Wednesday, 15 October 2025

'সৃজনশীল বিনাশ'এর গল্প

প্রযুক্তির উদ্ভাবনেই অগ্রগতির পথ?

সুব্রত বোলার



এই বছর (২০২৫) অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী তিন অর্থনীতিবিদ জোয়েল মকিয়র (Joel Mokyr), ফিলিপ আগিয়োঁ (Philippe Aghion) ও পিটার হাউইট (Peter Howitt) এক অভিনব বিষয়ে বিচরণ করেছেন। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে তাঁরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির দ্যোতক হিসেবে পেশ করেছেন; ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে নবতর প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের নতুনতর উদ্ভাবন আরও অগ্রগতির কারণ হয়ে ওঠে। দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রসরতায় নতুন পণ্য ও উৎপাদন পদ্ধতিগুলি এক অন্তহীন চক্রে পুরনো যা কিছু, তার বিনাশ করে। আগিয়োঁ ও হাউইট'এর ধারণা, সৃজনশীল বিনাশের আছে এক রূপান্তরমূলক প্রক্রিয়া, যা পুরনো কোম্পানি বা বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানকে ক্রমাগত অকেজো করে দেয় এবং প্রতিস্থাপিত হয় নতুনতর প্রযুক্তি ভিত্তিক এক নবতর রীতি ও পদ্ধতি। এই নব উন্মেষ আমাদের টেঁকসই বৃদ্ধির দিকে ধাবিত করে।

১৯৪২ সালে জোসেফ শুম্পেটার প্রবর্তিত 'সৃজনশীল বিনাশ' (creative destruction) ধারণাটি এমন একটি প্রক্রিয়াকেই বোঝায় যেখানে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে নতুন কাঠামোর জন্য পথ তৈরি করে। এটি প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে এবং 'বিঘ্নকামী প্রযুক্তি' (disruptive technology) প্রবর্তনের মাধ্যমে পুঁজিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যায়। 'সৃজনশীল বিনাশ' অর্থনীতির এমন একটি ধারণা হয়ে ওঠে যেখানে নতুন উদ্ভাবনগুলি পিছিয়ে পড়তে থাকা বা অচল উদ্ভাবনগুলিকে প্রতিস্থাপন করে। শুম্পেটার এই তত্ত্বটি মার্কস'এর ভাবনার মধ্যে খুঁজে পান ও তাকে নিজস্ব ব্যাখ্যায় জনপ্রিয় করেন। এই তত্ত্ব শুম্পেটার'এর 'সৃজনশীল ধ্বংসের ঝড়' (Schumpeter's Gale) হিসেবেও বিখ্যাত। সহজ কথায়, উক্ত প্রক্রিয়ায় নতুন শিল্প, সম্পদ ও কর্মসংস্থান তৈরি হয়, কিন্তু একইসঙ্গে পুরনো প্রতিষ্ঠান, পণ্য ও কাজ বিলুপ্ত হয়ে যায়। অনেকেই বলেন, আধুনিক অর্থনীতিতে 'সৃজনশীল বিনাশ' তত্ত্বটি বর্তমানে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত।

বৃটিশ অর্থনীতিবিদ জেমস এ রবিনসন'এর মতে, বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও নিম্নগামিতার মূল কারণ, 'সৃজনশীল বিনাশ'এর অমোঘ বাস্তবতার প্রতি প্রবল অনীহা ও তাকে আটকানোর প্রবল প্রচেষ্টা।প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন বাণিজ্যকে এক ধরনের প্রযুক্তি হিসেবে ভাবা হয়? কারণ, নতুন প্রযুক্তির মতো নতুন বাণিজ্য পদ্ধতিও আমাদের সস্তা উপায়ে পণ্য উৎপাদন করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, গোলাপের কথাই ধরুন। আরও দক্ষ গ্রিনহাউস পরিবেশে উন্নত পরিচর্যা বা বীজের মতো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ফলে গোলাপের দাম কমে আসে। এই প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে, যা খরচ কম করতে ও মান উচ্চ রাখতে সহায়ক। বলা হয়ে থাকে, এইভাবে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভেঙে ফেলে পুরনো শিল্প বা প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা কমানো গেলে অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে।

ইতিহাসে 'সৃজনশীল বিনাশ'এর উদাহরণগুলির মধ্যে অন্যতম হেনরি ফোর্ডের অ্যাসেম্বলি লাইন। আমরা জানি, তা কীভাবে অটোমোবাইল উৎপাদন শিল্পে বিপ্লব এনেছিল; পাশাপাশি, পুরনো বাজারগুলিকে স্থানচ্যুত করে এবং বহু শ্রমিককে কাজ থেকে অপসারিত করে। অটোমোবাইলের নতুন উদ্ভাবকরা তখন দ্রুততর ও ব্যক্তিগতকৃত পরিবহনের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করেছিলেন। অটোমোবাইল বিপ্লব মানুষের ভ্রমণের ধরণকে চিরতরে বদলে দেয়। বলাই বাহুল্য, প্রথম অটোমোবাইলের উদ্ভাবন পরবর্তী উদ্ভাবনগুলিকে ইন্ধন জোগায়।

অবশ্য এই প্রশ্নও উঠতে পারে, এবারের নোবেল পুরস্কার ঘোষণায় সময়ের কি কোথাও গোলমাল হল? কারণ, আগিয়োঁ ও হাউইট'এর এ সংক্রান্ত মূল লেখাটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৯২ সালে এবং মকিয়র'এর ক্ষেত্রে তা ১৯৯৮ সালে। তাহলে এতদিন পরে তাঁদের সম্মানিত করা কেন? কারণ, এতদিন ধারণাটি বহমান থাকলেও তাকে যেন সম্যক ভাবে উপলব্ধির সমস্যা ছিল। তা এই অর্থে যে, নবতর প্রযুক্তির উন্মেষ কতকটা ছিল ধীরে এবং বিবর্তনমূলক পথে। ফলে, পরিবর্তনের অভিঘাতগুলি তেমন সজোর ছিল না; সবটাই যেন ধীরে ধীরে এক মানিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রগতি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমনে এই পরিবর্তনের ধারা গেল আমূল বদলে। তা এতটাই বৈপ্লবিক অভিঘাতে উপস্থিত হল যে, 'সৃজনশীল বিনাশ'এর মর্মকথা এবার হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল। হয়তো তাই নোবেল কমিটিও নড়েচড়ে বসল। 

দেখাই যাচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে এক  হৈ হৈ ভাব, বা বলা ভালো, গেল গেল রব। অনেকে এর জন্য বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদদের দোষারোপ করছেন, একে মানব সভ্যতার ধ্বংসের সোপান হিসাবে দেখছেন। শিক্ষিত কর্মীরা কর্মচ্যুত হওয়ার ভয় পাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে, সৃজনশীল যে কোনও উদ্ভাবন বা সৃষ্টির ভালো ও খারাপ দুই দিকই থাকে। সুফলটা পেতে মানবসভ্যতার কল্যাণকল্পে সকলকে (রাষ্ট্র, জনগণ, বিজ্ঞানী/গবেষক/পেশাদার) একযোগে কাজ করতে হয়। যেমন শিক্ষা, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, কৃষিতে আমরা তার সুফল পাচ্ছি। পাশাপাশি মানবসম্পদের উন্নয়নে জোর দিতে হয়। আসলে, যন্ত্রের উদ্ভাবনে ভয় না পেয়ে তাকে চালনা করার শিক্ষা লাভ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা সর্বাগ্রে জনকল্যাণমুখি হওয়া প্রয়োজনীয়। না হলে আবার সেই জন হেনরি'র গান.... 'আমি মেশিনের হব প্রতিদ্বন্দ্বী....', তারপর অহেতুক শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু।



4 comments:

  1. উত্তম ভট্টাচার্য15 October 2025 at 18:56

    অর্থনীতি তে আলফ্রেড নোবেল র স্মৃতি তে,সুইডেন এর ব্যাংক প্রদত্ত পুরস্কার ২০২৫, বিষয়ে , লেখকের সুন্দর এবং সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন ভালো লাগলো। পুরস্কার প্রাপক গনের বিষয়ে আরো একটু আলোকপাত হলে ভালো হতো। তাঁদের গবেষণার কাজ ও প্রবন্ধ গুলো নিয়ে আরো আলোচনা হলে ভালো হয়। আশা করি ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরো বিশদে লেখা পাবো। যাইহোক, লেখক, সম্পাদক এবং প্রকাশক কে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  2. Capitalism is a spontinously developed order in which technological progress (TP) plays a key role. TP arises out of two basic tendencies of Capital--- concentration and centralisation of capital which leads to capital accumulation. This theory is due to Marx (Capital vol 1).Schumpeter goes deeper in explaining this tendency of Capital and redefines it as creative destruction through innovation.Implication is that,in Schumpeter, Capitalism survives through economic cycles (innovation leading to displacement which makes economic progress cyclical).It is not destroyed even though the misery of the people increases during innovation-led disruption. I should mention that this is what Schumpeter perceived in 1911.In Schumpeter, J.A. (1934) 'The Theory of Economic Development: An Inquiry into Profits, Capital, Credit, Interest, and the Business Cycle', the idea remains more or less the same
    But this is not the end of Schumpeter.In "Capitalism, Socialism and Democracy"(1942), Schumpeter moves further and perceives the ultimate historical outcome of this process as transformation of capitalism into some sort of socialism (bureaucratic socialism /managerial capitalism) where non-market forces play a great role.

    Did Marx perceive sui generis break-down of Capitalist order? As in Schumpeter, the answer here is also no.As Marx perceived, capitalism will face crisis and again survive until and unless a conscious intervention takes place(See Sweezy on break-down controversy). In Schumpeter, the conscious intervention in the process leads to bureaucratic socialism/Managerial Capitalism. In Marx, it leads to revolution by which the spontaniously developed order is replaced with planned utilisation of resources in which TP plays a great role. TP arises here out of innovative spirit which is ingrained in non-alieneted labour (Ref. Economic and Philosophical Manuscript 1844, Marx)
    These Nobel Laureates do not perceive this at the level at which Marx or Schumpeter grasped it. This is why they fail to explain the Chinese miracle in TP.That the free market may often thwart the TP remains beyond their comprehention .

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ দাদা! আপনাদের আশীর্বাদ ও উৎসাহ পেলে আরও একটু পড়াশোনা ও জানার৷ মাধ্যমে লেখারও চেষ্টা করবো,।🙏🙏🙏🙏

    ReplyDelete