Tuesday 22 January 2019

ফিরে দেখা

#একক মাত্রা ২০
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 ১)
ফিরতে হবে গত শতকের আশির দশকের প্রায় শেষ পাদে। যখন বাংলার পরিমণ্ডলে একাডেমিক ঘরানা এক পরিপুষ্ট বাম পরিচিতি অর্জন করেছে। সত্তর দশকের নকশাল যুবকেরা ও অন্য বাম ঘরানার বহু জনেই তখন একাডেমিক ঘরগুলির অধিকার নিয়েছে। ভারত-মুক্তির সশস্ত্র লড়াই ঠাঁই পেয়েছে একাডেমির সেমিনার, রচনা ও এমনকি ক্লাশঘরেও। রাজ্যে অধিষ্ঠিত বামফ্রন্ট, যাদের প্রতিনিধিরাও তখন সীমিত ক্ষমতায় রাজ্য চালানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলাপে সরগরম করে রাখছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-বিদ্যায়তনের করিডোর ও ক্লাশরুম। সেই আবহেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে আয়োজিত হল একটি কূট ও উত্তপ্ত বিতর্কঃ বামফ্রন্ট কতটা বাম! সরকার পক্ষে একদিকে বললেন অসীম দাশগুপ্ত, বিপ্লব দাশগুপ্ত ও সত্যব্রত সেন; বিরুদ্ধ পক্ষে অশোক রুদ্র, রতন খাসনবিশ ও দীপঙ্কর চক্রবর্তী। সেই বিতর্কের বাক-উত্তাপ সেদিন কলকাতার রাজপথে ছড়িয়েছিল।

সেই নরম গরম সময়ে, বামপন্থার উত্তুঙ্গ তরঙ্গে তখন কে বাম কে নয় সেই হদিশ করাই ছিল দুষ্কর। বামপন্থার তখন যত মত তত পথ। তখনও বহু যুবকের চোখে বিপ্লবের স্বপ্ন মলিন হয়নি। সত্তর দশকে ঘরছাড়া বহু যুবকেরা তখনও রাজনীতির ময়দানে হোলটাইমার। সমসাময়িক কিছু বন্ধুরাও পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বা মধ্যবর্তীতেই হোলটাইমার হচ্ছে। এমনকি উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম স্থানাধিকারী ছেলেও আয়েসি, মসৃণ কেরিয়ারের পথ ছেড়ে গোপন বামপন্থী বিপ্লবী পার্টিতে যোগ দিচ্ছে।

কিন্তু সময়টা যেহেতু আশির দশকের শেষভাগ, গোটা বিশ্ব জুড়ে এ দেশেও ঘটে যাচ্ছে কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন। ইউরোপে দুর্বল হয়ে পড়ছে ইউরো-কমিউনিজম, সোভিয়েত ইউনিয়নে শুরু হয়েছে গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈকা, পূর্ব ইউরোপের বহু সমাজতান্ত্রিক দেশে শুরু হয়ে গেছে জনবিক্ষোভ, চীনে দেংজিয়াওপিং'এর 'সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের সীমিত প্রয়োগ' মান্যতা পেয়েছে। এ দেশে প্রবল হয়েছে জাতপাতের রাজনীতি, আসছে শঙ্কর গুহ নিয়োগীর 'সংঘর্ষ ও নির্মাণ'এর বাস্তব অভিঘাত, মহারাষ্ট্র কেঁপে উঠছে দত্ত সামন্তের নয়া শ্রমিক আন্দোলন ও শ্বেতকারী সংগঠনের কৃষি সংঘর্ষে, রাজ্যে রাজ্যে সংহত হচ্ছে নতুন নতুন আঞ্চলিক দল। এই আবহে পালটে যাচ্ছে বিষয়াদির উপাদানগুলিই। একাডেমিক ঘরানায় এসে গেছে সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ, পোস্ট-মডার্নিজম ও পোস্ট-কলোনিয়ালিজম, আলোচিত হচ্ছেন রোজা লুক্সেমবার্গ, গ্রামসি, আলথুজার, ফুকো, দেরিদা। যাঁদের খোলা মন, নির্দিষ্ট ভাবে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলেন না, জানার আগ্রহ ষোলআনা, তাঁরা নানা উপচারে একাডেমিক এই কর্ষণ ও বাস্তব চলাচল দুটোকেই বোঝার চেষ্টা করছেন। তৈরি হচ্ছে একাডেমিক গবেষণা ও কেরিয়ারেরও নানা খাত, উপখাত।

এ যেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন সদ্য অর্থনীতি পাশ দেওয়া পাঁচ যুবকের মনে হল, মেলাতে হবে এই কর্মযজ্ঞকে। প্রতিষ্ঠানের গবেষণাকে যেতে হবে বাস্তব ময়দানে, আর বাস্তবতার কঠিন আগলকেও জানতে হবে একাডেমির থেকে। তবেই তো সমাজবিজ্ঞানের সফলতা। তত্ত্ব ও প্রয়োগের বুঝি বা মেলবন্ধনের প্রয়াস। জন্ম নিল ত্রৈমাসিক 'সমাজবিজ্ঞান' পত্র (পরে রেজিস্ট্রেশন জনিত কারণে নাম হয়েছিল 'সমাজবীক্ষণ')। এক নীরব সূত্রপাত।

তবে সে ভাবনাতে বেশ গোলযোগ ছিল। সে স্পষ্ট হবে চলার পথে। কিন্তু তখন আর উপায়ই বা কী!

২)
তো শুরু হল 'সমাজবিজ্ঞান' (পরে নাম পরিবর্তে 'সমাজবীক্ষণ')। যতদূর মনে পড়ে, প্রথম বছরে চারটে সংখ্যা বেশ হৈ হৈ করে বেরিয়ে গেল। বেশ সাড়াও পড়ল। কিন্তু গণ্ডগোল একটা ছিল, সেটা ধীরে ধীরে প্রকট হল। এক, যারা উদ্যোক্তা, তাদের তখন কেরিয়ার গড়ার পালা, এদিক সেদিক চাকরি-বাকরি ফলত স্থানচ্যুতি ও ব্যস্ততায় অচিরেই ঘনিয়ে এল 'সমাজবীক্ষণ'এর আয়ু। তবুও দু-একজন থেকে গেল একে টেনে চলার দায়ে।। দুই, বলা হল বটে তত্ত্বে-প্রয়োগে বা হাতেকলমে এ এক সমাজ অন্বেষণের প্রয়াস কিন্তু আখেরে এতে একাডেমির গবেষকদেরই পোয়া বারো হল; তাদের রিসার্চ পেপার লেখার গরজ ও দক্ষতা দুইই উৎসাহ পেল, যে পেপারের উৎপাদনে আদতে আমজনতার কিছুই এল গেল না। 'সমাজবীক্ষণ' হয়ে পড়ল মূলত একাডেমিক লোকজনদের হাত পাকানোর আখড়া, যদিও অন্যরকম চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। আসলে, সেই পরিবর্তনকামী সময়ে গবেষণার এত উপচার এসে পড়েছে যে তা নিয়ে তখন কেরিয়ার গড়ার সোপান অনেক চোস্ত। দেশের সমাজমন্থনের রক্ত ঘাম জল করা বাস্তব উপাদানগুলি - যা নির্মিত হচ্ছে লড়াইয়ের ময়দানে - আমেরিকা, ইউরোপের একাডেমিক্সের পাদস্পর্শে মহিমান্বিত হয়ে চালান হচ্ছে এ দেশের প্রতিষ্ঠানাগারে। সুনিশ্চিত হচ্ছে স্থায়ী চাকরি আর মোটা মাইনে। আর তা আঁকড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম কাঁপাচ্ছেন অধ্যাপক-গবেষকেরা। ফ্রি মলিকিউলের মতো সারসত্য তখন ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে। অতএব, চার-পাঁচ বছর অনিয়মিত টেনে নব্বই দশকের প্রথম ভাগে বন্ধ হয়ে গেল 'সমাজবীক্ষণ'। কিছুতেই হদিশ পাওয়া গেল না কীভাবে একে একাডেমিক চর্বিত-চর্বণ থেকে বের করা যায়, কারণ তখন একটা ধারণা ছিল এই যে মূলত একাডেমিক্সের লোকজনেরাই তো সমাজ নিয়ে নতুন কিছু লেখেন! সে ভ্রম ভাঙ্গবে আরও কিছু বছর বাদে।

ইতিমধ্যে তিয়েনমেন স্কোয়ারে গুলি চলেছে। সোভিয়েত পতন সুনিশ্চিত হয়েছে, পূর্ব ইউরোপ ছারখার। অথচ, এ রাজ্যে সংহত হয়েছে বামফ্রন্টের শাসন, যেন এক অপ্রতিরোধ্য মূর্তিমান অমরত্ব। পাশাপাশি, অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং দেশে এনেছেন উদার অর্থনীতির প্রস্তাব। এই টালমাটাল আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই এসে পড়বে ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য বিস্ফোরণ।

তখন ১৯৯৫।

৩)
১৯৯৫ সাল ছিল এক সন্ধিকাল। আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়নের ঠাণ্ডা যুদ্ধের কালে সামরিক প্রয়োজনে যুদ্ধ গবেষণার ফলিশ্রুতিতে যে ইন্ট্রানেট ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির উদ্ভাস হয়েছিল, তার আগল ভেঙ্গে গেল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। মার্কিন অধিপতিরা এবার মনে করলেন, আগামী একমেরু বিশ্বে আমাদেরই রাজ হবে, অতএব খুলে দাও ইন্টারনেট প্রযুক্তির দ্বার। শুরু হল এক নতুন ভুবনায়নের অধ্যায়। এ দেশেও তার ছাপ পড়ল। বোঝা গেল, আমরা প্রবেশ করছি তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার এক অভিনব পরিসরে।

ইতিমধ্যে সত্তর দশক থেকেই পরিষেবা ক্ষেত্রের বাড়বাড়ন্ত বদলে দিচ্ছিল কর্মক্ষেত্র, শ্রেণি ও অর্থনীতির আদল। ক্রমেই যেন অর্থনীতিতে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংখ্যাগত আধিক্য কমে আসছে, জায়গা করে নিচ্ছে পরিষেবা ক্ষেত্রের কর্মীবর্গ। কর্মজগতে কায়িক শ্রম থেকে মানসিক শ্রমের বৃদ্ধির হার যেন ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। ১৯৮২ সালে ইপিডব্লু'তে একটি বিতর্কিত লেখাও প্রকাশ পেল: Where have all the Workers Gone?

এই পরিবর্তিত আদরায় স্বভাবতই তখন এক সার্বিক সংশয় ও অন্বেষণের সময়। সমাজ ও অর্থনীতি কি এক নতুন ধারায় এগোচ্ছে? এ রাজ্যেও তখন নতুন আড়ম্বর। পাড়ায় পাড়ায় শুরু হচ্ছে সিন্ডিকেট ও প্রমোটার রাজ, লোকাল কমিটি এলাকা নিয়ন্ত্রণের সমস্ত ভার নিয়ে নিয়েছে কিন্তু নীতিগত ভাবে অর্থনীতির উপায়টা কী তা নিয়ে ঘোর সংশয়।
এই প্রখর বাস্তবতাই কতকগুলি দিক দর্শন করালো ও নতুন ভাবনাকে উস্কে দিল। রাজ্যে তখন এক আধা-নৈরাজ্য বিধিব্যবস্থা জাঁকিয়ে বসছে। লাল পতাকার ছায়ায় সরকারি অফিসে বসে আমজনতার থেকে উৎকোচের বিনিময়ে কাজ করে দেওয়া তখন একটি পুরোদস্তুর রীতি হয়ে গেছে। পার্টির জেলা কমিটি অফিসে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের প্যানেল তৈরিও একটি পাকা ব্যবস্থায় দাঁড়িয়েছে। গ্রামে পার্টির অনুমোদন ছাড়া মিলছে না গাবের চারা কি সরকারি বীজ। তাহলে রইলটা কী? রইল কিছু শুষ্ক তত্ত্ব যেগুলো আউড়ে সেমিনারে আর গবেষণাপত্রে দিন কাটত পণ্ডিতপ্রবরদের। এমতাবস্থায় গেরস্তের আর কীই বা করার থাকতে পারে।

ওই, ধর কলম, খাতা লাও, মগজে শান দাও। যারা এসব দেখছে, অনুভব করছে, শুধু মাটিতে বা চারপাশে নয়, অন্তরীক্ষেও, ভাবনাতেও, তারাই এবার সাথী হও অন্বেষণে। তিনজন মিলে বসে ভেবে ফেলল 'একক' অর্থাৎ একটি ইউনিটের কথা।

১৯৯৮ সালের অক্টোবরে প্রকাশ পেল 'একক'। পাতলা সস্তার কাগজে মাত্র ১৬ পাতার একটি পত্র। প্রচ্ছদ বিষয়: বিশ্বায়ন।

৪)
পরপর কয়েকটি সংখ্যার ভাবনা তৈরি হল। ইতিমধ্যে ১৯৯৯ সালে নন্দন চত্বরে শুরু হয়েছে লিটল ম্যাগাজিন মেলা। কবি শুদ্ধসত্ত্ব বসু এসে আপত্তি জানালেন, 'একক' নামে গত ৪০ বছর তাঁরা প্রকাশ করছেন একটি কবিতাপত্র। অতএব, 'একক' এরপর হল 'একক সাময়িকী'।

সময়টা এমনই, উল্লেখযোগ্য বাংলা ছবি আর নির্মিত হচ্ছে না, গ্রুপ থিয়েটারেরও দৈন্যাবস্থা। বিষয় ও ভাবনাগুলি যেন দোল খাচ্ছে এক সংশয়দীর্ণ মানচিত্রে। সময় চাইছে নতুন শব্দ-কথার বুনন। এসে গিয়েছেন গিটার হাতে সুমন-নচিকেতা-অঞ্জন। সুর, লয়, তালের থেকেও শব্দ-কথা-ভাব হয়ে উঠছে চলা-বলার সঙ্গী। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী জুটি বেঁধেছেন বাংলা ভাষার অপার রহস্যের হদিশ পেতে। যেন ইতিহাস কথা বলতে শুরু করেছে। স্পষ্ট হচ্ছে, শব্দ কথা বাক্যের অন্তর্নিহিতেই লুকিয়ে রয়েছে কালের গতি ও অর্থের দ্যোতনা।

তথ্য প্রযুক্তি, আমলা ও কেরানি, এই প্রজন্ম কী ভাবছে, শিল্পায়নের ওলটপালট, শিক্ষার বাণিজ্য অথবা বাণিজ্য শিক্ষা, রাজনীতির মুখ - এইসব নিত্য নতুন বিষয়ে ভরে উঠছে 'একক সাময়িকী'র পাতা। একটা সাড়া পড়ছে, কিছু আলোড়ন যেন তৈরি হচ্ছে, খোলা মনে জগতের প্রদক্ষিণ চলছে। সমাজ জুড়ে পরিবর্তনের দিগদর্শন যেন ধরা দিচ্ছে লেখালিখির অনুশীলনে। এবার আর একাডেমিক নির্ভরতা নয়, সাধারণজন যাঁরা চিন্তা করেন, তাঁদের ভাষ্যে ধরা দিচ্ছে সমাজ বিবর্তনের পল-অনুপল। সকলে মিলে মগজে শান দেওয়ার অনুশীলন। যোগাযোগ গড়ে উঠছে বাংলাদেশের সঙ্গে, আরও আরও মানুষের সঙ্গেও, যাঁরা প্রকৃত প্রস্তাবে বেঁচে থাকার নানা লড়াই ও ভাবনার সঙ্গে জুড়ে থাকেন, হয়তো ঈষৎ কিছু কিছু বদলেরও অনুঘটক হয়ে ওঠেন।

অবশেষে ২০০০ সালের জুলাই। আরএনআই রেজিস্ট্রেশনে নাম হল 'একক মাত্রা'। এ শব্দদ্বয়ের কোনও অর্থ নেই। তবু কেউ কেউ চেষ্টা করলেন অর্থ নিষ্কাশনের। প্রকাশ পেল 'অর্থনীতির সত্যি মিথ্যা'। এই বিষয় নিয়ে এই প্রথম বসল গণ আড্ডা। বহু অর্থনীতিবিদেরা এলেন, নানান মানুষ, এক জমাটি আড্ডায় 'একক মাত্রা' যেন উত্তীর্ণ হল এক শক্তিশালী বিন্দুতে।

তারপর আরও কাণ্ড, আরও হৈচৈ।
৫)
জনপ্রিয় হল একক মাত্রা'র আড্ডা। পরের আড্ডা 'ভদ্দরলোকের মুখ ও মুখোশ'। সিগাল বুক স্টোর ভেঙ্গে লোকজন এলেন। এই আড্ডার ধরনই হল, বিষয়ের ওপরে সকলেই বলতে পারেন। সঞ্চালক খানিক নিয়ন্ত্রণ করেন মাত্র। গোটা আড্ডাটা রেকর্ড করে হুবুহু ছাপা হল পত্রিকার পাতায়। আরও কিছু আড্ডা কলকাতায়, এরপর শান্তিনিকেতনের চীনা ভবনে, আইআইটি খড়্গপুরে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদবপুরের আড্ডায় বাংলাদেশ থেকে চারজন এলেন। তারপর একক মাত্রা'র তরফে চারজন গেলেন ঢাকায়। দুই বাংলার আড্ডা জমে উঠল। কলকাতায় আবার এলেন তাঁরা। এবার দেখানো হল তারেক মাসুদের বিশ্ববন্দিত ছবি 'মাটির ময়না'। তারেক মাসুদ স্বয়ং উপস্থিত। ম্যাক্স মুলার হল ভেঙ্গে লোকজন দেখতে এলেন সেই অসাধারণ ছবি। কলকাতায় 'মাটির ময়না'র প্রথম পাবলিক প্রদর্শন।

'একক মাত্রা' ঠাঁই পেয়েছে প্রায় সমস্ত চিন্তাশীল বাঙালির হৃদয়ে। মানুষের উন্মুখনতা ঘিরে 'একক মাত্রা' পরিণতি পেয়েছে এক গণ আন্দোলনে, হয়ে উঠেছে এক ভাবনা চর্চার কেন্দ্র। লেখক ও পাঠকের সীমানা ভেঙ্গে গেছে। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক গবেষকেরাই শুধু নন, আপামর সাধারণজন যাঁরাই সদর্থক ও নতুন করে ভাবছেন, তাঁরাই একক মাত্রা'র লেখক ও পাঠক। এক সুবিশাল ক্যানভাস তৈরি হতে থাকল। কিন্তু তাকে সামাল দেবে কে? যাঁরা একক মাত্রা করছেন তাঁরা তো সকলেই বিভিন্ন পেশার মানুষজন। চাকরি-বাকরি করে, ঘর সংসার সামলে তবে তো একক মাত্রার কাজ। অতএব, যেমনটা সকলে চাইলেন, তেমন হওয়াটা সাধ্যে কুললো না। তায়, অনেকেই আবার মোট বইতে নারাজ। ঘাড়ে করে স্টলে দাও, মেলায় নিয়ে চল, বসো, প্রুফ দেখ, প্রেসে ছোটো, হিসেবপত্র রাখ - এইসব হাজারটা কাজের ঝক্কি কে নেবে, তার ওপর প্রতি দু মাস নিয়মিত পত্রিকা বের করার নিত্য ঘর্মকলরব। অতএব, সেই দু-একজনের ঘাড়েই সবটা এসে পড়া। সে এক মহা আতান্তর ও অবিশ্রান্ত চাপ। বাবু বাঙালিদের কায়িক শ্রমের প্রতি মহা বিরাগ আঘাত করল 'একক মাত্রা'কেও। পায়ে যেন বেড়ি পড়ল।

তবুও, তবুও নিস্তার নেই কাজের। সকলে দেখলেন প্রতি দু মাস অন্তর 'একক মাত্রা' তার স্বভাবসিদ্ধ শৃঙখলায় প্রকাশ পেল - বিষয় ও লেখার গুণবেত্তায় কোনও কার্পণ্য নেই, মেলাতেও সময় করে হাজির, টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পাঠক-ক্রেতার ভীড়। তা কীভাবে হল সে অন্য গল্প। রাত জাগা পাখিদের নিরন্তর স্বপ্ন দেখার গল্প।

এইভাবে পার হল একবিংশ শতকের প্রথম পাঁচটি বছর। চারপাশে তখন এক গুমোট পরিবেশ। আর সব কিছু যা শাসকের অপছন্দ, একক মাত্রা'ও তেমন নেকনজরে। অনেকে লিখতে ভয় পাচ্ছেন, পড়তেও, অপবাদ আসছে, কেউ কেউ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করছেন। এইসব ঘনঘটার মধ্যেই পাকিয়ে উঠছে সমাজের ভবিতব্য।

তখন ২০০৬।

৬)
২০০৬। ২৩৫টা আসন নিয়ে বিপুল ভোটে বামফ্রন্ট আবারও ক্ষমতাসীন হল। দু এক মাস পরেই শিল্প দফতরের আধিকারিকরা এক নির্জন দুপুরবেলায় সিঙ্গুরে গেলেন জমি দেখতে। ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে উঠবে টাটাদের ন্যানো কারখানা। সে খবর চাউড় হতেই ঘরের মেয়ে-বউরা ঝাঁটা হাতে বেরিয়ে এলেন আধিকারিকদের সামনে। বিপদ বুঝে তাঁরা চম্পট দিলেন। এই ছিল সূত্রপাত। 'কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ' - এই শ্লোগানে বামফ্রন্ট তখন খোয়াব দেখছে এক আসন্ন 'শিল্প বিপ্লব'এর।

গুমোট, দমবন্ধ সে পরিস্থিতিতে একদিকে শুরু হল সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি রক্ষার লড়াই, পাশাপাশি খুলে গেল 'উন্নয়ন' ভাবনা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের এক সিংহদুয়ার। শাসক ও বিগ মিডিয়া একযোগে প্রচার চালাচ্ছে শিল্প এলে কর্মসংস্থান হবে তাই ন্যানো কারখানা জরুরি। কৃষিজমি অধিগ্রহণে গড়ে ওঠা আধুনিক শিল্প যে সামান্য কর্মসংস্থান তৈরি করে, তার চেয়ে বেশি কর্মচ্যুতি ঘটায় - এই ধারণাটিও তখন দানা বাঁধছে। পরে শীর্ষ আদালতও টাটার উকিলকে একই প্রশ্ন করবেন - প্রায় ২০ হাজার কৃষিজীবীর কর্মচ্যুতি ঘটিয়ে মাত্র ৪০০ (প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান) + ৮০০ (পরোক্ষ কর্মসংস্থান) = ১২০০ লোকের কর্মযোগ করে আপনারা কী ধরনের কর্মসংস্থান করতে চাইছেন? অশোক মিত্র মহাশয় একটি পত্রে জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ নিয়ে লিখলেন, কৃষকদের উৎপাদন থেকে উচ্ছেদ করে কুসীদবৃত্তিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
ঠিক এই ঐতিহাসিক সময়ের বাঁকে 'একক মাত্রা' সমস্ত বিপদের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে নিজেকে উজাড় করে দিল কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, উন্নয়ন নিয়ে বাক-বিতণ্ডায়। প্রকাশ পেল 'জমির লড়াই'। তারপর 'কৃষি বনাম শিল্প?', 'শিল্পায়নের গোলকধাঁধা', 'এখন গণতন্ত্র', 'নাগরিক শক্তি', 'গ্রামবাংলা', 'আলো-আঁধারে পশ্চিমবঙ্গ' ও আরও কিছু লেখা যা হয়ে উঠল তর্ক-বিতর্কের অনুষঙ্গ। বহু লেখা ফটোকপি হয়ে হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ কিছু কিছু লেখা নিয়ে ছোট পুস্তিকাও বের করে ফেললেন। বিগ মিডিয়া ও শাসকের প্রস্তাবের বিপক্ষে তখন 'একক মাত্রা'র এই লেখাগুলিই হয়ে উঠল সওয়ালের হাতিয়ার। ইতিমধ্যে অশোক মিত্র মহাশয় নিজে ফোন করে 'একক মাত্রা'র সঙ্গে জুড়ে গেলেন তাঁর মহামূল্যবান কিছু লেখা দিয়ে। আরও বহু লিটল ম্যাগাজিনও তখন একই পথের অনুসারী। 'একক মাত্রা' উদ্যোগ নিল সকলকে মেলানোর।

১৮ ডিসেম্বর ২০০৬। ১৮টি লিটল ম্যাগাজিন একযোগে বসে তৈরি করল 'লিটল ম্যাগাজিন সমন্বয় মঞ্চ'। কাকতালীয় ভাবে, ওইদিনই মিটিং চলার সময় খবর এল, সিঙ্গুরে তাপসী মালিককে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। 'একটি স্ফুলিঙ্গই দাবানলের জন্ম দেয়'। ইতিমধ্যে লড়াই ছড়িয়েছে নন্দীগ্রাম, লালগড়ে। সারা রাজ্য জুড়ে কৃষক অভ্যুত্থান। তার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছেন খেটে খাওয়া মানুষেরা। 'একক মাত্রা'র সংখ্যাগুলি হয়ে উঠল এই সার্বিক আন্দোলনের দৃশ্যপট ও যুক্তির হাতিয়ার।

২০০৭ সালের নন্দনের লিটল ম্যাগাজিন মেলায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল বেরল। গ্রেফতার হলেন দুজন লিটল ম্যাগাজিন কর্মী। ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্সির মাঠে সমন্বয় মঞ্চ আয়োজন করল বিকল্প লিটল ম্যাগাজিন মেলা। বহু লিটল ম্যাগাজিন বয়কট করল নন্দনের মেলা।

'একক মাত্রা' তখন নতুন চিন্তা, বিকল্প ভাবনার পাটাতন। লর্ড সিনহা রোডের আইবি ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন আসছে পরবর্তী কর্মসূচির তল্লাশ চেয়ে। সমাজবিজ্ঞান চর্চা জুড়ে যাচ্ছে সমাজের বাস্তব চরিত্র ও ঘটনাবলীর সঙ্গে। আরও আরও নাগরিক উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে 'একক মাত্রা'র পথ চলা। ঘর্মাক্ত মাটির আলোড়নে নির্মিত হচ্ছে সমাজের তত্ত্ব-ভাবনা। 'টাটার কেশাগ্র স্পর্শ করতে দেব না' - শাসকের এই হুমকির বিরুদ্ধে কলম ও যুক্তির বয়ান গড়ে তুলছে প্রতিস্পর্ধা।

ইতিহাস হাসছে মুচকি করে। তারপর ২০১১।

৭)
অবশেষে দীর্ঘ ৩৪ বছর রাজ্যপাট চালিয়ে মহীরূহের পতন হল। সরকার পরিবর্তনের মামুলি কর্মকাণ্ডটিই এ রাজ্যে হয়ে উঠেছিল এক অবিশ্বাস্য প্রকল্প। সে অর্থে 'পরিবর্তন চাই' শব্দদ্বয় এক সুদূরপ্রসারী বাঙময়তায় মানুষের কল্পনায় মিশে গিয়েছিল। পণ্ডিতেরা ভাবলেন, এক মহাবিপ্লব আসন্নপ্রায়; যে কারণে ২০১১ সাল পেরতে না পেরতেই তাঁদের সবিস্ময় জিজ্ঞাসা: পরিবর্তনে কী মিলল? অথচ, সাধারণজন, খেটেখাওয়া মানুষেরা নিতান্তই বুঝেছিলেন, এ ছিল নিছকই এক সরকার পরিবর্তন, ওই তাতে সামান্য বাড়তি যেটুকু যা মেলে। সংসদীয় গণতন্ত্রে এই সামান্য সরকার পরিবর্তনের কম্মোটিই যে এ রাজ্যে এত কষ্টসাধ্য ছিল, তা 'পরিবর্তন' শব্দটিকেই দিয়েছিল এক দুঃসাধ্য মাত্রা। অবশেষে কৃষক অভ্যুত্থান ও গণজাগরণের মধ্য দিয়ে তা সম্ভবপরও হল। যে দাবিগুলিকে নিয়ে উত্তাল হয়েছিল এ রাজ্য, স্বভাবতই তার অনেকাংশ মান্যতাও পেল। 'একক মাত্রা'র এ বিষয়ে অবস্থানও ছিল খুব স্পষ্ট যা ২০১০-১১ সালের সংখ্যাগুলির বিভিন্ন লেখাগুলির মধ্যে ধরা ছিল।

পাশাপাশি, সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান বিগ মিডিয়াকে কার্যত কাবু করে ফেলল। পাওয়া গেল উন্মুক্ত পরিসর ও যোগাযোগের বিস্তৃত ভূমি। এখন আর বিগ মিডিয়া আপনার খবর কতটা বলবে, যার ওপর আপনার গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করতে পারে, তার দিন ফুরলো। এখন আপনিই মিডিয়া। এই বিন্যাস নির্মাণ করল একক মাত্রা'র আরও প্রসার ও জনপ্রিয়তা। গদ্য প্রবন্ধের একটি অনির্বচনীয় পরিসর হিসেবে তা হয়ে দাঁড়াল চিন্তাশীল মানুষদের একটি অঙ্গাঙ্গী জোটবদ্ধতা। চলল তর্ক, অনুসন্ধান, অন্বেষণ। আরও নতুন ও বিবিধ বিষয় জুড়তে থাকল প্রচ্ছদ কাহিনিতে। কোনও দল নয়, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির চলমান বাস্তবতার আকর হয়ে উঠল 'একক মাত্রা'। বাংলা ভাষাতেই যে এমন একটি কাজ নিরন্তর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তারই নিদর্শন নির্মিত হল।

সেই সঙ্গে বিশ্বের অর্থনীতিতেও এসেছে আরও যুগান্তকারী পরিবর্তন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বলয়ে বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির আঙ্গিক। কেউ কেউ বলছেন, আমরা ক্রমশ প্রবেশ করে চলেছি 'গিগ' অর্থনীতির বলয়ে যেখানে প্রায় অধিকাংশ কর্মের আর কোনও স্থায়ী কর্মীর দরকার নেই; কাজগুলি স্তরে স্তরে অর্পিত হবে স্বল্প সময়ের চুক্তির ভিত্তিতে। অর্থনীতির মূল কেন্দ্রে চলে আসছে অতিকায় কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত যন্ত্ররাজ-বিভূতি, যেখানে দৈত্যসম পুঁজি ও যন্ত্র দখল নিয়ে নিচ্ছে জগৎ সংসারের ভার। রাজনীতিকরাও পড়ছেন ফাঁপড়ে। তাঁরাও জানেন না, ঠিক হচ্ছেটা কী! যে কারণে ফেসবুক ও গুগল'এর সিইও'দের ডেকে মার্কিন কংগ্রসে খুব কড়কে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতিকদের যেটুকু যা 'আপেক্ষিক স্বাধিকার' ছিল তাও বুঝি গেল। বিগ ডাটা, ডাটা আনালিটিকিস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্তরালে কী ঘটে চলেছে তা গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া কেই বা জানে! যন্ত্ররাজ-বিভূতি এখন যেন মুখোমুখি গোটা মনুষ্যসমাজের। যন্ত্র ও অর্থনীতির এই একদেশদর্শিতা অপাঙক্তেয় করে দিয়েছে সমস্ত রাজনীতিক ও তাদের দলগুলিকে। বর্তমান সময় যেন প্রবেশ করছে এক অযাচিত অনিশ্চয়তা ও চমকের মহা গহ্বরে।

সময়ের এই অবিশ্বাস্য বয়ানকে যদি 'একক মাত্রা' পড়তে না পারে তবে সে হারাবে তার কার্যকারিতা, প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্যকে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। তাও আবার বাংলা ভাষায়। আরও একবার প্রমাণিত হবে বাংলা ভাষার সম্পদ কোথায়!

তবু কিছু কথা থাকে শেষে বলার জন্য।

৮)
যন্ত্ররাজ-বিভূতি যখন গোটা বিশ্বের দখল নিয়ে নিচ্ছে তখন অসহায় রাজনীতিকদের আর তেমন কিছু করার নেই। যন্ত্র-পুঁজির অর্থনীতিই এখন নিয়ামক। ক্রমেই তাই জাতপাত, জাতিগত, ধর্মীয় রাজনীতির খেলায় মেতে উঠছে রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দলগুলি। এ দেশে রাজনীতির অক্ষটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সেইসব উপাদান। আমেরিকার শাসকও সরকারকে শাটডাউন করে এখন মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তুলতে মরীয়া।

এই হল সার্বিক প্রেক্ষাপট যখন আজকের রাজনীতি ও অর্থনীতি এক যুগ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি আত্মসমর্পণ করছে অর্থনীতির উদ্দামতার কাছে, তার একমাত্রিক দ্রুতগামী চলার পথের কাছে। কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে বাস্তবিক আর কোনও পথ নেই, সকলেই যন্ত্ররাজ-বিভূতিকে আজ্ঞা মেনেছে। উপায়ন্তর না পেয়ে, সকলেই এখন খতিয়ে দেখছে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের সম্ভাবনাকে। অর্থাৎ, যন্ত্রের শাসনে যখন কর্মসংস্থানেরই ঘোর অমানিশা তখন সকলের হাতে ধরিয়ে দাও কিছু অর্থ যা দিয়ে অন্তত মোটা ভাত-কাপড়টুকু জোটে। যন্ত্ররাজও তাই চায়।

এর উপায়ন্তর কী? জিজ্ঞাসু মন খুঁজে ফেরে পরশপাথর। আমাদের সকলের মধ্যে সেই 'আগুন্তুক' ছবির মনমোহন মিত্রের যে ছোট কৌতূহলগুলিও আছে, সেগুলিই আজ ভুরভুরিয়ে উঠছে। হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে।

এক দার্শনিক-রাজনীতিবিদ গত শতকে তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, 'তোমরা সকালের আটটা-নটার সূর্য।' সকাল হয়েছে। ছেড়ে দিতে হবে প্রাঙ্গণ। কুড়ি বছরের ভরা যৌবনে পৌঁছে 'একক মাত্রা'র এখন যাত্রা হল শুরু অজানা সমীরণে। বুদ্ধদেব বসু কবেই বলেছিলেন, কুড়ি বছর পর লিটল ম্যাগাজিনটির আর চলা উচিত নয়। সমর সেন 'ফ্রন্টিয়ার' চালিয়েছিলেন কুড়ি বছর। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, 'আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার'।

তাই নতুন সময়ে নতুনদের আবাহন। যাঁরা পুরাতন, তাঁরা দাঁড়ান পিছনের সারিতে। ঘুচে যাক কায়িক ও মানসিক শ্রমের সমস্ত প্রাচীর। বাবু বাঙালি যাঁরা মোট বইতে নারাজ, বাঁ হাতে ধুলোকাদা ঘাঁটেন, তাঁদের কর্ণকুহরে অতএব এই সময়ের নিনাদ প্রবেশ করে না। সমাজের বাস্তব ভূমিতেই নির্ণীত হয় সমাজবিজ্ঞানের আকর। সেই তার পরীক্ষাগার।

যাঁরা চিন্তিত, যাঁরা ভাবেন, ভেদ করার চেষ্টা করেন সমাজের রহস্য, তাঁরা আদতে পথের মানুষ। প্রজেক্ট করে সমাজবিজ্ঞান জানা যায় না। কারণ, এ অন্বেষণ জৈবিক, ধুলোকাদা মাখা এক নিরন্তর পরিক্রমা। ইতিহাস তৈরি হয় সেই অতল থেকে। বাকী সব পেপার।

'একক মাত্রা'র ভবিষ্যৎ তাই তরুণদের হাতেই।

৯)
তবুও কিছু কথা অধরা থাকে।

খুব আয়েসে, নিশ্চিন্তে 'একক মাত্রা' করা যাবে, তেমন নয়। পুরনোরা যখন চালিয়েছে তখন তারাও নানা গোলযোগ, হুমকি, বিদ্রূপ, মিথ্যাচারের মুখোমুখি হয়েই কাজটাকে নিরলস ভাবে এগিয়েছে। বহুজনে, আরও আরও প্রসারিত বহু বহু জনে, এর বিস্তার ঘটেছে; কিন্তু কিছু জন থাকে যারা নিন্দামন্দের জন্যই থাকে। অতএব, নতুন যারা হাল ধরছে, তাদের এই অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হয়েই আগামী দিনের পথ চলা।

যে লিখতে পারে এবং মোটও বয়, সেই একক মাত্রা'র কাজের সঙ্গী, তরুণ বন্ধুর ভাষায় 'পত্রিকা শ্রমিক'। আর কৌতূহলী মন, অদম্য মগ্নতা, লিখে-পড়ে অনন্য আনন্দ পাওয়া হল চলার দোসর। বিজ্ঞাপন নেই, আলগা অর্থের যোগান নেই, প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান নেই, ক্ষমতাশীলের আশীর্বাদ নেই - এই হল সেইসব না-পাওয়াগুলি যা অফুরন্ত চ্যালেঞ্জের খাঁটি উৎস। পত্রিকা বিক্রি করে, গ্রাহক সংগ্রহ করে, মেলায় বসে তবে যোগাড় করতে হয় অর্থ। সেই সঙ্গে প্রতি দু মাস অন্তর লেখা তৈরি, সংগ্রহ, যথাযথ সম্পাদনা, বিন্যাস, প্রেস, সব সেরে বিষয় ও সম্ভাব্য লেখকের খোঁজতল্লাস। তার আগে পরে ঘাড়ে করে পত্রিকা স্টলে স্টলে বিলি, গ্রাহকদের ডাকযোগে প্রেরণ ও হিসাব করণ। বেলা যায়, রাত গভীর হয়, সকাল আসে।

কেন এই তাড়ণা? সমাজের ধমনীতে যে রক্ত চলাচল, নিত্য লড়াইয়ে যে পুষ্টি অর্জন তার আনন্দঘন মুহূর্তগুলি তো এইভাবেই সজীব রাখে সংবেদনশীল মানুষদের। নিজের অস্তিত্ব ও সত্তাকে তাই বারবার বিচার করে নিতে হয় আপাত চলমান নির্দেশমূলক যন্ত্রবৎ অনুশাসনের বিপক্ষে। যিনি পারেন না, তিনি যন্ত্র হয়ে টিঁকে থাকেন। নিছক এলগরিদম হয়েই তাঁর বাঁচা।

এখন সকাল আটটা-নটা। আলোকজ্জ্বল স্বচ্ছতোয়ায় ভেসে যাচ্ছে পথঘাট, গাছপালা, পাখিদের কলরব। আকাশ জুড়ে ভেসে উঠছে মেঘেদের ভেলা। সমুদ্র গর্জনে অকালভৈরবী সুর, তাল, লয় ছুঁয়ে ফেলছে দূরের মহাদেশ। কে দাঁড়িয়ে তোমার পিছনে? মনের চৈতন্য গভীর স্নান সেরে রৌদ্রমাখা মৃত্তিকাতে বিলীন হচ্ছে। কালের মুখোমুখি হতে দ্বিধা কীসের?

রইল কলম অথবা কীবোর্ড। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর অনুসন্ধিৎসু মন। দিগন্ত বিস্তৃত আলোকভূমি। এবার দুই কুড়িতে পৌঁছক 'একক মাত্রা'। নতুন মন, উষ্ণ হৃদয়, তারুণ্যের কল্লোল।

পরের সংখ্যার প্রচ্ছদ বিষয়: দেশান্তর (মার্চ ২০১৯)।

No comments:

Post a Comment