Sunday, 12 October 2025

নীল নকশার অভিযান

আমাদের পক্ষ নেওয়ার পালা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

এই প্রথম দেখা গেল, ভারতের বুকে এমন এক সাংবাদিক সম্মেলন যেখানে নারী সাংবাদিকরা ব্রাত্য। হ্যাঁ, গত ১০ অক্টোবর দিল্লিতে ভারতে সফররত আফগান বিদেশ মন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি’র সাংবাদিক সম্মেলনে তেমন ঘটনাই ঘটেছে। এ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদের ঢেউ উঠলে ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আফগান দূতাবাসে বিদেশ মন্ত্রী মুত্তাকি নিজ দায়িত্বে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছেন, এর সঙ্গে ভারত সরকারের কোনও যোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হল, দিল্লিতে আফগান দূতাবাস নামে যে বাড়িটি দৃশ্যমান তা কার্যত অচল এবং সেখানে যে দু-চারজন আফগান পদাধিকারী ও কর্মচারী আছেন, তাঁরা পূর্বতন আফগান সরকারের অনুসারী এবং সেই সরকারের পতাকাই সেখানে এখনও উড়ছে, কারণ, ভারত তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় এ দেশে এই সরকারের কোনও locus standi নেই। কিন্তু সে সবের তোয়াক্কা না করে ভারত সরকার আফগান বিদেশ মন্ত্রীকে উল্লিখিত দূতাবাসে সাংবাদিক সম্মেলন করার অনুমতি দেয় যা কার্যত অস্বীকৃত এক বিদেশি সরকারকে দেশের কিছু অংশ ব্যবহারের অনুমতি মোতাবেক এমন কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া যা আমাদের সংবিধানের মূল আত্মাকে বিদ্ধ করে। দুনিয়া সুদ্ধ লোক জানে, তালিবানরা তাদের সাংবাদিক সম্মেলনে কোনও মহিলা সাংবাদিককে ঢুকতে দেয় না। এবং তা জেনেই এমন একটি কুনাট্য করার সুযোগ তাদের দেওয়া হল। কারণ, আমাদের শাসকেরাও যে সামান্য ভিন্ন আঙ্গিকে নারী বিরোধী, সম্ভবত তা তালিবানিদের কাছে প্রকট করার দায় ছিল।

এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশে পর পর এমনতর কয়েকটি ঘটনা ঘটেই চলেছে, যা খানিক আলটপকা মনে হলেও দেখা যাবে, প্রতিটি ঘটনার মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট যোগসূত্র আছে। সর্বোপরি, আজ যে পরিস্থিতিতে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি, সেখানে এই ধরনের ঘটনা উত্তরোত্তর বাড়বে বলেই অনুমান। কারণ, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক পরিসর ও খোলামেলা মতপ্রকাশের যে আবহে স্বাধীনতার পরে অন্তত ৬৫ বছর আমরা কাটিয়েছি (হাজারও সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ সহ), তা আজ এক লহমায় বিলীন-প্রায়। তাই, আরও ভয়াবহ সব ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

যেমন, এতদিন ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প’এর সঙ্গে আদিখ্যেতার কুরঙ্গ করার পর সেখানে লাথি-ঝাঁটা খেয়ে এখন আমাদের একচ্ছত্র শাসক ভাব জমাচ্ছেন একদিকে চীন (একদা যাদের পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন) এবং অন্যদিকে তালিবানিদের সঙ্গে যাদের ভয়ঙ্কর শাসনে আফগানিস্তানে এক ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। আফগানিস্তানে মেয়েরা ঘরের বাইরে পা রাখা তো দূরের কথা, কোনও বই পড়ারও অধিকারী নয়। সেখানে গানবাজনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ফলে, এ দেশের স্বঘোষিত ‘সনাতনী’রা এতে খুশি হচ্ছে, কারণ, তারাও তো কতকটা এমনতর মনুবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাই গড়ে তুলতে সোচ্চারে প্রয়াসী। অতএব, রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মৌলবাদ নিয়ে ‘শঙ্কা’ প্রকাশ করলেও আফগানিস্তান এখন আমাদের শাসকদের ‘ব্লু আইড বয়’।

তাই, অতি আয়াসে ও কতকটা নিশ্চিন্তে দেশের দলিত ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রধান বিচারপতি বি আর গভাই’এর দিকে জুতো ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হয় এক স্বঘোষিত সনাতনী। উপরন্তু, পেশাগত ভাবে এই অপরাধী একজন উকিল হওয়া সত্ত্বেও নিজ দোষ স্বীকারে রাজী তো নয়ই, বরং উচ্চনিনাদে জানান দেয়, এরকম কাজ সে আবারও করবে। বোঝাই যাচ্ছে, এই ঘটনাগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন ভুল বা তাৎক্ষণিক উন্মাদনা নয়, নীল নকশা ধরে এক পরিকল্পিত অভিযান, যার অন্তিমে গিয়ে পৌঁছনোর কথা সেই কল্পিত রাষ্ট্রে যা তালিবানিদের থেকে তেমন আলাদা নয় কিছু, যেখানে নারী এবং দলিত ও ভিন্ন ধর্ম বা চিন্তার মানুষের কোনও স্থান তো নেইই, বরং কেউ গলা তুললে তাকে আদিম ও নৃশংসতম শিক্ষা দেওয়ার আয়োজন চারিধারে সাজানো। যদিচ, উক্ত আইনজীবীর আচরণের নিন্দা করেছেন মোদিজী কিন্তু সংবিধান পদদলিত করেও যে ব্যক্তি অনুশোচনাহীন থাকে, তার যে খুঁটির জোর অনেক গভীরে, তা বলাই বাহুল্য। মিথ্যা কেসে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে পাদ্রী ও সমাজকর্মী স্ট্যান স্বামীকে গ্রেফতার করে হত্যা করতে অথবা ছাত্রনেতা উমর খালিদকে ইউএপিএ আইনে বছরের পর বছর আটকে রাখতে শাসক যেখানে দ্বিধাহীন, সেখানে ওই অপরাধী আইনজীবী রাকেশ কিশোরকে যে মামুলি কিছু হাল্কা কেস দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না!

যত দিন যাচ্ছে তত সুকৌশলে সমাজটাকে এইভাবেই দু’ ভাগ করে ফেলার চেষ্টা চলছে। একদিকে মনুবাদী সমাজের পক্ষে ওকালতি, বিপরীতে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের (Inclusive Society) নির্মাণ— এই দ্বৈরথেই এখন দেশের পারদ ওঠানামা করছে। ইতিহাসকে বিকৃত করে, বিশেষত একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে জাতিগত নির্মূলিকরনের (ethnic cleansing) কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যে বিশেষ পশ্চাদপদ সমাজ নির্মাণের অভিসার শুরু হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই নতুনতর সংঘাতেরও উদয়। যে কারণে হরিয়ানার এডিজিপি পদমর্যাদার আইপিএস অফিসার ওয়াই পূরণ কুমার’কে নিজের সার্ভিস রিভলবার দিয়ে আত্মহত্যা করতে হয়। কারণ, তিনি তফসিলি জাতি সম্প্রদায়ের হওয়ায় ১০ জন আইপিএস ও ৩ জন আইএএস অফিসার সহ মোট প্রায় ১৬ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গত পাঁচ বছর ধরে জাতপাতগত কারণে তাঁকে প্রকাশ্যে মানসিক হয়রানি ও অপমান সহ তাঁর প্রতি নৃশংসতা প্রদর্শন করে গেছে— নিজের স্যুইসাইড নোটে তিনি এই কথাগুলি লিখে গেছেন। যদি একজন  কর্মরত আইপিএস অফিসারেরই এই দুর্দশা হয়, তাহলে গরিব আমজনতার কী হাল তা সহজেই অনুমেয়। আমরা দেখছিও, বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমজীবী গরিব বাঙালি হিন্দু নিম্নবর্ণ ও মুসলমানদের উপর কী অকথ্য অত্যাচার নামিয়ে আনা হয়েছে এবং তাদের অনেককেই বেআইনি ভাবে বাংলাদেশে পুশব্যাক করে আরও বিপন্নতায় ছুঁড়ে দিয়েছে। এইগুলি সবই সেই নীল নকশার অংশ, নিছক কোনও বিদ্বেষ তাড়িত ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহের সাময়িক ঘৃণার উদ্রেক নয়। গোদি মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, Whatsapp University, প্রশাসন, বিবিধ কালাকানুন, নিবিড় গুজব, হিংস্র ধর্মীয় প্রদর্শন, আরএসএস’এর শাখা, ভীতি, উগ্র দেশপ্রেম ইত্যাদি নানাবিধ প্রচার ও কৌশলে এমনই এক বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে যেখানে মনুবাদী সমাজের সমস্ত আকারপ্রকারকে সিদ্ধ করে তোলা যায়। তাই, ধর্মীয়, জাতপাত ও জাতিগত-- এমনতর নৃশংস মনোভাব ও ঘটনাবলী আমাদের চারপাশে অনায়াসেই প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্পষ্টতই দৃশ্যমান।

এমনকি উড়িষ্যাতেও বিজেপি দল শাসনক্ষমতায় আসতেই সে রাজ্যেরও হালহকিকত কী দ্রুত বদলে যাচ্ছে! এবার দুর্গোৎসবে কটকে ঝাঞ্জিরিমাঙ্গলা ভাগবত পূজা কমিটির বিসর্জনের শোভাযাত্রা নিয়ে গত ৩ অক্টোবর দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হলে তা ৩৬ ঘন্টা কারফিউ ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ পর্যন্ত গড়ায়। অথচ, পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে দুর্গোৎসবে কোথাও কোনও বিন্দুমাত্র উত্তেজনারও খবর পাওয়া যায় না। ফলে, বোঝাই যাচ্ছে,  গণ্ডগোল ও হিংসার রাজনীতি কোথা থেকে ও কী উদ্দেশ্যে আয়োজিত হয়।

তাই, এই কালবিষকে এখন বাংলায় প্রোথিত করার উদগ্র প্রচেষ্টা। বাংলার উচ্চবর্ণের কৌলিন্য গৌরব বহুকাল আগেই খর্বিত হলেও তার রেশ ও কিছু প্রথা চোরাপথে থেকে গিয়েছিল বেশ সবলেই। সারা দেশ জুড়ে মনুবাদী মতাদর্শের উদ্গীরণে তা বাংলাতেও এই সময়ে তাল পেয়েছে বৈকি! বেশ দেখা যাচ্ছে, সরবে বা নীরবে, নিম্নবর্ণ ও মুসলমান নিধনে বাঙালি উচ্চবর্ণের এক বড় অংশের কী পরম হর্ষধ্বনি! বাংলায় সোশ্যাল মিডিয়ার এক বড় মাঠ দখল করে এরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যেখানে মার্কস ও মনু যেন এক পাতে বসে পড়েছেন। উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত বাম মনোভাবাপন্ন লোকজনের এক বড় অংশের এ ব্যাপারে উৎসাহেরও শেষ নেই! ভিন রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অসহনীয় নির্যাতন এদের স্পর্শ করে না; দিনরাত বিনা মজুরিতে পরিশ্রম করা বাড়ির মা-মেয়েদের প্রদত্ত সরকারি অনুদানকে এরা ‘অদেয় মজুরি’ হিসেবে দেখে না, ভাবে ভিক্ষা; শ্রমজীবী মানুষের মজুরি বা দর বেড়ে যাচ্ছে বলে এদের আপসোসের শেষ থাকে না-- ‘ছোটলোকদের সব মাথায় তোলা হচ্ছে’; বড় বড় শিল্প কেন আসছে না, তবেই নাকি কর্মসংস্থান হবে, অথচ সকলেই জানে, আধুনিক বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে নিয়োজনের হার অত্যন্ত স্বল্প, তবুও; বাংলায় নাকি সব রসাতলে গেছে, কারণ, এখানে সব কিছুই নাকি মুসলমানেরা দখল করে ফেলেছে; আর যে কোনও অপরাধের নিদান হল, এক বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকজনকে ধরে ধরে এনকাউন্টারে মেরে ফেলা অথবা বুলডোজার চালিয়ে তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া। এই হল কালবিষের মোদ্দা ন্যারেটিভ।

এই সার্বিক পরিস্থিতিতেই তালিবানি সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্মীয় মৌলবাদ, হিংস্র ব্রাহ্মণ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ মিলে যাচ্ছে এক প্রবাহে, যা রক্তাক্ত, হিংস্র ও দানবিক। অতএব, এই সন্ধিক্ষণেই আমাদের অবস্থান ও পক্ষ নেওয়ার পালা। বেঁচে ওঠার নির্মল আকুতি। পিট সিগার’এর একটি গানের কলি ছিল: Which side are you on boys?/ Which side are you on…’


5 comments:

  1. একদম সঠিক বিশ্লেষণ যা অত্যন্ত সময় উপযোগী

    ReplyDelete
  2. সঠিক বিশ্লেষণ। মানুষকে জবাই করার মনু বাদী প্রচেষ্টা।

    ReplyDelete
  3. অত্যন্ত সঠিক।
    প্রতিটি ক্ষেত্রে সংবিধানকে অস্বীকার করা হচ্ছে।

    ReplyDelete
  4. খুব সময়োপযোগী এবং যথাযথ বিশ্লেষণ করে একটা ফাসিবাদী sinister grand design লেখাটাতে তুলে ধরেছো। সবার মধ্যে, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে, দলিত/ সংখ্যালঘু এবং দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে আর সমাজের প্রতিবাদী, প্রশ্নকারী সব মানুষের কাছে এই লেখা পৌঁছে দেওয়া দরকার। আমি শেয়ার করছি আরো অনেকের মধ্যে।

    ReplyDelete
  5. সময়োপযোগী এই বিশ্লেষণ আরো ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

    ReplyDelete