও তাদের মানসিকতা ভিন্ন; শোয়েব আক্রমণাত্মক কিন্তু চন্দন সংযত, তাই পুলিশে চাকরির পরীক্ষায় পাশ-ফেল জনিত কলহ-হাতাহাতির পর তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। হাঁটু ক্ষয়ে যাওয়া ক্র্যাচ অবলম্বনকারী বাবার উপার্জনের অক্ষমতা আর সংসার পালনের দায়িত্ব শোয়েবকে বাধ্য করে কর্পোরেট অফিসে বেয়ারার পদে যোগ দিতে, অন্যদিকে চন্দন যোগ দেয় সুরাতে কাপড় মিলে শ্রমিকের চাকরিতে। কর্পোরেট অফিসে মুসলিম বেয়ারার হাতে ভরা জলের বোতল টেবিলে রাখতে বাধা-দেওয়া ও বসের বাড়ির নৈশভোজে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট যুদ্ধে মুসলিম কর্মচারীকে কেন্দ্র করে ব্যঙ্গক্তি ও টীকা-টিপ্পনী বুঝিয়ে দেয়, এখনও ধর্মীয় বিভাজন সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের মধ্যে কতটা প্রকট। অপমানিত শোয়েব হাজির হয় সুরাতের কাপড় মিলে কর্মরত বন্ধু চন্দনের ডেরায়। কয়েক মাসের ব্যবধানে অভিমানী, অপমানিত ঘাড় গোঁজ করে থাকা শোয়েব সান্ত্বনা দিতে আসা চন্দনকে বারবার ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলেও একসময় আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে চন্দনকে জড়িয়ে ধরে। অসামান্য অভিনয় করেছেন ঈশান এবং বিশাল। দুই বাল্যবন্ধুর সারল্য, খুনসুটি, স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্নভঙ্গ, ঝগড়া-হাতাহাতি এবং তারপরে আবার পরস্পরের কাছে অবলম্বন হয়ে ফিরে যাওয়ার যে নকশিকাঁথা নীরজ বুনেছেন, তা সম্ভব হয়েছে ঈশান-বিশালের অভিনয়ের গুণে।

'হোমবাউন্ড'এর সার্থকতা শুধু তাদের গল্প বা অভিনয়ে সীমাবদ্ধ নয়, সেট নির্মাণের বাস্তবতা, কস্টিউম ও সব কিছুর মধ্যেই বিস্তৃত এবং সঙ্গীতের বিচ্ছিন্ন কিন্তু অনুরণিত ব্যবহার (সুরকার নরেন চন্দভারকর এবং বেনেডিক্ট টেলর) ছবিটিকে সব দিক থেকেই অতুলনীয় করে তুলেছে। দীর্ঘ হাইওয়ের উপর জোরালো সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলোতে উপর থেকে দেখা যায় অজস্র খুদে খুদে পোকামাকড়ের সারি দল বেঁধে চলেছে কোথাও দূরে। ওই পোকামাকড়ের ঝাঁক আসলে মানুষের দঙ্গল। কোভিড লকডাউনের সময় ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকের দল, এক একটা আলোর বৃত্তে তারা দৃশ্যমান। সেলুলয়েডের এই দৃশ্য আমাদের মনে ঝাঁকুনি দেয়। এক ধাক্কায় নিয়ে যায় পাঁচ বছর আগের সেই অবিশ্বাস্য, অসহনীয় কোভিডের দিনগুলোতে যখন আত্মীয়, পরিচিত পড়শির দিকে সবাই তাকাত অবিশ্বাসীর চোখে; সহমর্মিতা-বন্ধুত্ব ছাপিয়ে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে গণসৎকারের চিতায় পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছে নিজেদেরই ঘরের মানুষ, অসহায়তায় একাকী প্রাণ হারাচ্ছেন প্রিয়জনেরা, প্রান্তিক মানুষেরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন, জীবিকা হারাচ্ছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণচিতা জ্বলছে, কেউ তাদের বন্ধু আত্মীয়ের দেহ ফেলে রেখেই পাড়ি দিচ্ছেন বাকি পথ। নীরজের ছবি আমাদের আরও একবার নিয়ে যায় মানবিকতার সেই গভীর সঙ্কটের মুহুর্তে যখন কোভিড-সন্দিগ্ধ গ্রামবাসীরা টিউবওয়েলে জল নেবার সময় তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। 

এই ছবির বীজ বপন হয় কোভিডের সময় তৎকালীন টুইটারে ভেসে আসা মধ্যপ্রদেশের এক হাইওয়ের পাশে মে মাসের রোদে পড়ে-থাকা দুই তরুণের এক ছবিতে; ২০২০ সালে ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স’-এর দিল্লিস্থিত সাংবাদিক বশরত পিরের লেখা একটি খবর থেকে, যার শিরোনাম ছিল ‘টেকিং অমৃত হোম'।  দলিত অমৃত কুমার এবং তার বন্ধু মহম্মদ সাইয়ুব'এর উপর প্রকাশিত 'নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স’ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ওই খবরটির স্বত্ব কিনে নেওয়ার পরে যে কাহিনির নাম বদলে গিয়ে হয়েছে ‘আ ফ্রেন্ডশিপ, আ প্যানডেমিক অ্যান্ড আ ডেথ বিসাইড দ্য হাইওয়ে’। সেটাই এই ছবির গল্প। দুজনেই মজুরের কাজ করতেন সুরাতের কাপড়ের মিলে। বাস্তবেও সাইয়ুব অমৃতকে বেওয়ারিশ ছেড়ে যায়নি বরং পুলিশের সহায়তায় তার মৃতদেহ গ্রামে ফিরিয়ে এনে পরিবার-পরিজনের উপস্থিতিতে গ্রামের বাইরেই সৎকার করেছিলেন। ধর্মে হিন্দু এবং জাতে দলিত অমৃত জীবিতাবস্থায় যে সম্মান পাননি তা তিনি পেলেন ভিন্‌ধর্মের মুসলমান বন্ধুর সৌজন্যে তাঁর মৃত্যুর পর। 

এই ছবি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কোভিডের সময় রাষ্ট্রের লকডাউনের মতো হঠকারী সিদ্ধান্তের কথা, যার জন্য হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন বিপন্ন হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে অগুনতি মানুষের,  বিনা যানবাহন ও চূড়ান্ত অব্যবস্থার মধ্যে দেশের এক বড় জনসংখ্যার বলি হয়েছে অনাহারে, খাদ্য  ও ওষুধ সামগ্রীর অপ্রতুলতায়। কোভিড কালে সরকার যে অপদার্থতার প্রমাণ দিয়েছে, এই ছবি তার জলন্ত উদাহরণ। 

২০১৫ সালে নীরজ তৈরি করেছিলেন এক অকল্পনীয় ছবি ‘মসান'। দশ বছর পরে এটি তাঁর কেরিয়ারের দ্বিতীয় পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি। গত ২১ মে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটির প্রদর্শন শেষ হওয়ার পরে দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন ছবিটিকে এবং একটানা হাততালির ঝড় উঠেছে প্রায় দশ মিনিট ধরে। 

সমাজ ও রাষ্ট্রের গিঁটগুলো খুলে অপাপবিদ্ধ বন্ধুত্ব এবং মানবিকতার এক ক্লাসিক ও সরল আখ্যান তৈরি করেছেন পরিচালক নীরজ ঘ্যাওয়ান। আবেগে পরিপূর্ণ হলেও পূর্ণমাত্রার সচেতন শৈল্পিক বিকাশ ঘটেছে ছবিটিতে। এমন অসংখ্য মুহূর্ত আছে যা প্রচণ্ড ক্রোধ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আবার এই ছবি একই সঙ্গে বলে আশাবাদের কথা। প্রচারসর্বস্ব  অর্থলোভী এবং অসত্য দুনিয়াতেও গ্রাম্য বাছবিচার, ছোঁয়াছুঁয়ি ঘুচে যায় যখন দিন আনা-দিন খাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকেরা পাশাপাশি বিছানায় ঘুমোয়, একই শয্যা দিন ও রাতের শিফ্‌টে ভাগাভাগি হয়। দলিত বাড়ির মায়ের পাঠানো আচারের বয়াম নিয়ে কাড়াকাড়ি করে সকলে। সেখানে ধর্ম, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা এক লহমায় ঘুচে যায়। তেমনই কোভিড-জর্জর সময়েও ভীত-সন্ত্রস্ত এবং পলায়নপর দুই আপাত-সন্দেহভাজন আগন্তুকের আঁজলায় স্টিলের জগ হাতে জল ঢেলে দিতে দেখা যায় দেড় হাত ঘোমটা টানা সহানুভূতিশীল গ্রাম্য বধূকে। তাঁর খালি পায়ের ফাটা গোড়ালির দিকে নজর যায় চন্দনের। ঠিক তার মায়ের পায়ের মতো। ছবির শেষে সাদা কাপড়ে বাঁধা চন্দনের মৃতদেহ খাপরার চালের বাড়ির দাওয়ায় রেখে ঘরের ভিতরে শোয়েব দ্বিধাগ্রস্ত হাতে সন্তানহারা মায়ের হাতে তুলে দেয় মৃত বন্ধুর মলিন ব্যাকপ্যাক হাতড়ে পাওয়া নতুন একজোড়া মেয়েদের চপ্পল। ফাটা গোড়ালির বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। শোকে পাথর মূক মায়ের বাঁধ ভাঙা কান্নার দৃশ্যটি নিঃসন্দেহে আলোড়িত করে। হৃদয় দ্রব হয়! 

ছোট ছোট এই সব মুহূর্ত রচনা করেছেন পরিচালক নীরজ যা আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষের অসহায়তাকে ধরে এক গভীর অভিঘাতের সৃষ্টি  করে। ছবি শেষ হয়েও যেন হয় না। আমাদের পূর্ণবৃত্তের জীবনে ঘরে ফেরার আবহে মানবিক বোধ, অসহায়তা ও নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের এই কোলাজ এক অসামান্য প্রতিচ্ছবি, যা সবাইকে ফিরতে বাধ্য করে কোভিডের অসহনীয় স্বার্থপর মনখারাপের দিনগুলিতে!


Monday, 17 November 2025

রহস্য না ডাকাতি?

আন্দোলনই এখন পথ 

সুমন সেনগুপ্ত



বিহারের নির্বাচনের পরে আবার নতুন করে নির্বাচন কমিশনের দিকে আঙুল ওঠা শুরু হয়েছে। অভূতপূর্ব ফলাফল যা এসেছে, তাতে এই অভিযোগ ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিহারে যে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনী হয়েছিল, সেই প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচন কমিশনার দফতর থেকে জানানো হয় যে বিহারে মোট ভোটার ৭.৪২ কোটি। কিন্তু ফলাফল ঘোষণা হবার দিনে জানা যায় যে ঐ ভোটারের সংখ্যা ৭.৪৫ কোটি, অর্থাৎ ৩ লক্ষ বেশি। এই ৩ লক্ষ ভোটার কারা? তাঁদের নাম তালিকায় যে উঠল, তাঁদের মধ্যে কতজন আছেন যাঁদের নাম প্রাথমিকভাবে বাদ পড়েছিল? তাঁরাই কি এই ৩ লক্ষের মধ্যে আছেন, না এই সংখ্যাটাই ভূতুড়ে-- সেই প্রশ্নও উঠছে। 'অল্ট নিউজ'এর মহম্মদ জুবেইর যে ভুয়ো ভোটারদের ভোট দেওয়ার কিছু প্রামাণ্য ছবি তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে দিয়েছেন, যার মধ্যে আরএসএস'এর রাকেশ সিনহা’র ছবিও আছে, এরাই কি মূলত এই ৩ লক্ষ ভোটারদের অধিকাংশ? 

রাজ্যসভার সাংসদ কপিল সিব্বল ভোটের পরে আরও মারাত্মক অভিযোগ করেছিলেন যে, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ থেকে যে ভোটারদের বিহারে ভোট দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁরা সবাই কি তাহলে ঐ ভূতুড়ে এবং ভুয়ো ভোটার, যাঁদের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যেই বিহারে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনী প্রক্রিয়া চালানো হয়েছিল? নাকি আরও কোনও রহস্য আছে?  

'রিপোর্টার্স কালেক্টিভ' কিংবা অজিত আঞ্জুমের মতো বহু সাংবাদিক বারংবার দেখাচ্ছিলেন যে বিহারের বিশেষ নিবিড় সংশোধনীতে একের পর এক অনিয়ম হচ্ছে। দেখাচ্ছিলেন, টোলার পর টোলা ধরে ধরে বিহারের বিরোধীদের জেতা আসনে বেছে বেছে বাদ দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। অজিত আঞ্জুমের বহু ভিডিও আছে যাতে দেখা গেছে বুথ লেভেল অফিসাররা বাড়িতে বসে নাম তোলার চেষ্টা করেছে; যার ফলেই বাদ গেছেন প্রাথমিকভাবে ৬৭ লক্ষ মানুষ। পরে অবশ্য দেখা গিয়েছিল, ৪৭ লক্ষ মানুষকে বাদ রেখেই বিহার বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে। 

ভোটের ফলাফলের পরে যে তথ্য আসছে তাতে আরও চমকে দেওয়ার মতো বিষয় আছে, যা নিয়ে কথা বলাটা এখন সময়ের দাবি। দেখা যাচ্ছে, যে বিভিন্ন বিধানসভায় যত মানুষ বাদ পড়েছেন, তার যে হিসেব তা সরাসরি বিজেপি এবং এনডিএ জোটের জেতায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তাই নয়, বিজেপি জেডিইউ'র থেকেও বেশি আসন পেয়েছে। তথ্য বলছে, বিহারে এনডিএ যে ২০২টি আসন জিতেছে তার মধ্যে ১২৮টিতে জয়ের ব্যবধান ওইসব আসনের ভোটারদের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া ভোটারের সংখ্যার তুলনায় কম। তবুও অনেকে ভাবছে যে রাহুল গান্ধীর অকর্মণ্যতা এবং আরজেডি'র অতীতের দুঃশাসনের স্মৃতির কারণে বিরোধী দল হেরেছে। সেটা ভাবতেই পারেন, তথ্য কিন্তু তা বলছে না। বিহারে পোস্টাল ব্যালটেও কিন্তু বিরোধী মহাগঠবন্ধন এনডিএকে টেক্কা দিয়েছে। পোস্টাল ব্যালটে মহাগঠবন্ধনের ১৪২'এর তুলনায় এনডিএ পেয়েছে ৯৮টি আসন। তার মানে সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীদেরও ক্ষোভ ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এই সমস্ত তথ্যকে সরিয়ে রেখে যারা বিহার নির্বাচনের ফলাফলকে বিশ্লেষণ করবেন তা একপেশে হতে বাধ্য। 

অবশ্যই বিহারে মহাগঠবন্ধনের অন্তর্গত কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল, যা বেশ কিছু আসনে বিভিন্ন শরিকদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ফলে নিশ্চিতভাবে ভোটারদের মধ্যে ভুল বার্তা দেয়। বলতে হবে আসন বন্টন নিয়ে আলোচনায় রাহুল গান্ধীর অনুপস্থিতির কথাও। জিজ্ঞেস করতে হবে, তাহলে কি ‘ভোট চোর গদ্দি ছোড়' শ্লোগান পরোক্ষে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনকেই বৈধতা দিল? কোনও কোনও সাংবাদিকের বিশ্লেষণ এই যে, ভোটের আগে মহিলাদের দেওয়া নীতিশকুমারের ১০ হাজার টাকার ঘুষ কাজ করে গেছে শেষ মূহুর্তে, তাই এই ফলাফল। কেউ কেউ বলছেন, এবারের ভোট ছিল মেরুকরণের এবং বিরোধীরা নীতিশকুমারের এই চালে কুপোকাত হয়েছেন। আবার কেউ বলছেন, বিরোধীরা এই বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ না হওয়ায় এবং নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকা উল্লঙ্ঘন করেই সবার চোখের সামনে মহিলাদের ভোট কেনা, সেই জন্যেই এই ফলাফল। অনেকে এও বলছেন, তেজস্বী যাদবের নাম মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য ঘোষণা করার জন্যেই বিজেপি’র সুবিধা হয়েছে বিহারের জঙ্গলরাজের স্মৃতিকে আবার সামনে নিয়ে আসতে। অনেকে বলছেন, গত নির্বাচনে নীতিশকুমারের মদ বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মহিলারা এবারও সমর্থন করেছেন বলেই তাঁরা দু’ হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন এনডিএ জোটকে। 

এই সমস্ত কিছু নিয়ে কথা হতেই পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিহারে যে সব 'চাঙ্গাসি হ্যায়' তা অতি বড় বিজেপি সমর্থকও স্বীকার করছেন না। ২০১০'এর পরে ২০২৫-- এই কুড়ি বছরে কি নীতিশকুমারের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছে যে এনডিএ জোটের জেতার স্ট্রাইক রেট প্রায় ৯০ শতাংশে পৌঁছে গেছে? ২০১০ ছিল নীতিশকুমারের উত্থানের সময়, তার সঙ্গে কি পড়ন্ত বেলার নীতিশকুমারের কোনও মিল পাওয়া যায়? রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক সিরিয়াসনেস নিয়ে আপনি কথা তুলতেই পারেন, কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে বিজেপি'র নিজের কব্জায় নিয়ে আসার পরে ভোট চুরিকেই আইনি বৈধতা দেওয়ার বিরুদ্ধে কথা না বললে তা অন্যায় হবে। আসলে nothing succeeds like success। সেই জন্যেই হয়তো সমস্ত আলোচনাকে আজ পিছনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। 

বিরোধীরা এই মুহূর্তে কী করতে পারে তা নিয়ে নানান তর্ক চলছে নানা মহলে। অনেকে বলছেন, এরপর থেকে সমস্ত নির্বাচন বয়কট করা উচিত। কেউ বলছেন, বিরোধী যে কয়েকজন বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা বিধানসভা বয়কট করুন। তবে যেহেতু সিপিআইএমএল এই মহাগঠবন্ধনের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শরিক এবং তারা বিহারের বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর সবচেয়ে বেশি বড় সমালোচক ছিল, তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। বিহারে ভোটের দিন দেখা গেছে, বহু প্রান্তিক মহিলারা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে জানতে পেরেছেন তাঁদের ভোটাধিকার নেই। এই বাদ যাওয়া মানুষদের তালিকা বানিয়ে যদি সিপিআইএমএল নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ তৈরি করে পুনরায় তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, তবে সেই লড়াইকে কিন্তু অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। 

নির্বাচক তালিকা তো শুধু ভোটাধিকার নয়, এটা নাগরিকত্বেরও অন্যতম শর্ত। সেই নাগরিকত্বের লড়াইকে যদি সিপিআইএমএল নেতৃত্ব দেয়, তাহলে তা বাংলার রাজনীতিতেও তাঁদের প্রভাব বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। প্রাথমিকভাবে অন্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনে নামতে না চাইলে তাঁদেরকেও এই লড়াইতে ধীরে ধীরে সামিল করানো যেতে পারে। এই লড়াই কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী, এই লড়াই গরিব খেটে খাওয়া মানুষের লড়াই। এই লড়াই-ই কিন্তু সিপিআইএমএলকে একদিন বিহার জুড়ে পরিচিতি দিয়েছিল। 

নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা আজ তলানিতে। এটাই উপযুক্ত সময় মানুষের আন্দোলন গড়ে তোলার। এছাড়া এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর এই electoral fascism'কে আটকানোর আর কোনও পথ নেই।


Wednesday, 5 November 2025

Condominium হিন্দুত্ব

‘অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো’

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



আপামর বাঙালি এখন মূলত দু’ ভাগে বিভক্ত: একদিকে condominium (ইস্টার্ন বাইপাস জুড়ে, কলকাতা ও শহরতলি এবং মফস্বলেরও বহু জায়গায় গড়ে ওঠা বিস্তৃত উদ্যান সম্বলিত ছ-আট টাওয়ারের উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত অধ্যুষিত আবাসিক ঘেটো) প্রসূত বিষাক্ত বিদ্বেষ-বিষ, অন্যদিকে সাধারণ আপামর শ্রমজীবী বাঙালি সমাজের মিলেমিশে বেঁচে থাকার পরম্পরা ও আকুল বাসনা। অবশ্য প্রথমোক্তের বিদ্বেষ-বিষ যে দ্বিতীয় গোত্রকেও কমবেশি প্রভাবিত করে তা যেমন সত্য, তেমনই condominium’এর ভয়ঙ্কর বাতায়নে ‘দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের’ মতো যে দু-চারজন স্থিতপ্রাজ্ঞ কেউ নেই, তাও বলা যায় না।

আসলে প্রশ্নটা হল, আজকের বিভাজন ও হিংসার রাজনীতির উৎসস্থলটা কোথায়! বলাই বাহুল্য, আজ উগ্র হিন্দুয়ানি দলের যে বাড়বাড়ন্ত, তা এমন এক উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত লালিত বর্ণাশ্রম ভিত্তিক মতাদর্শ থেকে নির্গত, বাংলায় যার সূত্রপাত দ্বাদশ শতকে বল্লাল সেনের কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে সেই ভয়ঙ্কর প্রথা (প্রায় দাস ব্যবস্থার মতো) চৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তি আন্দোলন ও ইসলামি সুফিতন্ত্রের উদার আবহে এবং লালন-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শে ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসে। পাশাপাশি, বাংলার দীর্ঘকালীন বাম ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী প্রভাবও হিন্দু বর্ণাশ্রমবাদী চিন্তা-ভাবনাকে মাথা তুলতে দেয়নি। এ ক্ষেত্রে স্মর্তব্য, ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ কৃত ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’, যা ছিল হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ দূর করে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের লক্ষ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। তৎসত্ত্বেও, এক অংশের হিন্দু উচ্চবর্ণের চিন্তা-চেতনায় কৌলিন্য প্রথা সদা প্রবহমান ছিল এবং সেই সব পরিবারে কান পাতলে নিম্নবর্ণ হিন্দু ও মুসলমান-খ্রিস্টানদের প্রতি তাদের সর্বাত্মক ঘৃণা বেশ উচ্চনিনাদে শোনা যেত। আজ সেই সংখ্যালঘু প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু উচ্চবর্ণ গোষ্ঠীগুলিই পরিবর্তিত আবহ ও নিজ নিজ আর্থিক কৌলিন্যের পরিস্থিতিতে শহরের আনাচেকানাচে ও উদরেও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো গড়ে ওঠা condominium ঘেটোগুলিতে আশ্রয় নিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষের একেকটি দূর্গ নির্মাণ করেছে। এদের whatsapp গ্রুপগুলিতে সেই ঘৃণা ও হিংসার নিত্য চাষ চলে, নির্মিত হয় ভয়ঙ্কর সব গুজব ও মিথ্যাচার। এরাই হল আরএসএস-বিজেপি’র মতাদর্শগত রসদের জোগানদার, দাঙ্গার কারিগর। আজ এদেরই স্বঘোষিত পাণ্ডা তিলোত্তমা মজুমদার, নারায়ণ ব্যানার্জি’র মতো উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তরা, যারা whatsapp গ্রুপের ফুসুর-ফুসুর ছেড়ে প্রকাশ্যে নেমে পড়েছেন বিদ্বেষের ওকালতি করতে। এদের মূল টার্গেট নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান, যারা নাকি বেশ মাথায় উঠে পড়েছে; এবং মূল উদ্দেশ্য, সেই অতি-পুরাতন, জীর্ণ ও কঠোর বর্ণাশ্রমবাদী সমাজকে আবারও ফিরিয়ে আনা যেখানে অতি সহজে ও সস্তায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও বাড়ির যাবতীয় কাজের জন্য নিম্নবর্ণের ঝি-চাকর মিলবে, যারা সদা অবনত হয়ে থাকার মন্ত্র শিখে নেবে।

এই উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তদের গোষ্ঠীতে যারা নিজেদের খানিক ‘প্রগতিশীল’ বলে দাবি করে, তাদের আবার দুটি স্পষ্ট বর্গ আছে: এক) বামপন্থী হিন্দুত্ববাদী অথবা হিন্দুত্ববাদী বাম-- যারা মনে করে মুসলমান ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে বাংলা ভরে উঠেছে (অথচ সে সবের কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই), অতএব, তাদের ঠেঙ্গিয়ে বার করে দিতে হবে। এই গোষ্ঠীর অন্যতম মুখ হলেন নারায়ণ ব্যানার্জি, যিনি ফেসবুক লাইভ করে এইসব কথা বলেছেন এবং এই গোষ্ঠীর লোকজনেরাই ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচন থেকে পরের পর নির্বাচনগুলিতে দলে দলে বিজেপি’র ভোটবাক্স উজাড় করে ভোট দিয়ে চলেছেন; দুই) ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদী— যারা মনে করে বাঙালি মুসলমানেরা কেউ বাঙালি নয়, তারা সব ‘মুজাহিদ’ (শব্দটির অর্থই তারা অবগত নয়) এবং সকলেই ‘দুশমন’। তারা প্রকারান্তরে মুসলমান (ethnic) cleansing’এর পক্ষে, দখলিকৃত নিজেদের whatsapp গ্রুপগুলিতে খুব সোচ্চারে সেইসব কথা আওড়ায়, জনপরিসরে খানিক ‘মার্জিত’ হয়ে হরেদরে মুসলমান নিধনের কথাই বলে, যেমন তিলোত্তমা মজুমদার।

পরিহাসের হলেও, আজ বাংলার বাস্তব চিত্র কতকটা এমনতরই। গত এক দশকে বিজেপি’র উত্থানে condominium-প্রসূত হিন্দুয়ানার যে নখদন্ত-যুক্ত ঘৃণ্য প্রসার ঘটেছে, তার প্রভাব বহু সচেতন ও উদার মনের মানুষকেও বিভ্রান্ত করেছে। ফেক হিন্দুয়ানার মায়ামোহে এ রাজ্যের মতুয়া ও রাজবংশী মানুষেরাও কম বোকা বনেননি। প্রকৃত প্রস্তাবে, SIR’এর জুজুতেই সেই মোহ এবার কেটে যাবার পালা। কারণ, যে তথাকথিত হিন্দুয়ানাকে রক্ষা করতে এতসব ফন্দিফিকির, সেই হিন্দুরাই এবার পড়েছে সবচেয়ে বেশি বিপদে। বাংলাদেশ থেকে চলে আসা এইসব হিন্দুরা ইতিমধ্যেই ভারতে সমস্তরকম পরিচয়পত্র ও জনকল্যাণ প্রকল্পের কার্ড ইত্যাদি বানিয়ে একজন পুরোদস্তুর নাগরিক হিসেবে যখন এখানে স্থিত রয়েছেন, তখনই SIR’এর অজুহাতে তাঁদের বলা হচ্ছে সিএএ মারফত নাগরিকত্বের আবেদন করতে, যা আবারও ছিন্নমূল হয়ে পড়ার সমতুল। কারণ, নাগরিকত্বের আবেদন দেওয়া মানেই তৎক্ষণাৎ তিনি বিদেশি হিসেবে সাব্যস্ত হবেন, ডিটেনশন সেন্টারে যাবেন এবং কতদিনে তাঁর বয়ান পরীক্ষিত হয়ে তিনি নাগরিকত্ব পাবেন তার কোনও নিশ্চিতি নেই। ঠিক এই কাণ্ডটিই অসমে হয়েছে যেখানে লক্ষ লক্ষ অসমবাসী বাঙালি বেঘর হয়ে ডিটেনশন সেন্টারে দিন কাটাচ্ছেন। 

অবশেষে, মতুয়া অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ এই বিভেদের রাজনীতি ও উচ্চবর্ণীয় সনাতনী ফাঁকিবাজিটা ধরে ফেলেছেন। SIR’এর জুমলাবাজির বিরুদ্ধে গত ৪ নভেম্বর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে কলকাতায় গণ মিছিলে আমজনতার বিপুল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও তার সাক্ষ্য দিচ্ছে।

উল্টোদিকে, মূলত যে উদ্দেশ্যে এই SIR’এর উদ্যোগ— তথাকথিত বিদেশি তকমা দিয়ে মুসলমানদের ভিটেমাটি ছাড়া করা— তা গুড়ে বালি। কারণ, কোনও সেনসাস বা কোনও ধরনের তথ্য থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না যে বিদেশ থেকে, বিশেষত বাংলাদেশ ও মায়ানমার থেকে, লাখে লাখে নিদেনপক্ষে হাজারে হাজারে বাঙালি মুসলমান ও রোহিঙ্গারা এ দেশে ঢুকে জমি-জিরেত দখল করে সব বসে আছে। বিহারের SIR’এও গোটা পঞ্চাশের বেশি ‘বাংলাদেশি’ পাওয়া যায়নি। যে কোনও দেশের সীমান্ত অঞ্চলে বৈধ-অবৈধ লেনদেনের কারণে কিছু মানুষের এদিক-ওদিক যাতায়াত থাকে, তা বড়জোর কয়েক’শো হতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। ‘মুসলমান অনুপ্রবেশের’ তত্ত্বটি আরএসএস-বিজেপি’র একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক গুজব, যাকে তা’ দিয়ে condominium-বাসী উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত হিন্দুরা একটি অ্যাটম বোমা তৈরি করেছে-- চূড়ান্ত নিক্ষেপের আগেই যাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়াটা আমাদের দেশপ্রেমিক কর্তব্য।    

অতএব, আমরা আপামর বাঙালি এক তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি। এ লড়াই সারা দেশ জুড়ে বিস্তৃত। কারণ, মৌলবাদী সনাতনীরা জানে যে উদার হিন্দুত্বের মর্মবাণী বাংলার আকাশে বাতাসে চিরপ্রবহমান। সেই চিরন্তনকে ধ্বংস করে আদিম বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে যদি ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে বাঙালিদের (বিশেষত নিম্নবর্গের হিন্দু ও মুসলমান) ওপর ঘরে-বাইরে সর্বাত্মক আক্রমণ নামিয়ে আনতে হবে। সেই লক্ষ্যকে মাথায় রেখেই বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকদের উপর রাষ্ট্র কর্তৃক নৃশংস আক্রমণ শুরু হয়েছে। আর তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে একযোগে উপভোগ করছে condominium-বাসী উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত বাঙালি ও অবাঙালি, উভয়েই। আর ‘হাসি হাসি গন্ধে’ এই কর্মকাণ্ডকে হাওয়া দিয়ে চলেছে গোদি মিডিয়ার কুল শিরোমণি ‘এবিপি আনন্দ’, যেখানে condominium-হিন্দুদের গল্পদাদুর সান্ধ্য আসরে ছড়ানো হয় বিষাক্ত বিষ। পাশাপাশি, সোশ্যাল মিডিয়াতেও সারাদিন এইসব অলস কূপমণ্ডুকেরা বুনে চলেছে বিভেদের গরল জালিকা।

এই বিষ এতদূর ছড়ানো হয়েছে যে, অসমের এক স্কুল শিক্ষককে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করেছেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা; কারণ, তিনি রবি ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি স্কুলের ছাত্রদের দিয়ে গাইয়েছেন। এই ঘৃণা এতদূর অবধি বিস্তৃত যে, দিল্লির পুলিশ ২৬ বছরের অন্তঃসত্ত্বা ভারতীয় বাঙালি সোনালি বিবি’কে তাঁর সন্তান সহ জোরজবরদস্তি বাংলাদেশে পুশব্যাক করেছে শুধু তাই নয়, শীর্ষ আদালতের নির্দেশের পরেও তাঁদের ফিরিয়ে আনার কোনও নামগন্ধও নেই। এই অসহনীয় একবগ্‌গা পরিস্থিতিতে, অতএব, আমাদের সকলের এখন পক্ষ নেওয়ার পালা। যে বহুল চেনা-পরিচিত স্কুল বা কলেজের সহপাঠী, অফিস কলিগ, আত্মীয়-পরিজন, পাড়ার বাল্যবন্ধু, কিংবা দেখতে ভিজে-বিড়াল (কিন্তু অন্তরে লেলিহান জিঘাংসা) উচ্চবর্ণীয় ভদ্দরলোক জোর গলায় মুসলমান নিধনের সোরগোল তুলছে, অথবা, গরিব-নিম্নবর্ণের মানুষদের নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের তামাশা করছে, কিংবা, বুলডোজার-রাজ ও হিন্দু-ফ্যাসিবাদী শাসনের ওকালতি করছে, বাঙালিয়ানার আদ্যশ্রাদ্ধ করছে, তাদের আজ আস্তাকুঁড়ে’তে ছুঁড়ে ফেলার সময় হয়েছে।

প্রশ্ন উঠে গেছে, আমরা কি মৌলবাদ-লালিত হিংস্র condominium-হিন্দুত্বের দিকে থাকব, নাকি, চৈতন্য-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-চিত্তরঞ্জন-নেতাজীর প্রদর্শিত পথে সকল সম্প্রদায় ও সর্বস্তরের মানুষদের নিয়ে এক উদার, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের বাসিন্দা হব! তাহলে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু’র সেই অমোঘ কথাগুলিকে: ‘হিন্দু মহাসভা ত্রিশূল হাতে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ভোট ভিক্ষা করতে পাঠিয়েছে। গেরুয়া পোশাকে ত্রিশূল দেখলেই হিন্দুরা শ্রদ্ধায় নত হয়। হিন্দু মহাসভা ধর্মের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে প্রবেশ করে ধর্মকে কলুষিত করেছে। প্রতিটি হিন্দুর উচিত এর নিন্দা করা। এই বিশ্বাসঘাতকদের জাতীয় জীবন থেকে বিতাড়িত করো। এদের কথা শুনো না।’ (ঝাড়গ্রামের জনসভা, ১২ মে, ১৯৪০)।

আসুন, মাঠ বাড়িয়ে খেলি।


Tuesday, 4 November 2025

উমর খালিদ: বিচারের প্রহসন!

বিচারকেরাও যখন সন্ত্রস্ত

অনিন্দ্য শুভ্র দত্ত



২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন উমর খালিদ। অর্থাৎ, ঠিক পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি জেলে বন্দী হয়ে আছেন এবং এখনও কোনও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। উমরের এইভাবে জেলবন্দী জীবন কাটানো এক অর্থে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের অভিযোগ যে, উমর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে যাওয়া দিল্লি দাঙ্গার একজন মূল ষড়যন্ত্রকারী। ফলে, তাকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়। এই ষড়যন্ত্রের 'রূপকার' হিসেবে দিল্লি পুলিশ উমরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগনামা দাখিল করে সেখানে উল্লিখিত হয় মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে উমর কৃত একটি বক্তৃতা, 'দিল্লি প্রোটেস্ট সাপোর্ট গ্রুপ' নামক একটি হোয়াটস আপ গ্রুপের সদস্য হওয়া এবং এমন কিছু লোকের সাক্ষী যাদের কোনওভাবে প্রকাশ্যে আনতে দিল্লি পুলিশ নারাজ। এই মুহূর্তে উমর খালিদের মামলাটি শুধু ন্যাশনাল মিডিয়াতে নয়, ইনটারন্যাশনাল মিডিয়াতেও সমান প্রচারিত। 

আজ থেকে এক বছর আগে ললিত বাচানী নির্মিত একটি তথ্যচিত্র ‘কয়েদী নং ৬২৬৭১০ হাজির হো’ দেখেছিলাম সুজাতা সদনে। ছড়ানো ছিটানো বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপিংস জুড়ে আর বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরলেন ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির যে বৃহৎ ষড়যন্ত্র, তারই এক খণ্ড চিত্র। ২০১৬ সালে জেএনইউ প্রাঙ্গণে আফজল গুরু সম্পর্কিত একটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানের কিছু ভিডিও ক্লিপিংস এবং শ্লোগানকে বিকৃত করে মিডিয়াতে প্রচার করা হয়। মিডিয়া বিচারে কিছু ছাত্র-যুবকে দেশদ্রোহী বানিয়ে দিয়ে সারা দেশ জুড়ে তার প্রচার শুরু হয়। এই ছাত্র-যুবদের মধ্যে একটি নাম ছিল উমর খালিদ। শুধু তাই নয়, দেশদ্রোহিতার অভিযোগে উমর'কে গ্রেফতার করে দিল্লী পুলিশ। এভাবেই শুরু হয় উমরের ছাত্র রাজনীতির এক নতুন পর্যায়। 

উমর'কে ঘিরে তৈরি হলেও এই তথ্যচিত্রের অন্যতম বিষয় ছিল শাহীনবাগ। কেন্দ্রে আসীন এই সরকারের হিন্দুত্ববাদী এবং একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের (মুসলিম) বিরুদ্ধে নানা ক্রিয়াকলাপের প্রতিবাদের রাস্তা ধরেই উমরের উত্থান। সেই ক্রিয়াকলাপের একটি সুচিন্তিত এবং অত্যন্ত বিভেদকামী পদক্ষেপ ছিল সিএএ আইন প্রণয়ন। এই আইনটি সংবিধানের মূল নীতি থেকে বিচ্যুত। ভারতবর্ষের মানুষের সহজাত মননশীলতা, যার দীর্ঘ ইতিহাস হল বিবিধের মাঝে ঐক্যের খোঁজ, তা এই বিভেদকামী প্রয়াসকে সহজে মেনে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। এই মেনে না নেওয়া এবং তাকে প্রতিরোধের রূপ দেওয়ার একজন প্রধান কাণ্ডারী ছিলেন উমর। তাই শাহীনবাগ যখন ঘটল তখন সেখানকার প্রতিবাদী প্রতিটি মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই উমরের আত্মিক সংযুক্তি গড়ে ওঠে। 

২০১৪'র পর থেকে আজ পর্যন্ত বিজেপির হাত ধরে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আরএসএস'এর পরিকল্পনায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নির্মাণের একটি পর্ব চলেছে। বিশেষ করে সম্প্রদায়গত ঘৃণা এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্রমশ কোণঠাসা করা এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যেকার সংহতিকে নষ্ট করে এক ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণের আধিপত্যকারী সমাজ তৈরি করা, এটাই এই সরকারের অন্তর্লীন পরিকল্পনা। এভাবেই আরএসএস চেয়েছিল সংবিধানের মূল ভিত্তিকে আঘাত করতে। এইরকম একটি টালমাটাল সময়েই উমরদের প্রতিবাদের সফর শুরু। এই প্রতিবাদের অভিনবত্ব ছিল আরএসএস'এর নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যেকার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে জনমত তৈরি করা। খুব স্বাভাবিক ভাবে আরএসএস'এর মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল ভারতের সংবিধান। সংবিধানের জন্মলগ্ন থেকেই তারা ভারতের সংবিধানকে সরাসরি আক্রমণ করার প্রয়াস নেয়। দীর্ঘ সময় ধরে তাদের এই প্রচেষ্টা প্রচারের আড়ালে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে অন্তঃসলিলা হয়েছিল। বর্তমানে বিজেপির উত্থানের সুযোগ নিয়ে সেই অন্তঃসলিলা প্রবাহের এক বিধ্বংসী বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই বিধ্বংসী প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে উমর এবং তাঁর মতো আরও যারা আছেন, তাঁদের প্রতিবাদ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যে সংবিধান দীর্ঘ সময় ধরে জনমানসের অন্তরালে এক প্রাচীন বিগ্রহের মতো প্রতিষ্ঠিত ছিল, উমররা তাকে জনতার কাছে এক প্রাণবন্ত পাথেয় হিসেবে হাজির করেন। স্বাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর আগে এই গ্রন্থটি কখনও এত ব্যাপক ভাবে চর্চিত হয়নি। যে বেগবান জলধারা আরও ধ্বংসাত্মক হওয়ার দিন গুনছিল, তা মুখ থুবড়ে এক বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হতে বাধ্য হয়। তারই মাশুল হয়তো উমর'কে আজও গুনতে হচ্ছে।   

তথ্যচিত্রটি প্রদর্শনের পরে ছিল উমরের সাথী বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে কথোপকথন। সঞ্চালক কস্তুরী বসু।  সুজাতা সদন প্রেক্ষাগৃহের প্রতিটি দর্শক দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে ধরে শুনতে চাইছিলেন সেই কাহিনি, যাতে তাঁর বুকের ভিতর চেপে বসে থাকা হতাশার জগদ্দল পাথরটাকে সরিয়ে দেওয়া যায়। 'কয়েদী নং ৬২৬৭১০ হাজির হো' দেখে আমরা সবাই ততক্ষণে জেনে গিয়েছি উমরের গ্রেফতার হওয়ার নেপথ্যের খুঁটিনাটি। কিন্তু দর্শক বসেছিলেন এই কথোপকথনে বিচার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত খবর জানতে। খবরের কাগজে যতটুকু সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে উমরের বিচারের জটিলতা খুব একটা পরিষ্কার হয়নি। অথচ বিনা দোষে একজন ব্যক্তিকে বছরের পর বছর জেলে আটকে রেখে দেওয়া হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব তা সাধারণের কাছে সত্যিই একটা ধোঁয়াশা। বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে কথোপকথনে যেটুকু বোঝা গেল তা কতকটা এইরকম:

এই বিচার প্রক্রিয়ায় যে দুটি বিষয় গুরুত্বপুর্ণ তা হল আইন ও বিচারব্যবস্থা । যে আইনে উমর গ্রেফতার হয়েছেন, অর্থাৎ ইউএপিএ, সেটির উদ্ভবের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা পৌঁছে যাব ১৯৬৩ সালে। এই সময় ন্যাশনাল ইন্ট্রিগ্রেশন কাউন্সিল'এর অধীন ন্যাশনাল ইনট্রিগেশন অ্যান্ড রিজিওনালাইজেশন কমিটির সুপারিশে সংবিধানের ১৯ নং পরিচ্ছদে কিছু সংশোধন করা হয়। এই সংশোধন করা হয় দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বকে মাথায় রেখে। সালটা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন যে, ঠিক এক বছর আগে ১৯৬২ সালে ঘটে গেছে ভারত-চীন যুদ্ধ, যেখানে ভারতের সুরক্ষা ও সার্বভৌমত্ব দুইই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল।  এই প্রেক্ষিতে সংবিধানের ১৯ নং পরিচ্ছদের ২ নং ধারায় একটি সংশোধন করা হয়। 'দেশের সুরক্ষার স্বার্থে'র বদলে লেখা হয় 'দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে'। সাধারণ ভাবে দেখলে এটি খুবই সামান্য একটি সংশোধন, যাকে সংশোধন না বলে পরিমার্জনও বলা যেতে পারে। কিন্তু একটু গভীরে গেলে বোঝা যাবে এর গুঢ়ার্থ। পূর্ববর্তী বাক্যবন্ধটির মধ্যে যে স্পষ্টতা ছিল তা অনেকাংশেই অনুপস্থিত এই বাক্যবন্ধটির মধ্যে। এক কথায়, 'সুরক্ষা' শব্দটির মধ্যে একটা বস্তুগত অর্থ ছিল। সে ক্ষেত্রে সংহতি এবং সার্বভৌমত্ব অনেকটাই বিষয়িগত প্রকাশ। ফলে, সংহতি এবং সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যার মধ্যে বিভিন্নতা থাকতে বাধ্য। কোনটা গ্রহণযোগ্য হবে তা রাষ্ট্রই ঠিক করবে। এরই ভিত্তিতে ১৯৬৭ সালে তৈরি হল ইউএপিএ আইনটি। এরপরে ক্রমশ এই আইনটি সংশোধিত হতে হতে এসেছে। এই সংশোধনের সময়গুলি ১৯৬৯, ১৯৭২, ১৯৮৬, ২০০৪, ২০০৮, ২০১২ ও সর্বশেষ ২০১৯। 

২০১৯'এর আগে এই আইনে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত থাকার সম্ভাবনায় শুধুই অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠনের উল্লেখ ছিল। ২০১৯'এর সংশোধনে তার সঙ্গে যুক্ত হল, একজন ব্যক্তি যিনি কোনও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন, তিনিও সন্ত্রাসবাদী আখ্যা পেতে পারেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই এই আইনের আওতায় চলে আসবেন। এক অর্থে, এই সংশোধন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের অধিক সম্ভাবনা তৈরি করল। এর সঙ্গে যুক্ত হল ইউএপিএ আইনটির এমন কিছু ধারা, যেমন ৪৩ডি, যার প্রয়োগে একজন ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলস্বরূপ, বহু মানুষ যারা সরকারের নানা নীতি বা পদক্ষেপের প্রতিবাদ করেছেন এবং জনমত তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছেন, তারা আজ জেলের মধ্যে বন্দী হয়ে রয়েছেন। অনেকের জামিন হতে লেগে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়। হয়তো বিচারে তাঁরা প্রত্যেকেই নির্দোষ প্রমাণ হবেন, কিন্তু জীবনের বেশ কিছু অমুল্য সময় তাঁরা আর কোনওদিন ফেরত পাবেন না। 

একদিকে গণতন্ত্র নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে নানান কাঁটাছেড়া, যার ফলে তার নানান সুপ্ত দিক প্রকাশ্যে আসছে এবং অধিকারের নানান বেড়াজালকে ভাঙতে ভাঙতে ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিসর আরও বিস্তৃত হয়ে চলেছে। উল্টোদিকে, ভারতবর্ষের মতো বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে নানা আইনি বিধিনিষেধ তৈরি করে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং বিশেষ করে বাক্‌ স্বাধীনতার কন্ঠরোধ করার জন্যে চলছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আজ যে বিরোধী দলটি এই ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে এই মুহূর্তে সতত মুখর, ২০০৮ সালে তারাই যখন ক্ষমতায় ছিল তখনই ইউএপিএ আইনটিতে জামিন সংক্রান্ত ৪৩ নং ধারাটি যুক্ত করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিত সম্ভবত ছিল মুম্বই শহরে ২০০৮ সালে ২৬ নভেম্বর ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী হানা। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিত যাই থাকুক না কেন, আজকের পরিস্থিতিতে এই আইনের যে প্রয়োগ তাতে বর্তমান সরকারের অভিসন্ধি খুবই স্পষ্ট-- যে কোনও গণআন্দোলনকে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত করে আন্দোলনকর্মীদের গ্রেফতার করে দীর্ঘ সময় ধরে বিনা বিচারে জেলে বন্দী করে রাখা। এভাবে শুধু সাধারণ মানুষ নয় বিচারকদেরও সন্ত্রস্ত করে রাখার চেষ্টা চলছে। বিচারকরা বিশেষ করে নিম্ন আদালতের বিচারকরা আজও জামিনের সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধান্বিত। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই নিয়ে নানান মন্তব্য এবং সমালোচনা সত্ত্বেও নিম্ন আদালতের বিচারকরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার যথেষ্ট সাহস অর্জন করে উঠতে পারেননি। ফলে, বিচারপ্রার্থীরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। 

শুধু গণআন্দোলনকারী নয়, অনেক সময় এই আইন ব্যবহৃত হচ্ছে মূলধারার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতা এবং কর্মীদের বিরুদ্ধেও। কিন্তু এই বিষয়গুলি নিয়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে মূলধারার বিরোধী দলগুলি যদি প্রতিবাদ না জানায় বা জনমত তৈরি করার উদ্যোগ না নেয়, তবে এই সন্ত্রস্ত পরিবেশ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়বে এবং এক ফ্যাসিস্ট পরিস্থিতির তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা প্রগাঢ়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মুলধারার বিরোধী দলগুলির মধ্যে এসব নিয়ে কোন নড়াচড়া চোখে পড়েনি। কিন্তু যতদিন সেটা না হচ্ছে ততদিন সাধারণ মানুষ যারা সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী কর্মসূচির বিরোধিতা করে জনমত গঠনের চেষ্টা করবেন তাদের একটা অংশকে এর মাশুল গুনে যেতে হবে। এটাই ভবিতব্য।


Sunday, 2 November 2025

নিম্নবর্গ হিন্দুদের ওপরেই কোপ

এই তাড়াহুড়োর এসআইআর কেন?

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



প্রদীপ কর। নিছক একটি নাম নয়, বাংলায় এসআইআর (SIR)'এর প্রথম বলি। আত্মঘাতী প্রৌঢ় তাঁর সুইসাইড নোটে উল্লেখ করেছেন এসআইআর'এর আতঙ্কের কথা। সে ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বীরভূমের ইলামবাজারে ৯৫ বছরের ক্ষিতীশ মজুমদার এসআইআর আতঙ্কে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। এরপরে পানিহাটিতে এক গৃহবধূ ও কেরলে এক পরিযায়ী শ্রমিকও একইভাবে নিজেদের শেষ করেছেন এবং কোচবিহারে আরও একজন আত্মহননের চেষ্টা করে প্রাণে বেঁচে গেছেন। আমি মনে করি, এই প্রতিটি ঘটনাই রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত পরোক্ষ রাজনৈতিক হত্যা। কেন্দ্রীয় সরকারেরর পিট্টু জ্ঞানেশ কুমার পরিচালিত নির্বাচন কমিশন এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর এগজিকিউটিভ এজেন্সি। আর সে কারণেই এই আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে বিজেপি'র তথাগত রায় ও সজল ঘোষ টিভি চ্যানেলের চ্যাটবাজিতে যে ভাষায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করলেন তা শুধু অশ্লীল নয়, অমানবিক ও নৃশংস। 

অতিবাচাল ও স্বঘোষিত ধূর্ত তথাগত রায় বললেন, এটা একটু কাঁচা কাজ হয়ে গেছে। বঙ্গ বিজেপির আধবুড়ো তরুণ তুর্কি সজল ঘোষের মত, মানুষ মরলে শকুনও এত তাড়াতাড়ি আসে না। তাই বুঝি! হিন্দি ও হিন্দুত্বর সঙ্গে ঘর করা সজল এটা জানেন না, শকুনের আগে অবশ্যই কুকুর-শেয়াল আসে। ছেঁড়ে-খোঁড়ে লাশ। তার পর শকুনের পালা। না-বাঙালি দলের বোড়ে আর কী-ই বা জানবেন!

আর তিলোত্তমা যা বললেন তা শুনে আমার একটা জিনিস পরিস্কার হয়েছে যে, ওই লেখিকা আদপে অবিদ্যার ধাড়ি! নইলে এ ভাষায় মুসলমান বিদ্বেষের কথা কোনও সংবেদনশীল মানুষ বলতে পারেন!? ওঁর ইসলামোফোবিয়া তো সংঘ সঞ্চালকদেরও লজ্জা দেবে; খোদ নেতানিয়াহুকেও কুণ্ঠিত করবে। কী বলেছেন এই আদ্যোপান্ত আবাপ পণ্যটি? সারা পৃথিবীতে মুসলমান কমিউনিটি নাকি সন্ত্রাস তৈরি করেছে। এই সন্ত্রাসবাদীরা নাকি সর্বত্র খুন করে, রক্তপাত ঘটায়। তাই ওনার ভাষায়, যারা অনুপ্রবেশকারী সেই মুসলমানদের যাদের নাকি তিনি জন্ম থেকে তাঁর পাশে দেখেননি, বাংলায় কথা বললেও তাঁদের নাকি তাঁর 'দুশমন' বলে মনে হয়। সার্থক জনম আমার তিলোত্তমার কথা শুনে! 

তিলোত্তমা সাহিত্যিক হিসাবে কী ছাইপাশ লেখেন তা আমি জানি না, জানার ইচ্ছেও নেই। শুধু এটা বুঝেছি, এক অতল অবিদ্যার ধাড়ি বলেই তিনি জানেন না, সব ধর্মেরই কিছু লোক ধর্মের নামে সন্ত্রাস করে মুখ্যত ধনী থেকে ধনীতরদের হাতিয়ার হয়ে আরও শোষণের ব্যবস্থা করতে। এ সম্পর্কে তিলোত্তমার হয় স্পষ্ট ধারণা নেই, নয় তিনি নিজেই এমন এক হাতিয়ার হয়ে উঠতে চান তাঁর প্রভুদের তুষ্ট করতে। আর গত ১১ বছর ধরে ভারতে যা ঘটে যাচ্ছে? পুশব্যাকের নামে বাঙালিদের জেসিবি'তে উঠিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত পার করে ছুঁড়ে ফেলে দিলেও তিলোত্তমা দেখতে পান না। বীরভূমের অন্তঃসত্ত্বা সোনালি বিবিকে দেশছাড়া করা মোদী-শাহর শাসন নিয়ে তাঁর মাথাব্যথাও নেই। প্রদীপ কর বা ক্ষিতীশ মজুমদারের আত্মহত্যা বা খাইরুল শেখের আত্মহত্যার চেষ্টা তাঁকে ভাবায় না, বিচলিত করে না, কারণ এদের কাউকে তিনি জন্ম থেকে পাশে বেড়ে উঠতে দেখেননি। তিনি দেখতে পান না তথাকথিত বর্ণ হিন্দুদের নিম্নবর্গের ওপর অত্যাচার। তিনি কোনওদিন প্রশ্ন করেননি, কেন তথাকথিত হিন্দু উচ্চজাতের সঙ্গে হিন্দু 'ছোটজাত' একত্রে থাকতে পারে না। কেন নগরে ও গ্রাম-মফস্বলের একই অঞ্চলে মিলেমিশে হিন্দু-মুসলমানরা থাকে না। কেন সব আলাদা আলাদা ঘেটো করে বাঁচে। এসব প্রশ্ন করলেই তো তিলোত্তমার বর্তমান গুরুকলের হিন্দু মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদীদের কথা চলে আসবে, আসবে তাদের ভূমিকার কথা। তাই তিনি এড়িয়ে যান বা তিনি এতটাই অশিক্ষিত যে দেশের ইতিহাস-ভূগোলও পড়েননি ঠিক করে। উনিশ-বিশ শতকের রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দর যে ভাবধারা, তা-ও তিনি অনুধাবন করতে চাননি। ৫০০ বছর আগে চৈতন্যর জাগরণের বার্তাও তিনি পড়েননি। তিনি এও জানেন না যে, তৎকালীন বাংলার সুলতান হুসেন শাহের হস্তক্ষেপেই চৈতন্যদেব নবদ্বীপে তাঁর নগর সংকীর্তন করতে পেরেছিলেন, যা উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আসলে, তিলোত্তমা'র কোনও চোরাগোপ্তা অ্যাজেন্ডা আছে অভিজিৎ গাঙ্গুলির মতো।

আমরা তো জানি, সংসদের ভিতরে ও বাইরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বহুবার এনআরসি করার হুমকি দিয়েছেন। ভারতীয় উগ্র দক্ষিণপন্থার সবচেয়ে জঙ্গি নেতা শাহ বলেন, 'ভারতের সব নাগরিকের জন্য এনআরসি তালিকা হবে। সবার নামই যুক্ত হবে এনআরসি তালিকায়। কোনও ধর্ম বা বিশেষ অঞ্চলের ভিত্তিতে এনআরসি করা হচ্ছে না।' কী নিদারুণ মিথ্যেবাদী এই লোকটা! তেমনই ওঁদের এখানকার নেতারাও। বঙ্গ বিজেপির নেতা সহ বহু তথাকথিত সেলিব্রিটিই বলছেন, ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) হচ্ছে। ২০০২ সালেও হয়েছিল। এর সঙ্গে এনআরসি-র কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু এসআইআর'এর গর্ভে যে এনআরসি আছে, সে বিতর্ক তো উসকে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ স্বয়ং। তাঁর ভাষ্যের পর এবারের এসআইআর'কে ২০০২ সালের মতো নির্বিষ বলে ভাবা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে অমিত শাহ স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, এবারের এসআইআর কার্যত এনআরসি-র প্রথম ধাপ। তাঁর বার্তা, এসআইআর'এর মাধ্যমে প্রথমে অবৈধ ভোটারদের চিহ্নিত (ডিটেক্ট)করা হবে, তারপর তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ (ডিলিট) দেওয়া হবে, পরে বিতাড়িত করা (ডিপোর্ট) হবে। অর্থাৎ, ডিটেক্ট, ডিলিট ও ডিপোর্ট-- এই থ্রি-ডি ফর্মুলার ওপর ভিত্তি করেই এবারের এসআইআর। এই বক্তব্য জাহির করে বিজেপি সমর্থকদের দেদার হাততালিও কুড়িয়েছেন পদ্ম শিবিরের নাম্বার টু। তাই এবারের এসআইআর নিয়ে বাংলা তথা দেশের নাগরিকদের একাংশ যদি আতঙ্কিত বোধ করেন, তাকে অকারণ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কোনও গণতন্ত্রের বুলি দিয়ে চাপা দেওয়া যাবে না নাগরিকদের বেনাগরিক করার এই হীন ষড়যন্ত্র। 

এই ষড়যন্ত্রমূলক আতঙ্কের জেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এর জন্য কে বা কারা দায়ী? এই বিচার তিলোত্তমার মতো স্পনসর্ড লেখকরা করবেন না, বিচার হবে জনতার আদালতে। মনে রাখবেন, রামমন্দির, মুসলিম জুজু, সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলেও যখন ২০২৪ সালের ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হল না, তারপরই বিজেপি সিলেক্টেড ভোটারের লাইন নিয়েছে। কমিশনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যে ভোটচুরি করে জিততে হচ্ছে নির্বাচন। বিধানসভার ভোটার প্যাটার্ন'এর অ্যালগরিদমটা তারা বুঝে নিয়েছে। তাই, কোথাও বাদ পড়বে কোথাও সংযোজন হবে। যেমন এখন বৃহৎ মুম্বই পুরনিগমের ভোটের কথা মাথায় রেখে ভুয়ো ভোটার যুক্ত করা হয়েছে ভোটার তালিকায়! এর প্রতিবাদে এক মঞ্চে উঠে এসেছেন দুই ঠাকরে ভাই, উদ্ধব ও রাজ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এখানেও তাই হবে। বিহারে যখন প্রথম এসআইআর শুরু হল, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বলেছিলেন যে বিহার নামেই, এর আসল লক্ষ্য বাংলা। জ্ঞানেশ কুমারের ঘোষণার দিন তা প্রমাণ হল। সীমান্ত রাজ্যগুলোর মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই এসআইআর চালু হল। এর মাধ্যমে ভাগীরথীর পূর্ব তীরে মূলত বলি হবেন নিম্নবর্গের হিন্দু, দলিত, মতুয়ারা। বলা যায়, তথাকথিত 'বাঙালরা'। আর বাঙালরা জব্দ হচ্ছে বলে ভাগীরথীর পশ্চিমের 'ঘটি' হিন্দু বাঙালিরা বিজেপিকে হাত খুলে ভোট দেবেন বলে পদ্ম শিবিরের আশা। 

অনুপ্রবেশকারীদের দেশের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে, এ নিয়ে কারও কোনও আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু অবৈধ ভোটার বাদ দেওয়ার অছিলায়, নানা নথির ছুতোয়, এসআইআর'এর মাধ্যমে যদি একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব হরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় তাহলে বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় উঠবেই। অন্যায় ভাবে প্রকৃত নাগরিকদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে কেউ যদি প্রতিরোধ গড়ারও ডাক দেন— তাকে অসাংবিধানিক বলা যায় না। নথি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মনোভাব, নানা হুঁশিয়ারি, ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ার মতো একটি স্বাভাবিক বিষয়কে কার্যত নাগরিকত্ব যাচাইয়ের পরীক্ষায় পর্যবসিত করেছে। যদিও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের অধিকার কমিশনের নেই। গরিব, পরিযায়ী, প্রান্তিক-সমাজের পিছিয়ে পড়ারা— সংখ্যালঘু বা যে সম্প্রদায়েরই মানুষ হন না কেন, তাঁদের যথাযথ কাগজ না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে সাধারণত কাগজ নিয়ে কারও মাথাব্যথা থাকে না। যাদের চালচুলোর ঠিক নেই, নিজের শরীরটাই যত্নে রাখতে পারে না, তারা রাখবে নথি! ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড (এসআইআর-এ যে নথিগুলোর কার্যত গুরুত্ব নেই)'এর মতো কাগজপত্র তাঁরা গুছিয়ে রাখেন। কারণ, এই নথিগুলি তাদের দৈনন্দিন জীবনে ও সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার মতো জীবিকা নির্বাহের কাজে লাগে। 

যাঁরা লাফাচ্ছেন, নিজেদের সমস্ত নথিপত্র সব ঠিক আছে, তাঁরা একবার যে ফর্মটা নির্বাচন কমিশন থেকে দেওয়া হবে, সেটা দেখুন। যাঁরা আপনাদের মতো 'শিক্ষিত' নন, তাঁরা এই ফর্ম নিজেরা ভর্তি করতে পারবেন বলে মনে হয়? আমাদের বলা হচ্ছে, SIR ২০০২ সালে শেষবার হয়েছিল-- সেটা সম্পূর্ণ ভুল এবং মিথ্যা কথা। যে কোনও বছরেই যেটা হয়ে থাকে সেটা সামারি রিভিশন এবং তা করার দায়িত্বও কমিশনের। তাঁরা সেটা করেনি কেন, সেই প্রশ্ন করুন। নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট করে বলতে হবে, কেন ২০০২ সালকে ধরা হচ্ছে। কেন ১৯৮৭ বা ১৯৫১ নয়? কারণ, সিএএ ২০০৩ কার্যকর করতে গেলে ২০০২-এর বেঞ্চমার্কই লাগবে। কারণ, ১৯৮৭ সালেই নাগরিকত্ব আইন প্রথম বদল হচ্ছে। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। 'ঘুরপথে এনআরসি' নয়, এসআইআর'এ যে বিশেষ কাগজপত্র চাওয়া হচ্ছে তাতে এর মাধ্যমে সরাসরিভাবে এনপিআর-এর প্রথম ধাপের কাজ হচ্ছে। ভোটের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে এ কাজ না করলে ওরা অন্তত বাংলায় এটা করতে পারত না, এমনকি সেনসাসের সঙ্গে মিলিয়েও করতে পারত না, সেটা জেনেবুঝে ভোটের সঙ্গে মিলিয়ে করছে। বিহারে যা করা হয়েছে তা বাংলার এসআইআরের উপক্রমণিকা ছাড়া কিছু নয়। কত মানুষ বাদ যাবেন কল্পনাও করতে পারবেন না। কত প্রদীপ কত ক্ষিতীশের মৃত্যু হবে তা কেউ জানে না। 

উদ্বাস্তু আন্দোলনের বিশ্বস্ত নেতা সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস ঠিকই বলেছেন, এসআইআর'এ বড়জোর পাঁচ শতাংশ মুসলিম বাদ পড়বে, আসল কোপটা আসবে গরিব, নিম্নবর্গের হিন্দুদের ওপর। এটাই এসআইআর'এর উদ্দেশ্য। তাই, গত ২৭ অক্টোবরের পর এখন পর্যন্ত যাঁরা আত্মঘাতী হলেন, সবাই হিন্দু।