Monday, 2 November 2015

অমরলোকের আলোচনা



মানুষের ধর্ম গরুর যুক্তি
অনুরাধা রায়
বুধি, মহেশ আর কালাপাহাড় অমরলোকের গোপল্লীর বাসিন্দা। বুধি একটি গরু, মহেশ ষাঁড়, কালাপাহাড় মহিষ। স্বর্গ তো চির সুখশান্তির জায়গা, সুস্বাদু খড়-খোল-ভূষির অভাব নেই। এখানে এসে স্বাস্থ্যের সঙ্গে ওদের মস্তিষ্কেরও উন্নতি হয়েছে, জ্ঞানবুদ্ধি চর্চায় আগ্রহ হয়েছে। নন্দনকাননে কচি ঘাস খেতে খেতে তিনজনে প্রায়শ নানা সিরিয়াস আলোচনা করে। নরলোক ওদের আলোচনার বড় বিষয়। সে জগতের খবর মিডিয়া মারফত নিয়মিতই এখানে আসে। তাছাড়া তিনজনেই জীবSকালে মানুষের সমাজেই ছিল, মানুষের ভালবাসাও পেয়েছে, তবে মোটের ওপর মানুষের অত্যাচারের স্মৃতি দগদগে হয়ে আছে মনের মধ্যে।

সম্প্রতি খবর আসছে একদল মানুষ নাকি গোহত্যা বন্ধ করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। বুধি আহ্লাদ করে বলল – ‘কি, বলেছিলাম না তোমাদের? সব মানুষ মোটেই খারাপ নয়। আমাদের বাড়ির খুকি আমাকে কত ভালবাসত! আর, সেই যখন কসাইখানা থেকে পালিয়ে আসার পথে হতক্লান্ত হয়ে নদীর পাড়ে অচেতন হয়ে পড়েছিলাম, সুন্দর একটা বউ জোর করে আমাকে উঠিয়ে, চাঙ্গা করে ---, সে গল্প বোধহয় তোদের বলেছি, তাই না?’
মহেশ – ‘অনেকবার বলেছিস। কিন্তু বুধি, তুই বরাবর সরল আর বোকাই রয়ে গেলি। তুই কি মনে করছিস গোজাতকে ভালবেসে ওরা গোহত্যার প্রতিবাদ করছে? অতই যদি দরদি মন ওদের, তবে কি ওদেরই জাতভাই একটা মানুষকে – কি যেন নাম? আখলাক – তাকে গোহত্যার অপরাধে পিটিয়ে মেরেই ফেলত, তাও ভাল করে খোঁজখবর না নিয়েই! পরে তো জানা গেল সে মোটেই গরুর মাংস খায় নি, খেয়েছে পাঁঠার মাংস!’
কালাপাহাড় – ‘আর ঐ মানুষগুলোই, যারা গোহত্যার জন্য অন্য মানুষ খুন করে, পুজোর সময় মোষ বলি দিয়ে কত না তাদের ফুর্তি! আবার তার আগে মোষটাকে তেল-সিঁদুর মাথায় দিয়ে, গলায় মালা পরিয়ে, ঘাড়ে তেল দলে কত সোহাগ! তারপর তার মুণ্ডুটায় কোপ বসিয়ে, রক্তারক্তি করে, তার যন্ত্রণা দেখে ততই আনন্দ! এ একমাত্র মানুষই পারে! এত বিকৃতি, এমন নিষ্ঠুরতা দুনিয়ার আর কোনও জীবের মধ্যে নেই!’
বুধি – ‘কেন এমন করে?’
কালাপাহাড় – ‘জানিস না? ধর্মের নামে করে!’
বুধি – ‘সেটা আবার কি বস্তু!’
কালাপাহাড় – ‘ওটা একটা গ্যাঁড়াকল বানিয়েছে, তাতে নানারকম ভণ্ডামির সুবিধে হয়। অন্য প্রাণী পেটের তাগিদে প্রাণীহত্যা করে, সে বোঝা যায়। মানুষ আবার ধর্মের নামেও করে। কদল আছে যারা আবার এমনি কোপ দিয়ে গলা কাটে না; পেঁচিয়ে, যত পারে কষ্ট দিয়ে কাটে ওটাই নাকি ধর্ম! কিন্তু সবচেয়ে মজার কথা, শুধু গরু-ছাগল নয়, ধর্মের নামে মানুষ মানুষকেও দেদার খুন করে। ধর্ম আসলে ভণ্ডামি!’
মহেশ – ‘ভণ্ডামি বলে ভণ্ডামি! সেবার খরার সময়ে কোনও খাবার নেই, জল পর্যন্ত নেই কোথাও। আমার মনিব গফুর জ্বরে ধুঁকছে। জমিদারের চামচা তর্করত্ন এসে তাকে ডাঁটাতে লাগল – “গরুটাকে না খাইয়ে রেখেছিস কেন! গোহত্যা করতে চাস নাকি?” যেন আমার জন্যে কত দরদ! মনিব নিজে কি আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছিল না! আমি কি বুঝি নি? ঘরের চাল থেকেও খড় বের করে নিয়ে আমাকে খেতে দিয়েছে। তা সে কাকুতিমিনতি করে তর্করত্নকে বলল – “দু কাহন খড় দাও না, বাবাঠাকুর, মহেশের জন্যে।” তা কিন্তু দিল না! যেমনি ঐ তর্করত্ন, তেমনি তার জমিদার, যার নাকি খুব গো-ব্রাহ্মণে ভক্তি! কেউ কিছু করে নি আমাকে বা আমার মনিবকে বাঁচানোর জন্যে। বরং কি যন্ত্রণাই না দিয়েছে!’ বলতে বলতে মহেশের গলাটা ভারি হয়ে এল।
বুধি – ‘বেশির ভাগ মানুষ বড় নিষ্ঠুর, এটা ঠিক কথা। আমার এক একটা বাচ্চা হত, তাকে আমার সামনে বেঁধে রাখত, তবু আমার কাছে আসতে দিত না, আমার দুধ সব দুয়ে নিত। কদিন বাদে বাচ্চাগুলোকে আর দেখতেও পেতাম না। বেচে দিত আর কি! তারপর যখন বুড়ি হতে আমাকেই বেচে দিল – ওঃ, সেই কসাইখানার তাজা রক্তের গন্ধ ---’
কালাপাহাড় – ‘থাক না এসব কথা! মনে করলে বড় কষ্ট হয়! সেই গোহাটার পাইকারের হাতে লাঠির আগায় ছুঁচ লাগানো – তার খোঁচায় পিঠ ক্ষতবিক্ষত! ভাগ্যিস আমায় রংলাল মনিব এসে কিনে নিয়ে গেল। সে আমাকে খুবই যত্নে রেখেছিল। কিন্তু অত সুখ কপালে সইল না---। কালাপাহাড়েরও গলা বুজে এল।
কালাপাহাড় – ‘অথচ জানিস, কত মানুষ পশু-অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছে। সেদিন Peter Singer  বলে একটা লোকের কথা পড়লাম। তার Animal Liberation বইটা নাকি খুবই বিখ্যাতআজকাল কিছু দার্শনিক post-humanism-এর কথা বলছে। মানুষ তো সচরাচর মনে করে সারা বিশ্বজগৎ, সমস্ত প্রাণীজগত মানুষেরই জন্যে তৈরি হয়েছে, নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না - এই জায়গাটায় নতুন করে ভাবাতে চাইছে এরা।’
বুধি – ‘অত জানি না, তবে অন্তত বেশ কিছু মানুষ অহিংসার কথা বোধহয় অনেক দিন ধরেই বলছে। গান্ধি বলে একটা লোকের কথা শুনেছিলাম খুকিদের বাড়িতে থাকতে কিন্তু এদের কি কোন প্রভাব নেই জাতভাইদের ওপরে?’
মহেশ – ‘এরা সংখ্যালঘু, বুঝলি তো! মোটের ওপর মানুষ জাতটা যাচ্ছেতাই!’

এদের আড্ডার মধ্যেই গোপ্রাসাদের ছাদ থেকে হৈ হৈ করে নেমে এল ন্যাদোশ। সে হল খুব অ-সাধারণ গরু। প্রায়ই ছাদে উঠে ঘুরে বেড়ায়, মাছমাংস খেতে ভালবাসে, কারোর তোয়াক্কা করে নাআর বেঁচে থাকতে মানুষ ওর ওপর অত্যাচার করবে কি – ওই মানুষকে দেদার গুঁতিয়ে বেড়িয়েছে! এখানে সেই সুযোগটা পায় না – এটাই যা ওর একটু দুঃখ। ন্যাদোশ উত্তেজিত হয়ে বলল – ‘আজ টিভির খবর শুনেছিস? দিল্লির কেরল হাউসেকেন গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছেবলে কারা যেন তা হাঙ্গামা করে আটকাতে গেছে; তারপর যখন শোনা গেছে ওটা মোষের মাংস, বেশি ঝামেলা আর করে নি ওদের ধর্মে গোহত্যা বারণ, কিন্তু মোষহত্যা তো নয় তাই মোষহত্যা-নিবারণ ওদের এজেণ্ডাতে নেই! এসব বজ্জাতি নয়! আচ্ছা করে গুঁতিয়ে দেওয়া উচিত কিনা বল! আবার অন্যদিকে অন্য খবরও পেলাম, এটা মিডিয়াতে তেমন আসে নিপৃথিবী থেকে সদ্য আসা কয়েকজন গরুর সঙ্গে আলাপ হল। তারা বলল, কদিন আগে বকর-ঈদের দিন রাস্তার ওপর ফেলে রীতিমত প্রদর্শনী করে তাদের কাটা হয়েছে! যারা কেটেছে, গরু কাটা নাকি তাদের মহান ধর্ম। ইচ্ছে করে শালাদের পশ্চাদ্দেশে বেশ করে ঢুঁ মারি! ওদিকে আরও শোন, অন্য এক দল লোক - বুদ্ধিজীবী নাকি সব বলে – সরকারের ওপর রাগ করে পুরস্কার ফেরত দিচ্ছে। সরকার নাকি গোহত্যা-বিরোধীদের মদত করছে। তাদের কেউ কেউ আবার লোক দেখিয়ে, মিডিয়া ডেকে গরুর মাংস খাচ্ছে বাহাদুরি করে - গরু-মারা জাতভাইদের সমর্থনে এই বে-আক্কেলে হতচ্ছাড়া মানুষগুলোকে নিয়ে কী করা যায় বল দিকি!’
বুধি – ‘আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কে গোহত্যা করতে চাইছে, কেন চাইছে; কে চাইছে না, কেন চাইছে না – কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না!’
ন্যাদোশ – ‘বোঝা মুশকিল বটে। তবে শোন বলি, সবটাই আসলে রাজনীতির খেল। রাজনীতিওয়ালারা খেলাচ্ছে দু’দল খেলোয়াড়কে দিয়ে। দুই ধর্ম, দুই দল – হিন্দু, মুসলমান।
বুধি – ‘এরা কি এই আমাদের গরু-মোষের মত একটু আলাদা জাতের?’
ন্যাদোশ – ‘না না, শরীরে-স্বভাবে একদম এক। অন্তত, তফাত যা আছে, সে অন্য কারণে, ধর্মের জন্য নয়। তবু ধর্ম আলাদা বলে পরস্পরকে শত্রু মনে করে আর মিছামিছি মারামারি করে। তাদের রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, আর বেচারা উলুখাগড়া গরুর প্রাণ যায়!’
কালাপাহাড় – ‘মজার কথা কি জানিস? যারা নাকি মুসলমান, তাদের ধর্মের যে আদিভূমি, মানে আরবের মরুভূমি, সেখানে গরু ছিলই না আর হিন্দুরাযারা নাকি গরুকে খুব ভক্তি করে, গোমাতা-ফাতা বলেআসলে কত ভক্তি করে, সে তো মহেশ এখনি বললতাদের পূর্বপুরুষরা খুব গরু খেত
ন্যাদোশ – ‘দেখ, আমি নিজে আমিষাশী। “এখুনি গরু খাওয়া একদম বন্ধ কর” বলে মানুষের মতো ভণ্ডামি করতে পারব না। আমার বক্তব্য – খাদ্য ব্যক্তিগত রুচি আর অভ্যসের ব্যাপার। আমি কোন একটা খাবার খাই না বলে তুই খাবি না – এটাও যেমন কোন লজিক নয়; যে গরু খায় না তার নাকের ডগায় জোর করে গরু কাটা, গরু খাওয়া – এটাও সভ্যতা-ভদ্রতা নয়। এই যে আমি তো প্রায়ই সুরপল্লী কি নরপল্লীর রেস্তরাঁতে গিয়ে মাছমাংস খেয়ে আসি (অবশ্য গোমাংস বাদ দিয়ে!), কিন্তু তোদের দেখিয়ে দেখিয়ে তো খাই না? তাছাড়া দেখ, গরু মারা যদি বন্ধ করতে হয়, ছাগল শুয়োর মুরগি কি দোষ করল। আমার তো মনে হয়, বিভিন্ন খাবারের পুষ্টিগত গুণাগুণ নিয়ে তর্ক চলুক, বড় করে আমিষ-নিরামিষ নিয়ে তর্ক চলুক, আরও বড় করে মানুষ আর অন্য সব প্রজাতির মধ্যে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা হোক। এগুলোই তো প্রাসঙ্গিক, তাই না? এরমধ্যে ধর্ম কোত্থেকে আসে?’
বুধি – ‘তবে আমার মনে হয়, প্রাণীহত্যা করা, তার জন্য বাহাদুরি নেওয়াটা ভাল কথা নয়। একে মানুষ নিষ্ঠুর জাত, এতে নিষ্ঠুরতা আর বাড়বে। আর সেটা অন্য প্রাণীকে হত্যার মধ্যেই আটকে থাকবে না, আমার বিশ্বাস এতে মানুষ ক্রমেই আরও বেশি করে মানুষও মারতে থাকবে।‘
কালাপাহাড় – ‘আরে সে সব কথা ওরা বুঝলে তো! ওরাই আবার নিজেদের সভ্য বলে, সংবেদনশীল বলে, বুদ্ধিমান বলে। কোথায় ওদের সভ্যতা, কোথায় অনুভূতি, কোথায় যুক্তিতক্কো! খালি হোঁতকামি আর গুণ্ডামি! অত বড় মস্তিষ্কটা ওসবেই ভর্তি!’
মহেশ – ‘অবাক লাগে, বুদ্ধিজীবীগুলোই বা কী করে! খালি পুরস্কার ফিরিয়ে কী হবে! এ তো আসল সমস্যা এড়িয়ে টোকেনিজম।‘
কালাপাহাড় – ‘টোকেন হিসেবেও তার অনেক গোলমাল। ডগমগ হয়ে একদা পুরস্কার নিয়েছিলিই বা কেন?তখন মনে হয় নি, রাজনৈতিক নেতারা আমাকে কবি হিসেবে, নাট্যকার হিসেবে দেবার স্বীকৃতি দেবার কে! আসলে পুরস্কারটা দেশ দিচ্ছে বলেই নিয়েছিলি তো, না কি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে যোগাড় করেছিলি? সেইজন্যেই কি আজ আরেকটা দল রাজত্বি করছে বলে, তার সাথে তোর বনছে না বলে সেটা ফেরত দিচ্ছিস!’ 
ন্যাদোশ – ‘আরে, এতে ধান্দাও আছে। পুরস্কার পেতে যত না লোকে ওদের নাম শুনেছিল, এখন তার চেয়ে বেশি লোক শুনছে আর ধন্য ধন্য করছে। অন্তত ওরা তাই ভাবছে। ওদের খুব চিনি। ওরা সচরাচর যেদিকে হাওয়া দেখে, সেদিকেই গা ভাসায়। কীসে নামডাক হবে, মিডিয়ায় ছবি বেরবে – এই হল ওদের ধান্দা বুদ্ধির তো ঢেঁকি সব! একটা নির্মোহ চাবুকের মতো চিন্তা, একটা তীক্ষ্ণ তর্ক দেখছিস এত হট্টগোলের মধ্যে?’
বুধি – ‘ভাগ্যিস আমরা মানুষ নই রে! শুনেছিলাম মানুষ ভগবানের সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব। তার কি সব নমুনাই না দেখলাম! বেঁচে থাকতেও দেখলাম, এখনও দেখছি।‘

সূত্রঃ
শরSচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বুধির বাড়ি ফেরা’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালাপাহাড়’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘ন্যাদোশ’।

No comments:

Post a Comment