কুমার সাহানি আজও প্রাসঙ্গিক
উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়
আগত ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সাজো সাজো রবে'র আবহে আরও একবার মনে পড়ছে কুমার সাহানি'র কথা। গতবারের (৩০তম) চলচ্চিত্র উৎসবে কুমার সাহানিকে নিয়ে একটি বিশেষ আলোচনা সভা হয়েছিল। তার কয়েক মাস আগেই তিনি প্রয়াত (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) হয়েছেন। এবারের উৎসবেও কি তাঁকে নিয়ে কোনও আয়োজন থাকবে? কারণ, তাঁর প্রাসঙ্গিকতা এক বিস্তৃত পরিধি জুড়ে।
বলাই বাহুল্য, তাঁর চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বামপন্থার আলোচনা অনিবার্যভাবে চলে আসে। অতীতে সহজেই বিবিধ মতাদর্শগুলোর মধ্যকার সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল; কিন্তু রাজনীতির জটিলতাগুলো এমন যে এখন অনুধাবন করা যায়, এর মূলে 'ক্ষমতা' অর্জন ও প্রয়োগের ইচ্ছা কাজ করে। 'বাম' আর 'ডান'-- এই পরিভাষাগত পার্থক্যগুলো দার্শনিক মতপার্থক্যের সত্যিকারের প্রতিফলনের চেয়ে রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানের ফসল বলেই মনে হয়। ক্ষমতা কেন্দ্রহীন, রাজহীন হয়েও বিচরণ করে। কর্তৃত্ব না থাকলেও ক্ষমতার গতিশীলতা রাজনৈতিক ভূদৃশ্য গড়ে তোলে। ঠিক এখানেই কুমার সাহানিরা সব সময়েই প্রাসঙ্গিক। কারণ, তিনি তাঁর ছবির মাধ্যমে ক্ষমতার কাঠামো, সামাজিক সম্পর্ক ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর ছবিগুলি ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ এবং ভারতীয় দর্শন, রীতিনীতি ও ঐতিহ্যকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে।
তিনি মনে করতেন, শিল্পকে পণ্যায়ন থেকে মুক্ত রাখতে হবে এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্য তুলে ধরতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর 'মায়া দর্পণ' বা 'তরঙ্গ' ছবি দুটিতে দেখা যায় প্রতীকী এক চিত্রকল্প ও বিমূর্ত আখ্যান, যেখানে তিনি সামাজিক শোষণ ও ক্ষমতার বৈষম্যকে তুলে ধরেন। তাঁর কাজ ব্রেসঁ'র মতো কৃচ্ছ্রতার দ্বারা প্রভাবিত হলেও তিনি ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ এক নতুন আঙ্গিকে তা প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর ছবিতে তাই প্রতিটি ফ্রেম emptiness ও nothingness'এর তফাত বুঝতে চাইত; এ স্বাধীনতা এক বৌদ্ধিক সর্বজনীনতা।
আমরা জানি, মণি কাউল, জন আব্রাহাম, কে কে মহাজন, কুন্দন শাহ্, অজয় করক ও কুমার সাহানি, এনারা সকলেই ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র। প্রথমে জন আব্রাহাম বিদায় নিয়েছিলেন এ ধরাভূমি থেকে আগেই, তারপরে ক্রমান্বয়ে কে কে মহাজন, মণি কাউল ও কুমার সাহানি। হয়তো পরিণত বয়সেই গেলেন, অথচ আশ্চর্য, বিদায়কালে বেছে নিলেন সেই শহরকেই যা তাঁর গুরুর সাধনাস্থল ছিল। ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র কুমার সাহানিদের মতো চলচ্চিত্র নির্মাতারা আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ, তাঁদের কাজ মানুষের জীবন, সমাজ ও রাজনীতির জটিলতাকে অন্বেষণ করে। বাস্তবতা ও কল্পনাকে মিশিয়ে তিনি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন। তিনি চলচ্চিত্রে এক অনন্য শৈলী উপহার দিয়েছেন, যদিও চলচ্চিত্র সমালোচকদের দ্বারা তিনি একইসঙ্গে প্রশংসিত ও সমালোচিতও।
নয়াদিল্লি'র ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা (এনএসডি) থেকে সদ্য বেরিয়ে মিতা বশিষ্ট কুমার সাহানি পরিচালিত একটি নাটকে মেক-আপ শিল্পী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এর পরপরই মিতা ১৯৮৭ সালে সাহানি'র স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'ভার ভার ভারি'তে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত হন। কুমার শাহানির অধীনে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করা ছিল মিতা বশিষ্ঠ'এর কাছে সিরিয়াস ছবির পবিত্র প্রবেশদ্বারে প্রবেশের মতো।
'কুমারের সঙ্গে দেখা করার পর আমি তাৎক্ষণিক ও সহজাত ভাবে বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি একজন অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বুদ্ধিধারী ব্যক্তি এবং তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের অর্থ হল আপনি আপনার আত্মা, মন, শরীর ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে গভীরভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন।' 'ফ্রন্টলাইন'এর সাংবাদিক শেখ আয়াজ'কে মিতা এ কথা বলেন। এর আগে মিতা কুমার সাহানি সম্পর্কে বা তাঁর বহুল প্রশংসিত 'আর্টহাউস চলচ্চিত্র' সম্পর্কে কিছু শোনেননি। এই স্মৃতিগুলো প্রায় তিন দশক পুরনো, কিন্তু মিতা বশিষ্ঠ যিনি আজ ৫৭ বছর বয়সী, এগুলিকে এমনভাবে ধরে রেখেছেন যেন গতকালের কথা। মিতা বশিষ্ঠ 'খেয়াল গাথা' (১৯৮৯) ও 'কসবা' (১৯৯১) ছবিতে কুমার সাহানি'র সঙ্গে প্রথম অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করেন এবং জীবনের শেষ অবধি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কুমার সাহানি, শ্যাম বেনেগাল ও সমান্তরাল ছবির পরিচালকদের থেকেও আলাদা ছিলেন। অদ্ভুতভাবে, তাঁর কাজ যতটা শ্রদ্ধার ততটাই দুর্বোধ্য ও অস্পষ্ট।
এফটিআইআই'এর সহকর্মী এবং কাল্ট ক্লাসিক ছবির চর্চা করা ব্যক্তি ও পরিচালক কমল স্বরূপ যিনি মণি কাউল ও সাহানি উভয়কেই জানতেন এবং তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন, কুমার সাহানি সম্পর্কে বলেন, 'তিনি একজন সুপণ্ডিত ব্যক্তি ও অসাধারণ নন্দনতত্ত্ববিদ ছিলেন, যিনি ডিডি কোসাম্বি (বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও গণিতবিদ), রবার্ট ব্রেসঁ এবং সের্গেই আইজেনস্টাইনের মতো উগ্র চিন্তাবিদদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।' ফ্রান্সে রোবের ব্রেসঁ-র অধীনে প্রশিক্ষণের শেষে ফিরে আসার পর সাহানি ১৯৬৮ সালের মে মাসে ফরাসি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের একজন প্রচারক হয়ে ওঠেন এবং প্রায়শই জঁ-পল সাঁর্ত্রের মতো অস্তিত্ববাদীদের সম্পর্কে আলোচনা করতেন।
যদিও সাহানি পাশ্চাত্য দর্শনে পারদর্শী ছিলেন, তবুও তিনি মনেপ্রাণে ভারতীয় নন্দনতত্ত্বের একজন গুণী সমর্থকও ছিলেন। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ 'খেয়াল গাথা' (১৯৮৯) ও 'ভবন্তরণ' (১৯৯১) ছবিতে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, যা ছিল ওড়িশি নৃত্যশিল্পী গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের প্রতি এক শ্রদ্ধাঞ্জলী। একই সঙ্গে তিনি পাহাড়ি ক্ষুদ্রাকৃতি চিত্রকলার একজন ভক্ত ছিলেন, যা 'কসবা' (১৯৯১) ছবিতে তাঁর ফ্রেমগুলিকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর বেশিরভাগ চলচ্চিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আন্তন চেখভ ও নির্মল ভার্মার সাহিত্যের মহান রচনার উপর ভিত্তি করে তৈরি।
কুমার সাহানি অন্যান্য বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মতো ভারতীয় লেখালেখি এবং পুরাণে পাওয়া বস্তুবাদকে প্রত্যাখ্যান করেননি। ১৯৭২ সালে হিন্দি লেখক নির্মল ভার্মার গল্পের উপর ভিত্তি করে তাঁর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'মায়া দর্পণ' পরিচালনা করেন, যা মণি কাউলের 'উস্কি রোটি' বানানোর তিন বছর পর মুক্তি পায়। এক সাক্ষাৎকারে পরিচালককে 'মায়া দর্পণ'এর মূল্যায়ন করতে বলা হলে উত্তরে তিনি কিছুটা রসিকতা করে বলেন, 'জানি, এটি এমন একটি চলচ্চিত্র যা প্রথমবার দেখার পর কেউ পছন্দ করেনি।' ১৯৭২ সালে সেরা পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী 'মায়া দর্পণ' ঠিক এমনই এক রহস্যময় ছবি। এটি একজন জমিদারের যুবতী কন্যার প্রতিকৃতি, যখন সে তার অভ্যন্তরীণ জগতের অনুসন্ধান করে এবং শূন্যতার দিকে মননশীলভাবে তাকিয়ে থাকে, মাঝে মাঝে তার দম বন্ধ আকাঙ্ক্ষার দিকে আমাদের ক্ষণিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সুযোগ দেয়। গল্প বলার মধ্যে একটি জাদুকরী চেতনার ধারা রয়েছে, যা 'তোমাকে ছাড়া কখনও দেখা যেত না তা দৃশ্যমান করে তোলে' - ব্রেসঁনিয়ান সত্যবাদকে জাগিয়ে তোলে।
যদিও সবাই সাহানির প্রতিভা ও সাহসিকতার প্রশংসা করেননি। সত্যজিৎ রায় ছিলেন তাঁর অন্যতম তীব্র সমালোচক। 'চলচ্চিত্রের ভাষা বিলুপ্তির হুমকি' দেওয়ার অভিযোগে তিনি সাহানি'কে অভিযুক্ত করেছিলেন। অবশ্য কমল স্বরূপ পাল্টা বলেন, 'রায় নাটকীয় আখ্যানের শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। সম্ভবত, তিনি আশা করেছিলেন যে অন্যরাও একইরকম সাবলীল থাকবে। এবং আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ১৯৭০-এর দশকে মণি ও কুমার সবে মাত্র শুরু করেছিলেন এবং তাদের বাগধারা সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হতে তখনও কয়েক বছর দূরে ছিলেন।'
অভিনেতাদের উপর সাহানির মানসিক প্রভাব ব্রেসঁনিয়ানদের কঠোর পরিশ্রমের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, তিনি মিতা বশিষ্ঠকে 'কসবা'তে তেজো চরিত্রটি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলেননি। তিনি কেবল বলেছিলেন (মিতা বশিষ্ঠ'এর ভাষায়), 'আমার তোমাকে তার জন্য হাঁটার জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। তাই, আমি দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ট্রেন ধরে প্রতিদিন সকাল ১০টায় ওনার ফ্ল্যাটে পৌঁছতাম যেখানে দু' ঘন্টা ধরে আমি তাঁর ড্রয়িংরুমে এদিক-ওদিক হেঁটে যেতাম এবং আমরা হাঁটার চেষ্টা করতাম। কুমার বলতেন, তুমি যদি 'কসবা দেখে থাক তাহলে দেখতে পাবে তেজোর একটি রহস্যময় হাঁটা আছে। এবং সে যত বেশি নিস্তেজ হয়ে ওঠে, তাকে তত বেশি বিপজ্জনক দেখায়।'
বম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা করে সাহানি গিয়েছিলেন পুনা FTII-এ ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাণের শিক্ষাগ্রহণ করতে। স্নাতক স্তরে পড়েছিলেন ইতিহাস। চর্চা বজায় রেখেছিলেন আজীবন ইতিহাসবিদ ডি ডি কোসাম্বির সান্নিধ্যে। ফ্রান্সে শিক্ষাকেন্দ্রেরই ছাত্র ছিলেন আলাঁ রেণেঁ, ওলকার স্লোনড্রফ, থিও আঞ্জেলোপুলোস, কস্টা গাভ্রাস প্রমুখ। ঠিক এই সময়ে তিনি রোবের ব্রেসঁ-র সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন আঁ ফিউম্ ডশ্ (Un Femme Douce) ছবিতে।
জীবনের অনেকটা সময়ই কেটেছে কলকাতা শহরে। প্রয়াণও এই কলকাতাতেই। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উগ্র এবং মৌলিক মনের মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতেও সমান প্রাসঙ্গিক।
No comments:
Post a Comment