কীভাবে তৈরি হয় জাল ওষুধ
প্রদীপ রায়
প্রথম কিস্তি
কথায় আছে, ব্যয় করে আরাম/ তারই নাম ব্যারাম। বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবা কিনতে গিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি হচ্ছে। ২০২১-২২ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রকের দেওয়া হিসেবে, জনপ্রতি চিকিৎসা খরচের ৩৯.৪ শতাংশ খরচ হয় রোগীর পকেট থেকে এবং পশ্চিমবঙ্গবাসীর ক্ষেত্রে এই খরচ ৫৮.৩ শতাংশ। এই খরচের সিংহভাগই ওষুধ ক্রয়ের জন্য। একটি সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওষুধ ক্রয়ের দরুণ হাসপাতালে ভর্তি থাকলে ২৯.১ শতাংশ ও বহির্বিভাগে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৬০.২ শতাংশ খরচ হয়। কারণ, উচ্চহারে ওষুধের দাম।
স্বাধীনতার সময় দেশের ওষুধের ব্যবসা ছিল ১০ কোটি টাকা। বর্তমানে সেই ব্যবসার পরিমাণ ৫ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাজারের ব্যবসার পরিমাণ আড়াই লক্ষ কোটি টাকা। এই বিপুল ব্যবসা গড়ে উঠেছে প্রায় ১০,৫০০টি উৎপাদক ও প্রায় ৩০০০ ওষুধ ব্যবসায়ীর হাত ধরে। বিগত শতকের শেষ দিকে সরকারি নীতিকে আশ্রয় করে হিমাচল প্রদেশে ৫৫৫টি ও উত্তরাখণ্ডে ২২০টি ওষুধ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে ওঠার কারণ, ওই এলাকায় দেওয়া শুল্ক, বিদ্যুৎ, জল ও জমির ওপর বিশাল ছাড়। স্বাধীনতাত্তোরকালে কেমিক্যাল শিল্পের হাত ধরে ঐতিহ্যগত ভাবে ওষুধ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছিল গুজরাত (৩৩৩২), মহারাষ্ট্র (৭২৯) ইত্যাদি রাজ্যে, পরিণামে এই শিল্পের পরিকাঠামো উন্নত হয়েছে সময়ের তালে তাল মিলিয়ে। শুল্কগত ভাবে ও অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্তির দিক থেকে এই পরিকাঠামোর সঙ্গে বিস্তর ফারাক রয়েছে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলিতে। দেশের প্রথম সারির কোম্পানিগুলোর অনেক ওষুধ আজ তৈরি হয় তৃতীয় পক্ষের উৎপাদন কেন্দ্র থেকে। এই উৎপাদন কেন্দ্রগুলো রয়েছে বাড্ডি, সোলান (হিমাচল প্রদেশ), হরিদ্বার, দেরাদুন, উত্তরাখণ্ড ইত্যাদি জায়গায়। নয়া উদার অর্থনীতি চালু হওয়ার আগে কোম্পানিগুলোর নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্র থেকে যে ওষুধ তৈরি হত তার নজরদারি ছিল কোম্পানির হাতে। বর্তমানে সেই নজরদারি তৃতীয় পক্ষের হাতে চলে যাওয়ায় দুটি সমস্যা তৈরি হয়েছে--
১) অনেক ওষুধের গুণমানে আপস করা হচ্ছে;
২) বৃহৎ কোম্পানির দেওয়া নিজস্ব ওষুধ তৈরির কৌশল ও প্রযুক্তি বাইরে পাচার হচ্ছে, যার বেশিরভাগ করায়ত্ত করছে জাল ওষুধ কারবারীর দল।
বিশ্বের ২০ শতাংশ জেনেরিক ওষুধের বাজার ভারতের দখলে এবং এর সিংহভাগ রফতানি হয় আমেরিকা সহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে। শুধুমাত্র আমেরিকার ৬০ শতাংশ জেনেরিক ওষুধের প্রস্তুতকারক ভারতীয় সংস্থা। এই ওষুধ উৎপাদিত হয় দেশের প্রথম সারির কোম্পানিগুলোর নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্রে। উৎপাদনে নজরদারির জন্য আমেরিকার ওষুধ নিয়ামক সংস্থা এফডিএ রাজধানী দিল্লিতে স্থায়ী অফিস তৈরি করেছে, যেখানে অনধিক ৭০ জন পরিদর্শক কর্মরত। লাইসেন্স প্রাপ্ত উৎপাদন কেন্দ্রে প্রতিটি ওষুধ এফডিএ প্রদত্ত পদ্ধতি মেনে উৎপাদন করতে হয়। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতে সেই ব্যাচের সমস্ত ওষুধ বাতিল বলে গণ্য হয়। খবরের কাগজে প্রায়শই নামজাদা কোম্পানির তৈরি জেনেরিক ওষুধ আমেরিকার বাজার থেকে ফেরত আসার খবর পরিবেশিত হয়। মজার কথা এই, নামজাদা ভারতীয় ওষুধ কোম্পনিগুলো দেশের অভ্যন্তরে যে ওষুধ বিপণন করে তার ক্ষেত্রে নজরদারি অনেকটাই শিথিল। অর্থাৎ, উন্নত দেশের মানুষের জন্য তৈরি ওষুধের গুণমান যতটা উচ্চস্তরের, নিজের দেশের রোগীর জন্য সেই গুণমান ততটাই নিম্নস্তরের।
এখন দেশীয় ওষুধ বাজারে জাল ওষুধ ধরা পড়ায় পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। সংসদে সমস্যাটি উত্থাপিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ শঙ্কিত। অথচ, সমস্যাটি একাধারে বৈশ্বিক ও প্রাচীন। সমস্যার ব্যাপ্তি অনুধাবন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৩ সালে তৈরি করে গ্লোবাল সারভাইলেন্স অ্যান্ড মনিটারিং সিস্টেম। ওষুধের বাজার সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাল বা নকল ওষুধের ব্যবসা বেড়েছে দুনিয়া জুড়ে। তবে উন্নত দেশগুলোতে যেখানে নজরদারি অত্যন্ত কঠোর, সেখানে নকল বা জাল ওষুধের উপস্থিতি কম। আমাদের দেশে এই জাল ওষুধের বাজারের যথাযথ পরিমাণ কত, সে বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য নেই। ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকদের মতে, এই বাজার ২০-২২ শতাংশ। আবার ফার্মা এক্সপার্ট কাউন্সিলের উপদেষ্টার মতে, এই জাল ওষুধের পরিমাণ ১০-১২ শতাংশ। ২০১১-১২ সালে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ামক সংস্থা ৪৮,০৮২টি ওষুধের স্যাম্পল পরীক্ষার হিসেব সংসদে পেশ করে জানিয়েছিল যে এর মধ্যে ২১৮৬টি ওষুধ অর্থাৎ ৪.৫ শতাংশ জাল বলে চিহ্নিত করা গেছে। তথ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক জানায়, ২০০৯-১০ সালে ৪.৯ শতাংশ, ২০১০-১১ সালে ৪.৭ শতাংশ ওষুধ নির্ধারিত মানে পৌঁছতে পারেনি এবং ৬ শতাংশ আক্ষরিক অর্থে জাল ওষুধ।
Spurious ড্রাগের রকমফের আছে। যেমন, জাল-নকল বা নিম্নমানের ওষুধ। নিম্নমানের ওষুধে সক্রিয় উপাদানের পরিমাণ যা দাবি করা হয় তার চাইতেও কম থাকতে পারে অথবা ওষুধের অন্যান্য গুণমান যথা দেহের অভ্যন্তরে প্রবশের পর সক্রিয় উপাদানে নির্দিষ্ট সময়ে কার্যকরী না হওয়া অথবা সহযোগী উপাদানের গুণমান ঠিক না থাকা। এছাড়া সিরাপ বা শরীরে দেওয়া ফ্লুইডের মধ্যে অপ্রত্যাশিত অবাঞ্ছিত পদার্থ থাকা। সম্প্রতি দেশে তৈরি রফতানি যোগ্য কাশির সিরাপে বেশি মাত্রায় সহযোগী উপাদান ডাই ইথিলিন গ্লাইকল বা ইথিলিনের মাত্রা বেশি থাকায় ওই ওষুধ ব্যবহারে গাম্বিয়া, উজবেকিস্তানে ব্যাপক শিশু মৃত্যু ঘটেছে।
নকল ওষুধ সাধারণত নামজাদা কোম্পানির সব চাইতে চালু ব্র্যান্ডের নামে তৈরি করা হয়, যাতে ওষুধের সক্রিয় উপাদান থাকে না অথবা থাকলেও কম থাকে। এর দরুণ ওষুধ কার্যকরী হয় না। অ্যাসিড কমানোর ওষুধ প্যান্টেপ্রাজল'এর আমাদের দেশের বাজারে বিক্রির পরিমাণ ৬৯২৩ কোটি টাকা। রক্তচাপ কমানোর ওষুধ টেলমেসার্টন'এর বিক্রির পরিমাণ ৩৫০০ কোটি টাকা। ফলে, এই ধরনের বিশাল বিক্রির ওষুধের অবিকল নকল ওষুধ তৈরি হতে পারে অথবা বানানোর সামান্য তারতম্য করে (যা রোগীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়) ওষুধের মোড়কের চেহারার প্রভেদ ঘটিয়ে বাজারে ছাড়া হয়। এই ওষুধের উৎপাদনের উৎস, তৈরি করার লাইসেন্স বা কোম্পানির অস্তিত্ব সর্বদা ভুয়ো প্রমাণিত হয়। এই নকলের ক্ষেত্রে QR কোড পর্যন্ত নকল হচ্ছে। যদিও বারকোডের ক্ষেত্রে এখনও তা করা সম্ভব হয়নি। নকল ওষুধের বৃহৎ বাজার গ্রামগঞ্জে, যেখানে নজরদারি কম।
জাল ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়:
১) ওষুধের মধ্যে সক্রিয় উপাদানের বদলে নিষ্ক্রিয় পদার্থ যথা স্টার্চ, ক্যালসিয়াম ল্যাক্টেট বা কার্বনেট থাকতে পারে;
২) মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধের তারিখ পালটে তাকে পুনরায় বাজারজাত করা হয়। এই ধরনের ওষুধ সংগ্রহের ক্ষেত্রটি বেশ জটিল ও অভিনব। খুচরো দোকান বা পাইকারি ওষুধ ব্যবসায়ীর কাছে অবিক্রিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া ওষুধ ফেরত নেওয়ার জন্য সেই কোম্পানির নির্দিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কাছে জমা দেওয়ার কথা। এই পথচক্রের মধ্যেই তা হাতবদল হয়ে পৌঁছে যায় জাল ওষুধ কারবারীদের হাতে;
৩) উৎপন্ন ওষুধের মধ্যে ক্ষতিকারক, অর্থাৎ, ভেজাল পদার্থ (Adulterated) মেশানো হয়, যা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে যে যে পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যিক সেখানেই ঘাটতি থাকে। বিভিন্ন ধরনের ফ্লুইড যা রক্তে সরাসরি দেওয়া হয়, তাতে ছত্রাক বা অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি প্রায়ই খবর হয়। হার্বাল ওষুধের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও উদ্বেগজনক।
জাল ওষুধের কারবার দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ওষুধের ব্যবসা যতটা প্রসারিত হচ্ছে, ততটাই বাড়ছে জাল ওষুধের রমরমা। ওষুধের ভেজাল রুখতে, গুণমান বজায় রাখতে, উৎপাদনের শর্ত মানা ও সমস্ত দেশে নজরদারির জন্য স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে। এদের কাজ উৎপাদিত ওষুধের গুণমান ও শুদ্ধতা বিচার করা এবং নকল বা জাল অথবা নিম্নমানের ওষুধ ধরা পড়লে আইন মোতাবেক শাস্তি দেওয়া। 'ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস'এর নামে ওষুধ উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরগুলোর অল্পস্বল্প বিচ্যুতি ঘটলে তার দরুণ শাস্তি কেবলমাত্র জরিমানা। ফলে, ওষুধ কোম্পানিগুলো এই সুযোগ নিয়ে উৎপাদন খরচ কমায় গুণমানের সঙ্গে আপস করে।
ক্রমশ...