Wednesday 20 March 2024

প্রোমোটারের দাপট

নগর যখন ভেঙ্গে পড়ে!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

কলকাতা পৌরসভার ১৩৪ নং ওয়ার্ডে অবৈধ ভাবে নির্মীয়মাণ একটি বহুতল ভেঙ্গে এখন পর্যন্ত দশজনের মৃত্যুতে তুমুল সোরগোলের পর প্রোমোটার মহঃ ওয়াসিম ও জমির মালিককে গ্রেফতারি কতটা ক্ষতে মলম দেবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কারণ, শহরতলির অলিতে গলিতে চলমান যে অবৈধ হাইরাইজের নির্মিতি তা একদিনের ঘটনাক্রম নয় এবং ভবিষ্যতে যে এর ইতি ঘটবে তার তেমন কোনও ইঙ্গিতও নেই। সস্তার মালমশলায় ছোট ছোট খুপরিতে নাগরিকদের মাথা গোঁজার ঠাই করে দিতে যে ‘সামাজিক ব্যাধি’ (মেয়রের ভাষায়) আজ শহরের আনাচে কানাচে ডানা মেলেছে, তার রসদ বহু গভীরে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগও যথেষ্ট সুবিদিত।

যদিও কাউন্সিলর অতীন ঘোষ এই দুষ্ট চক্রে রাজনৈতিক যোগের কথা স্বীকার করেছেন, এমনকি রাজ্যের শাসক দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষও অন্তর্নিহিত গভীর অন্যায়ের তদন্তের দাবিকেও মান্যতা দিয়েছেন, কিন্তু মহানাগরিক বিষয়টিকে ঠেলতে চেয়েছেন শুধুমাত্র প্রশাসনিক অকর্মণ্যতার দিকেই। বলাই বাহুল্য, এই ব্যাধি সাম্প্রতিক নয়, গত ২০-২৫ বছর ধরেই প্রোমোটার-দাপটে বহু অঞ্চলে সাধারণ নাগরিক যাপনে এক অস্থিরতা শুধু বিরাজই করেনি, উত্তরোত্তর তার ক্রমবৃদ্ধি এক তীব্র সংকটেরও জন্ম দিয়েছে। পুকুর ও জলাভূমি বুজিয়ে, নাগরিক পরিসরের সুস্থিতিকে তছনছ করে এর প্রকোপ দিনের পর দিন প্রবলতর হয়েছে। ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে সাহস করে বহু মানুষ এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছেন, তৎক্ষণাৎ প্রশাসনিক আধিকারিকেরা ঘটনাস্থলে ছুটেও গিয়েছেন, কিন্তু কোনও এক যাদুবলে আবার তা কিছুদিন পরে ধামাচাপাও পড়ে গিয়েছে। বহু জায়গায় মানুষ নালিশ জানাতে ভয়ও পেয়েছেন। অর্থের জোর ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ‘সব ঠিক হ্যায়’ গোছের এক ভারসাম্য বজায় থেকেছে। বাইক নিয়ে সপার্ষদ এই প্রোমোটারেরা এমন মেজাজে এলাকায় ঘুরে বেড়ায় যে নিরীহ জনতার কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে তাদের বিরুদ্ধে কোথাও অভিযোগ জানানোর।

এই প্রবণতা শুধু কলকাতা শহরেই নয়, ভারতবর্ষের বহু মহানগরে আজ নাগরিক জীবনের কাছে এক ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতার অ্যাডেড এরিয়ায় যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাট রাস্তার পরিসর, পয়ঃপ্রণালীর বহন ক্ষমতা, পানীয় জলের জোগানের নাব্যতা- কোনও কিছুকেই ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে না। আট-দশ ফুটের রাস্তায় দেড়-দু কাঠা জমিতেও অবাধে উঠে যাচ্ছে তিন-চারতলার ফ্ল্যাটবাড়ি। নির্মাণের শুরুতে লোকদেখানো নিয়ম মেনে আইন অনুসারে জমির কিছু অংশ রাস্তায় ছাড় দিয়ে ছোট পাঁচিল তুলে নির্মাণ সম্পূর্ণ করে তারপর সেই পাঁচিল ভেঙ্গে ছাড় দেওয়া রাস্তাকে আবার জমির অংশে ঢুকিয়ে নতুন করে পাঁচিল তুলে দেওয়া হচ্ছে। খুপরি ফ্ল্যাটের সংখ্যা বাড়াতে ও ঘরগুলিকে ঈষৎ বড় করতে নিয়মমাফিক জমির চারধারে ছাড় দেওয়ারও কোনও বালাই নেই। এইগুলি যে স্থানীয় কাউন্সিলর বা পৌরসভার আধিকারিকেরা জানেন না তেমনও নয়। কৌশলটা ভারী চমৎকার। হুড়হুড় করে ফ্ল্যাট তুলে চটজলদি তা বিক্রি করে দিলেই কেল্লা ফতে! কারণ, একবার ফ্ল্যাটবাড়িতে লোক ঢুকে গেলে ‘মানবিকতা’র স্বার্থে সে ফ্ল্যাটের অবৈধ অংশ আর নাকি ভাঙ্গা যায় না, এই যুক্তিতেই সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে যাবতীয় অপরাধ। উপরন্তু, ‘কমপ্লিশন সার্টিফিকেট’ বা ‘সিসি’ নেওয়ারও দায় প্রোমোটারদের নেই! তারা বিক্রি করেই ধা! ক্রেতারা এবার পৌরসভার দরজায় দরজায় ‘সিসি’র জন্য হন্যে হয়ে দৌড়চ্ছে মিউটেশনের জন্য।

আসলে, কলকাতা এবং মফস্বল শহরগুলিতে নগর পরিকল্পনা বলে কিছুই নেই। দু-একটি পার্ক তৈরি করে নগর পরিকল্পনার দায় ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে। একটি পাড়া বা অঞ্চলে যেখানে রাস্তা অপ্রশস্ত, সেখানে বাড়িগুলির উচ্চতা কত দূর অবধি হতে পারে, ঘিঞ্জি পরিসরকে কতটা নিরাময় দেওয়া যায়, সে সবের কোনও দায়-ই নেই। সল্ট লেক বা নিউ টাউন যে ভাবে পরিকল্পনা করে গড়ে তোলা হয়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও দ্রুত নগরে পরিণত হতে থাকা দূর-দূরান্তের শহরতলির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এখানে যেনতেন প্রকারেণ জমি হাতিয়ে ফ্ল্যাট তুলে বিক্রি করে দেওয়ার মধ্যেই নগরায়নের যাবতীয় কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত। ফলে, শহরতলি যেন ক্রমেই হয়ে উঠছে ইট-কংক্রিটের নতুন ‘পাকা’ বস্তি। আট কি বারো ফুটের রাস্তার ওপর দু-কাঠা জমিতে নির্মিত চার-পাঁচতলা ফ্ল্যাটের মধ্যে বাস করছেন প্রায় ৬০ থেকে ৮০ জন মানুষ। বহু জায়গায় পরিশ্রুত পানীয় জলের জোগান নেই, ফলে ডিপ টিউবেল বসিয়ে এতগুলি লোককে জল জোগাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে পাতালপুরী। আর এ তো একটা মাত্র ফ্ল্যাটে নয়, এরকম পাড়ায় পর পর দশটা বাড়িকে গুনতি করলে তার মধ্যে ৭ থেকে ৮টা বাড়িই এখন ফ্ল্যাট। অতএব, পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক তা সহজেই অনুমেয়।

নিম্নমানের সস্তা মশলায় তৈরি ফ্ল্যাট ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কাই শুধু নয়, বিক্রির দু-তিন বছরের মধ্যে ক্রেতারা নিজ নিজ ফ্ল্যাটের অবস্থা দেখেও কপাল চাপড়াচ্ছেন। কোথাও পিলারে ক্র্যাক তো কোথাও ছাদ ভিজে উঠছে বৃষ্টির চুইয়ে পড়া জলে; অথবা, ঘরের দেয়ালে ফাটল নয়তো মেঝে উঠছে ঘেমে। সে ফ্ল্যাট বিক্রি করে পালানোর পথও নেই। কারণ, এই অবস্থায় নতুন ক্রেতাও অমিল। সময় গড়াতে ফ্ল্যাটগুলির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ছে যে তা একপ্রকার মনুষ্য-বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। শরীর হয়ে পড়ছে রোগের ডিপো; শিশু অথবা বাচ্চাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ঘরে বা বারান্দায় জামাকাপড় মেলবার জায়গা নেই, ছাদে মেলতে গিয়ে সামান্য পরিসরে ফ্ল্যাট-প্রতিবেশীদের মধ্যে লেগে যাচ্ছে ধুন্ধুমার কাণ্ড। সব মিলিয়ে, স্থান সংকুলানের গোদের ওপর রোগভোগের বিষফোঁড়া।

কিন্তু কেন এই বাধ্যবাধকতা? ফ্ল্যাট বানালেই যে বিক্রি হবে তার তো কোনও মানে নেই। এখানেই একটি মজার চিত্র লুকিয়ে আছে। ছোট জমির ওপর ফ্ল্যাট তুলতে গিয়ে যদি পৌরসভার বিধি (জমি ছাড় ইত্যাদি) অমান্য করা যায়, ৪০০ থেকে ৫০০ বর্গ ফিটের অনেকগুলি ছোট ছোট ফ্ল্যাট একেকটা ফ্লোরে নির্মাণ করা যায়, বেআইনি ভাবে যতটা সম্ভব তলা (তিন থেকে পাঁচ) বাড়ানো যায়, এবং যতটা সম্ভব রড, সিমেন্ট ও স্টোনচিপে কারচুপি করে মশলা তৈরি করা যায় তাহলে এক লপ্তেই যে বিপুল মুনাফা ওঠে তা লটারিতে প্রথম পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়। অতএব, আপাত-দৃশ্যে ‘সস্তায়’ এই ক্ষুদ্রকায় ফ্ল্যাটগুলি নগদের বিনিময়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের হাতে সহজেই তুলে দেওয়া যায়। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতার আপাত ভারসাম্যও সাধিত হয়। বলাই বাহুল্য, এই কারবারটা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগ ব্যতিরেকে একেবারেই অসম্ভব। অন্যদিকে, ফ্ল্যাট তৈরির জমিগুলি আসে দুই তরফ থেকে- এক) পারিবারিক উত্তরাধিকারে একাধিক ওয়ারিশ হয়ে যাওয়ায় কারওরই যখন তেমন প্রাপ্তি কিছু নেই, প্রোমোটারের হাতে তুলে দিলে বরং ফ্ল্যাট নয়তো নগদ মিলতে পারে; দুই) অবসরের পরে বাড়ি করার উদ্দেশ্যে, ২০-২৫ বছর আগে সস্তায় কিনে রাখা ২-৩ কাঠা জমির বিনিময়ে যদি মুফতে ফ্ল্যাট ও নগদ মিলে যায় তাহলে তার থেকে সহজে কিস্তিমাত আর কী হতে পারে!

তাই, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা প্রোমোটার-রাজ যে আজ শুধু এক ‘সামাজিক ব্যাধি’ নয়, বরং, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগসাজসে এক মাফিয়া-রাজ, এবং নগর-বিধ্বংসী প্রকল্প, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। বার বার একেকটা ইমারত ভেঙ্গে পড়বে, মানুষের মৃত্যু-মিছিল দেখা দেবে, সকলে আপাত সজাগ হবেন, কিছুটা হৈচৈ হবে। কয়েকদিন সব শান্ত থাকবে। সব মিটে গেলে আবার, নীরবে মৃত্যুসজ্জা তৈরি হবে। আমরা কখনও দাবি তুলব না যে,

১) শহরের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল ব্যতিরেকে কোথাও হাইরাইজ তোলা যাবে না;

২) অন্তত ১৬ ফিট প্রশস্ত রাস্তা না হলে দোতলার বেশি তল তৈরির অনুমতি দেওয়া যাবে না;

৩) প্রোমোটার ‘সিসি’ না পাওয়া পর্যন্ত ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারবে না;

৪) জমি প্লট করে নতুন বসতি গড়ে তুলতে গেলে অন্তত ১৬ ফিটের রাস্তা থাকাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে, নয়তো জমির মিউটেশন অথবা বাড়ির নকশা অনুমোদন পাবে না।

এটা বাস্তব, দেশভাগ ও ১৯৭১’এর যুদ্ধের কারণে এ রাজ্যে যে বিপন্ন মানুষের বিপুল আগমন, তার ফলে জনসংখ্যার আচম্বিত বিস্ফোরণে রুটি-রুজি সহ বাসস্থানের সমস্যার কারণে শহরতলির ওপর স্থানজনিত অত্যধিক চাপ পড়েছে। কিন্তু তার থেকে নিস্তারের উপায় অপরাধপ্রবণ প্রোমোটার-রাজ নয়, সুপরিকল্পিত নগরায়ন ও যথাযথ ইমারত-নীতি। এই সুবোধ চিন্তা কি আদৌ প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহল থেকে আশা করতে পারি? 

  

No comments:

Post a Comment