জিডিপি'র ফাঁকি ও গরিবি কমার গপ্পো
দীপঙ্কর দে
জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে প্রায়শই নানা তথ্য কানে আসে। কখনও বিতর্কও বাঁধে অর্থশাস্ত্রের পণ্ডিতদের মধ্যে। অবশ্য গড়পড়তা নাগরিকের জীবনযাপনে স্রেফ জিডিপি বৃদ্ধির হারে কোনও তফাত হয় না। জিডিপি বৃদ্ধি হলেও ক্ষেত্র বিশেষে নাগরিকের আর্থিক সংকোচন হতে পারে। যেমন ধরুন, বর্তমান অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) ভারতের জিডিপি বেড়েছে ৮.৪ শতাংশ হারে, কিন্তু একই সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন সংকুচিত হয়েছে। তাই অনুমান করাই যায়, কৃষি ক্ষেত্রে যুক্ত ভারতের বিশাল সংখ্যক নাগরিকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। মোদ্দা কথা, জিডিপি বাড়লেই হবে না, জাতীয় উৎপাদনের বন্টন সুষম হতে হবে। নইলে ভারতের মতো রাষ্ট্রে যেখানে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য দিন দিন বাড়তে বাড়তে খুব কুৎসিত রূপ নিয়েছে, সেখানে জিডিপি বাড়লে শ্রেণি বৈষম্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও বাড়ে।
জিডিপি নিয়ে এই নিবন্ধের আলোচনা একটু খটমটে। অন্য সময় এ আলোচনা না করলেও চলত। আম নাগরিকের কী বা যায় আসে যদি সরকার জিডিপি বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে বা দেশের গরিবের সংখ্যা কমিয়ে বলে। মিথ্যে পরিসংখ্যানে বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন হয় না। রাজনৈতিক চাপানউতোর বাড়ে। তবে মিথ্যের জোরে অপদার্থ শাসকের পক্ষে সহমত নির্মাণ সহজ হয়। নির্বাচনের মরসুমে রাষ্ট্রের তথ্যকে যাচাই করা তাই খুব জরুরি।
সমস্যা শুরু গত সপ্তাহে, যেদিন ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকাল অফিস (NSO ) ঘোষণা করে যে বর্তমান অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৪ শতাংশ। হঠাৎ এই বৃদ্ধির হার. রিজার্ভ ব্যাংকের বৃদ্ধির আগাম হিসেবের (৬.৫ শতাংশ) থেকে অনেকটাই বেশি। দেশের সংসদীয় নির্বাচনের মুখে এই বৃদ্ধির ফলে বর্তমান অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির আনুমানিক হার ৭.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৬ শতাংশে। স্বভাবতই এই তথ্য শাসক দলের সাফল্য বলে প্রচারিত হতে থাকে।
অর্থনীতির পণ্ডিতেরা সন্দিহান হন দুটি কারণে: ক) রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সহ বিশ্ব ব্যাঙ্ক বা আইএমএফ'ও এতটা বৃদ্ধির আগাম অনুমান করেনি; খ) উক্ত সময়ে দেশের গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড (GVA) পরিসংখ্যানের সঙ্গে জিডিপি পরিসংখ্যানের অমিল খুব বেশি। ওই ত্রৈমাসিকে ভারতের জিভিএ বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশ, যার অর্থ, জিডিপি ও জিভিএ বৃদ্ধির হারের তফাত ১৯০ বেসিস পয়েন্ট যা গত দশ বছরে সর্বাধিক। তাই শুরু হল কাটাছেঁড়া।
নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, আমরা অনেক পণ্য কিনি যার প্যাকেটে লেখা থাকে 'কর সমেত সর্বোচ্চ মূল্য'। আমরা কিন্তু পণ্যের প্রকৃত মূল্য কত তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। ঘামালে দেখব, পণ্যের বিক্রয়মূল্য = পণ্যের প্রকৃত মূল্য + অপ্রত্যক্ষ কর - অনুদান। একই ভাবে যদি এবার জাতীয় উৎপাদনের কথা ভাবি তবে দাঁড়ায়: জিডিপি = জিভিএ + অপ্রত্যক্ষ কর -অনুদান।
বোঝা যাচ্ছে, তৃতীয় ত্রৈমাসিক জিডিপি বৃদ্ধির হার আর জিভিএ বৃদ্ধির হারের যে তফাত'টা হচ্ছে তার কারণ: ১) অপ্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি ও ২) অনুদান হ্রাস। কর বৃদ্ধি ও অনুদান হ্রাস পেলে নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা কমে। তাই বলা যেতেই পারে, ৮.৪ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে অপ্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে ও অনুদান কমিয়ে। যার ফলে জিডিপি বাড়লেও আম নাগরিকের আর্থিক দুরবস্থা বেড়েছে। অবশ্য সরকারি তথ্যও সে কথা বলছে। বর্তমান আর্থিক বছরে জিএসটি খাতে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১২.৫ শতাংশ। আর খাদ্য ও সারে সরকারের যে অনুদান দেওয়ার কথা, তার মাত্র ৭০-৭৫ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। তাই অঙ্কের নিয়মেই জিডিপি ও জিভিএ তথ্যে এত গরমিল চোখে পড়ছে। আর সরকার পোষিত মিডিয়া ও কতিপয় অর্থশাস্ত্রী জিডিপি বৃদ্ধির মূল কারণ লুকিয়ে সরকারের জয়গান গাইছে।
শুধু জিডিপি বৃদ্ধির তথ্যই নয়, দেশের গরিবি মোচনের হার নিয়েও ব্যাপক কারচুপি করছে সরকার। গত সপ্তাহে বহু বছর পর ন্যাশনল স্যাম্পল সার্ভে অফিস (NSSO ) Household Consumption Expenditure Survey ( HCES ) ২০২২-২৩'এর আংশিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তার ভিত্তিতে নীতি আয়োগের কর্তা দাবি করেছেন, বর্তমানে দরিদ্র নাগরিকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১১-১২ সালের সর্বশেষ HCEC তথ্যের নিরিখে দরিদ্র মানুষের অনুপাত কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। কারণ, ২০১১-১২ সালে সুরেশ তেন্ডুলকরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি HCEC তথ্যের ভিত্তিতে হিসেব করে বলেছিল, ভারতের মোট জনসংখ্যার ২১.৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এ ক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞ অর্থশাস্ত্রীরা সরকারি হিসেবে কয়েকটি গুরুতর ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। (টেলিগ্রাফ অনলাইন ২ মার্চ ২০২৪)।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন:
১) ২০১১-১২ সালে তেন্ডুলকার যে পদ্ধতিতে দরিদ্রের সংখ্যা অনুমান করেছিলেন, সেই একই পদ্ধতি ২০২২-২৩ সালে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, আগেরবার HCES তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল মিক্সড রেফারেন্স পিরিয়ড (MRP ) পদ্ধতিতে; কিন্তু নতুন HCES'এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে মডিফাইড মিক্সড রেফারেন্স পিরিয়ড (MMRP) পদ্ধতি। তাই, এ ক্ষেত্রে ভিন্ন পদ্ধতিতে হিসেব করতে হবে। কমলা ও আপেলের তুলনা সম্ভব নয়। দুটোই ফল হলেও ভিন্ন জাতের ফল।
২) ২০১১-১২'এর সমীক্ষায় পারিবারিক খরচের হদিস পেতে ৩৪৭টি পণ্য ও পরিষেবার তথ্য তালাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২২-২৩'এ সে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৫টি পণ্য ও পরিষেবায়। স্বাভাবিক ভাবেই এ ক্ষেত্রে পারিবারিক খরচের পরিমাণ আগের তুলনায় বেশি হওয়ার কথা।
৩) অর্থনীতিবিদ সন্তোষ মেহরোত্রা হিসেব কষে দেখেছেন, ২০২৬ সালের পর দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে অবনতির ফলে প্রায় ছয় কোটি মানুষ কৃষি ক্ষেত্রে ফেরত যান। এঁদের প্রায় পাঁচ কোটি নিজেদের পারিবারিক কৃষিতে বিনা পারিশ্রমিকে যুক্ত হন, যদিও সরকারি পরিসংখ্যানে তাদের কর্মরত শ্রমিক বলেই নথিভুক্ত করা আছে। স্বাভাবিক ভাবেই অনুমান করা যায়, এই ছয় কোটি নাগরিকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ২০২২-২৩'এর আর্থিক সমীক্ষাতেও স্বীকার করা হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতির ফলে ভারতে প্রকৃত মজুরি কমেছে।
সরকারি পরিসংখ্যান যাই বলুক, মুষ্টিমেয় ধনী ও উচ্চবিত্ত ছাড়া ভারতের আম নাগরিক প্রতিদিন টের পাচ্ছেন বাস্তব পরিস্থিতি কী। সরকারি পরিসংখ্যানে নাগরিকের আস্থা দিন দিন তলানিতে এসে ঠেকেছে। মিথ্যে পরিসংখ্যানে আর চিড়ে ভিজবে না। এটাই ভরসা।
No comments:
Post a Comment