Friday, 10 October 2025

প্রলয়ের নন্দন: লাসলো ক্রাসনাহর্কাই

'তবু আমরা গল্প বলব'

শাহেদ শুভো



২০২৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লাসলো ক্রাসনাহর্কাই (László Krasznahorkai)-এর নাম উচ্চারণ করলেই মনে হয়, সময় যেন থেমে যায়। তাঁর লেখায় পৃথিবীটা যেন এক ধ্বংসপ্রায় সভ্যতার ধূসর মরুভূমি— যেখানে মানুষ, সময় ও ঈশ্বর, সব কিছুই অস্পষ্ট হয়ে মিশে যায়। এই লেখকের ভাষা যেমন ধীর, তেমনই গভীর; তাঁর বাক্য এক অনন্ত যাত্রা, যার শেষ নেই, শুধু প্রবাহ। আর সেই প্রবাহই পর্দায় জীবন্ত হয়ে ওঠে বেলা তার (Béla Tarr)-এর ক্যামেরায়।

বেলা তার ও লাসলো ক্রাসনাহর্কাই— এই দুই শিল্পী যেন একে অপরের আয়না। একজন শব্দ দিয়ে যে জগৎ সৃষ্টি করেন, অন্যজন ক্যামেরার নীরবতায় সেটিকে দৃশ্যরূপ দেন। তাঁদের কাজ শুধু শিল্প নয়, মানব সভ্যতার অস্তিত্ব নিয়ে এক গভীর দর্শনচর্চা। 

বেলা তার

নোবেল কমিটি ক্রাসনাহর্কাইকে পুরস্কার দেওয়ার সময় ঘোষণায় বলে: 'For his compelling and visionary oeuvre that, in the midst of apocalyptic terror, reaffirms the power of art.'। অর্থাৎ, প্রলয়ের ভেতর থেকেও তিনি শিল্পের শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এই ‘apocalyptic terror’ (প্রলয়ের ভয়) ক্রাসনাহর্কাই'এর সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে, যেমন Sátántangó (The Melancholy of Resistance)'এ দেখা যায়, এক ভগ্ন সমাজ ও নিঃশেষ সময়, যেখানে মানুষ বাঁচে কিন্তু জানে না কেন!

তিনি লেখেন এমন এক পৃথিবীর কথা যেখানে বিশ্বাসের আলো নিভে গেছে, কিন্তু লেখক তবু জিজ্ঞাসা করেন, 'আর কিছুই যদি অবশিষ্ট না থাকে, তবে শিল্পের প্রয়োজন কি নেই?' এই প্রশ্নই তাঁকে আধুনিক সময়ের সবচেয়ে নৈরাজ্য-সচেতন অথচ গভীর এক মানবিক লেখকে পরিণত করেছে। তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, তাঁর দীর্ঘ ও অবিরাম বাক্যপ্রবাহ। অনেক সময় একটি বাক্য কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে চলতে থাকে, যেন শ্বাসরোধকারী এক নদী, যেখানে পাঠককে সাঁতরে যেতে হয় ধীরে ধীরে। এ শুধু ভাষার অলংকার নয়, বরং এক ধরনের দর্শন। তাঁর লেখায় সময় ধীর, যেমন মানুষের মন ধীর হয় হতাশার মধ্যে; তাঁর গদ্যে বিরতি নেই, কারণ জীবনের প্রলয়ে বিরতির সুযোগও নেই।

এখানেই বেলা তার'এর ছবির সঙ্গে তাঁর মিল। বেলা তার'এর ক্যামেরাও ঠিক তেমনই ধীর, অনন্ত; একটি দৃশ্য কখনও দশ মিনিট ধরে চলে, কিন্তু তবুও তার ভেতরে এক অসীম তীব্রতা লুকিয়ে থাকে। হাঙ্গেরির এই দুই শিল্পীর সহযাত্রা ইউরোপীয় আধুনিক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা।

ক্রাসনাহর্কাই'এর উপন্যাস Sátántangó (১৯৮৫) থেকেই শুরু হয় তাঁদের যৌথ যাত্রা। বেলা তার ১৯৯৪ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে সাত ঘণ্টার এক মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন: Sátántangó।


এই ছবিটি শুধু ধৈর্যের পরীক্ষা নয়; সময় ও স্থবিরতার দর্শন। গ্রামের মানুষের জীবনের অবক্ষয়, এক ভণ্ড ত্রাণকর্তার প্রতারণা এবং মানুষের অবিশ্বাস— সব মিলিয়ে ছবিটি এক ধর্মহীন পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। ক্যামেরা ধীরে হাঁটে, বৃষ্টি পড়ে, গরু হেঁটে যায়, সব কিছু এক প্রলয়োত্তর স্থবিরতায় ডুবে থাকে।

এরপর আমরা  পাই Werckmeister Harmonies (২০০০), যেখানে এক নৈরাজ্যময় শহর ও এক অজানা তিমির আগমন মানুষের মনোজগতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। বেলা তার ও ক্রাসনাহর্কাই এখানে একযোগে প্রশ্ন করেন, 'মানুষের সভ্যতা কি কখনও সুরে বাঁধা পড়েছিল?'

শেষে The Turin Horse (২০১১) হল তাঁদের দর্শনের পরিণতি— এক পিতা, এক কন্যা, একটি ঘোড়া ও এক শুষ্ক পৃথিবী। এ যেন ঈশ্বরের পরিত্যক্ত সময়ের গল্প, যেখানে জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাসই মৃত্যুর অনুশীলন। 

ক্রাসনাহর্কাই ও বেলা তার— উভয়ের কাজেই আছে এক অস্তিত্ববাদী সুর। তাঁদের পৃথিবী কালো-সাদা, কিন্তু তার ভেতর আলো আছে, সেই আলো মানুষ নয়, বরং অস্তিত্বের অনিবার্যতা। তাঁরা বলেন, মানুষ যতই সভ্যতা নির্মাণ করুক না কেন, তার ভেতরের একাকীত্ব থেকে পালাতে পারে না। বেলা তার একবার বলেছিলেন, 'My films are about the end— the end of stories, the end of people, the end of time.'। এই উক্তিটি যেন ক্রাসনাহর্কাই'এর সাহিত্যকেই প্রতিফলিত করে। দুজনেই বিশ্বাস করেন, শেষের মধ্যেই এক নতুন শুরু লুকিয়ে থাকে; মৃত্যু আসলে ধীর এক পুনর্জন্ম।

বেলা তার-এর ছবি ও ক্রাসনাহর্কাইয়ের সাহিত্য রাজনৈতিক নয়, কিন্তু গভীরভাবে রাজনীতির পরবর্তী এক সময়। তাঁদের জগতে রাষ্ট্র নেই, আদর্শ নেই, আছে কেবল মানুষ, যে নিজের ক্ষয় দেখতে দেখতে বেঁচে থাকে। হাঙ্গেরির সমাজতন্ত্র-উত্তর বিভ্রান্ত সময়, ইউরোপীয় মূল্যবোধের ভাঙন এবং আত্মপরিচয়ের সংকট— এ সবই তাঁদের শিল্পে প্রবাহিত। তাঁরা চিৎকার করেন না; নীরব থাকেন।  নীরবতাই তাঁদের প্রতিবাদ। তাই, লাসলো ক্রাসনাহর্কাই'এর নোবেল জয় শুধু সাহিত্য নয়, বরং চলচ্চিত্র ও দর্শনের জগতেও এক পুনর্মূল্যায়ন। তা প্রমাণ করে, আজকের শব্দ ও ছবির যুগে ধীরতা, নীরবতা ও চিন্তাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে।

বেলা তার চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ করেছেন, কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকার এখন ক্রাসনাহর্কাই'এর লেখার ভেতর বেঁচে আছে। তাঁদের শিল্পে আমরা দেখি এক অচল পৃথিবী, কিন্তু সেই স্থবিরতার মধ্যেও এক অনন্ত গতি, যেখানে সময় ধীরে বয়ে যায়, কিন্তু থেমে থাকে না। তাঁরা আমাদের শেখান, শিল্প মানে শুধু সৌন্দর্য নয়; শিল্প মানে অবক্ষয়ের সৌন্দর্য, নৈরাশ্যের নন্দন, প্রলয়ের ভেতর অর্থের অনুসন্ধান। তাঁদের কাজ আমাদের বলে, 'যদি সবকিছু শেষও হয়ে যায়, তবু আমরা গল্প বলব।' এই গল্পই মানবতার শেষ আশ্রয় এবং শিল্পই তার একমাত্র ভাষা।

ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের শৈশবে সিনেমাকে 'বই' বলত, কারণ বাংলা সিনেমা ছিল উপন্যাস নির্ভর!  বেলা তার'কে আবিষ্কারের পর বুঝেছিলাম 'বই' বিষয়টা কী! যেন প্রতিটি দৃশ্যকল্প উপন্যাসের চরণ!!


5 comments:

  1. অনবদ্য মর্মকথা। চলমান ধ্বংসের নৈরাজ্যের ছবি।

    ReplyDelete
  2. দারুন লেখা!!

    ReplyDelete
  3. চমৎকার লিখেছেন। ঋদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  4. ইতিবাচক লেখা জরুরী। নেতিবাচক চিন্তা নয়।

    ReplyDelete
  5. উত্তম ভট্টাচার্য15 October 2025 at 19:52

    খুব ই সুন্দর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এবারের (২০২৫) ,সাহিত্যে "নোবেল" পুরস্কার প্রাপকের বিষয়ে ,এই হাঙ্গেরির সাহিত্যিকের সাহিত্য বিষয়ে, লেখকের আলোচনা বেশ ভালো লাগলো।আমাদের বাঙালি পাঠক কুলের জন্য, খুব ই চমৎকার এক প্রাথমিক মুখবন্ধ হিসাবে, অবশ্যই পরিগন্য হবে। লেখকের অন্যান্য আরো বই পড়তে উৎসাহিত করবে । বাংলা সাহিত্যে র ধারা নিশ্চয়ই সে সব সাহিত্য কর্ময়পাঠ হতে হতে সমৃদ্ধ হবে। একক মাত্রার সম্পাদক, প্রকাশক এবং বর্তমান লেখক কে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।

    ReplyDelete