Wednesday, 23 October 2024

প্রাপ্তিও কিছু আছে!

সব আন্দোলনেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে 

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



দেখা গেল, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর পরই ও অভয়া'র মা-বাবার অনুরোধে জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা আমরণ অনশন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব যারপরনাই বিরক্ত ও হতাশ হয়েছে। বোঝা ভার, তারা ঠিক কী চাইছিলেন জুনিয়র ডাক্তারদের এই সংঘবদ্ধ আন্দোলন থেকে। তবে কেউ কেউ যে এর মধ্যে এক ঘোরতর বিপ্লব সংগঠিত করে ফেলার যথেষ্ট উপাদান পাচ্ছিলেন, তা অমূলক হলেও দৃশ্যত অস্পষ্ট ছিল না। কেউ কেউ আবার দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন যে, বাংলাদেশ স্টাইলে নবান্ন'র ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে মুখ্যমন্ত্রী পগার পার হবেন। এইসব অপরিণত, বালখিল্য আচরণে তিলোত্তমার সুবিচার ও লিঙ্গ সাম্যের দাবি এবং জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনে উত্থাপিত-- যদিচ কিছুটা প্রচ্ছন্নে থাকা-- জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের দাবি কতকটা যেন আড়ালে চলে যাচ্ছিল।

অথচ, ৯ অগস্ট পরবর্তী ঘটনাবলী কিন্তু গোটা রাজ্য জুড়ে তিনটি অভিমুখকে বর্শাফলকের মতো ক্ষুরধার করেছিল: 

এক) অভয়া'র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরিণতিতে জনমানসে এক তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি হেতু নাগরিক ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ; 

দুই) আরজিকর ও অন্যান্য সরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চূড়ান্ত দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তারদের দীর্ঘদিনের তীব্র অসন্তোষের এক ব্যাপক ও সুসংগঠিত আত্মপ্রকাশ; 

তিন) এই দুই গণবিক্ষোভের আবহে নাগরিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির তৎপরতা।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেখানে নিরাপত্তার সর্বোচ্চ গ্যারান্টি কাম্য, সেখানে এক কর্মরত চিকিৎসকের ওপরে এমন এক নিদারুণ অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডে সরকার ও তার প্রশাসনের কাঁধেই নৈতিক ও রাজনৈতিক দায় এসে পড়ে। সে অর্থে যে কোনও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও শাসক ও সরকারি দলের বিরুদ্ধেই প্রাথমিক ভাবে ধাবিত হয়। আর এ ব্যাপারে, বিশেষত দুর্নীতি প্রসঙ্গে এ রাজ্যে শাসক দলের যে বেশ দুর্নাম আছে, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই, ১৪ অগস্টের মধ্যরাতে যখন রাজ্য জুড়ে অন্তত ৩৫০'এরও বেশি জায়গায় লক্ষাধিক সাধারণ মানুষের, বিশেষত মহিলাদের তীব্র রোষ রাজপথে আছড়ে পড়ল, তা ড্যাবড্যাবে চোখে দেখা ছাড়া সরকারপক্ষ ও শাসক দলের আর কোনও উপায়ও ছিল না। তারা ইতিমধ্যে দেওয়াল লিখনও পড়ে ফেলেছে, আর তা যে একেবারেই তাদের পক্ষে স্বস্তিদায়ক নয়, তা বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। ইতিমধ্যে আরজিকরের জুনিয়র ডাক্তারেরাও সংগঠিত হয়ে ময়দানে নেমে পড়েছেন, তাদের পাশে অন্যান্য হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারেরা ধীরে ধীরে সামিল হতে থেকেছেন। নিহত চিকিৎসকের মা-বাবা কলকাতা হাইকোর্টে সিবিআই তদন্তের দাবি করে তার মঞ্জুরি পেয়েছেন আর এসবের মাঝেই, আইএমএ'এর দৃষ্টি আকর্ষণ হেতু শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি গোটা বিষয়টিকে স্যুয়ো-মোটো নিজেদের এক্তিয়ারে নিয়ে এসেছেন।

তখন চারিদিকে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে আরজিকর নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা। মেইনস্ট্রিম ও সোশ্যাল মিডিয়া ভরে উঠছে কিছু সত্যের সঙ্গে মিথ্যার নানা অতিকথনে, এমনকি পাগলের প্রলাপেও। মানুষ কিছুটা ক্ষিপ্ত ও বিভ্রান্ত। শাসক দল নিজেদের দায়কে হাল্কা করতে নানারকম প্রশাসনিক পদক্ষেপ সহ দলীয় স্তরেও নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। তবে তদন্তভার সিবিআই'এর হাতে চলে যেতেই শাসক আস্তে আস্তে নিজেদের কিছুটা গুটিয়ে নেয় এবং মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে, আরজিকর বিষয়ে সরকারের তরফে যা বলার তা একমাত্র তিনিই বলবেন। পাশাপাশি, ১৪ অগস্টের 'রাত দখলের' অভূতপূর্ব সাফল্যের পর 'নাগরিক সমাজ' ও বিবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নামে ইতস্তত আরও কয়েকটি 'রাত দখল' এদিক ওদিক সংগঠিত হয়, কিন্তু ক্রমান্বয়ে দেখা যায়, জমায়েত ও গণ অংশগ্রহণের গুনতি কমে আসছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা কিছু বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি সোশ্যাল মিডিয়ার কয়েকজন ইউটিউবারদের দিয়ে রাতারাতি এক 'ছাত্র সমাজ' বানিয়ে ২৭ অগস্ট 'দফা এক দাবি এক/ মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ' শ্লোগান তুলে 'নবান্ন দখলের' ডাক দেয়; যদিও, পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো কলকাতা শহরের ইতিউতি কয়েকশো লোকের বিচ্ছিন্ন দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও পুলিশের টিয়ার গ্যাস, জলকামান সহযোগে তার অকাল প্রয়াণ ঘটে। ইতিমধ্যে দানা বেঁধে ওঠা জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনকারীরাও জানিয়ে দেন যে, তাঁরা ওই 'নবান্ন দখল' অভিযানে একেবারেই নেই। 

তবে ইতোমধ্যে, জুনিয়র ডাক্তাররা এই কদিনে নিজেদের বেশ সংগঠিত করে ফেলেছেন এবং ১৪ অগস্ট আরজিকরে মধ্যরাতে বহিরাগত দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবের পর পাঁচ দফা দাবি নিয়ে এক সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন; শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা এক চ্যালেঞ্জের মুখে এসে পড়ে। তাদের আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ায় সর্বস্তরের চিকিৎসক সমাজ। কর্পোরেট ও বেসরকারি হাসপাতালগুলি এতে উৎসাহ পায় এবং কর্মবিরতির কারণে সরকারি চিকিৎসা অপ্রতুল হয়ে পড়ায় অল্প কয়েক দিনেই তাদের ব্যবসা প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল, এ রাজ্যে গত কয়েক বছরে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা আগের থেকে কিছু উন্নত হয়েছে, নিখরচায় সে পরিষেবা পাওয়ার নানাবিধ ব্যবস্থাদিও গড়ে উঠেছে, ফলে, স্বাস্থ্য দুনিয়ার মুনাফাবাজদের একটা মতলবই ছিল এই সরকারি ব্যবস্থাদিগুলিকে পঙ্গু করে দেওয়ার। জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন ও তাদের কর্মবিরতি তাদের সামনে সেই সুযোগকে 'পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা'র মতো এনে দিল। ফলে, কর্পোরেট হাসপাতাল, ফার্মা লবি ও স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানিগুলি এই সুযোগকে ষোলোআনা উশুল করতে কোনও চেষ্টারই কসুর করতে বাকী রাখল না। সরকারি হাসপাতালে রোগী পরিষেবার ঘাটতি ও হয়রানি উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। বিনা চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগও উঠল।

কিন্তু এমন কঠোর পরিস্থিতিতেও, এমনকি শীর্ষ আদালতের নির্দেশে জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি না তুললে সরকারের তরফ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে আদালতের কিছু করার থাকবে না-- এই মোতাবেক হুকুম থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার আলাপ-আলোচনার পথকেই বেছে নিল এবং দু-তিনবারের ব্যর্থ চেষ্টার পর সে আলোচনা প্রথম দফায় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে সম্পন্নও হল। পাঁচ দফা দাবির প্রায় সবই মেনে নেওয়া হল (স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণের দাবি ব্যতীত)। জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি তুলে নিলেন। কিন্তু আবারও দশ দফা দাবি সহ তারা ফিরে এলেন এবং কলকাতার কেন্দ্রস্থল ধর্মতলায় আমরণ অনশনে বসে পড়লেন। সেও কয়েকদিন গড়াল। তারপর আমরা জানি, ওই দশ দফা দাবির মধ্যেও (এক-দেড়খানা বাদ দিলে) প্রায় সবকটি মেনে নেওয়া হয়েছে এবং জুনিয়র ডাক্তাররা অনশন প্রত্যাহার করে আবারও কাজে ফিরে গেছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এত সব কিছুর পর, সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ (বা রোগী) ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মী-- উভয়ে উভয়ের দিক থেকে কি কিছু আদায় করতে পারলেন? অবশ্যই কিছু পারলেন; হয়তো সে পারা বা পাওয়ার মধ্যে সব-পাওয়া নেই, কিন্তু বেশ কিছু নতুন ও উল্লেখযোগ্য পাওয়া আছে বৈকি! আসুন, এক এক করে খানিক দেখে নেওয়া যাক:

১) নাগরিক সমাজ ও জুনিয়র ডাক্তারদের এই লাগাতার আন্দোলনের ফলেই তো সিবিআই আরও বেশি তৎপর হয়েছে এবং ৫৮ দিনের মাথায় শিয়ালদহ আদালতে প্রাথমিক চার্জশিট জমা দিয়েছে। ৪ নভেম্বর এই মামলার চার্জশিট পরবর্তী প্রথম শুনানি;

২) শীর্ষ আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত হস্তক্ষেপে জাতীয় ও রাজ্য স্তরে বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছে যারা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মরত সমস্ত কর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়টিকে দেখভাল করবে। ২১ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রী ও জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠক থেকেও রাজ্য টাস্ক ফোর্সে ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্বকে সুনিশ্চিত করা হয়েছে (জুনিয়র ডাক্তারদের জোরালো দাবিতে) এবং ইতিমধ্যেই সরকারের তরফে সে সম্পর্কে নির্দেশাবলীও প্রকাশ পেয়েছে;

৩) সব থেকে বড় পাওনা, যা জুনিয়র ডাক্তারদের দশ দফা দাবির মধ্যে ছিল, কেন্দ্রীয় রেফারেল ও ডিজিটাল বেড ভ্যাকেন্সি ব্যবস্থার প্রবর্তন। এই দ্বি-ব্যবস্থা শুধু ডাক্তারদের তরফে সুচিকিৎসা প্রদানকেই সুনিশ্চিত করবে না, রোগীদের অযথা হয়রানি ও ভর্তি সংক্রান্ত নানান দুর্নীতিকেও প্রতিরোধ করবে। সরকারের তরফে জানানোও হয়েছে, এই দুই ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই পাইলট আকারে পরীক্ষামূলক স্তরে রয়েছে, যা ১ নভেম্বর থেকে গোটা রাজ্যে চালু হয়ে যাবে;

৪) স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধে আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে তোলা হয়েছিল-- কলেজে কলেজে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন, অর্থাৎ, নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রতিনিধি চয়ন। এ বিষয়েও উভয় পক্ষ সহমতে পৌঁছেছে এবং মার্চ ২০২৫'এর মধ্যে নির্ধারিত নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে;

৫) স্বাস্থ্য পরিষেবায় সমস্ত শূন্য পদগুলি পূরণ করাও ছিল একটি অন্যতম দাবি, যা নীতিগত ভাবে সরকার মেনে নিয়েছে, কিন্তু ওবিসি সংক্রান্ত আদালতের একটি নির্দেশ ও তার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে দায়ের করা মামলায় ব্যাপারটা আপাতত আইনি গেরোয় ফেঁসে আছে। আইনি জট খুলে গেলে এ ক্ষেত্রেও সদর্থক পদক্ষপ দেখা যাবে বলে উভয় পক্ষ আশা রেখেছে বলে মনে হয়।

নির্দিষ্ট ভাবে এই প্রাপ্তিগুলো কিন্তু কম কিছু নয়। যে সমস্ত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের একাংশ, যারা কোনওভাবেই সরকারি হাসপাতালের দোরগোড়া অবধিও যান না, অর্থের জোরে স্বাস্থ্য পরিষেবা কিনে গর্ব প্রকাশ করেন, তাদের কাছে এই দাবিগুলির হয়তো কোনও অর্থই নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও নিত্যভোগী যারা সরকারি পরিষেবায় চক্কর কাটেন, তাদের কাছে এই প্রাপ্তি অমূল্য। এই প্রাপ্তিগুলিতে (বিশেষত উপরে উল্লিখিত ৩ নং প্রাপ্তিটি) সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে বলে আশা করা যায়।

তবে এর মধ্যেও দুটি কাঁটা যেন রয়ে গেল:

১) 'থ্রেট কালচার'এর নামে কলেজ একাডেমিক কাউন্সিলের নির্দেশে কলেজ থেকে ডজন ডজন ছাত্র বা জুনিয়র ডাক্তার বহিষ্কারের নীতি-নৈতিকতার এক্তিয়ার কতটা, তা নিয়ে ২১ অক্টোবরের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন শুধু তাই নয়, পরের দিন কলকাতা হাইকোর্টও আরজিকর থেকে ৫১ জন শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তারের ওপর শাস্তি রদ করে একই প্রশ্ন তুলে রাজ্য সরকারের কাছে তা বিচার ও সিদ্ধান্তের জন্য পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে;  

২) জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির সময় তাদের যে ৫৬৩ জন বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করে অর্থ কামিয়েছেন, তথ্য হাতে মুখ্যমন্ত্রীর তোলা এই অভিযোগের জবাব এখনও কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের তরফ থেকে পাওয়া যায়নি।

এ ব্যতিরেকে, অভয়ার সুবিচারের দাবিতে জনসমাজের সোচ্চার আওয়াজ, কাজে নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিকীকরণ ও রোগীদের সুচিকিৎসার দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের জোরদার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, অন্যদিকে, আন্দোলনের প্রতি সরকারের ধৈর্য, নিজেদের গাফিলতির দায়কে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নমনীয়তা অবলম্বন ও কোনওভাবেই দমন-পীড়নের পথে না হেঁটে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যা নিরসনের চেষ্টা-- উদ্ভুত সমস্যাকে কিছুটা হলেও সমাধানের দিকে এগোতে সাহায্য করেছে।     

কিন্তু তার মানে এও নয় যে, সব কিছু মিটে গেল। আন্দোলনের যেমন শুরু ও বিরতি থাকে, নানাবিধ ওঠানামাও থাকে, শাসকের তরফেও তাকে মোকাবিলার নানান তরিকা থাকে; প্রশ্নটা হল, বিপরীত দিক থেকে ধাবিত শাসক ও শাসিতের এই দুই প্রক্রিয়া কি উভয়ের পক্ষে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে, নাকি, সেখানে বোঝাপড়ার জায়গা থাকছে। এই দ্বান্দ্বিক নিয়ম যারা বোঝেন না, তারাই 'থ্রেট কালচারের' আসল তল্পিবাহক হন এবং 'ট্রোলিং' ও 'বুলিং'এর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে জনবিচ্ছিন্ন মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে নিজেদের এজেন্ডাকে কোথাও অনুমোদন না করাতে পেরে খিস্তিখেউড় আর হিংসাকে অবলম্বন করে হতাশায় দিন কাটান।

 

Tuesday, 22 October 2024

লাদাখের লড়াই

কর্পোরেট আগ্রাসন বনাম সোনম ওয়াংচুক

প্রশান্ত ভট্টাচার্য 



টানা ১৬ দিন অনশনে থাকার পর কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে আগামী ৩ ডিসেম্বর বৈঠকে বসার প্রতিশ্রুতি পেয়ে গত ২১ অক্টোবর দিল্লিতে সোনম ওয়াংচুক অনশন ভঙ্গ করেন। কিন্তু কেন এই অনশন? কোন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে ও কীসের দাবিতে লাদাখের এই ব্যাপক জন আন্দোলন যার অন্যতম নেতা সোনম ওয়াংচুকের এই দীর্ঘ লড়াই? দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল লাদাখের এই সমস্যাকে বুঝতে আমাদের কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে।

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ার সুবাদে খুশি হয়েছিলেন লাদাখের মানুষ। জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আনন্দে হাত ধুয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন লাদাখবাসী। সেই তাঁরাই আজ ক্ষুব্ধ! কেন? 

অনেকের মনে আছে, লাদাখের সাংসদ বিজেপির জামিয়াঙ্গ শেরিং নামগিয়াল লাদাখের জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়া আর ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ভাষণ দিয়েছিলেন সংসদে। কিন্তু তারপর সবটাই কেমন বদলে গেল! বিজেপির বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তুলে আর কর্পোরেট আগ্রাসনের প্রতিবাদে সোনম ওয়াংচুকদের লড়াইয়ে বরফে মোড়া লাদাখ আজ ক্রমেই তপ্ত হচ্ছে। কেন? সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে সোনম ওয়াংচুক ও লাদাখবাসীদের প্রতিটি পদক্ষেপে। লাদাখ আর সোনম ওয়াংচুক আজ সমার্থক। চলতি বছরে ২১ দিন টানা অনশন করার পর ২৬ মার্চ অনশন প্রত্যাহার করলেও সোনম ওয়াংচুক জানিয়ে দিয়েছিলেন, লড়াই চলবে। লড়াই চলছে, যা আজ পৌঁছে গিয়েছে দেশের রাজধানী দিল্লিতে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, গত ৫ অক্টোবর থেকে কলকাতার ধর্মতলায় আমরণ অনশন শুরু করেন ৬ জন জুনিয়র ডাক্তার। পরে  অনশনে যোগ দেওয়া আন্দোলনকারী ডাক্তারদের সংখ্যা বেড়েছে। পুলিশ ও রাজ্য প্রশাসনের তরফে বারবার অনশন তুলে নেওয়ার জন্য ডাক্তারদের কাছে অনুরোধও করা হয়েছে। কিন্তু তাদের উপর কোনও জোরজবরদস্তি হয়নি। অথচ, দিল্লিতে দুর্গাপুজোর কার্নিভাল না থাকলেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশ লাদাখের পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুক-সহ ২০ জনকে জোরজবরদস্তি অনশনস্থল থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটক করে।

দিল্লির লাদাখ ভবনের কাছে আলাদা রাজ্যের দাবিতে অনশন চালাচ্ছিলেন জলবায়ু আন্দোলন কর্মী সোনম ওয়াংচুক। তাঁর সঙ্গে এই একই দাবিতে আন্দোলনে ছিলেন আরও ২০-২৫ জন। ১৩ অক্টোবর রবিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সাফাই দিয়ে সোনম-সহ ২০ জনকে লাদাখ ভবনের সামনে থেকে আটক করে দিল্লি পুলিশ। দিল্লি পুলিশের এই ভূমিকার তীব্র বিরোধিতা করে সোনম ওয়াংচুক জানান, 'এটা সত্যিই খুব দুঃখের যে গণতান্ত্রিক পরিবেশে মানুষ নিজের মতামতও প্রকাশ করতে পারছে না। লাদাখ ভবনের সামনে আমরা যখন নীরব অনশন শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন ওখানে অনশনে যোগ দেবে বলে অনেকে জড়ো হয়েছিলেন। আমাদের বলা হয়েছিল কোনও স্লোগান দিতে পারব না। আমরা তাও মেনে নিয়েছিলাম। তা সত্ত্বেও আমাদের জোর করে তুলে দিল পুলিশ। পুলিশের বাসে চাপিয়ে আমাদের আটক করা হল। আমাদের বলা হল, এখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এটা শুধু আমাদের জন্য দুঃখজনক নয়, গণতন্ত্রের পক্ষেও লজ্জার। ভারতের জন্য আমাদের দুঃখ হচ্ছে।' লজ্জার হচ্ছে, এ নিয়ে বাংলার প্রধান সংবাদমাধ্যমের কোনও হেলদোল নেই। ভাবটা এমন, কে সোনম ওয়াংচুক! অথচ এই প্রযুক্তিবিদ যখন পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে ম্যাগসেসাই পুরস্কার পান, তখন ধন্য ধন্য করেছিল এই সংবাদমাধ্যমগুলিই। আসল কথাটি হচ্ছে, কর্পোরেট বিরোধী কোনও আন্দোলনের খবর করতে নারাজ এখানকার সরকার বাড়ি।

লাদাখকে রাজ্যর মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছেন বাস্তবের 'র‍্যাঞ্চো' সোনম ওয়াংচুক। তাঁর দাবি, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতাভুক্ত করে পূর্ণ রাজ্যর মর্যাদা দেওয়া হোক। লাদাখের জন্য একটি পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন ও লে আর কার্গিলের জন্য আলাদা লোকসভা আসনের বন্দোবস্ত করা হোক। এমনই সমস্ত দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনের পাশাপাশি ফের অনশনে বসেন সোনম। শুধু নুন আর জল পান করেছেন। ফলে, শরীর হয়ে পড়েছিল দুর্বল। প্রথমে দিল্লির যন্তর মন্তরের সামনে ধর্নায় বসতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু অনুমতি না মেলায় দিল্লির লাদাখ ভবনের সামনে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন শুরু করেন। শাহমন্ত্রক নিয়ন্ত্রিত দিল্লি পুলিশের বক্তব্য, 'আন্দোলনকারীরা যন্তর মন্তরের সামনে অনশনে বসার অনুমতি চেয়েছিলেন। সেই অনুমতিই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লাদাখ ভবনের সামনে এভাবে অনশনে বসার কোনও অনুমতি ছিল না তাঁদের কাছে। আমরা কয়েকজনকে আটক করেছি। ছেড়ে দেওয়া হবে।' লে থেকে দীর্ঘ ৩০ দিন পথ পায়ে হেঁটে দিল্লিতে এসেছেন আন্দোলনকারীরা। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁদের দিল্লির সিঙঘু সীমানার কাছে আটক করা হয়েছিল। পরে সোনম-সহ বাকিদের ২ অক্টোবর ছেড়ে দেওয়া হয়। 

লাদাখে কর্পোরেট আগ্রাসন নিয়ে কোনও সমঝোতায় আসতে নারাজ সোনমরা। সোনমের স্পষ্ট কথা,  লাদাখে এখন না আছে স্থানীয়দের জন্য সংরক্ষণ, না আছে গণতান্ত্রিক কাঠামো। এখানে বিধানসভা নেই, নির্বাচিত নেতা নেই। দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রিত একটি আমলাতান্ত্রিক শাসন চলছে লাদাখে। ফলে, এক কালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল চেয়ে আসা মানুষেরই আজ মোহভঙ্গ হয়েছে। লাদাখি সেনাদেরও মনোবল একই কারণে ভেঙে গিয়েছে বলে দাবি করেন সোনম। তিনি অকপটে বলেন, ‘ওঁরা শুধু ভোটের কথা আর কতগুলো আসন জেতা যেতে পারে, সেই কথা ভাবেন। কিন্তু মানুষের কথা ভুলে যান। আমরা কেন্দ্রের কাছে এই নিশ্চয়তা চাই যে, ভবিষ্যতে তারা এ ভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না।’ কেন্দ্রের সঙ্গে একটি বহুপাক্ষিক আইনি চুক্তিই তাঁরা চাইছেন বলে সোনম জানিয়েছেন। তাঁদের লক্ষ্য, ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্তি তো বটেই, সেই সঙ্গে পূর্ণ রাজ্যর মর্যাদাও।

চলতি বছরের গোড়ায়, লাদাখের ওই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় আমরা দেখেছি, গায়ে একটা কম্বল জড়ানো, অনশনক্লিষ্ট শীর্ণ কালি পড়া মুখ ‘বাস্তবের র‌্যাঞ্চো’ সোনম ওয়াংচুককে। টিভি সাক্ষাৎকারে অকম্পিত তাঁর গলা। কোনও শীতল-জড়তা ছাড়াই লাদাখের পরিবেশ আন্দোলনের অদম্য প্রহরী বলে গেলেন, ‘লোকে আজ জানতে চাইছে, আমাদের পাহাড়গুলোকে বিভিন্ন শিল্প আর খনি সংস্থার কাছে বেচে দেওয়াটাই লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার আসল উদ্দেশ্য নয় তো?’ এক্কেবারে গোড়া ধরে নাড়া দিয়েছেন সোনম। তাঁর উচ্চারিত এই লোকরা কারা? সোনম জানাচ্ছেন, এঁরা লাদাখবাসী, কেন্দ্রীয় শাসক দলের নেতাদের প্রতি মোহভঙ্গ হয়েছে যাঁদের; রোজ যাঁরা সোনমের সঙ্গে খোলা আকাশের নীচে মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে হাড়জমানো শীতে রাত কাটিয়েছেন। সংখ্যায় এঁরা অন্তত আড়াইশো। এ ছাড়া রোজ সারা দিনে ভিড় জমাচ্ছিলেন আরও দুই থেকে পাঁচ হাজার মানুষ। অনশনরত সোনমের মুখে সেদিনও শোনা গিয়েছিল, ‘আমরা বিদায়ী সরকারকে মনে করাতে চাই, তারা লাদাখের মানুষকে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিভিন্ন বৈঠকে, ১৯'এর লোকসভা ভোট এবং ২০'র পার্বত্য পরিষদের নির্বাচনে তারা বলেছিল, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের রক্ষাকবচ দেওয়া হবে। এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই তারা বিপুল ভোটে জেতে। কিন্তু তারপর থেকে টালবাহানাই চলেছে। গত ৪ মার্চ তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, ষষ্ঠ তফসিল হবে না।’

সোনম অনশনে বসার আগেই পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা এবং ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে লাদাখে বিক্ষোভ ও বন্‌ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ে কার্গিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স বা কেডিএ এবং লে অ্যাপেক্স কাউন্সিলের ছ' সদস্যর একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বৈঠক করেন। জানা যায়, সেই বৈঠকে জমি, চাকরি এবং সংস্কৃতি নিয়ে লাদাখবাসীদের উদ্বেগ দূর করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৭১ ধারার মতো রক্ষাকবচের আশ্বাস দিয়েছিলেন শাহ। তবে এ-ও জানিয়ে দিয়েছিলেন, ষষ্ঠ তফসিলে লাদাখের অন্তর্ভুক্তি আর পৃথক আইনসভার দাবি মানা সম্ভব নয়। সোনমের অনশন আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে কেডিএ লাদাখে অর্ধদিবস ধর্মঘটের ডাকও দিয়েছিল। এই লড়াই-সংগ্রামগুলো প্রমাণ করে সোনমের পাশে আছে বৃহত্তর লাদাখ। 

কর্পোরেট সমাজের সীমাহীন লোভ যে হিমালয়ের পরিবেশকে নানাভাবে বিপন্ন করে তুলছে, তার নমুনা আমরা বিভিন্ন সময় পাচ্ছি। হরিদ্বার-ঋষীকেশ বা চারধামের মতো তীর্থস্থানে এই বিপন্নতার ছবি স্পষ্ট বোঝা গেছে। তা নিয়ে বারবার কথা উঠেছে, পর্যটনের সঙ্গে এর যে ভয়াবহ সম্পর্ক আছে তাও সুবিদিত। অথচ কোনওরকম তোয়াক্কা না করে এক  বিরাট প্রযুক্তিগত কেরামতি চালানো হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার অস্বাভাবিক উন্নতির জন্য। এর দুঃসহ পরিণাম সবাই দেখছেন। যোশী মঠের মানুষের হাহাকার গেরুয়া শিবিরের কার কার হৃদয়ে পৌঁছেছে জানা নেই, তবে নির্মাণ শ্রমিকদের সুড়ঙ্গে আটকে পড়া এবং হাড় হিম করা উদ্ধারকার্য আমরা গিলেছি রিয়েলিটি শো দেখার বিনোদনে। আহা! কী টান টান উত্তেজনা। 

‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির নায়ক ফুংসুক ওয়াংডুর মধ্যে সোনমেরই ছায়া একসময় যারা দেখেছিল, সেই সংবাদমাধ্যম কী নিষ্ঠুর উদাসীন! তাই একুশ দিন ধরে ভারতের এক প্রান্তে অনশন করা সোনম ওয়াংচুকের কথা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে উপেক্ষিত। সোনম কিন্তু কোনও এলিতেলি নন। আদ্যন্ত অহিংস ভাবনায় হিমালয়ের পরিবেশ এবং এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার সুরক্ষা নিয়েই তাঁর কাজকর্ম। তিনি এক ব্যতিক্রমী প্রযুক্তিবিদ ও শিক্ষক, যিনি বিজ্ঞানকে প্রকৃত অর্থে হাতেকলমে নেড়েচেড়ে মানুষের কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর বরফ-স্তূপ লাদাখের মানুষের জল সমস্যা মেটানোর এক অভিনব প্রক্রিয়া। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তির ফলেই ভারতের এই সংবেদনশীল সীমাঞ্চলে প্রবল ঠাণ্ডায় থাকা সৈনিকদের জন্য সৌর তাঁবু তৈরি করা গেছে। প্রকৃতির শৌর্য ও শক্তির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে থাকায় আজ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট ও হিমালয়ের সম্ভাব্য বিপর্যয়ের দিকে খেয়াল রেখে তিনি একের পর এক উদ্ভাবনের কথা ভেবেছেন এবং সকলের সহযোগিতায় এক বিকল্প পথের সন্ধান করে চলেছেন। এমন মানুষকে যখন বিশ্ব স্বীকৃতি দেয়, তখন তাঁর ওপর রাষ্ট্র এবং গোদী মিডিয়া চটে কেন? কারণ একটাই, যে কর্পোরেটের সেবা করার দায় রাষ্ট্র ও তার পেটোয়া চতুর্থ স্তম্ভের, সেই কর্পোরেটের বিরুদ্ধেই সরব সোনমরা। তাঁদের আন্দোলন হিমালয়ের পরিবেশ ধ্বংসের মতো বিষয়কে সরাসরি কর্পোরেট আগ্রাসনের সঙ্গে যুক্ত করে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর সে কারণেই লাদাখবাসীর এই আন্দোলনকে মূলধারার রাজনীতি ও সমাজমাধ্যম নির্লজ্জভাবে অগ্রাহ্য করে চলেছে।‌ মুনাফাবাজরা তার ধারেকাছেও যাবে না। তাদের কাছে মাটির ওপরে বা নীচে যা যা পাওয়া যায় সমস্তই পণ্য, তা লুঠে নিয়েই তারা মুনাফার পাহাড় গড়বে। 

এই অবস্থায় লাদাখ ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত হলে কী হবে? হবে, কিছুটা সুরাহা হবে। যেহেতু লাদাখের জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত, তাই খানিকটা সুরক্ষা পাওয়া যাবে। স্থানীয় মানুষের ভাবনাও তেমনই। তফসিলি জনজাতির জাতীয় কমিশন থেকেও সেই সুপারিশ করা হয়েছে। সোনমদের আন্দোলনও তাই অব্যাহত।


Thursday, 17 October 2024

২০২৪: অর্থনীতিতে নোবেল

প্রতিষ্ঠান একটি সামাজিক চয়নের বিষয়

অচিন চক্রবর্তী



সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন ও পোল্যান্ড দুটি সার্বভৌম দেশ। ইউক্রেনের অর্থনীতি তখন যথেষ্ট এগিয়ে – শিল্পোন্নত, প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অভাব নেই, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে উন্নয়নের নিরিখে পোল্যান্ড রয়েছে অনেক পিছনে। অথচ পরবর্তী তিন দশকে দেখা গেল ইউক্রেনের অর্থনীতি প্রায় স্থবির, সমস্যায় জর্জরিত আর পোল্যান্ডের মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়ে হল প্রায় তিন গুন। কেন এমন হল? কেন এমন হয়? বুঝতে গেলে এই দু' দেশের প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে তাকাতে হবে। 

এখন অনেকে স্বাভাবিকভাবেই মনে করেন, জটিল জালের মতো বিছানো প্রতিষ্ঠানগুলির উপর সমাজ প্রগতি নির্ভর করে থাকে। সেগুলি বিবাদের নিষ্পত্তি করে, বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে, বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়, পরিবেশকে সুরক্ষা দেয় ইত্যাদি। খেলার নিয়ম স্থির করে দেওয়াই প্রতিষ্ঠানের কাজ। সে নিয়ম আইনের চেহারায় থাকতে পারে, না হলে প্রচলিত রীতি হিসেবেও। পোশাকি আইন আর প্রচলিত রীতি মিলেমিশেই হয় এক একটি প্রতিষ্ঠান। ভারতে জাতপাত সে অর্থে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান যেমন ডিজাইন মেনে স্থাপন করার চেষ্টা হয়, আবার তা দীর্ঘ সময় ব্যেপে বিবর্তিতও হতে পারে। ইউক্রেনের ব্যর্থতার কারণ যদি হয় বাড়াবাড়ি রকম দুর্নীতি, তাহলে দুর্নীতির কারণ খুঁজতে হবে সে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলিতে। পোল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, সেগুলি দুর্নীতি ঠেকাতে যে তেমন কার্যকরী হয়নি, তার ব্যাখ্যা তাদের প্রকৃতিতেই খুঁজে পাওয়া যাবে। 

আগেই বলেছি, প্রতিষ্ঠান বলতে বুঝব খেলার নিয়ম, যাকে বলে ‘রুলস অফ দ্য গেম’। রাষ্ট্র যেমন একটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাও একটি প্রতিষ্ঠান, আবার দাস-ব্যবস্থাও একটি প্রতিষ্ঠান। যে কোনও ব্যবস্থারই মর্মবস্তুতে রয়েছে একগুচ্ছ নিয়ম যা মানুষের আর্থনীতিক কাজকর্মকে নির্ধারণ করে। সোভিয়েত-উত্তর ইউক্রেনে একটি ছোট এলিট গোষ্ঠী সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। এঁরাই আবার সোভিয়েত যুগে ক্ষমতার সিঁড়ির মাথায় ছিলেন। ফলে, খেলার নিয়মও বেঁকিয়ে-চুরিয়ে এমন করা হল যাতে তাঁদের স্বার্থ রক্ষা হয়, দেশের অর্থনীতির নয়। এমতাবস্থায় সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনীহা দেখা দেবে উৎপাদন ও নতুন প্রযুক্তি-উদ্ভাবনের জন্যে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগে, যার পরিণতি অর্থনীতির মন্দগতি। 

ডারন আসেমগলু, সাইমন জনসন এবং জেমস রবিনসন আর্থনীতিক প্রগতি বা তার নিম্নগতিকে বিশ্লেষণ করেছেন এই প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যাখ্যা যে তাঁরাই প্রথম দিলেন তা নয়। অতীতে অনেক বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রীই নানান ছাঁদে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ডগলাস নর্থ তো আর্থনীতিক ইতিহাসের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক তত্ত্বায়নের জন্যে নোবেল পুরস্কারই পেয়েছিলেন ১৯৯৩-এ। নর্থ-অনুসৃত বিশ্লেষণ-ধারাকে বলা হয় ‘নিউ ইনস্টিটিউশনাল ইকনমিকস’। তবে আসেমগলু-জনসন-রবিনসনদের তত্ত্ব নর্থের থেকে অনেকটাই আলাদা। নর্থের তত্ত্বে সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। সম্পত্তির মালিকানা অস্পষ্ট থাকলে বাজার বিস্তার লাভ করতে পারে না। তাই যে রকম প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মুক্ত বাজারের বিস্তারে সহায়ক তা-ই আর্থনীতিক বৃদ্ধিও ঘটাতে পারে, নর্থের মতে। উন্নত দেশগুলির ইতিহাস নাকি সে রকমই বলে। কিন্তু এবারের নোবেল প্রাপক তিন অর্থশাস্ত্রী প্রতিষ্ঠানের গবেষণা নিয়ে গেছেন অন্য খাতে। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার। নর্থের মতো মুক্ত-বাজার-সহায়ক প্রতিষ্ঠানে তাঁরা আটকে থাকেননি। তিনজনের জোটকে নোবেল কমিটি স্বীকৃতি দিলেও ধারে এবং ভারে আসেমগলুর নামই প্রথমে আসবে। 

আসেমগলুদের মতে প্রতিষ্ঠান মূলত দুরকম হতে পারে। এক ধরনের প্রতিষ্ঠান আহরণমূলক বা এক্সট্র্যাকটিভ, যা উৎপাদন ও উদ্ভাবনকে প্রণোদনা দেওয়ার বদলে যেটুকু যা সম্পদ তৈরি হচ্ছে তা-ই বিশেষ ক্ষমতাধারী গোষ্ঠী বা শ্রেণিকে পাইয়ে দেয়। আর্থনীতিক কাজকর্মের থেকে উদ্ভূত ফল অসম অনুপাতে সেই গোষ্ঠীরই হস্তগত হয়। ধরা যাক দাস ব্যবসা, যা দীর্ঘকাল চলেছে নির্দিষ্ট সামাজিক রীতি (নর্ম) ও নির্দেশ (কম্যান্ড) নির্ভর করে, উচ্চ শ্রেণিদের স্বার্থর দিকে লক্ষ রেখে। এও এক ধরনের এক্সট্র্যাকটিভ প্রতিষ্ঠান। এক সময়ে বামপন্থী বিশ্লেষণে ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ‘আধা-সামন্ততন্ত্র’ কথাটি খুব ব্যবহৃত হত। এই ব্যবস্থায় জমির মালিক তথা ঋণদাতা ভাগচাষীকে এমন সুযোগ দেবেন না যাতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায়, চাষির আয় বাড়ে এবং তিনি ঋণমুক্ত হন। এ ক্ষেত্রে বর্গাদারী ব্যবস্থাটিকে বলা যায় এক্সট্র্যাকটিভ, যা কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক নয়। এখন আমাদের ঘরের কাছে আছে অতি পরিচিত 'সিন্ডিকেট' নামক আহরণমূলক প্রতিষ্ঠানটি। পাঠক কল্পনা করে নিতে পারেন, সেটি না থাকলে পশ্চিমবঙ্গের ইমারত শিল্পের প্রগতি কেমন হতে পারত।   

তাহলে অন্যরকম প্রতিষ্ঠানটি কেমন? সেটি এরকম আহরণমূলক নয়, যাকে আসেমগলুরা বলছেন ‘ইনক্লুসিভ’ বা সমন্বিত। সেখানে আর্থনীতিক উদ্যোগ এবং পরিশ্রম যথাযথ পুরস্কৃত হবে; বাজারে সকলের সমান অন্তর্ভুক্তিতে কোনও রাজনৈতিক বা জাত পরিচয় বাধা হবে না। ইতিহাস ঢুঁড়ে দেখলে এই দু প্রকার প্রতিষ্ঠানেরই অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। আসেমগলুদের কৃতিত্ব তাঁরা কয়েক শতকের পরিসংখ্যান ঘেঁটে, আঁটোসাঁটো সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করে, সমন্বিত প্রতিষ্ঠান ও আর্থনীতিক প্রগতির মধ্যে জোরালো সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছেন।    

এই পদ্ধতি অনুসরণ করে দেখানো যায় তথাকথিত ‘ভাগ্যের ডিগবাজি’। মাথাপিছু আয়ের নিরিখে মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া বা আফ্রিকায় সাহারার নীচের দেশগুলি – যাদের সাধারণভাবে ‘উন্নয়নশীল’ বলা হয় – তাদের থেকে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। উন্নয়নের অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ে পশ্চাদপদতার যে কারণগুলি উল্লেখ থাকত তা হল পুঁজিতে বিনিয়োগ কম, শিক্ষার ধীরগতি প্রসারের কারণে মানব পুঁজির অভাব, প্রায় অচল প্রযুক্তি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলি সবই যাকে বলা যায় ‘সমীপবর্তী কারণ’, যে কারণের আবার গভীরতর কারণ থাকা সম্ভব, যাকে বলা যায় ‘মূল কারণ’। মার্কসীয় তত্ত্বে এই ‘মূল কারণ’ খোঁজা নিয়ে হাসিঠাট্টাও কম হয়নি। যেমন, ধরা যাক জনৈক মদ্যপ বেসামাল হয়ে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সমীপবর্তী কারণ হিসেবে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোকে যেমন চিহ্নিত করা যায়, আবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তি মানুষের বিচ্ছিন্নতা এবং তার মদ্যপ হয়ে ওঠার সম্পর্ক দেখিয়েও কেউ বলতে পারেন দুর্ঘটনায় এই মৃত্যুর আসল কারণ পুঁজিবাদী সমাজ। মজার ব্যাপার হল, সমাজবিজ্ঞানে এই সমীপবর্তী কারণ থেকে গভীরে প্রোথিত মূল কারণে পৌঁছনোর কোনও সোজাসাপটা ফর্মুলা নেই।  

উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়াটি আসেমগলুরা খুব গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন, যে পাঠে অর্থনীতির সঙ্গে ভূগোল, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে মেশাতে হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়নের ইতিহাসের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ ভৌগোলিক পার্থক্যকে কেন্দ্রে রাখতে চান। যুক্তিটা হল, পেছিয়ে পড়া দেশগুলির অধিকাংশই রয়েছে নিরক্ষরেখার আশপাশে, যেখানে বৃষ্টিপাত বেশি এবং গ্রীষ্মমণ্ডলে বিদ্যমান রোগভোগের (যেমন ম্যালেরিয়া) প্রাদুর্ভাব বেশি। আসেমগলুরা বললেন, ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থনীতিক অনুন্নয়ন, এরকম দুটি বৈশিষ্টের মধ্যে সহগতির সম্পর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু তা থেকে বলা যায় না একটি (ভৌগোলিক অবস্থান) অন্যটির (অনুন্নয়ন) কারণ। উপনিবেশায়নের ইতিহাস সেটি প্রমাণ করার সুযোগ এনে দেয়। ভূগোল যদি নির্ধারক হত তাহলে তো উপনিবেশায়নের আগে যে সব অঞ্চল সমৃদ্ধ ছিল তারাই থাকত আজকের উন্নত বিশ্বে, আর তখন যারা পিছিয়ে ছিল এখনও তাদেরই পিছনে থাকার কথা। কিন্তু তা হয়নি। উপনিবেশায়নের ফলে এক প্রকার ‘ভাগ্যের ডিগবাজী’ বা ‘রিভারসাল অব ফরচুন’ ঘটে গেছে; সমৃদ্ধশালী অঞ্চল তাদের জৌলুস হারিয়ে ঢুকেছে আজকের উন্নয়নশীল পরিবারে, আর সেকালের অনুন্নত অঞ্চল হয়েছে এখনকার উন্নত বিশ্ব। এই সামান্যীকরণে একটু ফাঁক-ফোকর থাকলেও মোটের উপর গ্রহণযোগ্য। 

ভূগোল-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যার দুর্বলতা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু এ থেকে ভাল প্রতিষ্ঠান আর খারাপ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বে কীভাবে উপনীত হলেন তাঁরা? ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয়রা তাদের বিভিন্ন উপনিবেশে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে এবং তার ফলে যে আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলি গুরুত্ব পেয়েছে তারা একই রকম নয়। বেলজিয়ান উপনিবেশ কঙ্গো থেকে শুরু করে ক্যারিবিয়ান এবং মধ্য আমেরিকার খনি – সর্বত্রই দমনমূলক শ্রম প্রক্রিয়া দেখা যায়, যা আহরণমূলক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উদাহরণ। ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও তাই। অন্যদিকে ‘নতুন বিশ্ব’ উত্তর আমেরিকা এবং কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ইউরোপীয়রা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে দেশগুলিকে নিজেদের পছন্দসই ধাঁচে গড়ে তুলে। স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার একটি কারণ অবশ্য রোগবালাই সেখানে কম। অন্যদিকে জমি অঢেল কিন্তু খাটার লোকের অভাব। ফলে, স্থানীয়দের একাংশের সঙ্গে আঁতাত করে অন্যদের শ্রমে বাধ্য করে সম্পদ আহরণের যে প্রাতিষ্ঠানিক মডেলটি মধ্য আমেরিকা ও কারিবিয়ানে গজিয়ে উঠল, তা সে সব দেশে চলবে না। এই দেশগুলিতে তাই প্রতিষ্ঠানগুলি এমন চেহারা নিল যা ব্যক্তির উদ্যোগকে পুরস্কৃত করতে সম্পত্তির অধিকারে জোর দিল; প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার গুরুত্ব পেল। সেই সঙ্গে অবশ্য দাস ব্যবসার মতো কুৎসিত ব্যাপারও চলতে থাকল। কিন্তু সেইসব অর্থনীতির দ্রুত উত্থানের পক্ষে দাস ব্যবসা অন্তরায় হওয়ার কথা নয়।

অর্থনীতির প্রগতির সঙ্গে সমন্বয়ী প্রতিষ্ঠানের জোরালো সম্পর্ককে কঠোর পদ্ধতির সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করায় এই ত্রয়ী অভিনন্দনযোগ্য। সমাজবিজ্ঞানে কোনও তত্ত্বই তর্কাতীত নয়। তর্ক থাকবে। এই তর্ককে উসকে দেওয়ার কাজটি শুধু অর্থনীতির উচ্চস্তরের গবেষণা পত্রিকায় পেপার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে হয় না। তাই আসেমগলুরা তাঁদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান সেভাবে আটকে রাখেননি। গবেষণার নির্যাস নিয়ে আসেমগলু ও রবিনসন ‘হোয়াই নেশানস ফেল’ শিরোনামে একটি চমৎকার বই প্রকাশ করেন বারো বছর আগে যা অর্থনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে যে কোনও সিরিয়াস পাঠকের আগ্রহের সঞ্চার করবেই। আসেমগলু ও জনসনের সাম্প্রতিক বই ‘পাওয়ার এন্ড প্রগ্রেস’ও অবশ্যপাঠ্য মনে করি। 

প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন – যা আমাদের এনে ফেলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার টালমাটাল ক্ষেত্রে – নানান উদ্বেগের জন্ম দিয়ে চলেছে ক্রমাগত। আসেমগলু ও জনসন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কার লাভ কার ক্ষতি এই প্রশ্নটি গত সহস্র বছরের মতো আজও প্রাসঙ্গিক। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান সমূহই নির্ধারণ করে দেয় লাভক্ষতির ভাগাভাগি কেমন হবে। মনে রাখতে হবে, সমাজই চয়ন করতে পারে ন্যায্য প্রতিষ্ঠানটিকে।


Saturday, 5 October 2024

নারী শ্রমিকদের লড়াই

শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল পাহাড়

অতনু চক্রবর্তী



আবার উত্তাল হল পাহাড়। দীর্ঘ আট বছর পর পাহাড় আবার দেখল সর্বাত্মক বনধ। তাও আবার মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের মাঝখানে। এবার বনধ ডাকা হয়েছিল চা বাগান শ্রমিকদের পুজো বোনাসের দাবিতে, যৌথ মঞ্চের পক্ষ থেকে। দার্জিলিং পাহাড়ের চা বাগিচার নারী শ্রমিকদের বর্ণময় পোশাক ও বিভিন্ন পাহাড়ি রাস্তা ধরে স্লোগান মুখরিত দৃপ্ত মিছিল, উত্তোলিত মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আবার চা বাগিচার অ্যাজেন্ডাকে সামনে নিয়ে এল। 

পর্যটনের ভরা মরশুমে পাহাড়ে প্রবল বৃষ্টির সাথে নানা জায়গায় নেমে আসা ধস, চা বাগানে কর্মবিরতি গোটা শৈল শহরে এখন যেন নিত্যদিনের ছবি। প্রতিবারের মতো এবারেও চা বাগিচার মালিকদের সাথে  শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর অনেকগুলো বৈঠক, বিস্তর দর কষাকষির পর রাজ্য শ্রম দফতরের মধ্যস্থতায় ১৬ শতাংশ বোনাস ঘোষিত হয়। এই বোনাস ঘোষণার পরেই পাহাড়ের চা বাগিচার শ্রমিকরা বেঁকে বসেন। তাঁরা ২০ শতাংশ বোনাসের দাবিতে শুরু করেন আন্দোলন। ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারটে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়। ওইদিন, অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকটি ভেস্তে যাওয়ার পর ৩০ সেপ্টেম্বর ১২ ঘন্টার বনধের ডাক দেয় আটটি ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ মঞ্চ। সেই সময় উত্তরবঙ্গ সফররত মুখ্যমন্ত্রী 'বনধ হচ্ছে না ' বলে বিবৃতি দিলেও বনধ হয় সর্বাত্মক। রাজ্য শ্রম দফতর দার্জিলিং চা শিল্পকে অবিলম্বে ১৬ শতাংশ বোনাস প্রদানের জন্য ১ অক্টোবর অ্যাডভাইজারি পাঠালে ইউনিয়নগুলি সম্মিলিতভাবেই তা সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করে বনধের ডাক দেয়। তাদের দাবি, তরাই ডুয়ার্সের বাগানগুলোর তুলনায় দার্জিলিং'এর চা থেকে অনেক বেশি মুনাফা আসে। তাই, বোনাসের ক্ষেত্রে তরাই ডুয়ার্সের সাথে সমতা বজায় রাখার যে যুক্তি সরকার দিয়েছে, তা পাহাড়ের ইউনিয়নগুলো মানতে প্রস্তুত নয়। 

দার্জিলিং পাহাড়ের ৮৭টি বাগানে বোনাস নিয়ে ত্রিপাক্ষিক আলোচনার সময় মালিকরা জানায় ২০ শতাংশ বোনাস দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ বোনাসে তারা রাজি হয়। এরপর থেকে পাহাড়ের  চা শিল্পে অশান্তি নেমে আসে। বনধ, কর্মবিরতি শুরু হয়ে যায়। জয়েন্ট ফোরাম'এর ডাকে ধর্মঘটকে জিটিএ'র চিফ একজিকিউটিভ অনীত থাপারের দল 'ভারতীয় জনতা প্রজাতান্ত্রিক পার্টি' সক্রিয় সমর্থন করে। 

ডুয়ার্সের নাগেশ্বরী ও কিলকোট চা বাগানের নারী শ্রমিকরাও ন্যায্য বোনাসের দাবিতে প্রতিবাদে মুখর হন। পিএফ-গ্রাচুইটির পর এবার এই দুই বাগানে ন্যায্য বোনাসের দাবিও বাগানগুলির পরিচালন সমিতি মানতে প্রস্তুত নয়। চা বাগানের পরিচালন সমিতির সিদ্ধান্ত হল, যে বাগানগুলো বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে সেখানে ৯ শতাংশ, আর যেগুলো চালু সেখানে ১৬ শতাংশ বোনাস দেওয়া হবে। কিন্তু, উল্লিখিত বাগান দু'টি চালু থাকলেও মেরিকো কোম্পানি সেখানে ৯ শতাংশের বেশি বোনাস দিতে প্রস্তুত নয়। এমনকি এ নিয়ে শ্রমিকদের সাথে আলাপ আলোচনার জন্যও তারা রাজি নয়। এই দুই বাগানের শ্রমিকদের দাবি, মালিকপক্ষ বিগত দিনে যথেষ্ট মুনাফা পেয়েছে, তাই তাদেরও ২০ শতাংশ বোনাস পাওয়া উচিত। এই দুটি বাগানের নারী শ্রমিকরা মেটালি থানা ঘেরাও করেন, প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ৮ কিলোমিটার পথ ধরে মিছিল করেন, কিছু জায়গায় পথ অবরোধও করা হয়।

এ কথা ঠিক, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, চা গাছগুলোতে এক ধরনের পোকা প্রভৃতি কয়েকটি কারণে চা পাতার উৎপাদনশীলতা বেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, দার্জিলিং'এ বহুজাতিক সংস্থাগুলো নিত্য নতুন চা বাগিচা কিনে নিচ্ছে, মালিকানারও হাত বদল হচ্ছে। শ্রমিকদের প্রশ্ন, চা শিল্প যদি রুগ্ন হয়, তবে নতুন নতুন বাগান হস্তগত করতে বহুজাতিকেরা কেন পিছপা হচ্ছে না! ২০২২ সালে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি এক রিপোর্টে জানায়, 'চা বাগিচার শ্রমিকদের নিদারুণ দুর্দশা ও অমানবিক জীবন ধারণের মান মনে করিয়ে দেয় ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ চা মালিকদের আমল। এরা আজও বাঁধা মজুরের মতো দিন যাপন করে।... দার্জিলিং'এর চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দেশের সমস্ত শিল্প শ্রমিকদের চেয়ে সবচেয়ে কম!' উচ্চমূল্যে রফতানিকৃত দার্জিলিং'এর চা পাতা বিপুল মুনাফা কামালেও শ্রমিকদের মজুরি আজও রয়ে গেছে তলানিতে। 

দেশে চা সহ বাগিচা শিল্পে মজুরির প্রশ্নে রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে বিস্তর তফাত। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে চা বাগিচা রয়েছে। এখানকার উৎপাদনশীলতা দক্ষিণী রাজ্যগুলোর সমান হলেও দক্ষিণ ভারতের তুলনায় উত্তর-পূর্ব ভারতের উৎপাদিত চায়ের নিলাম মূল্য দক্ষিণের রাজ্য থেকে অনেক বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, দক্ষিণ ভারতের তুলনায় উত্তর-পূর্ব ভারতে চা শিল্পের মজুরি অনেক কম, প্রায় অর্ধেক! 

এ রাজ্যে চা শিল্পের ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষের সাথে রাজ্য শ্রম দফতর পরের পর বৈঠক করার পর অবশেষে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হয় দৈনিক ২৫০ টাকা। অন্তর্বর্তীকালীন এই দৈনিক মজুরি মালিকপক্ষ মানতে অস্বীকার করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু হাইকোর্ট মালিকপক্ষের এই আবেদন খারিজ করে ১ আগস্ট থেকেই নতুন মজুরি কার্যকরী করার আদেশ দেয়। গত বছরের সাপেক্ষে এই অন্তর্বর্তীকালীন মজুরি বৃদ্ধি হয় মাত্র দৈনিক ১৮ টাকা! অসমে ২০২২ সালে ২৭ টাকা মজুরি বৃদ্ধি হয়, ফলে ১ আগস্ট থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তা হয়ে দাঁড়ায় ২৩২ টাকা, আর বরাক উপত্যকায় হয় ২১০ টাকা। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, যা ক্ষমতায় আসার পর তারা কিছুটা পালন করতে বাধ্য হয়।

এবার দেখা যাক, দক্ষিণ ভারতে চা শ্রমিকরা কত মজুরি পান। কেরলে এই মজুরি দেশের মধ্যে সর্বাধিক (৪২১.২৬ টাকা)। তারপর তামিলনাড়ু (৪০৬.৮০ টাকা), কর্নাটক (৩৭৬.৭৮ টাকা)। বিহার ও ত্রিপুরায় মজুরি সর্বনিম্ন: যথাক্রমে ১৭৫ ও ১৭৬ টাকা। বোঝাই যাচ্ছে, দক্ষিণী রাজ্যগুলোর তুলনায় উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর মধ্যে মজুরির প্রশ্নে রয়েছে আসমান জমিন পার্থক্য। তা সত্ত্বেও এ রাজ্যগুলোর মালিকপক্ষ লোকসানের অজুহাতে মজুরি বৃদ্ধিতে সম্মত নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০০- ২০১৫ পর্যন্ত এ রাজ্যের ডুয়ার্স অঞ্চল দেখেছিল ১৪০০ অনাহার মৃত্যু, আজও বহু শ্রমিক অর্ধাহারে অপুষ্টিতে ক্ষীণ দেহে কাজ করতে বাধ্য হন।

অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক শোভার বেষ্টনীতে নারী শ্রমিক প্রধান এই চা শিল্পের শ্রমিকরা সমস্ত দিক থেকে বঞ্চিত। মজুরির ক্ষেত্রে প্রকট লিঙ্গ অসাম্য, সমস্ত সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চনা, সামাজিক সুরক্ষাহীন এই অগণন নামহীন অবয়বহীন নারী শ্রমিকদের অমানুষিক শ্রমে উৎপাদিত চা পাতা বিশ্ব বাজারে 'ভারতের শ্যাম্পেন' হিসাবে খ্যাত। তাঁদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট চোখের জল আমরা শহুরে মধ্যবিত্তরা ঠাহর করতে পারি না। সকালে চায়ের প্রতিটি চুমুকের অন্তরালে চোখের জলের এই বেদনা আমরা কবে বুঝব?