এক অন্তহীন রঙের মহাকাব্য
অয়ন মুখোপাধ্যায়
দুর্গা কেবল এক পৌরাণিক দেবী নন, তিনি আসলে এক বর্ণময় প্রতীক। তাঁর প্রতিমায়, শাড়িতে, চোখের ভেতর, বিসর্জনের জলে— সর্বত্রই রঙ কথা বলে। দুর্গাপুজো তাই কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এক বিশাল রঙের দর্শন। প্রতিটি রঙের ভেতরে লুকিয়ে থাকে মানুষের অবচেতন, সমাজের ইতিহাস, শিল্পের নন্দনতত্ত্ব আর দার্শনিক প্রতিফলন।
লাল দিয়ে শুরু করা যাক। দেবীর শাড়ি, সিঁদুর, বিসর্জনের সিঁদুরখেলা— সবখানেই লাল। লাল মানে রক্ত, আগুন, শক্তি। মনোবিজ্ঞানে লাল এক দ্ব্যর্থক প্রতীক— একদিকে কামনার উত্তাপ, অন্যদিকে হিংসা আর ভয়। ফ্রয়েডের চোখে এই লাল আমাদের দমিত আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। সিঁদুরখেলায় মহিলারা যখন একে অপরকে লালে ঢেকে দেন, তখন অবচেতনের কামনা সামাজিক রূপ নেয়। আবার দেবীর হাতে লাল ত্রিশূল মানে ধ্বংসের আগুন। যুদ্ধ আর প্রেমের এক অদ্ভুত মিশ্রণ লালের ভেতরে। জুং বলতেন, লাল হল archetypal রঙ— শক্তি, জীবনশক্তি, প্রজননশক্তির প্রতীক। মহিষাসুরের রক্ত লালে ভেসে ওঠে এই archetype-এর ছাপ।
সাদা দেবীর আরেক মুখ। তাঁর চোখের সাদা, শঙ্খের সাদা, প্রসাদের খিচুড়ির সাদা— সবই শান্তির প্রতীক। কিন্তু সাদা মানেই আবার শূন্যতা। বিসর্জনের পরে নদীতে ভেসে থাকা সাদা বুদবুদ যেন সেই অনুপস্থিতির প্রতীক, যা আমাদের তাড়া করে। লাকাঁ বলতেন, দেবী আসলে সেই অনুপস্থিতির রূপ, যিনি থাকেন আবার থাকেন না। ফ্রয়েডের ভাষায়, সাদা মৃত্যুরও প্রতীক— অবচেতনের গভীর ভয়। অথচ দুর্গার সাদা শান্তির ভেতরে সেই ভয়কেও আশ্রয় দেওয়া হয়।
হলুদ মানে আলো। প্রদীপের শিখা, গাঁদা ফুল, ধূপের ধোঁয়া— সবকিছুতেই হলুদ উজ্জ্বলতা। মনোবিজ্ঞানে হলুদ আনন্দের প্রতীক, আবার কখনও অস্থিরতারও। জুং বলতেন, হলুদ সূর্যের প্রতীক, যা আলো দেয়, আবার জ্বালায়ও। দুর্গার হলুদ মানে সেই দ্ব্যর্থক আলো। কৃষির সঙ্গেও হলুদ যুক্ত। শরৎকালে ফসল পাকে, মাঠে ধানের শীষ হলুদ হয়ে ওঠে। দেবীর আগমন তাই কৃষিজীবনের উৎসবেরও প্রতীক।
সবুজ মানে প্রকৃতি আর পুনর্জন্ম। কাশবন, কলাপাতা, প্যান্ডেলের সাজ— সবুজের উপস্থিতি। সবুজ মানে নবজীবন, শরতের পুনর্জন্ম। ফ্রয়েড বলবেন, সবুজ হল দমিত জীবনশক্তির বহিঃপ্রকাশ। জুং বলবেন, সবুজ এক archetypal রঙ, পুনর্জন্মের প্রতীক। কিন্তু সবুজ কেবল প্রকৃতির নয়, রাজনীতিরও রঙ। পতাকা, কৃষক আন্দোলন, ধর্মীয় প্রতীকের সঙ্গেও সবুজ জড়িত। দুর্গার সবুজ তাই প্রকৃতি ও রাজনীতির দ্বৈত প্রতীক।
নীল রঙ দুর্গার আরেক রহস্য। আকাশের নীল, নদীর নীল, প্রতিমার চোখের নীল আভা। নীল মানে অসীমতা, শান্তি, গভীরতা। কিন্তু নীল মানেই আবার বিষাদ। বিসর্জনের সময় প্রতিমার প্রতিফলন যখন নদীর নীল জলে ভেসে ওঠে, তখন আনন্দের সঙ্গে বিষাদও এসে মেশে। লাকাঁ বলবেন, নীল হল সেই অনন্ত শূন্যতা, যা আমাদের অস্তিত্বের অংশ। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, 'নীল নির্জনে ঝরে পড়ে বকুল ফুল।' দেবীর নীল চোখ যেন সেই নির্জনেরই প্রতিচ্ছবি।
কালো হল অন্ধকারের প্রতীক। দেবীর ভ্রূকুটি, রাতের ছায়া, মহিষাসুরের দেহ— সবই কালো। কালো মানে মৃত্যু, ভয়, আবার একইসঙ্গে সম্ভাবনারও প্রতীক। ফ্রয়েড বলবেন, কালো আমাদের অবচেতন ভয়। জুং বলবেন, কালো shadow archetype— আমাদের ভেতরের অন্ধকার। মহিষাসুর সেই shadow, যাকে দেবী দমন করেন। কিন্তু কালো শুধু ভয়ের নয়, সৃজনশীলতারও প্রতীক, কারণ, অন্ধকার থেকেই আলো জন্ম নেয়।
অতএব, দুর্গা এক বহুরঙা দেবী। লাল তাঁর কামনা আর শক্তি, সাদা তাঁর শান্তি আর শূন্যতা, হলুদ তাঁর আলো আর অস্থিরতা, সবুজ তাঁর প্রকৃতি আর রাজনীতি, নীল তাঁর গভীরতা আর বিষাদ, কালো তাঁর ভয় আর সম্ভাবনা। প্রতিটি রঙ তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত, প্রতিটি রঙ আমাদের মনের গভীরে প্রতিধ্বনিত। ফ্রয়েড'এর চোখে এই রঙগুলো আমাদের দমিত প্রবৃত্তি আর আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। জুং বলবেন, এগুলো archetype— চিরন্তন প্রতীক, যা সমষ্টিগত অবচেতনে গেঁথে আছে। লাকাঁ বলবেন, দেবীর রঙ আসলে সেই অনুপস্থিতির খেলা, যা আমাদের পূর্ণ করে আবার শূন্যতায় ফেলে।
বাংলা সাহিত্যেও দেবীর রঙ বারবার ফিরে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় লাল মানে প্রেম, সাদা মানে মৃত্যু। জীবনানন্দের কবিতায় নীল মানে melancholy। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় লাল মানে উন্মাদনা, কালো মানে ভয়। শিল্পকলায়ও রঙের খেলা স্পষ্ট— পটচিত্রে লাল, জমিদারবাড়ির প্রতিমায় সাদা, আধুনিক থিম প্যান্ডেলে নীল আলো। প্রতিবারই রঙ আমাদের নতুন মানসিক অভিজ্ঞতা দেয়।
শেষ পর্যন্ত দুর্গাপুজো মানে এক রঙের নাট্যমঞ্চ। নদীর জলে প্রতিমার প্রতিফলন, লাল সিঁদুরের আগুন, সাদা শঙ্খের শূন্যতা, হলুদ প্রদীপের আলো, সবুজ কাশবন, নীল আকাশ, কালো অন্ধকার— সব মিলে দেবী আমাদের ভেতরের আলো-ছায়া দেখান। তিনি কেবল দেবী নন, তিনি আমাদের রঙ-মনোবিশ্লেষণের আয়না। আমরা তাঁকে পূজা করি, আসলে নিজেদের ভেতরের রঙ খুঁজতে।
যেন এক কাব্যিক সমাপ্তি...
হয়তো কোনও বিসর্জনের রাত, নদীর জলে প্রতিমার প্রতিফলন ভেসে যাচ্ছে। লাল আলো ছড়াচ্ছে ঢাকের শব্দে, সাদা ফেনায় ভাঙছে চাঁদের ছায়া, হলুদ প্রদীপ নিভে আসছে, সবুজ পাতা দুলছে বাতাসে, নীল জলে ডুবে যাচ্ছে চোখের দৃষ্টি, কালো অন্ধকার গিলে ফেলছে সবকিছু। কিন্তু ওই ভেতরেই দেবী রয়েছেন। রঙে রঙে, আলোতে আর ছায়ায়, কামনা আর শূন্যতায়, মৃত্যু আর জন্মের অদৃশ্য যাত্রায়। তিনি আসলে এক অনন্ত রঙ, যিনি আমাদের ভেতরেই আঁকা।
আমরা তাঁকে পূজা করি আসলে নিজেদের ভেতরের রঙকে চিনতে, নিজেদের অন্ধকারে আলো খুঁজতে। দুর্গা তখন হয়ে ওঠেন এক অন্তহীন রঙের মহাকাব্য, যেখানে প্রতিটি মানুষের চোখে প্রতিফলিত হয় লাল, সাদা, হলুদ, সবুজ, নীল, কালো। আর সেইসব মিলিয়ে তৈরি হয় এক অদৃশ্য দেবী, যিনি নদীর জলে ভেসে যান, আবার আমাদের হৃদয়ে থেকে যান চিরকাল।
খুব ভাল লেখা। এ ভাবেই চর্চায় থাকাটা বাঞ্ছনীয়। রঙের ব্যাখ্যা সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানের কথা থাকলেও একমাত্র নীলের জন্য জীবনানন্দের প্রসঙ্গ…
ReplyDeleteযাই হোক, ভাল লাগল।
ভালো লাগলো লেখাটি।
ReplyDeleteদারুণ লেখাটা হয়েছে
ReplyDeleteসুন্দর লেখা
ReplyDelete