Saturday, 26 January 2019

প্রজাতন্ত্র

জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও নিয়মতান্ত্রিকতা
           অরুণাভ বিশ্বাস

আর‌ও একটা সাধাণতন্ত্র দিবস। সাধারণ মানুষের আর‌ও একটা ছুটির দিন। শপিং মলে যাওয়ার দিন, অনলাইনে বিশাল ছাড়ে কেনাকাটা করার দিন, চিড়িয়াখানা ইকোপার্ক জাদুঘর যাওয়ার দিন, টিভি খুলে কুচকাওয়াজ দেখবার দিন, লাউডস্পিকারে দেশাত্মবোধক গান শোনার দিন আর স্কুলে স্কুলে সাতসকালে হাজিরা দিয়ে ছাত্রছাত্রী শিক্ষকশিক্ষিকা সকলে মিলে প্রভাতফেরী সেরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবার দিন। তবে সাধারণতন্ত্র দিবস যে আসলে ভোগবাদে গা ভাসানোর দিনে পর্যবসিত হয়েছে সে কথা এখন শুরুতেই তুলে বিতর্ক সৃষ্টি করব না। গত এক সপ্তাহ যাবৎ খবরের কাগজের পাতাজোড়া রঙচঙে বিজ্ঞাপনের আধিক্য আমার কথাকে প্রমাণ করার জন‍্য যথেষ্ট। এই মাত্র আমার ফোনে একটি বহুজাতিক জুতো কোম্পানির মেসেজ এল যে সত্তরতম সাধারণতন্ত্র দিবসে কিছু কিছু মডেলের জুতোয় নাকি ৭০% ছাড়। আমি শুধু ভাবছি শতবর্ষ পূর্তিতে জুতো ১০০% শতাংশ ছাড়ে আদৌ বিক্রি হবে কিনা!

তবে পণ‍্যসংস্কৃতি নিয়ে লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আসলে ধান ভানতে শিবের গীত গাইবার‌ই রীতি। বলতে বরং চাইছি যে বাঙালি তথা ভারতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস বা সাধারণতন্ত্র দিবসের তাৎপর্য আজকাল ভোগবাদের নিরিখে পরিপূর্ণতা লাভ করলেও এর একমাত্র ব‍্যতিক্রম স্কুল। স্কুলে স্কুলে এখন‌ও দিন দুটি পালিত হয় সাধ‍্যমতো। এখন মুশকিল হচ্ছে 'সাধ' আর 'সাধ‍্য' -- দুটো ব‍্যক্তি নিরপেক্ষ তো নয়‌ই, বরং আপেক্ষিক ও বোঝাপড়াভিত্তিক। আর সাধারণতন্ত্র দিবস বা স্বাধীনতা দিবস নিয়ে স্কুলে স্কুলে গন্ডগোলটা পাকিয়ে ওঠে এই বোঝাপড়ার অভাবেই যখন সাধের জাতীয় দিবস দুটি জায়গা ছেড়ে দেয় বাধ‍্যতামূলক উদ্‌যাপনের নিয়মতান্ত্রিকতাকে।

মূল বক্তব‍্যে যাওয়ার আগে তাই আর একটা কথা অল্প করে বলে নিই যে সবার উপরে মানুষ। মানুষের জন‍্য‌ই নিয়ম, নিয়মের জন‍্য মানুষ নয়। কিন্তু জাতীয়তাবোধের উগ্ৰতায় আমরা অনেক সময় এ কথা ভুলে যাই। তাই 'বন্দে মাতরম' না বলায় একেবারে নিরীহ মুসলিম চাচাকে প্রকাশ‍্যে চড় খেতে হয়। আবার সোশাল মিডিয়ার ভাইরাল ছবিতে অসমের প্রাইমারি স্কুলের ছোট্ট বাচ্চা বুকজলে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকে স‍্যালুট করলেও বাদ পড়ে যায় NRC থেকে। এই বাচ্চাটির কাছে জাতীয়তাবাদের স্বরূপ কিরূপে উদ্‌ঘাটিত হয়ে চলেছে ভেবে দেখেছি কি আমরা? ভেবে দেখেছি কি গত বছর স্বাধীনতা দিবসের দিন সক্কালবেলায় পথ দুর্ঘটনায় নিহত অলংকৃতা মল্লিকের পরিজনের কাছে জাতীয় পতাকার তাৎপর্য কেমন?

যে কোনও ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা আমার বদ অভ‍্যাস। কী হলে কী হত, কী হয়নি বলে কী হয়েছে ইত‍্যাদি ভাবনা মাঝে মাঝেই ব‍্যতিব‍্যস্ত করে। দঃ ২৪ পরগণার কুলপি ব্লকের লক্ষ্মীনারায়ণপুর বি এইচ এম হাই স্কুলের কৃতী শিক্ষিকা অলংকৃতা মল্লিকের আকস্মিক মৃত্যুতে একটা প্রশ্ন না তুলে পারছি না। ট্রেন দুর্ঘটনার আগের রাতে কী দরকার ছিল কাকদ্বীপে তাঁর বান্ধবীর বাড়িতে থাকার? তিনি থেকে গিয়েছিলেন তার কারণ পরদিন সকালবেলাতেই তাঁর স্কুলে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন তথা পতাকা উত্তোলন ছিল। আমাদের সবার স্কুলেই এই ব‍্যাপারটা নতুন কিছু নয়। যে যেখানেই থাকি না কেন প্রজাতন্ত্র দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে ট্রেনবাস ধরে সকালবেলায় আটটার আগে ঠিক পৌঁছে যাই নিজের নিজের স্কুলে। যাঁরা নিজেদের স্কুল থেকে খুব দূরে থাকি তাঁরা ভোরবেলায় বার হ‌ই; আর যাঁদের তাতেও উপায় নেই তাঁরা বাধ‍্য হ‌ই অলংকৃতা ম‍্যাডামের মতো বাড়ি ছেড়ে স্কুলের কাছাকাছি কোথাও একটা থেকে যেতে। এখন আমার প্রশ্ন, এই ঝক্কি পোহানোর কোনও প্রয়োজন আছে কি?

এই পর্যন্ত পড়ে পাঠক ভাববেন না আমি স্বাধীনতা দিবসে ছুটি চাইছি। আমার বক্তব‍্য, Flag Code of India, 2002 তন্নতন্ন করে পড়লেও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কোনও নির্দিষ্ট সময় যেখানে পাওয়া যায় না সেখানে কোন আইনের বলে শুধু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের‌ই সকাল আটটায় পতাকা উত্তোলন করতে হয় ? কোনও কোনও স্কুলে ঐদিনে সময়ে পৌঁছনোর ব‍্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে স্থানীয় এবং দূরাগত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ‍্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। প্রধান শিক্ষক আর সহশিক্ষকদের মধ‍্যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। কিন্তু যদি Flag Code of India, 2002 ঠিকঠাক জানা থাকে তাহলে নিজেদের মধ‍্যে এই নিয়ে মনোমালিন্য, ভোরবেলায় ট্রেনবাস করার ঝক্কি, অন‍্যের বাড়িতে থাকার বিড়ম্বনা বা ট্রেন দুর্ঘটনায় এরকম অকালমৃত্যু এড়ানো যেতে পারে। (Flag Code of India, 2002, পিডিএফ ফাইলে ইন্টারনেটে সহজলভ‍্য।) এ ক্ষেত্রে যেটা করতে হবে তা হল সপ্তাহের কাজের দিনে স্কুলের প্রার্থনার যে সময় নির্দিষ্ট করা আছে তাকেই পতাকা উত্তোলনের সময় হিসেবে ধার্য করা।

এবার একটু পিছনে তাকানো যাক। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি। দিল্লি জুড়ে প্রচন্ড কুয়াশা। রাজপথে সমারোহ তথা কুচকাওয়াজ শুরুই হতে চায় না। শেষমেশ সকাল ১০টায় তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় পতাকা উত্তোলন করলেন। হ‍্যাঁ, টাইপে ভুল হচ্ছে না। সকাল ১০টা'তেই। সেবারেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম আইনত ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। সকাল ৮টা'র ব‍্যাপারটা অলিখিত প্রথামাত্র। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ‍্যে পতাকা তুলতে হবে এবং অবশ‍্য‌ই সূর্যাস্তের পরে নামিয়ে নিতে হবে। এরপরেও তথ‍্য কিছু বাকি রয়ে যায়।

বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সাংসদ নবীন জিন্দাল ৭ বছর মামলা লড়ে ২০০২ সালে তাঁর কারখানায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার অধিকার অর্জন করেন। এই প্রেক্ষিতে পি ডি শেনয়ের নেতৃত্বে একাধিক মন্ত্রককে জড়িয়ে যে কমিটি গঠিত হয় তার সুপারিশে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় পতাকা সংক্রান্ত ১৯৫০ সাল থেকে চালু থাকা অধিকাংশ বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে নতুন যে বিধি প্রণয়ন করেন সেটিই Flag Code of India, 2002। এর পরে ২০০৯ সালে নবীন জিন্দালের আর একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় নাগরিকদের রাতের বেলাতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অধিকার মেনে নেয়। তবে তা হতে হবে কমপক্ষে ১০০ ফুট উঁচুতে এবং সর্বক্ষণের জন‍্য আলোকিত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই নবীন জিন্দাল‌ই প্রায় এক দশক মামলা লড়ে ১৯৯৬ সালে ভারতীয় নাগরিকদের হয়ে পতাকা উত্তোলনের মৌলিক অধিকার আদায় করেন। কাজেই সকাল ৮টায় পতাকা তোলার বাধ‍্যবাধকতা আদৌ রয়েছে কিনা সুধী পাঠক বিচার করবেন।

সব শেষে আর একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ বলতেই হবে। উক্ত Flag Code of India, 2002'এর Part II Section ii'তে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা কেমনভাবে উত্তোলিত হবে তা কিন্তু সুস্পষ্টভাবে বলা আছে এবং সেখানেও কোনও সময় নির্দিষ্ট করা নেই। অথচ যা বলা নেই তা মানতে স্কুলে স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মানতে বাধ‍্য করা হয়। আর যা বলা আছে তা বিন্দুমাত্র মানা হয় না অধিকাংশ স্কুলে। ছাত্রছাত্রীরা কেমন দাঁড়াবে, প্রধান শিক্ষক ও সহশিক্ষকেরা কোথায় দাঁড়াবেন, কখন কে কাকে স‍্যালুট করবে, কী শপথ নেওয়া হবে ইত‍্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যা যা বলা আছে তার প্রায় কিছুই ঠিকঠাক পালন হয় না। শুধু নিয়ম কেবল সকাল ৮টার আগে স্কুলে হাজিরা নিয়ে। অথচ সেটা বলা নেই !

একজন অত‍্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষিকার প্রাণ অকালে ঝরে গিয়েছে কয়েক মাস আগে। সোশাল মিডিয়ায় দায়সারা শোকবার্তা লিখে দায় না সেরে যদি শিক্ষক সংগঠনগুলির সাধারণ সম্পাদকেরা স্কুলে স্কুলে চালু থাকা এই একুশে আইনের বিরুদ্ধাচরণ করতেন তাহলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাশে দাঁড়ানোয় শিক্ষক সংগঠনের যে মূল দায়িত্ব তা পালন হত। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। একজনের প্রাণ চুরি গিয়েছে। সংগঠনগুলির বুদ্ধি বাড়বে কী ?

1 comment: