কোন ভয় থেকে সিএএ'র বিজ্ঞপ্তি জারি?
সোমনাথ গুহ
প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৯-এর ১১ ডিসেম্বর ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ (সিএএ) সংসদে প্রণয়ন করা হয়। ছয় মাসের মধ্যে ওই আইনের নিয়মাবলী গঠিত হবার কথা ছিল। ইতিমধ্যে ওই আইনের প্রতিবাদে দেশ জুড়ে প্রবল আন্দোলন দেখা যায়, অন্তত একশো জন রাষ্ট্রের দমনপীড়নের শিকার হন। অসমে পাঁচ ছাত্র পুলিশের অত্যাচারে মারা যান। আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে প্রায় দুশো পিটিশন জমা পড়ে। সরকার এর ফলে বারবার পিছু হটে, করোনার অজুহাত দিয়ে নিয়মাবলী গঠনের জন্য বারবার সময় চায়। অবশেষে ঠিক লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে, তারা একগুচ্ছ নিয়মাবলী ঘোষণা করে ১২ মার্চ থেকে সিএএ চালু করল। তাদের এই সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অংশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
কেন এই সিএএ? নাগরিকত্ব সংক্রান্ত মূল সমস্যা শুরু হয় ২০০৩ সালে যখন আইনের একটি সংশোধনী অনুযায়ী জনসংখ্যাপঞ্জী (এনপিআর) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সংশোধনীর ১৪(এ) ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে দেশ জুড়ে পঞ্জীকরণ চালু এবং প্রতিটি নাগরিকের ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’ তৈরি করা বাধ্যতামূলক করতে পারে। এই সংশোধনীকে হাতিয়ার করে ২০১৬ সালে অসমে বিজেপি সরকার এনআরসি চালু করে। চূড়ান্ত এনআরসি থেকে উনিশ লক্ষ মানুষের নাম বাদ যায় যার মধ্যে প্রায় বারো লক্ষ ছিলেন হিন্দু। এটা বিজেপিকে হতচকিত করে। অসম বিজেপি পত্রপাঠ এই ফলাফল খারিজ করে দেয়। হিন্দু মানুষের নাম এনআরসি থেকে বাদ পড়ায় বিজেপির ভাবমূর্তি ধাক্কা খায়। এমনকি ২০১৯'এ পশ্চিমবঙ্গের তিনটে উপনির্বাচনেও এর প্রভাব পড়ে। মাত্র ছয় মাস আগে লোকসভা নির্বাচনে ঝড় তোলা সত্ত্বেও বিজেপি কিন্তু তিনটি কেন্দ্রেই হারে। কালিয়াগঞ্জ কেন্দ্রের ফল বিশেষ ভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ, কেননা লোকসভায় এই কেন্দ্র থেকে তারা প্রায় ৫৬,০০০ ভোটে এগিয়ে ছিল। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে জেতা তখন বিজেপির ‘পাখির চোখ’। কিন্তু এনআরসি থেকে এত হিন্দুর নাম বাদ যাওয়ার কারণে বাংলায় হিন্দুদের মনে বিজেপি সম্পর্কে ঘোর সংশয় তৈরি হয়। উপরন্তু, মতুয়ারা আদৌ বিজেপিকে সমর্থন করবে কিনা তা নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়।
এই ক্ষতি সামাল দিতে বিজেপি তড়িঘড়ি বাজারে সিএএ নিয়ে আসে। শোনা যায়, অমিত শাহ'র বিখ্যাত উক্তি: 'আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে'- প্রথমে সিএএ, তারপর এনআরসি। অর্থাৎ, সিএএ'র সুযোগ নিয়ে হিন্দুরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন এবং এনআরসি হয়ে দাঁড়াবে মুসলিম ছেঁকে তোলার কল। মতুয়া সম্প্রদায়ের একটা অংশ কেন্দ্রের শাসক দলের এই প্রতিশ্রুতিতে প্রভাবিত হন। নাগরিকত্বের কলা-মুলো ঝুলিয়ে বিজেপি ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে ফয়দা তোলে- নদীয়া, উত্তর ২৪-পরগণা এবং উত্তর বাংলার কিছু অংশে এই সম্প্রদায় অধ্যুষিত প্রায় পনেরোটা আসনে তারা জয়লাভ করে।
বিজেপি এবার লোকসভায় ৩৭০টি আসন জয়ের লক্ষ্য নিয়ে নেমেছে। এর জন্য অসমে ও পশ্চিমবাংলায় তারা আসন সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য মরীয়া। বাংলায় মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক তাদের কাছে অপরিহার্য। তাই তারা 'নিঃশর্তে নাগরিকত্ব' নামক আরও একটি জুমলা সামনে নিয়ে এসেছে। সিএএ কি আদৌ নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেবে?
এই আইনের ফলে ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪ অবধি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিশ্চান ধর্মের যে সব মানুষ ভারতে এসেছেন তাঁদের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে গণ্য করা হবে না। মুসলিমরা এই আইনের সুযোগ পাবেন না, তাই এই আইন বৈষম্যমূলক। পাকিস্তান, আফগানিস্তানে শিয়া, হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষরাও নির্যাতিত, তাঁরা কিন্তু ভারতে আশ্রয় পাবেন না। পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের রোহিঙ্গারা, যাঁরা গণনিধনের শিকার হয়েছেন, তাঁদেরও এ দেশে ঠাঁই নেই। সঙ্ঘ পরিবারের যুক্তি, শ্রীলঙ্কার তামিলদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি কারণ তারা জাতিগত ভাবে নিপীড়িত, ধর্মীয় ভাবে নয়! নেপাল, ভুটানের নির্যাতিত মানুষেরাও এই আইনের সুযোগ পাবেন না।
নাগরিকত্ব কি নিঃশর্তে পাওয়া যাবে? আদৌ নয়। আইনে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হচ্ছে, এই ছটি ধর্মের যে মানুষরা আসছেন তাঁরা কিন্তু সরাসরি নাগরিকত্ব পাচ্ছেন না, তাঁরা শুধুমাত্র ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসাবে গণ্য হবেন না; তাঁদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে এবং তার জন্য কিছু শর্ত আছে। প্রথম শর্ত, ওই তিনটি দেশে ধর্মের কারণে নিপীড়িত ছটি ধর্মের মানুষেরাই কেবল এই আইনের সুযোগ পাবেন। দ্বিতীয় শর্ত, তাঁরা এই দেশে এসেছেন ২০১৪'র ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে। তৃতীয় শর্ত, এক বছর টানা ভারতে থেকেছেন এবং গত চোদ্দ বছরে অন্তত পাঁচ বছর এখানে থেকেছেন।
সিএএ'র জন্য ৩৯ পাতার যে নিয়মাবলী সরকার প্রকাশ করেছে সেটির প্রথম পাঁচ পাতা বিভিন্ন নিয়ম এবং বাকী নানা ধরনের ফর্ম। ধর্মীয় উৎপীড়নের কোনও প্রমাণ দিতে হবে কি না তা পরিষ্কার নয়। প্রথম ফর্মে নিজের সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। পিতামাতার নাম, কোন দেশ, কোন জেলা থেকে এসেছেন, কবে এসেছেন ইত্যাদি জানাতে হবে। সঠিক তথ্য জমা দিয়েছেন এই মর্মে একটি হলফনামা দিতে হবে। কোনও ভারতীয় নাগরিকের থেকে ‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট’ বা নিজের চরিত্র সম্পর্কে হলফনামা জমা দিতে হবে। আবেদনকারীকে অষ্টম তফসিলের যে কোনও একটি ভাষা বলতে জানতে হবে, সেটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকাও প্রয়োজন। তাঁর আবেদন যদি মঞ্জুর হয় তাহলে আগের দেশের নাগরিকত্ব ছাড়তে হবে এবং এই মর্মেও তাঁকে হলফনামা দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়োজিত দুটি কমিটি যাবতীয় তথ্য যাচাই করবে। আবেদন প্রথমে যাবে জেলা কমিটির কাছে। তাঁরা সব তথ্য খতিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হলে সেই আবেদন উচ্চতর একটি বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিটির কাছে পাঠাবে। দ্বিতীয় কমিটির দুই জন সদস্য, উভয়েই হবেন সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক। কোনও আবেদনকারী যদি সঠিক নথি জমা দিতে না পারেন তাহলে প্রথম কমিটি দ্বিতীয়কে সেটি খারিজ করার পরামর্শ দিতে পারে। সমস্ত নথি ঠিক থাকলে ডিজিটাল শংসাপত্র দেওয়া যেতে পারে।
এর থেকে এটা পরিষ্কার যে, মোটেও নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এবার একটা বাস্তব পরিস্থিতি ভেবে দেখুন। ধরা যাক একজন হিন্দু মানুষ ২০০০ সালে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবাংলায় এসেছেন। সীমান্তবর্তী কোনও ছোট শহরে বাড়ি ভাড়া করে তিনি একটা ব্যবসা শুরু করেছেন। প্রভাবশালী কাউকে ধরে নথিপত্র জোগাড় করেছেন। ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ছে। ভোটও দিয়েছেন এবং মোটামুটি থিতু হয়ে বসে তিনি একটা স্থায়ী জীবন শুরু করেছেন। এবার, কেন্দ্রীয় সরকারের এই নতুন আইন দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তিনি সিএএ'র মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন। এটা করা মাত্র যে মানুষটি স্থায়ী জীবন শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু নিজেকে অবৈধ ঘোষণা করলেন, নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে ফেললেন। এরপর, তাঁর আবেদন যে মঞ্জুর হবে তার কী নিশ্চয়তা আছে? প্রতিটি ফর্ম, হলফনামা তাঁকে ঠিকঠাক পূরণ করতে হবে, সঠিক নথিপত্র জমা দিতে হবে এবং তারপরেও তাঁকে এই দুটি কমিটির কর্মদক্ষতা, ধর্মীয়, জাতিগত নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করতে হবে। অসমের এনআরসি একটা বিরাট শিক্ষা! শুধুমাত্র নাম, পোশাক বা চেহারা ‘সন্দেহ’ উদ্রেক করার কারণে অনেক আবেদনকারীকে কাগজ নিয়ে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়েছে।
বর্তমানে সিএএ সাব-জুডিস, সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। সেদিক থেকে দেখলে প্রশ্ন উঠবে, সরকার কি আদৌ আদালতের রায়ের আগে এই আইনের নিয়মাবলী গঠন করতে পারে? এছাড়া এই আইন সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান করে ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শকে অস্বীকার করে। কিন্তু এই সরকার তো সংবিধান বা বিচারব্যবস্থাকে মান্যতা দেয় না।
রমজান শুরুর পরের দিন নিয়মাবলী ঘোষণা করা হয়েছে যাতে মুসলিম জনতা প্রতিবাদ করতে দ্বিধা বোধ করেন। ‘ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ’ আজ সুপ্রিম কোর্টে এই আইন ও এর নিয়মাবলীর ওপর স্থগিতাদেশের জন্য আবেদন জানিয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন এবং তাঁদের নির্মম ভাবে দমন করা হয়েছে। অসমে এনআরসি করা হয়েছিল ২৪শে মার্চ, ১৯৭১'কে কাট-অফ ডেট ধরে; সেটা নতুন আইনের কারণে হয়ে দাঁড়াল ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪। মানুষ সেখানে রাস্তায় নেমে পড়েছে, বিরোধী দলগুলি বনধ ডেকেছে। কলকাতা এবং বিহার ও ঝাড়খন্ডের শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়েছে। নির্বাচনী বন্ডের জালিয়াতি, নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ, দিল্লিতে নামাজিদের ওপর অভূতপূর্ব আক্রমণ এবং এখন সিএএ'কে আবার ঠাণ্ডা ঘর থেকে তুলে আনা- এসব মিলে মো-শা সরকার দেশ জুড়ে এক তুমুল অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।
প্রশ্ন উঠছে, শাসক এত মরীয়া কেন? তারা কি বিপন্ন, বিপর্যস্ত বোধ করছে?
No comments:
Post a Comment