Sunday, 13 April 2025

ডায়ার উলফ: বিজ্ঞানের কামাল?

নাকি পুঁজির ভাঁওতা?

আবু সঈদ আহমেদ



বিশ্ব জুড়ে অশান্তি, দেশ জুড়ে অনাচার আর রাজ্য জুড়ে হতাশার বাতাবরণ যখন আমাদের জীবনকে বিষাক্ত করে তুলেছে, তখনই কানে এল এমন একটা খবর যা শুধু অদ্ভুতই না বেশ লোমহর্ষক। দশ হাজারেরও বেশি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া একটা অতিকায় নেকড়েকে নাকি বিজ্ঞানীরা ফিরিয়ে এনেছেন। এই অতি নেকড়ে'রা তুষার যুগের পরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হলেও বহু উপকথাতেই জায়গা করে নিয়েছিল; এছাড়াও Games of Thrones নামে এক জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজের কল্যাণে বিশ্ব জুড়ে পরিচিতি পেয়েছে। যখন চারিদিকে একের পর এক পরিবেশহানির খবর আসে, যখন চোখের সামনে একের পর এক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, মুছে যায় ছোটবেলার একের পর এক খেলার মাঠ, পাড়ার গাছ, তখন এ হেন খবরে একটু পুলকিত হওয়া যায় বইকি। কিন্তু সত্যিই কি এটা কোনও সুখবর?

প্রথমত, আমাদের জানা দরকার এই Dire Wolf বা অতি নেকড়েকে ফিরিয়ে এনেছে Colossal Bioscience নামে একটি বেসরকারি সংস্থা, কোনও জাতীয় প্রতিষ্ঠান নয়। বিজ্ঞানের বিকাশ এবং পুঁজির অবদান দুইই হাত ধরাধরি করে চলেছে বহুদিন ধরে। এতে কোনও অভিনবত্ব নেই। কিন্তু পুঁজি থাকলেই থাকে স্বার্থ এবং কিছু অস্বচ্ছতা। এই প্রকল্পটা রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে হলেও স্বার্থ আর স্বচ্ছতার প্রশ্ন উঠত। তবে রাষ্ট্রকে এখনও সাংসদ, আন্তর্জাতিক বিধিব্যবস্থা এসবের ঝক্কি পোহাতে হয়, সওদাগরি ক্ষেত্রে সে সবের বালাই তুলনায় কম। ফলে, এখানে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কতটা হচ্ছে এসব অনেকটাই অজানা থেকে যাবে। হস্তক্ষেপ করা তো দূর অস্ত।

দ্বিতীয়ত, এর আগেও বিলুপ্ত প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলেছে। পীরানিয় আইবেক্স নামে একপ্রকারের বুনো ভেড়াকে কিছু সময়ের জন্য ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। যদিও সেই ছানাটি বেশিক্ষণ বাঁচেনি। ফলে, বিলুপ্ত জীবকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রথম হওয়ার দাবিটা এ ক্ষেত্রে খাটে না। এছাড়াও গত শতাব্দীতেই ক্লোনিং'এর মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল ডলি নামের ভেড়া। সেই পদ্ধতির উন্নত রূপ এখন চর্চিত হচ্ছে ইরানের মতো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কবলিত দেশগুলিতেও। আর উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এসবের প্রয়োগ তো দীর্ঘদিনের।

তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে বড় গ্যাঁড়াকলটি আছে এই মুদ্দাতে যে এই অতি নেকড়ে বা Dire Wolf আজকের নেকড়ের থেকে species বা প্রজাতিগত ভাবে তো বটেই, genus বা গণগত ভাবেও আলাদা। যেখানে সাধারণ কিংবা বড় আকারের ধূসর নেকড়ের genus বা গণ সাধারণ কুকুরের মতই Canis, কেবল প্রজাতি আলাদা হয়ে lupus। সেখানে এই অতি নেকড়ে বা Dire Wolf'এর genus বা গণ হল Aenocyon। ফলে, কেবলমাত্র জিনগত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে Dire Wolf'এর জীবাশ্ম বা ভাঙাচোরা কঙ্কাল থেকে কিছু জিন তুলে নিয়ে ধূসর নেকড়ের কোষে বসিয়ে surrogate পদ্ধতিতে একটা ভিন্ন দর্শন ভ্রুণ বার করে যদি দাবি করা হয় এর সঙ্গে সেই বিলুপ্ত অতি নেকড়ের এতই সাদৃশ্য আছে যে একে আপনারা বিলুপ্ত অতি নেকড়ে বলে মেনে নিন, তাহলে সেই দাবির প্রতি প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এটাকে নিশ্চিতভাবেই একটা Genetically Modified নেকড়ে বলা যায় যাতে বিলুপ্ত প্রাণীর জিন রয়েছে।

কিন্তু গবেষণাতে এও প্রমাণিত হয়েছে, অকৃষ্ণাঙ্গ মানুষের শরীরে কিছু পরিমাণে বিলুপ্ত নিয়েন্ডারথাল মানবের জিন রয়েছে। অকৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে অনেক ফর্সা, অন্যান্য শারীরিক পরিবর্তনও আছে। তাহলে কি অকৃষ্ণাঙ্গরা নিজেদের বিলুপ্ত নিয়েন্ডারথাল বলবেন? যে সব বেগুনে BT ব্যাকটেরিয়ার cry1Ac জিন থাকে সেগুলো বেগুন না ব্যাকটেরিয়া?

এই কোম্পানির দাবির সততার প্রশ্ন ছেড়ে বেশ কিছু আশঙ্কার জায়গা দেখা যাক। কিছুদিন আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দেশের অন্যতম ধনী-পুত্রের পশুশালায় যেতে দেখা গেছে, যার পোশাকী নাম 'বনতারা প্রাণী পুনর্বাসন কেন্দ্র' জাতীয় কিছু। এই পশুশালায় জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে পশুপাখিদের জোগাড় করা, সবেতেই ব্যাপকভাবে স্বচ্ছতা রক্ষিত হয়েছে তা বলা যায় না। এবার এই অতি নেকড়ের পরে যদি ভারতীয় হাতির সাথে মেরু অঞ্চলের বিলুপ্ত ম্যামথের জিন মিলিয়ে কোনও কুন্তলীয় মাতঙ্গ এনে কোনওদিন ম্যামথের প্রত্যাবর্তনও দাবি করা হয়, যেমনটা এই কোম্পানির কর্ণধারেরা তাঁদের লক্ষ্য নিয়ে বলেছেন, তাহলে কেমন দাঁড়ায়! এইভাবে একে একে বেশ কিছু বিলুপ্ত জীবের এ হেন ‘প্রত্যাবর্তন’ ঘটিয়ে এক বেসরকারি পশুশালাও খুলে দেওয়া যেতে পারে। 'জুরাসিক পার্ক' ফ্র্যাঞ্চাইজির ছায়াছবির মতো দলে দলে সেগুলো দেখতেও লোকে যাবে। এভাবে চলবে Money begets money পন্থায় পুঁজির বিকাশ। এবং পুঁজি যেখানে খাটবে সেখানে সব কিছু স্বচ্ছভাবে হবে তা বলা যায় না। আর পুঁজির জোর খাটিয়ে অন্যান্য মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন করা হবে কিনা সেই প্রশ্নও থেকে যায়।

সংকর জীব প্রসঙ্গে বলা যায় যে, বিশ্ব জুড়ে এ ধরনের জীবের চাষ হয়ে এসেছে। আমাদের ছোটবেলাতেও আলিপুর চিড়িয়াখানায় টাইগন, লিটিগন দেখার স্মৃতি এখনও অমলিন। কিন্তু এই সংকর জীবেদের সকলেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের সঙ্গে ছেলেখেলা সামলে উঠতে পারে না। অনেককেই অকালে চলে যেতে হয়। তাছাড়াও, একটা বিলুপ্ত জীবের জিন সম্বলিত অন্য একটি জীবের শরীর, দীর্ঘদিন ধরে চেপে থাকা বা একেবারেই নতুন কোনও রোগ-জীবাণুর আঁতুড়ঘর হয়ে উঠবে কিনা সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। আরেকটি বড় প্রশ্ন, এই পশুর জিন প্রকল্পের আড়ালে কোনও নিষিদ্ধ কিংবা বিতর্কিত গবেষণা চলছে না তো?

ফলে, প্রশ্ন আর আশঙ্কা কেবল একটা নয়, অনেকগুলো।


No comments:

Post a Comment