খেলার মাঠে কি মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটক?
অয়ন মুখোপাধ্যায়
'Cricket is a gentleman’s game'— এক সময় এভাবেই ক্রিকেটকে দেখা হত। ভদ্রতা, সৌজন্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরও মানবিকতা— এগুলোই ছিল খেলার মর্ম। অথচ সাম্প্রতিক ভারত-পাক ম্যাচ শেষে ভারতীয় ক্রিকেটাররা যখন পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাতে অস্বীকার করলেন, তখন সেই ঐতিহ্যকে যেন ছিঁড়ে ফেলা হল। শিষ্টাচারের সম্মান লুটিয়ে পড়ল।
অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব ও তাঁর দলের এই আচরণ নিছক আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়। এটা বড় এক প্রবণতার চিহ্ন। সাংবাদিক বৈঠকে তিনি পহেলগাঁও'এর প্রসঙ্গ টেনে নিজের অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তা আসলে আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নয়। খেলার মাঠে খেলোয়াড়ি মনোভাবকে মেরে দেশপ্রেমের বকলমে অভিনীত হল এক নাটক।
ভারত-পাক ম্যাচ বহুদিন ধরেই 'হাই-ভোল্টেজ' মহারণ বলে প্রচার পায়। মিডিয়া থেকে বোর্ড কর্তা— সবাই মিলে এটাকে যুদ্ধের মতো করে তুলেছে। দর্শকের উত্তেজনা বাড়ে, বিজ্ঞাপনে টাকার স্রোত বয়, সম্প্রচার সংস্থার আয় ফুলে ওঠে। ক্রিকেট আজ আর নিছক খেলা নয়, হয়ে উঠেছে বড় কর্পোরেট ব্যবসার ভেতরের খেলা।
সবচেয়ে বড় হাস্যকর ব্যাপার হল এই দ্বিচারিতা। একদিকে মাঠে খেলোয়াড়দের বলা হচ্ছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মেলানো দেশদ্রোহ, অন্যদিকে একই বোর্ড আবার পাকিস্তানি ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ নিয়ে আলোচনায় বসছে, কারণ তাতে আসে বিপুল আর্থিক লাভ। এমনকি যারা মিডিয়ায় যুদ্ধোন্মাদ ভাষণ দেন, তারাই আবার পর্দার আড়ালে সম্প্রচার অধিকারের ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনায় বসেন। প্রকাশ্যে শত্রুতা, আড়ালে ব্যবসায়িক সহযোগিতা— এই দ্বিচারিতার মধ্যেই আসল সত্য লুকিয়ে আছে। দেশপ্রেমের নামে দর্শককে আবেগে ভাসানো হয়, অথচ টাকার স্বার্থেই চালু থাকে সম্পর্কের দরকষাকষি। এটাই হল দেশপ্রেম Incorporated— একটা ব্র্যান্ড, এক ধরনের পণ্য।
ইতিহাসও বলে দেয়, ক্রিকেট শত্রুতা নয়, বরং সম্প্রীতির সেতু। যে ইংরেজ আমাদের ২০০ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছিল, জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো নৃশংস হত্যাকাণ্ড সহ দেশকে লুটপাট করে ছিন্নভিন্ন করেছিল, স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই দেশের সঙ্গেই ভারত কিন্তু নিজ দেশের মাটিতেই ১৯৫১-৫২ সালে টেস্ট ক্রিকেট সিরিজ খেলেছিল। রাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও ক্রিকেট বহুবার প্রমাণ করেছে, সম্পর্কের নতুন আবহাওয়া তৈরি করার ক্ষমতা তার আছে। উপরন্তু, এ কথাও সত্য, যে কোনও একটি দেশের শাসক ভয়ঙ্কর ও স্বৈরাচারী হতে পারে, তার অর্থ কখনই সে দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষও খারাপ, এমনটা কখনই নয়। তা যেমন আমাদের দেশের ক্ষেত্রে খাটে, তেমনই পৃথিবীর প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আসলে, ক্রিকেটের ইতিহাস আমাদের অন্য শিক্ষা দিয়েছে। কপিল দেব যখন ১৯৮৩-তে বিশ্বকাপ জিতলেন, তাঁর প্রথম ছবি ছিল প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো। সৌরভ গাঙ্গুলির লর্ডস'এর বারান্দায় জার্সি ওড়ানো নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু প্রতিপক্ষের সঙ্গে সৌহার্দ্য তাতে বাদ যায়নি। শচীন টেন্ডুলকার যখন সিডনিতে শতরান করলেন, তখন অস্ট্রেলিয়ার দর্শকরা দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এটাই ক্রিকেট— দেশভেদ ভুলে প্রতিপক্ষের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া।
ডন ব্র্যাডম্যান একবার বলেছিলেন, ক্রিকেট তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই ছিল এবং মৃত্যুর বহু বছর পরেও থাকবে। তিনি নিজেকে শুধু একজন খেলোয়াড় নয়, বরং ব্যাখ্যাকার মনে করতেন, যেমন, একজন পিয়ানিস্ট বেঠোফেনকে বাজিয়ে নতুন ব্যাখ্যা দেন। ক্রিকেটকে তিনি প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখেননি, দেখেছিলেন এক ধরনের শিল্প আর নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে। ক্রিকেটের মূলে আছে সৌজন্য, মর্যাদা ও মানবিকতা। কিন্তু আজকের ভারতীয় ক্রিকেট সেই ঐতিহ্য থেকে সরে গেছে। ফলে, খেলার মাঠে এখন খেলা নয়, মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটক। দর্শকের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘৃণা, তরুণ প্রজন্ম শিখছে প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবতে। এর প্রভাব শুধু খেলায় নয়, সমাজে পড়ছে— হিংস্র মানসিকতা বাড়ছে, ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হচ্ছে। ক্রিকেট, যা ছিল সেতুবন্ধনের খেলা, আজ ছদ্ম দেশপ্রেমের হাতুড়িতে সেই সেতুই ভেঙে যাচ্ছে।
ক্রিকেট সমালোচক নেভিল কারডাস লিখেছিলেন, ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, এক ধরনের নৈতিক শিক্ষা। সেই শিক্ষা আজ বিসর্জিত হয়েছে। ব্র্যাডম্যানও শেষ জীবনে সতর্ক করেছিলেন, দুঃখজনক কিছু ঘটনা সত্ত্বেও ক্রিকেট টিকে থাকবে এবং সবচেয়ে মহান খেলা হিসেবেই থাকবে। কিন্তু সেই 'দুঃখজনক ঘটনা'র তালিকায় আজ যোগ হল ভারতীয় ক্রিকেটারদের এই অকাঙ্ক্ষিত আচরণ। অথচ, ইতিহাসের পাঠ স্পষ্ট— ক্রিকেট শুধু ব্যাট-বলের খেলা নয়, সৌজন্যের প্রতীক। জয় মানে প্রতিপক্ষকে হেয় করা নয়, জয় মানে মানবতার জয়। ভারত যদি এই শিক্ষা ভুলে যায়, তবে ক্রিকেট আর gentleman’s game থাকবে না, হয়ে উঠবে কর্পোরেট যুদ্ধের বাজারি নাটক।
ভারত ম্যাচ জিতেছে, কিন্তু হেরেছে শিষ্টাচার। ক্রিকেটের গৌরব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দেশপ্রেম বিক্রি হয়ে গেছে শেয়ার বাজারের মতো। দেশপ্রেম কোনও ব্র্যান্ড নয়, কোনও ইনকর্পোরেটেড প্রোডাক্ট নয়। দেশপ্রেম হল হৃদয়ের গভীর মানবিকতা। যেদিন ক্রিকেট আবার সেই শিক্ষা মনে রাখবে, সেদিনই মাঠে ফিরবে খেলাধূলার আসল আত্মা।
No comments:
Post a Comment