Saturday, 27 September 2025

সকলেই উদ্বাস্তু হব!

প্রকৃতি এবার বদলা নেবে

সুব্রত কুণ্ডু



সুন্দরবন। মৌসুনি দ্বীপ। ২০০৯-এর আয়লা ঘূর্ণিঝড়ের পরেও এই দ্বীপের একটি অংশে বাস করতেন কিছু হত দরিদ্র পরিবার। কিন্তু ২০২১-এ গিয়ে তাঁদের কোনও হদিস পাননি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তাঁদের বক্তব্য, নিরন্তর ছোট, বড় নানা ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে ভিটে-মাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে পরিবারগুলি। ঘন ঘন এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণ জলবায়ু বদল। 

কাজের জন্য সারা সুন্দরবনেই ঘুরেছি। দেখেছি, ভিটে-মাটিহারা মানুষের হাহাকার। কান্না। মন ভারী হয়েছে বারবার। সারা পৃথিবীতে চরম আবহাওয়ায় উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে। বেড়েই চলেছে।

কিরিবাস দ্বীপ রাষ্ট্র। মোট ৩৩টা দ্বীপ নিয়ে এই রাষ্ট্র। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই ও অস্ট্রেলিয়ার প্রায় মাঝামাঝি, বিষুবরেখা এবং আন্তর্জাতিক তারিখ রেখার (বা ডেট লাইনের) ওপর অবস্থিত। বর্তমানে রাষ্ট্রটির কুড়িটি দ্বীপে মানুষের বসবাস। ২০২০ সালের গণনা অনুযায়ী জনসংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার। কার্বন নির্গমন সব থেকে কম। খুবই দরিদ্র দেশ। দেশটির মানুষ এখন ভয়ঙ্কর সংকটের সম্মুখীন। কারণ, জলবায়ু বদল। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি দ্বীপের কিছু অংশ ডুবে গেছে। বাকিটা ডুবে যাওয়ার অপেক্ষায়। সম্ভবত দেশটাই কিছুদিনের মধ্যে সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। সেখানকার নাগরিকরা তাই ফিজি এবং নিউজ়িল্যান্ডে গিয়ে বসবাস করছেন উদ্বাস্তু হয়ে। তাঁদের ছবি দেখেছি। কিরিবাসী মানুষের ভয়ার্ত মুখ, হাহাকার, কান্নার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই সুন্দরবনের ভিটেহারা মানুষের কান্না, হাহাকারের সঙ্গে। 

কলকাতা। সোমবার রাতে আকাশভাঙা বৃষ্টিতে পুরো শহরই জলমগ্ন। মূল শহরে বরাবরই জল জমে। আবার বৃষ্টি থামলে নেমেও যায়। পশ্চিম দিকে হুগলী নদী হলেও শহরের ঢাল পূর্ব দিকে। তাই পূবের জলাভূমি কলকাতার জল নিকাশের প্রধান মাধ্যম। তবুও ইএম বাইপাসের ধারে আয়লার সময় জল জমেনি। আমফানের সময় গলি-ঘুপচিতে সামান্য জল জমলেও বড় রাস্তা বা আবাসনের মধ্যে জল জমেনি। অসংখ্য খাল, নালা, বিল, পুকুরের মাধ্যমে বৃষ্টির শহর ধোয়া জল গিয়ে পড়েছে জলাভূমিতে, সেখান থেকে সুন্দরবনের দিকে বয়ে গেছে বিদ্যেধরী নদী হয়ে। পূবের এই জলাভূমি হল শহরের কিডনি।

বৃহস্পতিবার সকালে ফোন ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, বাইপাসের সেরা এক আবাসন, যেখানে কলকাতা শহরের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা থাকেন, ওপরতলার নীতিকার, স্থপতিরা থাকেন, সেখানকার আমার এক পরিচিত সত্তরোর্ধ অগ্রজ ও তাঁর স্ত্রী এবং এইরকম ৬-৭টি পরিবার ‘টাটা হাতি’ চড়ে চলেছেন। ভাবলাম, দুর্গা পুজোর সময় হয়তো ঠাকুর আনতে চলেছেন। ফোন করলাম— এই বয়সে কেন ওইরকম একটা গাড়ি চড়ে চলেছেন ঠাকুর আনতে! প্রায় আর্তনাদের সুরে বললেন, ঠাকুর আনতে! তুমি জানো গত দু' দিন ধরে নীচে ৪-৫ ফুট জল। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। লিফট বন্ধ। ফ্রিজে খাবার পচে গেছে। ফোনের চার্জ শেষ। পুরো আবাসন জলমগ্ন। ওপর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে একটা গামলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের জীবন সংকটে। তাই আজ কোনওক্রমে জল ঠেঙিয়ে, এক গাদা পয়সা খরচ করে আত্মীয়ের বাড়ি এসে উঠেছি। আমরা এখন উদ্বাস্তু। প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে গেলেন। 

উদ্বাস্তু— কথাটা চাবুকের মতো লাগল। অপ্রস্তুত হয়ে হাবিজাবি কয়েকটা কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। ওপরতলায় থাকা এই মানুষের আর্তনাদের সঙ্গে সুন্দরবনের মানুষের হাহাকারের কোনও পার্থক্য আছে বলে মনে হল না। শুনলাম, বাইপাসের দু’ ধারে তৈরি ঝাঁ-চকচকে আবাসনের বেশ কয়েকটির একইরকম জলমগ্ন অবস্থা। 

জল জমে কেন? কারণ নিকাশি বেহাল বলে। চাষের জমির ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। কলকাতা শহরের ক্ষেত্রেও সত্যি। জল জমে কেন? কারণ আমরা জমাই বলে। কংক্রিট ফেলে। বাঁধ বেঁধে। নদীর চলার পথ আটকে। বিদ্যুৎ, সেচের জল আর বন্যা নিয়ন্ত্রণের অর্ধসত্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে। জল জমে কেন? কারণ আমরা জমাই বলে। খাল, বিল, জলা, পুকুর বুজিয়ে। প্রাণ-প্রকৃতির জলা-জংলা নষ্ট করে, ইট কাঠ পাথরের অনিয়ন্ত্রিত জঙ্গল তৈরি করে। মানুষকে নগর বসতির সুবিধার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে। উদাহরণের কোনও শেষ নেই। তবে, প্রকৃতি শোষণে যাদের কোনও ভূমিকা নেই, যারা জীবন-জীবিকার স্বার্থে প্রকৃতি বা পরিবেশ বাঁচিয়ে কোনওক্রমে টিকে রয়েছে, সেই নির্দোষ মানুষগুলিকেই প্রকৃতির রোষের প্রথম মূল্য চোকাতে হয়। কিন্তু পর পর কয়েকটা ঘটনা প্রমাণ করছে, ধীরে ধীরে এই রোষ গ্রাস করছে ওপরতলার মানুষকেও। 

জলবায়ু উদ্বাস্তুর ক্ষেত্রে এটাই বাস্তবতা। 'ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার'এর তথ্য অনুসারে, ২০০৮ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বন্যা, ঝড়, দাবানল ও খরার মতো আবহাওয়া-সম্পর্কিত ঘটনাগুলির কারণে প্রতি বছর গড়ে ২ কোটি ১৫ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা রেকর্ড ৩ কোটি ২৬ লক্ষে পৌঁছেছিল। আন্তর্জাতিক 'থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট অফ ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস' নানা হিসেব-নিকেশ করে দেখেছে, এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে। তারা বলেছে, চরম আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি এবং জলবায়ু বদলের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে সারা বিশ্ব জুড়ে ১২০ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। 

জলবায়ু বদলের ফলে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম হল সুন্দরবন। এই বন আবার লাগোয়া কলকাতা এবং তার আশেপাশের আধা-শহর এবং গ্রামীণ এলাকার ফুসফুস বলে চিহ্নিত। সেই ২০১০ সালে 'ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার' এবং ২০১১ সালে বিশ্ব ব্যাংক তাদের গবেষণা রিপোর্টে জানিয়েছিল, সুন্দরবন বিপর্যস্ত হলে কলকাতা শহরের অস্তিত্বও সংকটে পড়বে। ২০১৫ সালের ১২ মার্চ 'ডেকান হেরাল্ড' পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জ্বালানি ব্যবহারের ধরন অনুসারে ভারতের ২৫টি শহরের মধ্যে কলকাতায় কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছিল, কলকাতা এশিয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চতুর্থ শহর। আর জলবায়ু বদলের ঝুঁকি মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম প্রস্তুত শহরগুলির মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে কলকাতা।

ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশন এবং কলকাতা মিউনিসিপ্যাল ​​কর্পোরেশন যৌথ উদ্যোগে তুলনামূলক কম কার্বন নির্গমন এবং জলবায়ু সহনশীল কলকাতার জন্য ২০১৫ সালে একটি ‘রোডম্যাপ’ তৈরি করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির তালিকায় কলকাতা শহরটি সপ্তম স্থানে এবং বন্যার ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। রোডম্যাপটিতে ১২ ধরনের কার্যক্রমের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল; তার মধ্যে ছিল দুর্যোগের জন্য প্রস্তুতি, জলবায়ু বদলরোধী পরিবহন ব্যবস্থা, সবুজ ভবন তৈরি এবং তার প্রচার ও প্রসার, সম্ভাবনাময় ৩২০,০০০ মিলিয়ন লিটার বৃষ্টির জল সংগ্রহ, জলবায়ু সহনশীল ভূমি ব্যবহার, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি, বিদ্যুতের জন্য সৌর প্যানেলের ব্যবহার, শক্তির দক্ষ ব্যবহার, সবুজ জীবিকার জন্য ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, পৌরসংস্থার জলবায়ু পরিবর্তন সেলের মাধ্যমে ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তথ্য এবং জ্ঞান বিনিময়, ওয়ার্ড-ভিত্তিক জলবায়ু বদলের ফলে তৈরি বিপর্যয়ের মোকাবিলার পরিকল্পনা। শোনা যাচ্ছে, সম্প্রতি শহরের জন্য নাকি আরও একটি জলবায়ু পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু এসবের প্রয়োগ কে করবে, কীভাবে হবে? কারণ, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।  

অতি লাভ ও লোভের অর্থনীতি এবং সম্পদশালীদের কাণ্ডজ্ঞানহীন ধান্দার আদর্শে আত্মমগ্ন হয়ে রয়েছি আমরা। সাম্প্রতিক অতিমারির মাধ্যমে প্রকৃতি আমাদের বুঝিয়েছে, অতি বাড় ভালো নয়। তবুও অ্যানথ্রোপোসিন কালে আমরা ভাবছি প্রকৃতি হল লুঠের মাল। তাই তার টানাবানা নষ্ট করে আমরা নগর বসিয়ে চলেছি। প্রাণ-প্রকৃতি তাই বদলা নিচ্ছে। পাঞ্জাব, হিমাচল, উত্তরাখণ্ডের নদী শাসনকে ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে প্রকৃতি। কলকাতায় আকাশভাঙা বৃষ্টিও সেরকমই একটি সূচক। প্রকৃতি বলছে, বদল চাই, বদল। না শুনলে বদলা হবে। আর তাই প্রকৃতি লুঠের এই ধান্ধা বন্ধ না করতে পারলে আমরা সকলেই উদ্বাস্তু হব। কেউ আগে কেউ পরে।


No comments:

Post a Comment